যুবরাজ বিস্মিতভাবেই ক্ষণকাল তাকিয়ে রইলেন তার দিকে–’ইজরায়েলের দুহিতা, কোন দেবতার নামে তা হলে তুমি পার শপথ নিতে?”
“জাহভের নামে, যুবরাজ! জাহভেকেই আমরা এক এবং অদ্বিতীয় ভগবান বলে মানি। বিশ্বজগতের স্রষ্টা তিনিই।”
একটু হেসে যুবরাজ বললেন–“তারই অন্য নাম ঐ কেফেরা। যাক সে কথা। তুমি তাহলে তোমার ভগবান জাহভের নামেই শপথ নিতে পার।”
তখন তরুণী দুই বাহু মাথার উপরে তুলে শপথ গ্রহণ করল–’ইজরায়েলী জনগণের লেভি উপজাতির বৃদ্ধ নাথানের মেয়ে আমি, মেরাপি, ইজরায়েলের ভগবান জাহভের নামে এই শপথ নিচ্ছি যে আমি সত্য কথাই বলব, এবং পরিপূর্ণ সত্যই বলব।”
“তাহলে মেরাপি, তুমি আমাদের বল যে এই নিহত ব্যাক্তির মৃত্যু সম্বন্ধে কী তুমি জান?”
“আমি যা জানি, তার খানিকটা তো আপনিও জানেন যুবরাজ। উনি ছিলেন আমার পিতা, ইজরায়েলের অন্যতম পঞ্চায়েত সদস্য। এবার যখন ফসল পাকবার সময় এল, ঐ কাপ্তেন খুয়াকা এল গোসেনে। তার উদ্দেশ্য, ফারাওয়ের বেগার দেবার জন্য তোক বাছাই করবে। এসেই সে আমাকে দেখল, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব করল যে আমাকে সে বিয়ে করবে। বাবা তাতে রাজি হতে পারলেন, কারণ শৈশব থেকেই আমি আমাদেরই জাতির একজনের সঙ্গে বাগ্দত্তা হয়ে আছি। তা ছাড়া মিশরীতে ইজরায়েলীতে বিয়ে আমাদের ধর্মমতে অচলও বটে। খুয়াকা কিন্তু এই বাধার কথা শুনে ক্ষেপে গেল, এবং বাবাকে পাকড়াও করল ফারাওয়ের বেগারের জন্য।”
যুবরাজ রুষ্টস্বরে মন্তব্য করলেন–“ফারাওয়ের বেগারের জন্য বুড়ো মানুষকেও যে ধরা যায়, তা আমার জানা ছিল না। ওর তো একটা বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া আছে?”
“আছে শুনেছিলাম’ –বলল মেরাপি–“কিন্তু খুয়াকা তা কই মানল? আসলে সে রেগে গিয়েছিল বাবার উপরে, তার সঙ্গে আমার বিয়েতে আপত্তি করার দরুন। তাই সে নিয়ে গেল তাকে, যদিও তিনি ইজরায়েলের একজন পদস্থ লোক! বেগার যাদের খাটতে হয়, তাদের পর্যায়ের মোটেই নন তিনি।
“বলে যাও তারপর”–“আদেশ করলেন যুবরাজ।
“একদল যুবক, আর সেই দলে একমাত্র বৃদ্ধ নাথানকে নিয়ে খুয়াকা চলে গেল গোসেন থেকে কয়েকদিন বাদেই আমি স্বপ্ন দেখলাম যে বাবা খুব অসুখে পড়েছেন। মনটা এত অস্থির হয়ে উঠল যে আমি আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না, বওনা হয়ে পড়লাম ট্যানিসের পথে। আজই সকালে তার সঙ্গে দেখা হল আমার, আর আজই রাত্রে-যুবরাজ! যুবরাজ! তার পরের কথা তো জানেনই আপনি!”
