দৃপ্তস্বরে বক্তৃতার উপসংহার করলেন উসার্টি ––”মিশরে এখনো একটা বিশাল সৈন্যবাহিনী আছে। আছে দ্রুতগামী রথ, আছে অস্ত্রকুশল পদাতিক। ফারাও আজ্ঞা দিন, এই বাহিনী অচিরে ধাবিত হোক ইজরায়েলীদের আটক করবার জন্য। না, মানুষগুলোকে তারা আটকাবে না। আটকাবে পশুপালকে, আটকাবে গম, রাই, আর ধানের বস্তাকে। মিশরীদের নিজেদেরই এখন বড় অভাব ওসবের! ইজরায়েলীদের ওসব আমরা খয়রাত করতে পারব না এখন।”
দৈবাৎ সেদিন বোকেনঘোন উপস্থিত ছিলেন ট্যানিসে। নিজের কানে তিনি শুনলেন, প্রথমে ফারাওয়ের ভাষণ, তারপরে উসার্টির তর্জন। তারপর ঐ প্রায় দেড়শো বছরের বুড়ো হাড় নিয়ে তিনি ধাবিত হলেন মেম্ফিসে। মেম্ফিসে যুবরাজ শেঠির প্রাসাদে সেদিন দারুণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যুবরাজ ও আমি। রানি মেরাপি স্বপ্ন দেখেছেন একটা। আমাদের কাছে সেটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। যেন একটা বিশাল সেনাদল নিয়ে মিশরের দ্বিমুকুটধারী ফারাও তলিয়ে যাচ্ছেন উত্তাল সমুদ্রের জলে। মেরাপি রাত্রিশেষেই শেঠিকে বলেছেন স্বপ্নের কথা। শেঠি আবার বলেছেন আমাকে, সূর্যোদয়ের পরেই। তারপর শেঠি আর আমি বসে বসে ভাবছি শুধু। ফারাও তলিয়ে যাচ্ছেন সমুদ্রে। কেন? কোথায়? সমুদ্রযাত্রা করার কোন প্রয়োজন হঠাৎ ঘটল আমেনমেসিসের? ইজরায়েলীদের দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে বলে একটা গুজব ইদানীং শোনা যাচ্ছে বটে। কিন্তু তারা দেশে যাক, আর জাহান্নমে যাক, সেটা তাদের ব্যাপার। ফারাও বা তার সেনাবাহিনী কেন সমুদ্রে তলিয়ে যাবেন? দুটোর ভিতর সংশ্রব কোথায়?
সংশ্রবটা বুঝতে পারা গেল, বোকেনঘো9 ফিরে আসার পরে। আমেনমেসিস প্রথমে অনুমতি দিয়েছিলেন ইজরায়েলীরা তাদের ধনসম্পদ সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে। পরে উসার্টির উত্তেজনায় তিনিই সসৈন্যে বেরিয়ে পড়েছেন, মিশরত্যাগী ইজরায়েলীদের কাছ থেকে তাদের পশু ও শস্য কেড়ে আনবার জন্য। যদি লোহিত সমুদ্রের এপারেই তিনি ধরে ফেলতে পারেন ইজরায়েলীদের, তাহলে তো ভালই। যদি তা না পারেন, সমুদ্রপারেও তিনি যাবেন সসৈন্যে। সেই যাওয়ার সময়
দেবী মেরাপি যা স্বপ্ন দেখেছেন, ফারাওর সৈন্য সমুদ্র পেরুবার সময় তা ঘটেও যেতে পারে বই কি! মেরাপি যে জাদুকরী, একথা শেঠিও বিশ্বাস করেন না, বোকেনঘোন্সুও না। কিন্তু জাদুকরী না হয়েও যে অনেক সময় তিনি নানা রকমের আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে থাকেন, তাও তো জানা আছে আমাদের। স্বপ্নের আকারে ভবিষ্যৎ যদি নিজেকে উদ্ঘাটন করে থাকে মেরাপির সমুখে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?
