এল অভিশাপ। একই দিনে একই মুহূর্তে, একান্ত অকারণে মারা পড়ল মিশরের প্রতি গৃহের প্রথম সন্তান। সেই সঙ্গে মেরাপিরও প্রথম সন্তান অকস্মাৎ ঢলে পড়ল মরণের কোলে।
শেঠির হৃদয় ভেঙে গেল। মেরাপি হয়ে গেল পাগলের মতো।
কিন্তু শেঠির সন্তানই একমাত্র রাজবংশধর নয়, যাকে গ্রাস করেছিল ইজরায়েলী পয়গম্বরদের শেষ এবং সর্বনাশা অভিশাপ। ফারাও আমেনমেসিসেরও জ্যেষ্ঠ পুত্রকে হতে হয়েছে এই অভিশাপের বলি।
আর শুনতে আশ্চর্য লাগবে, সারা দেশের উপর সর্বধ্বংসী ইজরায়েলী অভিশাপের তাথৈ নৃত্য বারবার পর্যবেক্ষণ করেও পাষাণ হৃদয় বিন্দুমাত্র টলেনি, নিজের সন্তানকে অকস্মাৎ সেই অভিশাপের খড়গে বলিদান হতে দেখে সে একেবারে ভেঙে পড়ল নৈরাশ্যে। “কেন আমি শেঠির সুপারিশকে সমর্থন করিনি তখন? কেন সিংহাসনে বসবার পরে নিজের দেশে চলে যেতে দিইনি ইহুদীদের? তা হলে তো বারবার খণ্ডপ্রলয় নেমে আসতে পারত না মিশরের বুকে? ধনেপ্রাণে সর্বস্বান্ত হত না মিশরী জনগণ?” এইসব হল এখন আমেনমেসিসের মুখের বুলি প্রতি মুহূর্তে।
মিশরী জনগণেরও বিপুল একটা অংশ এই মতই পোষণ করতে শুরু করল এবার। “ছেড়ে দাও ওদের। ওদের ধরে রাখতে গিয়ে সর্বনাশ হল মিশরের। যাক ওরা! নিজেদের মরুদেশে গিয়ে স্বর্গসুখ পায় যদি, তাই ওদের পেতে দাও।”
এবার যখন ইজরায়েলী পয়গম্বরেরা দরবারে এলেন, তাঁদের পুরোনো দাবি উত্থাপন করতে, তখন মন্ত্রী সভাসদবর্গের সঙ্গে পরামর্শ করে ফারাও বললেন “বেশ, আর আমি আপত্তি করব না তোমাদের প্রস্তাবে যেতে পার তোমরা মিশর ছেড়ে।”
উৎফুল্ল হয়ে পয়গম্বরেরা বললেন–“আমাদের ধনৈশ্বর্য সব নিয়ে তো?”
“কী আর এমন ধনৈশ্বর্য তোমরা সঞ্চয় করেছ এদেশে? তোমাদের কাছে তার মূল্য যতই হোক, মিশরীদের চোখে তা তুচ্ছ। নিয়ে যাও, নিয়ে যাও তোমাদের শস্যভাণ্ডার, তোমাদের পশুপাল, তোমাদের আর আর যা কিছু আছে, সব। বিদায় হও তোমরা। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচি।”
পয়গম্বরেরা আশীর্বাদ করে বিদায় নিলেন। বলে গেলেন–“আমরা বিশ দিনের মধ্যেই চলে যাচ্ছি মিশর ছেড়ে। এবার যে ফারাওয়ের সম্মতি আদায় হবে, তা আমরা আগে থেকেই জানতাম। তাই আমাদের জনগণকে আমরা প্রস্তুত থাকতেই বলেছি। তারা মোটঘাট বেঁধে তৈরিই আছে। তিন দিন পরে আর একটিও ইজরায়েলী থাকবে না মিশরে।”
পয়গম্বরেরা বিদায় হলেন। এই নতুন পরিণতির কথা ট্যানিসবাসীদের জানাবার জন্য বিশেষ করে এক দরবার আহ্বান করলেন আমেনমেসিস। অভিজাতবর্গের সঙ্গে এতে আমন্ত্রিত হয়ে এলেন সাধারণ নাগরিকদের প্রতিনিধিরাও। আমেনমেসিস প্রথমে সবাইয়ের সমুখে এক বিশদ বিবরণ খাড়া করলেন বিগত দ্বাদশ অভিসম্পাতের। মিশর যে এখন সর্বান্ত, রিক্ত, তার জীবনীশক্তি যে ধাপে ধাপে ক্ষয় হতে হতে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছে ঐ সব বিপর্যয়ের দরুন, এসব বুঝিয়ে দিলেন সবাইকে। খেদ করে বললেন–“কী বলব তোমাদের, আমি যেন চোখ মেলেই ঝাঁপ দিয়েছি আগুনে। কী এক