অবশেষে আট দিন পরে আমরা পৌঁছোলাম। ঠিক কুম্ভীরকুণ্ডের তীরে নয়, তীরে পৌঁছোবার উপায় নেই। সমুদ্রতীর জুড়ে ছাউনি ফেলেছে লক্ষাধিক ইজরায়েলী। তার পিছনে শিবির পড়েছে মিশরী সেনার। এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান রচনা করেছে এক আশ্চর্য বস্তু। আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত আলম্বিত ঘোর কৃষ্ণ একখানা নিচ্ছিদ্র বিশাল মেঘ। পথে আসতে আসতে এই ব্যাপারটার সম্পর্কে কিছু কিছু জনরব আমরা শুনেছি। শুনেছি যে দিনের বেলায় ইজরায়েলী চমূর আগে আগে চলে একটা আকাশচুম্বী স্তম্ভ, আগুনের মতো রং তার। কিন্তু সূর্যাস্তের পরে (সেই স্তম্ভ সমুখ থেকে চলে আসে ইজরায়েলীদের পিছনে, তখন এর রং হয় কালো, আর স্তম্ভের মতো আকাশপানে না উঠে এটা দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়ে, ইজরায়েলী ছাউনিকে মিশরীদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে। তা দিনের বেলায় এর সেই অগ্নিস্তম্ভের মতো রূপ দেখবার সুযোগ অবশ্য হয়নি আমাদের, কিন্তু রাতের চেহারার যা বর্ণনা এর শুনেছিলাম, তা দেখলাম বর্ণে বর্ণে ঠিক।
ফারাও আমেনমেসিস তখন উজির, সভাসদ, সেনানীদের নিয়ে ভোজনে বসেছেন। আমরা শিবিদ্বারে পৌঁছোতেই সৈনিকেরা যথারীতি জিজ্ঞাসা করল “কে যায়?” আমি উত্তর দিলাম–“মিশর যুবরাজ শেঠি মেনাটা।” আশ্চর্য হয়ে গেলাম সৈনিকদের আচরণে। বাইরের লোক সৈন্য শিবিরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রহরীসেনার কর্তব্য হল উপরওলাদের কাছে এত্তেলা করা। কিন্তু এক্ষেত্রে সে-এত্তেলা এরা করল না কেউ। শেঠির নাম শোনামাত্র সসম্ভ্রমে অভিবাদন করে তাকে পথ ছেড়ে দিল। আমরা প্রবেশ করলাম শিবিরে।
ফারাওয়ের ভোজসভার জাঁকজমক এই সঙ্গিন মুহূর্তেও কিছু কম নয়। বরং সমবেত অতিথিদের বেশ যেন উৎফুল্লই মনে হল। এতদিন মিশরী সেনা পশ্চাদ্ধাবনই করে এসেছে ইজরায়েলীদের, কিছুতেই তাদের নাগাল পায়নি। আজ কিন্তু ওদের সমুখে দুর্লঙ্ঘ্য সমুদ্র, রাত্রি অবসানে ধরা না পড়ে ওরা যাবে কোথায়? এতদিনকার মেহনত মিশরী সেনার, কাল শেষ হবে তার। ভাল করে খাওয়া দাওয়া করছেন আজ মিশরী নেতারা।
“কে আসে বিনা এত্তেলায়?”“ক্রুদ্ধ প্রশ্ন এল ভোজ-টেবিল থেকে।
আমি উত্তর দিলাম–“মিশর যুবরাজ শেঠি মেনাটা ও তাঁর সঙ্গে রাজসভাসদ বোকেনঘোনসু ও রাজবন্ধু লেখক অ্যানা। মহামানা হারওয়ের দর্শনপ্রার্থী।”
নিজেই এবার কথা কইলেন ফারাও–“সব পুরাতন বন্ধু? আসুন যুবরাজ শেঠি, সঙ্গীদের নিয়ে আসন গ্রহণ করুন, যোগ দিন এই আনন্দভোজ।”
