থেকে থেকে ভিড়টা দুই দিকে সরে যাচ্ছে দুই ভাগ হয়ে। খামোকা নয়, ধাবমান পাইকেরা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে জনারণ্যের ভিতর, দুই হাতে ঠেলে ঠেলে দিচ্ছে মানুষগুলোকে, আর ক্রমাগত চিল্লাচ্ছে–“পথ ছাড়! পথ ছাড়! রথ আসছে অমুক লর্ডের বা অমুক লেডির, পথ ছাড় সবাই!” হাতের ঠেলায় কাজ হচ্ছে না দেখলে লম্বা লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিটোচ্ছেও মানুষগুলোকে।
হঠাৎ আবির্ভাব এক ধর্মীয় মিছিলের। দেবী আইসিসের এক দল পুরোহিত ঢোলা ঢোলা সাদা পোশাক পরে নগর পরিক্রমায় বেরিয়েছেন। আইসিস তো, চন্দ্রেরই দেবী! তার বিগ্রহ মাথায় নিয়ে চন্দ্রালোকে পথে পথে বিচরণ তো পূজা পদ্ধতিরই অঙ্গবিশেষ! জনতা সে বিগ্রহ দেখে ধূলায় লুটিয়ে পড়েছে ভক্তির আতিশয্যে।
এর পরে এল এক শবযাত্রা। বড়লোক মারা গিয়েছেন কেউ একজন, শোক করবার জন্য ভাড়া করে আনা হয়েছে যেসব লোক, গুনতিতে তারা এক পলটন বিশেষ। মৃতের বিবিধ গুণ তারস্বরে কীর্তন করে করে তারা কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে জনতার।
সবশেষে এল অন্য ধরনের আর এক মিছিল। একপাশের একটা অন্তরালবর্তী পথ থেকে বাজার চত্বরে এসে উঠল কয়েকশো লোক, বঁড়শির মতো বাঁকা নাক তাদের। দাড়িওয়ালা পুরুষ সব। অল্প কয়েকটি স্ত্রীলোকও দেখতে পাচ্ছি সে দলে। সবাই একসাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা, সশস্ত্র প্রহরী রয়েছে তাদের আগে-পিছে।
এ-ধরনের লোক আমি আগে কখনো দেখিনি। যুবরাজকে জিজ্ঞাসা করলাম—”এরা কে আবার?”
“দাস”–বললেন যুবরাজ বিরসকণ্ঠে–“ইজরায়েলী। গোসেনের লোক। গিয়েছিল নতুন খালের মাটি কাটতে। ঐ যে নতুন একটা খাল হচ্ছে না, শহর থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত?”
নীরবে দাঁড়িয়ে দেখছি। চলে যাচ্ছে ওরা সারি বেঁধে। একটা জিনিস লক্ষ করে অবাক হয়ে যাচ্ছি। দড়ি দিয়ে বাঁধা রয়েছে তারা সবাই, তবু চোখে তাদের কী উদ্ধত দৃষ্টি! আর ভঙ্গি তাদের কী হিংস্র! কাদায় জলে পরিচ্ছদ নোংরা, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে দেহ, তবু-তবু তেজ ওদের একটুও কমেনি যেন।
বেশ চলে যাচ্ছে ইজরায়েলী দাসেরা, হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটে গেল। সাদা দাড়িওয়ালা এক বুড়ো ঐ দলের, সে ঠিক সমান তালে হাঁটতে পারছিল না, অন্যদের সঙ্গে। তার ফলে গোটা দলটারই গতি শ্লথ হয়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে, একবার একেবারে থেমেই পড়ল তারা।
পাহারাওলাদের মধ্যে একজন অমনি ছুটে গেল বুড়োর কাছে। তার হাতে রয়েছে সিন্ধুঘোটকের চামড়ার চাবুক, তাই দিয়েই বুড়োর পিঠে বসিয়ে দিল কয়েক ঘা। চামড়া কেটে অমনি চুঁইয়ে পড়ল রক্ত।