দুর্বার শক্তি যেন আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছে—”দেব না, দেব না যেতে। হয়তো তা আমার স্বার্থবুদ্ধি, হয়তো তা আমার পূর্বজন্মের পাপের ফল। মেনাটা আমায় রাজ্য সিংহাসন দিয়ে গিয়েছিলেন শুধু এই উদ্দেশ্যেই যে আমি ইজরায়েলীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের দাবি কখনো মঞ্জুর করব না। হয়তো সেই মৃত ফারাওয়ের আজ্ঞাই আমাকে বাধ্য করেছে এই সর্বনাশা নীতির অনুসরণে।”
আত্মবিলাপ শেষ করে আমেনমেসিস এবার ভবিষ্যতের কথা তুললেন–“দশটা অভিশাপেই মিশর বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে একেবারে। এখনও যদি ইজরায়েলীদের সঙ্গে আমরা বিরোধ চালিয়ে যেতে থাকি, তা হলে ওরা হয়তো জাদুর বলে নীলনদটাই ভরাট করে দেবে বালি দিয়ে। অথবা হয়তো ভূমধ্যসাগরটাকে আকর্ষণ করে আনবে মিশরের বুকের উপরে! এই ভয়েই আমি এবার অনুমতি দিয়েছি যে ওরা যেথা ইচ্ছা চলে যেতে পারে এ দেশ ছেড়ে। আশা করি, এতে তোমাদের অনুমোদন আমি পাব।”
সমবেত মিশরীরা আর কী বলবে? পূর্ব ইতিহাস ফারাও যা বর্ণনা করলেন, তাও তাদের জানা, আবার ভবিষ্যৎ আশঙ্কার কথা তিনি যা আজ শোনালেন, তাও তাদের ধারণার বাইরে নয়। তারা সর্বসম্মতিক্রমেই ফারাওকে জানিয়ে দিল– তিনি যা ব্যবস্থা করেছেন, তাতে তাদের সবাইয়েরই সমর্থন আছে।
কিন্তু এর পরেই নতুন সুর বেজে উঠল সভাস্থলে। আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মিশরের রাজকন্যা, যুবরানি উসার্টি। তিনি পুরোপুরি সমর্থন করতে পারলেন না আমেনমেসিসকে। তার বক্তব্য হল এই যে ইজরায়েলীরা যেতে চায় যখন, চলে যাক। ওরকম দুবৃত্ত জাতি দেশে না থাকে যদি, তাতেই দেশের মঙ্গল। কিন্তু তারা সমস্ত ধনৈশ্বর্য সঙ্গে নিয়ে যাবে, এ কেমন কথা? কয়েক শতাব্দী আগে যখন তাদের পূর্বপুরুষেরা নিজের দেশে খেতে না পেয়ে এদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিল, তখন কি তারা সঙ্গে এনেছিল কোনো ধন বা ঐশ্বর্য? জীর্ণ চীর ছিল তাদের পরিধানে, উদর পূর্ণ ছিল শুধু হাওয়ায়। সেই তারা খেয়ে-পরে চকচকে হয়ে উঠেছে যুগ যুগ ধরে, বংশবৃদ্ধি করেছে কল্পনাতীত দ্রুতবেগে, মালিক হয়েছে জমিজিরাত, ঘোড়াভেড়া, বাড়ির ও খামারের। কোথায় পেলো? দিয়েছে এই মিশর। থাকত যদি এদেশে শান্তিপ্রিয় নাগরিকের মতে, সে-সব অবশ্যই ভোগ করত। কিন্তু চলে যখন যাচ্ছে, তখন কী অধিকারে নিয়ে যাবে সে-সব? দশ দশটা অভিশাপে মিশরের অন্য সব জমি জ্বলে গিয়েছে, যায়নি কেবল গোসেনের জমি। মিশরের সব প্রদেশের পশুপাল হয়েছে নির্মূল, হয়নি কেবল গোসেনের। এখন তো মিশরীদের চাইতে ইজরায়েলীদের অবস্থা ভাল! এখন কী বলে ফারাও তাদের ঢালাও অনুমতি দিয়ে দিচ্ছেন–গোলার শস্য আর পালের পশু সব তারা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে পুরুষ পরম্পরায় ভোগ করবার জন্য? যাবে যারা, তারা সেই ভিখারীর বেশেই যাক, যে ভিখারীবেশে তারা এসেছিল মিশরে।