ভোজসভায় যে বিতণ্ডা হয়েছিল ফারাও আর শেঠির মধ্যে, তা কি আর কানে যায়নি সৈনিকদের? শেঠিকে বেরিয়ে আসতে দেখে কেউ তারা হয়তো পথ ছেড়ে দিল অভিবাদন করে, কেউ বা হয়তো এগিয়ে এল, যেন কিছু বলবার মতলবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বলল না কেউ কিছুই, কিন্তু হাবেভাবে প্রত্যেকেই এটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল যে ইজরায়েলীদের অনুসরণ করে সমুদ্র পেরুনোর ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয় তারা।
কয়েকদিন যাবৎ রাতেও বিশ্রাম করিনি আমরা, বসে বসে ঝিমিয়েছি ধাবমান রথের উপরে। আজ আর রথের ধাবন কুর্দনের কোনো প্রয়োজন নেই, রাত্রি প্রভাতে কী ঘটে এই কুম্ভীরকুণ্ডের তীরে, তাই দেখবার জন্য আমরা বসে রইলাম নিশ্চল রথে। সেনাশিবির থেকে বেশি দূরে আমরা যাইনি, যদিও এ-সম্ভাবনার কথা সারাক্ষণ আমাদের অন্তরে জাগরূক ছিল যে গভীর নিশীথে হয়তো ফারাওয়ের তরফ থেকে একটা চেষ্টা হবে আমাদের হত্যা করবার জন্যই।
সে-আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও আমরা নিকটেই আছি। কী ঘটে, তাই দেখবার জন্যই আছি।
রাত দুপুর। একটা ঝড় বইছে। ঝড়টা এল পুব দিক থেকে, এত প্রবল সে ঝড় যে রথের আড়ালে আমাদের শুয়ে পড়তে হল, দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে না পেরে।
হঠাৎ সে ঝড় আবার থেমেও গেল। আর থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল নানারকম বিকট আওয়াজ, আর বহুকণ্ঠের চিৎকার। চিৎকার আসছে মিশরী শিবির থেকেও বটে, মেঘযবনিকার অন্তরালবর্তী ইজরায়েলী ছাউনি থেকেও বটে।
তারপর সারা পৃথিবী দুলে উঠল একবার, যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। যারা চিৎকার শুনে উঠে দাঁড়িয়েছিল, তারা সে-কম্পনে হুমড়ি খেয়ে মাঠিতে পড়ে গেল উপুড় হয়ে। আকাশে চাঁদ উঠছে তখন, সে চাঁদের রং রক্তের মতো রাঙা। সেই চাঁদের আলোতে আমরা দেখলাম, ফারাওর সমগ্র বাহিনী সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
যুবরাজ আমার হাতখানা আঁকড়ে ধরে আছেন। আমি নিজের মনেই বললাম “কোথায়? ওরা যায় কোথায়?”
যুবরাজ বললেন–যায় নিয়তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। কী সে নিয়তি, তা কে বলবে এক্ষুনি?”
আর কোনো কথা কইলাম না কেউ। বড় ভয় করছে যেন!
