সৈনিকও পালটা হুঙ্কার ছাড়ল–“কুত্তা! এত গোস্তাকি তোর যে তুই ফারাওর কাপ্তেনকে তার কর্তব্য শেখাতে আসিস?”-এই বলে যুবরাজের গালে বাঁ হাত দিয়ে এক চড় কষিয়ে দিল দুবৃত্ত।
দিয়েই সে আর কালবিলম্ব করল না। হাতের তরোয়াল আমূল বসিয়ে দিল ভূলুণ্ঠিত বৃদ্ধের বুকে। একবারটি কেঁপে উঠল বুড়োর দেহটা, তারপর নিশ্চল হয়ে গেল একেবারে, এক মুহূর্তের মধ্যে সব শেষ। সব নিস্তব্ধ এক মুহূর্তের জন্য, তারপরই সেই নিস্তব্ধতাকে দীৰ্ণবিদীর্ণ করে আর্ত হাহাকার উঠল একটা, এক পিতৃহারা অনাথিনীর কণ্ঠ থেকে।
যুবরাজ শেঠি ওদিকে, সেই এক মুহূর্ত তারও কণ্ঠ ছিল রুদ্ধ হয়ে, অবশ্যই অদম্য ক্রোধে। যখন বাক্যস্ফুরিত হল আবার, একটি মাত্র শব্দ তিনি উচ্চারণ করলেন–“রক্ষী।”
সেই চারজন নিউবীয় সৈনিক, যুবরাজেরই আদেশে যারা বরাবর একটু দূরে দূরেই সরে রয়েছে, তারা এই আহ্বান শুনে চোখের পলকে ভিড় ঠেলে ছুটে এল, কিন্তু তারা এসে পৌঁছোবার আগেই আমি, এই নকলনবিশ অ্যানা, ঝাঁপিয়ে পড়েছি সেই নরহস্তা সৈনিকের উপরে, টিপে ধরেছি তার গলা। সে তার রক্তমাখা তরোয়াল দিয়ে আঘাত করতে গেল আমাকে, কিন্তু আমার গায়ে রয়েছে ডিলা আঙরাখা, তরোয়ালের কোপ তাতে বসবে কেন? বিশেষ করে অত নিকটের আঘাত? তবে বাঁয়ের ঊরুর খানিকটা ছড়ে গেল বটে, তা যাক, সেদিনে দেহে শক্তি ছিল আমার, ধস্তাধস্তি করে সৈনিকটাকে ফেলে দিলাম মাটিতে, অবশ্য আমাকেও পড়ে যেতে হল তার সঙ্গে।
এরপর শুরু হল ভীষণ গণ্ডগোল। হিব্রু ক্রীতদাসেরা দড়ি ছিঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সৈনিকদের উপরে, যেমন করে শিকারী কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ে শেয়ালের উপরে। স্রেফ ঘুষি আর কিল মেরে মেরেই কাহিল করে ফেলল সৈনিকগুলোকে, সৈনিকেরা তখন তরোয়াল চালাচ্ছে আত্মরক্ষার জন্য, পাহারাওলারা হাঁকাচ্ছে চাবুক। নারীরা চিৎকার করছে ভয় পেয়ে, পুরুষেরা করছে ভয় দেখাবার জন্য। এদিকে সৈনিকটা গড়াতে গড়াতেও কায়দা করে নিয়েছে তরোয়াল হাঁকাবার, তুলেছে সেটা আমার মাথা লক্ষ্য করে। সব শেষ হল–ভাবছি আমি।
শেষই হত, কিন্তু যুবরাজ নিজেই সৈনিকটাকে টেনে সরিয়ে নিলেন আমার দেহের উপর থেকে। নিউবীয় রক্ষীরা এসে ধরে ফেলল তাকে। ততক্ষণে যুবরাজ আত্মপ্রকাশ করেছেন উচ্চৈস্বরে–“সবাই নিরস্ত হও। আমি আদেশ করছি নিরস্ত হতে, যুবরাজ শেঠি মেনাপ্টা, ফারাওর পুত্র, ট্যানিসের প্রদেশপাল”–এই বলেই তিনি মুখে উপর থেকে মুখাবরণটা টেনে খুলে ফেললেন। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার মুখ ।
সব নিস্তব্ধ আবার। সবাই তাকিয়ে আছে সেই মহিমান্বিত মুখাবয়বের দিকে। যে চিনতে পারছে, সেই তৎক্ষণাৎ নতজানু হয়ে বসে পড়ছে মাটিতে। কেউ কেউ বা ভয়ে সম্ভ্রমে অভিভূত হয়ে বলে উঠছে অনুচ্চস্বরে–“সম্রাটনন্দন মিশর যুবরাজের মুখে আঘাত করেছে একটা তুচ্ছ সৈনিক। রক্ত দিতে হবে ওকে এর জন্য।”
