অবশ্য, তারপর হেসে বললেন–“আত্মাপুরুষের আগে এই দেহধারী শেঠিই অবশ্য তা পড়ে নেবে বারবার। আচ্ছা ও-কথা থাকুক, ট্যানিস দেখলে?”
“কী করে দেখব যুবরাজ? এসে অবধি তো এই প্রাসাদ চত্বরেই ঘুরঘুর করছি এর-ওর-তার খোসামোদ করে করে।”
‘তা হলে চল, আমিই তোমায় রাজধানী শহর দেখিয়ে আনি। এই রাত্রেই। তারপর ফিরে এসে দু’জনে মিলে খাব এখন, কথা কইতে কইতে।
আমি শির নত করে সম্মতি জ্ঞাপন করতেই যুবরাজ জোরে, জোরে হাততালি দিলেন একবার। আর তাই শুনে একজন ভৃত্য এসে ঘরে ঢুকল। তাকিয়ে দেখলাম–এ সেই পাম্বাসা নয়, অন্য লোক।
“দুটো আঙরাখা নিয়ে এস’–তাকে হুকুম করলে যুবরাজ–“আমি এই লেখক মশাইয়ের সঙ্গে শহর দেখতে বেরুবো! চারজন নিউবিয়ান দেহরক্ষী থাকবে আমার সঙ্গে, বেশি নয়। তারা থাকবে বেশ একটু পিছনে, আর পরনে থাকবে তার ছদ্মবেশ, তাদের বল পিছনের গুপ্তদ্বারে তৈরি থাকতে।”
ভৃত্য অভিবাদন করে প্রস্থান করল।
আর প্রায় তখন, তখনই সেই কক্ষে এসে প্রবেশ করল এক কাফ্রি ক্রীতদাস। তার হাতে দুটো মুখোশওয়ালা আঙরাখা। অনেকটা মরুভূমির উষ্ট্ৰচালকদের পরিচ্ছদের মতো। আমরা দুজনে পরে ফেললাম সেই পোশাক। তারপর ক্রীতদাসটি আলো ধরে আমাদের বাইরে নিয়ে গেল। উলটো দিকের দরোজা দিয়ে। কত কত ঢাকা বারান্দা পেরিয়ে, একটা সরু সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলাম আমরা অবশেষে। এইবারে একটা চত্বর, সেটা পেরুতেই পাওয়া গেল পাঁচিল একটা, যেমন উঁচু তেমনি পুরু। সে-পাঁচিলে দুই কৰাটের দরোজা একটা। কবাটে আবার তামার পাত বসানো।
আমরা কাছে আসতেই দরোজটা খুলে গেল নিঃশব্দে। কে যে খুলে দিল, তা ঠাহর পেলাম না। কিন্তু বাইরে যেতেই একটা জিনিস সঙ্গে সঙ্গেই নজরে এল। আঙরাখা পরা চারজন লোক অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে আছে একটু তফাতে। আমাদের দিকে তারা যেন তাকিয়েও দেখল না। কিন্তু খানিকটা পথ চলবার পরই পিছন পানে তাকিয়ে দেখি, তারা ঠিক অনুসরণ করেছে আমাদের। অথচ ভাবটা তারা এমনিই দেখাচ্ছে যেন আমাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক তাদের নেই।
আমি মনে ভাবছি, সার্থক জন্ম এই রাজা আর রাজপুত্রদের। একটি মাত্র অঙ্গুলি সংকেতেই তারা যাকে ইচ্ছা তাকে নিজেদের সেবায় নিয়োজিত করতে পারেন।
আর ঠিক সেই সময়েই যুবরাজ আমায় বলছেন–“দেখ অ্যানা, রাজা বা রাজপুত্র হওয়ার মুশকিল কত! প্রহরী না নিয়ে এক পা একা চলবার উপায় নেই। আর প্রহরী সঙ্গে থাকার মানে কী জান তো? মানে হল এই যে, তুমি কোথায় যাচ্ছ, কী করছ তার পূর্ণ বিবরণ অবিলম্বে গিয়ে হাজির হবে পুলিশের কাছে। আর সে পুলিশ তো ফারাও ছাড়া অন্য কারও আজ্ঞাবহ নয়!”
প্রত্যেকটা জিনিসেরই সাদা-কালো দুটো দিক আছে, ভাবলাম আমি।
.
২.