“আর কিছু বলার নেই তোমার?”-জিজ্ঞাসা করলেন শেঠি।
বলার শুধু এইটুকু আছে, যুবরাজ! সকালে যখন আজ বাবাকে দেখতে পেলাম, তখন তিনি ক্লান্ত, অবসন্ন। ইজরায়েলের তিনি একজন মানী লোক, খালে নেমে কাদামাটি কেটে তোলার মতো কাজ তিনি যৌবনেই কখনো করেননি। আজ তত তিনি বৃদ্ধ, প্রায় অথর্ব। হ্যাঁ, খুবই অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন তিনি, সেই সময়ে আমি গিয়ে কিছু খাবার দিলাম তাঁকে। তিনি খেতে শুরু করেছেন, এমন সময়ে খুয়াকা গিয়ে হাজির সেখানে। আমার সমুখেই সে বাবাকে জিজ্ঞাসা করল–“মেরাপির সঙ্গে আমার বিয়ে তুমি দেবে কি না?” বাবা বললেন–“দেবার উপায় নেই, আমাদের দেশাচার তা হতে দেবে না।” তাতে খুয়াকা তাকে শাসিয়ে গেল–“বেশ, এই যদি তোমার শেষ কথা হয়, আজ রাত তোমার কাটবে না, দেখে নিও।”
মেরাপির সাক্ষ্য শেষ হল। এইবার যুবরাজ খুয়াকাকে সম্বোধন করে বললেন –“তোমার কী বলবার আছে, বল এইবার।”
কাপ্তেনটা নতজানু হয়ে বসে পড়ল যুবরাজের সমুখে–“বলবার কথা শুধু এইটুকু যুবরাজ, আপনাকে যে আমি আঘাত করেছিলাম, তা একমাত্র অজ্ঞতাবশতই। ছদ্মবেশ ধারণ করে স্বয়ং আমাদের ভাবী ফারাও আমাদের কার্যকলাপের উপরে দৃষ্টি রাখছেন, এ তো আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল! লম্বা আঙরাখা আপনার গায়ে, মাথার টুপিতে মুখখানাও ঢাকা। কী করে চিনব? রাজপুত্রের অঙ্গে আঘাত করলে তার দরুন অবশ্যই আমার প্রাণদণ্ড হতে পারে, কিন্তু অজ্ঞতাবশত যে অপরাধ করে বসেছি, তার দরুন ক্ষমাও কি আমি প্রত্যাশা করতে পারি না? ও-অপরাধে যদি আমি ক্ষমালাভ করি, তা হলে অন্য যে অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে এসেছে, তার দরুন কোনো দণ্ড আমার হওয়া উচিত নয়। ইজরায়েলীদের তো অহরহই বধ করছে মিশরীরা, তার আবার দণ্ড কী? ওরা তত দাস মাত্র! ওদের জীবনের আবার দাম কী?”
‘ইজরায়েলী নাথানের প্রাণের দাম কিছুমাত্র কম নয়, তোমার প্রাণের দামের চেয়ে। প্রাণ যারই হোক, সে-প্রাণ কেউ কেড়ে নিতে পারে না, বিচারকের মুখ থেকে প্রাণদণ্ডের আজ্ঞা না বেরুলে।”
“আমি আইন জানি না যুবরাজ! ইজরায়েলীরা অহরহই মারা পড়ছে আমাদের হাতে, এর প্রাণ নিয়ে যে কোনো ঝামেলা হতে পারে, তা আমি ভাবিনি।”
‘আইন জান না? দুঃখের বিষয়, তোমার আর অবকাশও হবে না জানবার। কিন্তু তোমার পরিণাম দেখে সারা মিশর আজ থেকে জানতে পারবে যে বিচারক ভিন্ন অন্য কারও অধিকার নেই কারও প্রাণ নেবার। না, তুচ্ছতম এক ইজরায়েলীর প্রাণও না।”
যুবরাজ আদেশ দিলেন–“রক্ষীগণ। ওর শিরচ্ছেদ কর।”
.
৩.
সেই রাতেই আরও একটি সুন্দরী নারীর দর্শনলাভ ছিল আমর ভাগ্যে।
অবশ্য ইজরায়েল-চন্দ্রমা মেরাপির সঙ্গে স্রেফ সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এঁর কোনো তুলনাই চলে না। কিন্তু বংশগরিমা রাজমহিমার কথা বিবেচনা করলে ইনি তো সারা পৃথিবীতে নারীসমাজের শিরোমণি।