রাত্রি প্রভাত হল অবশেষে। তখন যে ভয়াবহ দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ল, মানুষের চোখ আগে কখনো দেখেনি তেমন।
মেঘপ্রাচীর অন্তর্ধান করেছে। প্রভাতী সূর্যালোকে আমরা স্পষ্ট দেখলাম, লোহিত সমুদ্রের অগাধ জল আপনাআপনি ভাগ হয়ে গিয়ে মাঝ বরাবর জাগিয়ে তুলেছে। একটা উঁচু জাঙ্গাল। ঐ ভূমিকম্পের দরুনই কি জাগল এটা? কে বলবে? এইটুকু শুধু আমার মনে হল যে ও পথ যমদ্বারে পৌঁছোবারই পথ।
প্রশস্ত সেই পথ বেয়ে কাতারে কাতারে চলে যাচ্ছে ইজরায়েলী জনগণ। ডাইনে জলপর্বত, বাঁয়ে জলপর্বত, মাঝখানে চলমান বিপুল জনপ্রবাহ। মিশরী সেনারা? তারাও চলেছে ইজরায়েলীদের ধরবার জন্য। ঠিক পিছনেই চলেছে তারা। সমস্ত মিশরী বাহিনী, ফারাও সমেত। না, সমস্ত নয়। বাহিনীর কিছু লোক গত রাত্রিতেই পালিয়ে এসেছিল শিবির থেকে, আশ্রয় নিয়েছিল আমাদের আশেপাশে। এ-প্রলয়ের কালে শেঠির সান্নিধ্যই যে নিরাপদ, এই বিশ্বাসের বশেই এসেছে তারা।
দেখতে পাচ্ছি। সবই দেখতে পাচ্ছি। এইখান থেকেই স্বর্ণরথে সমাসীন ফারাওকে দেখতে পাচ্ছি আমরা, তার চারপাশে দেখতে পাচ্ছি তার রক্ষীসেনাকে, বিশৃঙ্খল, এলোমেলো তার পদক্ষেপ।
“এখন? এখন? কী হবে এখন?”–অধীর হয়ে বিড়বিড় করছেন শেঠি। আর তার জিজ্ঞাসার উত্তরেই যেন পৃথিবী দুলে উঠল দ্বিতীয়বার। আবার ভূমিকম্প? ভূমিকম্প বই কি! তার সঙ্গে সঙ্গে উত্তাল জলোচ্ছ্বাস। পশ্চিমপানে সমুদ্রে উঠেছে এক তরঙ্গ সম্রাট, তার শীর্ষমুকুট যেন পিরামিড চূড়ার মতো উঁচুতে। ঈষৎ বাঁকানো ফেনায়িত ফণা তুলে সে-তরঙ্গ গড়াতে গড়াতে আসছে, আসছে, আসছে! ফারাও? কোথায় ফারাও? কোথায় তার দুই হাজার রথ, বিশ হাজার পদাতিক? তরঙ্গ দানবের জঠরে এক পলকের জন্য দেখতে পেলাম তাদের, তার পরে জল! জল! জল ছাড়া কোথাও কিছু নেই। পূর্ব দিকের জলপাহাড় ভেঙে নেমেছে পশ্চিমে, পশ্চিম দিকের জলপাহাড় ভেঙে নেমেছে পুবে, দুইয়ে মিলে এক হয়ে গিয়েছে, অবিচ্ছিন্ন লোহিত সমুদ্র। সেই সমুদ্রেরই উপর দিয়ে আমি যেন দেখতে পেলাম মিশর অভিমুখে পলায়মান মহা-মহা দেবদেহ, আমন, অসিরিস, টা, আইসিস, মাট। অকারণে তারা পালাচ্ছে না, পিছনে পিছনে আগুনের চাবুক হাতে তাদের তাড়া করে নিয়ে আসছে এক মহান অগ্নিস্তম্ভ।
কিন্তু দূরে?
দূরে, লোহিত সমুদ্রের পূর্ব কুলে তখন ইজরায়েলী জনতা নিরাপদে এগিয়ে চলেছে সিনাই মরুর অভিমুখে।
কতক্ষণ আমরা তাকিয়ে থাকতাম সেদিকে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো, তা কে জানে? কিন্তু হঠাৎ রূঢ় আঘাতে মোহভঙ্গ হল আমাদের। পিছন থেকে একটা নারীকণ্ঠের করুণ আর্তনাদ আমরা শুনতে পেলাম, যুগপৎ যুবরাজ ও আমি দুজনেই শুনতে পেলাম এক অশরীরী হাহাকার–“বাঁচাও! প্রভু শেঠি! বাঁচাও আমাকে।”
চমকে পিছন ফিরলাম দুজনেই। কেউ কোথাও নেই। কিন্তু ও কণ্ঠস্বর তো আমাদের ভুল হবার উপায় নেই! ও-আর্তনাদ মেরাপির।
***
আট দিন পথেই কাটল আমাদের।
বায়ুবেগে ঘোড়া ছুটিয়েছি দিবারাত্রি। মেরাপি! মেরাপি! কী হল ইজরায়েল চন্দ্রমা মেরাপির? কেন আমরা দেখলাম তার অশরীরী ছায়ামূর্তি? কেন শুনলাম তার করুণ আর্তনাদ? পারব কি আমরা সময়মতো পৌঁছোতে? পারব কি তাকে রক্ষা করতে? বৃদ্ধ বোকেনঘোন্সু বলছেন–“ঐ পামর জাদুকর কাই-ই কিছু করেছে তার।”