বুড়োও ভয় পাওয়ার লোক নয়। তার হাতে আছে কোদাল, তাই মাথার উপরে ঘুরিয়ে প্রচণ্ড এক ঘা, তাই দিয়ে বসিয়ে দিল পাহারাওলার মাথায়। মাথাটা আমাদের চোখের সামনেই গেল গুঁড়ো হয়ে।
পাহারাওলা একজন নয়, কয়েক গণ্ডা। তারা যে যেখানে ছিল, এল দৌড়ে। সবাই মিলে পিটোতে লাগল বুড়োকে, বুড়ো মাটিতে পড়ে গেল। তারপর এল এক সৈনিক, সে দেখল অবস্থাটা, তারপর খাপ থেকে টেনে বার করল তরোয়াল*। [*সে-যুগে অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হত ব্রঞ্জ দিয়ে । ব্রঞ্জ হল তামা আর টিনের সংযোগে উৎপন্ন মিশ্র ধাতু বিশেষ।]
আর তক্ষুনি ভিড়ের ভিতর থেকে ছুটে বেরুলো এক তরুণী। বসন তার অতি গরিবানা ধরনের, কিন্তু তার ভিতর থেকে যে সৌন্দর্য ফুটে বেরুচ্ছে, তুলনা তার কোথাও দেখিনি আমি।
এরপরেও বহু-বহুবার আমি দেখেছি মেরাপিকে। যে মেরাপি ইজরায়েলীদের সমাজে পরিচিত ছিল ইজরায়েল-চন্দ্রমা বলে। বহুক্ষেত্রে বহুরূপে দেখেছি তাকে। রানি সেজে আসতে দেখেছি তাকে হীরা-মণি-মাণিক্যে অলঙ্কৃত হয়ে, দেবী সেজে আসতে দেখেছি, চারিধারে পুণ্যজ্যোতি বিকীরণ করে, কিন্তু সেদিন সেই দাসজীবনের হীন পরিবেশে তাকে যতখানি অনবদ্য সৌন্দর্যের অধিকারিণী আমি দেখেছিলাম, ততখানি আর কোনোদিন কোনো ক্ষেত্রে দেখিনি।
ডাগর ডাগর দুটি নলিন নেত্র, নীলও নয় কালোও নয় তা, পূর্ণিমার জ্যোৎস্না এসে পড়েছে অশ্রুভরা সেই চোখ দুটির উপর। তামা রংয়ের বিপুল কেশ কোমল তুষারশুভ্র কণ্ঠে বক্ষে এসে লুটোপুটি খাচ্ছে এলোমেলো গোছায় গোছায়। কমলকোমল দুখানি করপল্লব ব্যাকুল হয়ে কাকুতি করছে–“মেরো না গো, মেরো না বাবাকে।” কোথায় কোন দোকানে বুঝি আগুন জ্বলছে একটা, তারই রক্তালোকের আভায় দীর্ঘ তনুবল্লীটি প্রতীয়মান হচ্ছে যেন অপার্থিব জ্যোতিমালায় মণ্ডিত বলে।
মেরাপি আর্তনাদ করছে। মাটিতে পড়ে আছে বৃদ্ধ, তাকে আগলে দাঁড়িয়ে সকাতরে দয়াভিক্ষা করছে খগপাণি সৈনিকের কাছে। নাঃ, দয়া নেই ঐ পাষাণ সৈনিকের প্রাণে। কে তাকে রক্ষা করবে তা হলে? এদিকে-ওদিকে ব্যাকুলভাবে চাইতে চাইতে হঠাৎ তার চোখ পড়ল যুবরাজ শেঠির উপরে, অমনি, অমনি সে চেঁচিয়ে উঠল–“আপনি, আপনি, আপনাকে দেখেই আমার মনে হচ্ছে মহাপ্রাণ আপনি। বিনা দোষে আমার বাবা খুন হতে যাচ্ছে। এও কি আপনি নীরবে দাঁড়িয়ে দেখবেন?”
সৈনিকটা চ্যাঁচাচ্ছে–“ওকে টেনে নিয়ে যাও, নইলে এক কোপে বাপবেটী দুটোকেই খতম করে দেব আমি।”
মেরাপি ততক্ষণে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে বাপের দেহের উপরে, পাহারাওলারা তাকে টেনে নিয়ে সরিয়ে দিল সৈনিকের আদেশে।
এদিকে যুবরাজ হুঙ্কার করে উঠেছেন—“থাম্ কসাই!”