বায়ুবেগে ছুটেছে আমাদের রথ। তবু আমরা দেখছি, জনরব ছুটছে আমাদেরও আগে আগে। যে কোনো জায়গায় ঘোড়া বদলাবার জন্য থামছি আমরা, দলে দলে মানুষ ঘিরে ধরছে আমাদের, সর্বত্রই একই প্রশ্ন সকলের মুখে–“ফারাও নাকি সসৈন্যে ডুবে গিয়েছেন লোহিত সমুদ্রে?”
“দেখলাম তো সেই রকমই”-উত্তর দিচ্ছি আমরা।
বায়ুবেগে রথ ছুটল দিবারাত্রি, আট দিন পুরো। অবশেষে মেম্ফিস। মেম্ফিসের সিংহদ্বার রুদ্ধ। আমরা সবলে পদাঘাত করলাম সেই দ্বারে। ভিতর থেকে প্রশ্ন করল প্রহরী–“কে তোমরা?”
“সপারিষদ ফারাও শেঠি” “অকম্পিত কণ্ঠে উত্তর দিলেন বৃদ্ধ বোকেনঘোন্সু।
“শেঠি ফারাও? ফারাও তো আমেনমেসিস!”
“ছিলেন আমেনমেসিসই ফারাও। তোমরা কিসের নেশায় বিভোর হয়ে আছ যে সারা মিশর যা শুনেছে, তোমরা তা শোননি? আমেনমেসিস লোহিত সমুদ্রের তলায়। আজকার ফারাও শেঠি মেনা। খোলো দ্বার! খোলো!”
ঘড়াং ঘড় শব্দে খুলে গেল বিশাল সিংহদ্বার। শেঠির সমুখে নতজানু রক্ষিবৃন্দ, মুখে তাদের জয়ধ্বনি–“জীবন! রক্ত! শক্তি! ফারাও! ফারাও। ফারাও!
সারা মেম্ফিসে প্রচণ্ড কোলাহল–“ও কীসের গোলমাল?”–প্রশ্ন করলেন শেঠি।
রক্ষী বলল–“এক ইজরায়েলী জাদুকরী নাকি ধরা পড়েছে, তাকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে আমন মন্দিরের সমুখে। তারই কোলাহল।”
মারা হচ্ছে? হয়নি তাহলে এখনো? পারব কি আমরা? পারব কি সময় থাকতে আমন মন্দিরে পৌঁছাতে? বায়ুবেগে রথ ছুটেছে মেম্ফিসের রাজপথে। কতদূর? কতদূর আর আমন মন্দির?
বিরাট অগ্নিকুণ্ড আমন মন্দিরের সমুখে। জনতা আজ কাইয়ের আজ্ঞাবহ। কাই বুঝিয়েছে–পরপর ঐ যে দশটা অভিশাপে শ্মশান হয়ে গেল সোনার মিশর, সে-সব অভিশাপ আসলে এই জাদুকরী মেরাপিরই ইন্দ্রজাল। সব ইজরায়েলী ছেড়ে গিয়েছে মিশর, এ তবু যায়নি, নিশ্চয় ও রয়ে গিয়েছে মিশরের আরও কিছু অনিষ্ট করবার জন্য। এই বেলা পুড়িয়ে মার একে।”
জনতা মেরাপিকে বেষ্টন করে আছে। এইবার তাকে ধরে আগুনে ফেলে দেবার জন্য তৈরি হল। প্রাণভয়ে মেরাপি চেঁচিয়ে উঠল—“বাঁচাও! প্রভু শেঠি! বাঁচাও আমাকে?”
আর সে-আর্তনাদের রেশ হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে না যেতে আমি আর বোকেনঘোন্সু হুঙ্কার করে উঠলাম–“জীবন! রক্ত! শক্তি। ফারাও! ফারাও! ফারাও!” সন্ত্রস্ত জনতা দুই ভাগ হয়ে গেল চকিতে, রাজরথ ঘর্ঘর শব্দে ছুটে এসে পড়ল আমন মন্দিরের সমুখে। লাফিয়ে নামলেন তা থেকে নবীন ফারাও শেঠি, মেরাপিকে বেষ্টন করলেন বাহুযুগলের আলিঙ্গনে।
“জীবন! রক্ত! শক্তি। ফারাও! ফারাও! ফারাও!”
কাই প্রশ্ন করেছিল-ফারাও তো আমেনমেসিস?
বোকেনঘোন্সু উত্তর দিয়েছেন–“আমেনমেসিসের সমাধি হয়েছে লোহিত সমুদ্রের অতল তলে। কিন্তু ফারাওয়ের আসন শূন্য থাকে না। নতুন ফারাও এই শেঠি মেনাটা তোমার সমুখে।”
এবার কাই নিঃশব্দে অপসৃত হওয়ার চেষ্টা করছে, শেঠির আদেশে জনতাই তাকে ধরে ফেলল। কী চপল এই জনতার চিত্ত! কাইয়ের প্ররোচনায় তারা মেরাপিকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করতে যাচ্ছিল, এখন শেঠির আদেশে তারাই কাইকে নিক্ষেপ করল অগিকুণ্ডে।
মেরাপিকে আমরা প্রাসাদে নিয়ে এলাম। কিন্তু তার স্নায়ুমণ্ডলীতে লেগেছিল প্রচণ্ড আঘাত, তিন দিনের দিন শেঠির কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল ইজরায়েল চন্দ্রমা।
শেঠির যখন অভিষেক হল মিশর সিংহাসনে, রানির আসনে উপবেশন করলে যিনি, তিনি উত্সাটি, মেরাপি নন। কিন্তু তাতে যে মেরাপির আত্মার ক্ষোভের কারণ হয়েছে কিছু, আমি অ্যানা তো তা মনে করি না। মেরাপি যা চেয়েছিলেন তা তিনি পেয়েছিলেন। সে-বস্তু মিশর সিংহাসনের অর্ধাংশ নয়, শেঠির হৃদয় সিংহাসনের উপরে পরিপূর্ণ অধিকার। তা তিনি পেয়েছিলেন। রাজ্যলাভের পরে ছয় বৎসর জীবিত ছিলেন শেঠি, এই ছয় বৎসরের ভিতর এক মুহূর্তের জন্যও মেরাপি ভিন্ন অপর কাউকে তিনি পত্নী বলে ভাবতে পারেননি।
ছয় বৎসর রাজত্ব করার পরে শেঠি যখন স্বর্গারোহণ করলেন, তখন তার কফিনের ভিতরে, তার বক্ষের উপরে, আমি রাজবন্ধু লেখক অ্যানা সাশ্রুনেত্রে স্থাপন করলাম একটা দ্বিখণ্ডিত স্ফটিক পেয়ালার দুটো অর্ধাংশ, আমাদের অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের সেই আদি প্রতীক।