“যুবরাজ! মন্ত্র যদি সবাই পড়তে পারত, তাহলে তার আর কোনো দাম থাকত না”–সত্যকার বিজ্ঞজনের মতোই সাড়ম্বরে মন্তব্য করল পাম্বাসা।
‘“আর কেউই যদি তা পড়তে না পারে, তা হলে তো তা কারও কোনো কাজেই আসে না!”-জবাব দিলেন যুবরাজ।
পাম্বাসা একে একে অনেক জ্ঞানগর্ভ আপত্তি উত্থাপন করতে লাগল–“পড়তে পারা না-পারার কথা তো পরের কথা, আগে বিবেচনা করুন যুবরাজ, খুফুর পিরামিডের চুড়ায় মানুষ উঠবে কেমন করে? মসৃণ মর্মরে তৈরি গোটা পিরামিডটাই। দিন দুপুরেই তাতে এক পা উঠতে গেলে পা পিছলে যায়, রাত দুপুরের কথা তো ছেড়েই দিন। আর উঠতেই যদি না পারা গেল, তা হলে স্বপ্নভৃঙ্গারের রসপান করা বা মন্ত্র আওড়াননা, এসব কাজই বা করা যেতে পারে কেমন করে?”
“কেমন করে, আমি তো জানি না। জানতে পারলে বেঁচে যেতাম হে জ্ঞানবৃদ্ধ! কারণ অবসাদ থেকে মুক্তিলাভের জন্য আমার মতো এতখানি উতলা আর কেউ কোনোদিন হয়েছে বলে আমি তো মনে করি না। তুকতাকের কথা বাদ দাও এখনকার মতো, মনটা কিসে একটু হাল্কা হয়, বালাতে পার?
‘‘বাইরে কতগুলি বাজিকর এসেছে যুবরাজ, তাদেরই একজন বলেসে আকাশের পানে একটা দড়ি ছুঁড়ে দেবে, আর সেই দড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে শেষ পর্যন্ত স্বর্গে বিলীন হয়ে যাবে।”
“এটা যখন তাকে করতে দেখবে নিজের চোখে, তখন তাকে নিয়ে এসো আমার কাছ। তার আগে নয়। আমি যতদূর জানি, মৃত্যুই হচ্ছে একমাত্র দড়ি, যা বেয়ে আমরা স্বর্গে উঠতে পারি, অথবা নামতে পারি নরকে।”
“ওটা যদি অপছন্দ হয়, যুবরাজ, তা হলে একদল নর্তকী এসেছে, এমন সব নর্তকী, আপনার পিতামহ মহান রামেসিসের আমলে এলে যারা দুর্দান্ত খাতির পেতো এদেশে।”
“পিতামহের আমল আর নেই হে জ্ঞানবৃদ্ধ! অন্য কিছু বাৎলাও, যদি পার।”
“আর তো কিছুই মাথায় আসে না যুবরাজ! তবে হ্যাঁ, বাইরে একটা লেখক দাঁড়িয়ে আছে, নামটা তার অ্যানা, রোগাপানা, চোখ-নাকওয়ালা একটা লোক, স্পর্ধা কম নয় তার, বলে কিনা সে নাকি যুবরাজদের আমন-ক্ষেত্রজ যমজভাই।”
“অ্যানা?” যুবরাজ কান খাড়া করলেন হঠাৎ–“মেম্ফিসের অ্যানা? গল্পলেখক অ্যানা? আরে বোকা বুড়ো, আগে একথা বলতে কী হয়েছিল তোমার? এক্ষুনি, এক্ষুনি নিয়ে এস।”
দোরগোড়ায় পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি অ্যানা এসবই শুনছি এতক্ষণ, পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখছিও সব। “এক্ষুনি নিয়ে এস”–যুবরাজের মুখ থেকে আদেশ বেরুনো মাত্র আমি পর্দা ঠেলে ঢুকে পড়লাম কক্ষে, পাম্বাসার অপেক্ষা না রেখে। যুবরাজের সমুখে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বলে উঠলাম, “অবধান করুন মহিমান্বিত সূর্যপুত্র, আমি সেই দীন লেখক।”
পাম্বাসা ফোঁস করে উঠেছে ওদিকে–“নিয়ম হল, আমি গিয়ে নিয়ে আসব তোমায় যুবরাজের দরবারে। তার জন্য অপেক্ষা না করে নিজের খুশিতে তুমি চলে আস কী হিসাবে?” . “আর তুমি পাম্বাসা, তুমিই বা এই বরেণ্য লেখককে কুকুরের মতো দরোজার বাইরে ঠেলে রেখেছ কোন হিসাবে?”“তর্জন করে উঠলেন যুবরাজ–“ওঠো অ্যানা, মেজে থেকে ওঠো! সূর্যপুত্র-টুত্র উপাধি বাদ দাও এখনকার মতো, এটা তো দরবার নয়! কতদিন হল এসেছ ট্যানিসে?”