“ফারাওকে ধন্যবাদ।”–জবাব দিলেন শেঠি, ফারাওয়ের মর্যাদার অনুযায়ী কোনো সম্মান তাকে না দেখিয়ে-কিন্তু আনন্দ করবার মতো সময় এটা কিনা, আমার ঘোরতর সন্দেহ হচ্ছে ফারাও। ইজরায়েল-নন্দিনী মেরাপির কথা শুনে থাকবেন, তিনি কিছু কিছু অসাধারণ শক্তির অধিকারিণী। তিনি একটা স্বপ্ন দেখেছেন কয়েকদিন আগে। স্বপ্নটা এই যে ইজরায়েলীদের অনুসরণ করতে গিয়ে মিশরের ফারাও সসৈন্যে ডুবে মরেছেন অতল সমুদ্রে। এই স্বপ্নের বৃত্তান্ত শোনামাত্র আমি যাত্রা করেছি মেম্ফিস থেকে, দিবারাত্রি রথ চালিয়ে আট দিনে এসে পৌঁছেছি কুম্ভীরকুণ্ডের তীরে। এখন আমার অনুরোধ, ফারাও কদাপি মিশরী সেনাকে সমুদ্র পেরুবার আদেশ দেবেন না, দেন যদি, মিশরের হয়তো তাতে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
ফারাও অট্টহাস্য করে উঠলেন–“পরামর্শটা দিচ্ছেন সেই মেরাপি, নয়? জাদুশক্তির বলে যিনি আমন দেবতার বিগ্রহ চূর্ণ করেছিলেন? পয়গম্বরদের অভিশাপে অভিশাপে মিশর যখন ধ্বংস হতে বসেছিল, যিনি তখন মেম্ফিসে নিজের বাসভবনটিকে নিরাপদ রেখেছিলেন জাদুমন্ত্র প্রয়োগ করে। অথচ প্রতিবেশী মেসিবাসীদের নিরাপদে রাখবার জন্য একটি অঙ্গুলিও উত্তোলন করেননি। শুনুন সবাই, আমাদের চিরহিতৈষিণী সেই জাদুকরী আজ বলে পাঠাচ্ছেন মিশরী সেনা যেন সমুদ্র পেরুবার চেষ্টা না করে, অর্থাৎ পলাতক ইজরায়েলীদের যেন স্বচ্ছন্দে কুম্ভীরকুণ্ড অতিক্রম করে সিনাই মরুতে চলে যেতে দেয়। বাহবা পরামর্শ! এ পরামর্শও কি আমরা না নিয়ে পারি?”
কথা শেষ করে ফারাও অমেনমেসিস অট্টহাস্য করে উঠলেন, আর সভাসদ সেনানীদের একাংশও যোগ দিল সেই হাসির রোলে। শেঠি বুকের উপরে দুই হাত বেঁধে উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে আছেন, এই উন্মত্ত পরিহাসে তিলমাত্র বিচলিত হবার কোনো লক্ষণ তার মধ্যে নেই।
হাসির রোল কতকটা থামল যখন, তখন তিনি উচ্চকণ্ঠে অথচ শান্তভাবেই পুনরুক্তি করলেন–“আমি আবারও বলছি ফারাও, মিশরের মুখ চেয়ে আপনি এখনও নিবৃত্ত হোন, কদাপি সমুদ্র পেরুতে যাবেন না, ইজরায়েলীদের পিছনে পিছনে।”
“নিশ্চয় যাব’–হুঙ্কার করে উঠলেন আমেনমেসিস–“এবং তুমিও যাবে আমার সঙ্গে। আমরা মরি যদি, মরবে তুমিও।”
“মরব একদিন নিশ্চয়ই, কিন্তু সমুদ্রে ডুবে মরব না”–বললেন শেঠি “ফারাও যদি আমার কথায় কোনোমতেই কর্ণপাত না করেন, তবে আর আমি কী করতে পারি? আমি বিদায় নিচ্ছি।”
আবার হুঙ্কার ফারাওয়ের–“কক্ষনো না। তোমাকে যেতেই হবে আমাদের সঙ্গে। ধর ওকে সেনানীরা!”
সম্রাটের আজ্ঞা, সেনানীরা যে যার আসন থেকে লাফিয়ে উঠল বৈকি! কিন্তু এ কী হল তাদের? কেউই যে সমুখে পা বাড়াতেই পারে না! এগুবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা তারা স্পষ্টতই করছে, কিন্তু শ্রীচরণ যেন আজ ঘোরতর বিদ্রোহী তাদের! একবার তাদের ব্যর্থ প্রয়াসের দিকে, আর একবার ফারাওয়ের হতবুদ্ধি ক্রুদ্ধ মুখভঙ্গির দিকে তাকিয়ে শেঠি ধীর পদে অপসৃত হলেন ভোজঘর থেকে। চলে যাওয়ার আগে বুড়ো বোকেনঘোষ্ণু হেসে উঠলেন হঠাৎ, “এ-পর্যন্ত পাঁচ পাঁচটা ফারাওকে আমি দেখেছি মিশরের সিংহাসনে। এই কিন্তু প্রথম দেখলাম এমন এক ফারাওকে, যাঁর আজ্ঞা পালন করবার মতো সৈনিক মেলে না।”