বোকেনঘোন্সু বলছেন–“আপনার আর অপেক্ষা করা চলে না যুবরাজ! এক্ষুনি বেরুতে হবে। ফারাও যদি সমুদ্র পেরুবার চেষ্টায় থাকেন, তাহলে তাকে নিবৃত্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে আপনাকে।”
“আমার কী স্বার্থ?”–শেঠি একটা নিস্পৃহ ভাব দেখাবার চেষ্টা করছেন ‘আমি নিষেধই বা করব কেন, আর নিষেধ করলেই বা ফারাও তা শুনবেন কেন?”
“ফারাও না শুনতে পারেন, কারণ ব্যাপারটা এখন দাঁড়িয়েছে তার আর তার নিয়তির মধ্যেকার ব্যাপার। কিন্তু চেষ্টা আপনাকে করতেই হবে। ফারাওকে বাঁচাবার জন্য নয়, সৈন্যবাহিনীটাকে বাঁচাবার জন্য। কারণ ও সৈন্য মিশরের, যে মিশর দুদিন বাদে আপনারই হবে।”
.
৯.
মেরাপিকে সঙ্গে নেওয়া সমীচীন মনে হল না। কারণ এটা আমরা জানি যে বায়ুবেগে রথ চালিয়ে গেলেও আট দিনের কমে আমরা ফারাওয়ের নাগাল পাব না। এই আটদিন ধরে ধাবমান রথের ধাক্কা সহ্য করা কোমলাঙ্গী নারীর পক্ষে সম্ভব নয়। ওকে সঙ্গে নিলেই মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিতে হবে। আর তা নিতে গেলে সব চেষ্টা হবে ব্যর্থ। নিয়তি গ্রাস করবে মিশরী সেনাকে, আমরা কুম্ভীরকুণ্ডে পৌঁছোবার আগে।
কুম্ভীরকুণ্ড হচ্ছে লোহিত সমুদ্রের সেই বিশেষ অংশটা, যেখানে সমুদ্র শাখাটা সবচেয়ে সংকীর্ণ আর অগভীর। ইজরায়েলীরা সেইখান দিয়েই সমুদ্র পেরুবে, এই রকমই জনশ্রুতি শুনে এসেছেন বোকেনঘোষ্ণু। দেখে এসেছেন যে আমেনমেসিসও সসৈন্যে যাত্রা করলেন সেই কুম্ভীরকুণ্ডেরই পানে। কাজেই আমরাও যাব সেই কুণ্ড লক্ষ্য করেই।
মেরাপি কাতর হলেন খুবই। একমাত্র সন্তানকে হারাবার পরে তিনি যেন শেঠিকে পলকের জন্যও আর চোখের আড়াল করতে চান না। তবু বিষয়টার গুরুত্ব প্রণিধান করতে তার দেরি হল না, তিনি সাহস দেখিয়ে বললেন–“আমার জন্য চিন্তা করো না তোমরা। এ-প্রাসাদে আবার ভয় কী? অসুবিধাই বা কী? আমি খুবই সাবধানে থাকব। তোমরা কার্যসিদ্ধি করে সগৌরবে ফিরে এসো।”
মেরাপির কাছে বিদায় নিলাম। রক্ষীসৈন্যকে বিশেষ করে সতর্ক করা হল। সযতনে প্রাসাদ পাহারা দেবে তারা, রক্ষা করবে মেরাপিকে। বাইরের কাউকে ঢুকতে দেবে না প্রাসাদ সীমায়। প্রয়োজন হলে অবাঞ্ছিত প্রবেশার্থীকে হত্যাও করতে পারবে, তার জন্য দায়-দায়িত্ব সব যুবরাজ শেঠির।
বিদায় নিলাম আমরা। বায়ুবেগে ধাবিত হল অশ্ব। মাঝে মাঝেই ঘোড়া বদল করে নিচ্ছি। যে-কোনো শহরেই মেলে ঘোড়া। বিশেষত যুবরাজ শেঠির নাম করলে তো যে-কোনো গৃহস্থই ঘোড়া সরবরাহ করবে আহ্লাদ করে। তবে কথা এই, সব জায়গায় তেমন ভাল ঘোড়া পাওয়া তো সম্ভব নয় অল্প সময়ের মধ্যে। গতি মন্থর হলেই আমরা অধীর হয়ে উঠি।