“অনেকদিন যুবরাজ! রোজ চেষ্টা করেছি আপনার সম্মুখে পৌঁছোবার, কিছুতেই পারিনি।”
“শেষ পর্যন্ত পারলে কী করে?”
সরলভাবে স্বীকার করলাম–“ঘুষ দিয়ে যুবরাজ! ঐটাই রীতি মনে হল। দরোজায় যারা আছে—”
যুবরাজ শেঠি বললেন–“বুঝেছি, বুঝেছি, ঐ দরোজার মালিকেরা! পাম্বাসা! একটা হিসাব দাও তো দরোজার মালিকদের কত সেলামি দিতে হয়েছে এই লেখক মহাশয়কে! হিসাব কর, আর তার দ্বিগুণ ওঁকে এনে দাও আমার তহবিল থেকে। এখন তুমি যেতে পার। গিয়ে এই ব্যাপারটার সুব্যবস্থা কর আগে।”
পাম্বাসার অবস্থা কী করুণ! চোখের কোণ থেকে একটা অনুনয়ের দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে সে বেরিয়ে গেল।
শেঠি বললেন–“এইবার তুমি বল তো অ্যানা, একদিক দিয়ে কিছু জ্ঞান তো তোমারও অবশ্যই আছে, বল তো রাজদরবারে চোর থাকা অনিবার্য কেন?”
“ঠিক সেই কারণে অনিবার্য, যুবরাজ, যে কারণে কুকুরের পিঠে মাছি থাকা অনিবার্য। মাছিকে খেতে হবে তো! ঘেয়ো কুকুরের পিঠে খাদ্য পায় সে।”
“ঠিক বলেছ তুমি”–বললেন যুবরাজপ্রাসাদের এই মাছিগুলি বেতন পায় কম। আমার হাতে যদি ক্ষমতা আসে কোনোদিন, আমি এর প্রতিকার করব। লোক থাকবে কম, মাইনে পাবে বেশি। যাক সে কথা, অ্যানা, তুমি বসো। তুমি আমায় জান না, কিন্তু আমি তোমায় জানি। জানি তোমার লেখার ভিতর দিয়ে। জানি তোমায়, ভালও বাসি। ঐ লেখারই জন্য! তোমার কথা সব বল আমায়।”
কী-ই বা কথা আমার? দুই-চার কথাতেই সব বলা হয়ে গেল। তিনি শুনে গেলেন, একটিও কথা না বলে। তারপর বললেন–“আমি তোমায় ডেকেছিলাম অনেকদিন আগে। তারপর রাজা-রাজড়াদের যেমন হয়, ভুলেও গিয়েছিলাম সে কথা। এত দেরি করলে কেন?”
“ওদিককার কাজকর্মের বিলিব্যবস্থার জন্য। তারপর একটা সংকও ছিল, শুধু হাতে যুবরাজের দর্শনে যাব না। একটা নতুন গল্প লিখেছি এর মধ্যে। আর সেটা উৎসর্গ করেছি যুবরাজকে। আশা আছে, সে ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন যুবরাজ।” এই বলে জামার ভিতর থেকে প্যাপিরাসের তাড়াটা বার করে টেবিলে রাখলাম।
যুবরাজের সুন্দর মুখখানি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল–“বল কী! এ যে আমার মহৎ সম্মান! আমি পড়ব, তারপরে নির্দেশ দিয়ে রাখব যে মৃত্যুর পরে আমার সমাধিতে রক্ষিত হবে ঐ কাহিনি। সেখানে আমার আত্মাপুরুষ বসে বসে পড়বে তা।”