“ও-লোকটার নাম কী?” জিজ্ঞাসা করলেন যুবরাজ।
“খুয়াকা”–উত্তর দিল কেউ একজন।
নিউবীয় রক্ষীরা তাকে ধরেই রেখেছে। যুবরাজ আদেশ দিলেন–“আমন মন্দিরের সিঁড়ির নীচে নিয়ে চল ওকে।” আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–“হেঁটে যেতে পারবে তো? না যদি পার, আমার কাঁধে ভর দিয়ে চল।”
যুবরাজের কাঁধে ভর দিয়ে আমি, নকলনবিশ অ্যানা, ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম প্রায় একশো পা। ক্ষতবিক্ষত দেহ আমার, নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট বোধ করছি তখন।
সিঁড়ির মাথায় প্রশস্ত চাতাল, সেইখানে উঠে আমরা থেমে গেলাম। আমাদের পিছনে রক্ষীবেষ্টিত হত্যাকারী, তারও পিছনে সেই বিশাল জনতা, যাদের চোখের সমুখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই জঘন্য হত্যাকাণ্ড। সিঁড়ির সবগুলো ধাপ পরিপূর্ণ করে সেই জনতা উগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে যুবরাজের পানে।
যুবরাজ বসেছেন এক গ্রানাইট পাথরের বেদীতে। অত্যন্ত ধীর, শান্ত, সংযত তার কণ্ঠস্বর। তিনি বলছেন–“মহান রামেসিসের প্রতিষ্ঠিত এই ট্যানিস নগরের প্রশাসক আমি, এই নগরসীমার মধ্যে সর্বসাধারণের জীবনমৃত্যুর মালিক আমি ছাড়া আর কেউ নয়। যে-কোনো স্থানে যে-কোনো সময়ে বিচারালয় স্থাপনের অধিকার আমার আছে। সেই অধিকার বলে এইখানে এই মুহূর্তে আমি বিচারে বসেছি। আদালতের কাজ আরম্ভ হোক।”
“আদালতের কাজ আরম্ভ হল”–সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল জনতা।
‘ঘটনাটা এই”–বলছেন যুবরাজ–“খুয়াকা নামক ঐ লোকটা, পরিচ্ছদ দেখে ওকে ফারাওয়ের সৈন্য বাহিনীর জনৈক কাপ্তেন বলেই ধারণা হয়, ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে নরহত্যার। এক বৃদ্ধ হিব্রুকে ও হত্যা করেছে। তাছাড়া লেখক অ্যানাকে হত্যা করার চেষ্টাও করেছে ও, কে সাক্ষী আছ, এগিয়ে এস। নিহত ব্যক্তির শব এখানে স্থাপন কর আমার সম্মুখে। আর সেই যে স্ত্রীলোকটি, যে ঐ বৃদ্ধকে রক্ষা করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল, তাকেও নিয়ে এস সাক্ষ্য দেবার জন্য।”
সব আদেশই পালিত হল যুবরাজের। মৃতদেহ এনে চাতালে রেখে দেওয়া হল, রুদ্যমানা তরুণীকে এনে হাজির করা হল যুবরাজের সমুখে।
শেঠি বললেন–“সৃষ্টিকর্তা কেফেরার এবং সত্য ও ন্যায়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মাট-এর নামে শপথ নিয়ে বল যে সত্য ভিন্ন অসত্য বলবে না এই বিচারালয়ে।”
তরুণী মুখ তুলে চাইল, তারপর নিম্নস্বরে কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় নিবেদন করল–“মিশর যুবরাজ, আমি ইজরায়েলের দুহিতা, ওসব দেবদেবীর নাম নিয়ে শপথ আমি করতে পারি না।”