বেশ প্রশস্ত একটা রাজপথ ধরে আমরা চলেছি। পথের দুই ধারে তরুশ্রেণি, তার পিছনে চুনকাম করা সব বাড়ি। বোঙ্গুরে শুকনো ইটের গাঁথনি সে-সব বাড়িতে, ছাদ তাদের সমতল, প্রত্যেকটা বাড়ি চারদিকে বাগান দিয়ে ঘেরা। এইসব দেখতে দেখতে আমরা এসে পড়লাম যে-জায়গায়, সেটাকে বাজার বলেই মনে হল। আর সেই সময়ে পামবীথির মাথার উপরে হল পূর্ণচন্দ্রের উদয়। আকাশ পৃথিবী উঠল ঝলমলিয়ে, উজ্জ্বল দিবালোকে ওঠে যেমন।
শহরের নাম ট্যানিস বটে, কিন্তু মহান র্যামেসিস এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে র্যামেসিস নামেও অনেকে একে অভিহিত করে। সুন্দর শহর, কিন্তু আয়তনে মেম্ফিসের অর্ধেকও নয়। যদিও মেক্ষিসের আর আগের গৌরবের দিন নেই। রাজধানী উঠে গিয়েছে ওখান থেকে, কাজে কাজেই লোকও অনেক উঠে এসেছে এই ট্যানিসে।
এই বাজারটাই সবচেয়ে নাকি জমকালো বাজার শহরে। এর চারদিকে নানা দেবদেবীর বড় বড় মন্দির, প্রতি মন্দিরের সমুখে স্ফিংক-বীথি। মুখ রমণীর মতে, দেহ সিংহিনীর মতে, এই রকম সব অতিকায় প্রস্তরমূর্তি ছিল প্রাচীন মিশরের বৈশিষ্ট্য, এদেরই নাম স্ফিংকস্।
একদিকে দ্বিতীয় রামেসিসের বিরাট মূর্তি, অন্যদিকে একটা টিলার মাথায় ফারাওয়ের প্রাসাদ। শহরে প্রাসাদ আরও অনেক আছে, দরবারের বড় বড় লোক, মন্ত্রী, সেনাপতিরা, আর অভিজাতশ্রেণির ধনীরা বাস করেন তাতে। সাধারণ নাগরিকেরা থাকে ঐসব ছোট বাগান ঘেরা বাড়িতে, যা আমরা রাস্তার দুইধারে দেখতে দেখতে এসেছি।
নীলনদের একটি শাখা শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত। অনেক রাজপথই শেষ হয়েছে সেই শাখানদীর কূলে গিয়ে।
শেঠি দাঁড়িয়ে পড়েছেন বাজারের মাঝখানে। নীরবে নিরীক্ষণ করেছেন জ্যোৎস্নাধৌত প্রাসাদগুলির সৌন্দর্য। কিছুক্ষণ পরে আমার দিকে ফিরে বললেন “অনেক পুরোনো এইসব বাড়ি, তবে ঐ যে আমনের মন্দির, আরটা-এর মন্দির, এ দুটি আমার ঠাকুর্দার আমলে আমূল মেরামত করা হয়েছিল। ঐ যে গোসেন প্রদেশে ইজরায়েলী দাসেরা থাকে, করানো হয়েছিল ওদের দিয়েই।”
“বহু অর্থ ব্যয় হয়েছিল নিশ্চয়ই!”–মন্তব্য করলাম আমি।
“অর্থ? মিশরের রাজা কি দাসদের পয়সা দেন নাকি?”–শুকনো জবাব পেলাম যুবরাজের কাছ থেকে।
রাত বেশি তো হয়নি। হাজার লোক বাজার চত্বরে হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে, দিনের মেহনত সাঙ্গ করে এসে আমরাও মিশে গেলাম সেই ভিড়ে, ট্যানিস বলতে গেলে মিশরের সীমান্তেই অবস্থিত। নানা দেশের লোক এসে একত্র মিলেছে এখানে। মরুভূমি থেকে এসেছে বেদুইন, লোহিত সমুদ্রতীর থেকে এসেছে সিরিয়া চিট্রিম দ্বীপের বণিক যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে ভূমধ্যসাগরের উত্তরবর্তী দেশ থেকে নানা ধরনের ভাগ্যান্বেষী নানান রকম ফন্দি-ফিকির মাথায় নিয়ে। দল বেঁধে বেঁধে জটলা পাকাচ্ছে তারা, গল্প করছে, হাসাহাসি করছে, আর নাহয় তো কোনো কথকের কাহিনি বা গায়কের গান শুনছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এক এক জায়গায় নাচও হচ্ছে বিদেশিনী নর্তকীদের, ভিড় সেখানেই সবচেয়ে বেশি।