“কখনোই কাটবে না”–বললেন শেঠি। কিন্তু জনতা নাছোড়বান্দা। শেঠিকে সাধারণত তারা রাজার মতো সম্মান করে, কিন্তু এখন তারা কথা কইছে যেন বেশ একটু অসম্ভ্রমের সুরে। শেঠি সমস্যায় পড়লেন। রক্ষীসেনা তার আছে, কিন্তু সংখ্যায় তারা বড় জোর একশো হবে। ওদিকে সারা মেম্ফিস এসে একত্র হয়েছে তার দ্বারদেশে। ওরা যদি উগ্র হয়ে ওঠে, মেরাপিকে যদি জোর করেই নিয়ে যেতে চায় আইসিস মন্দিরে, ওদের তাড়িয়ে দেবার শক্তি সে রক্ষীসেনার হবে না। এই সমস্যার মুহূর্তে পরামর্শ চাইলেন তিনি বিজ্ঞ বৃদ্ধ বোকেনঘোর কাছে।
বোকেনঘোন্সু বললেন–“যুবরানির ক্ষতি কী হতে পারে আইসিস মন্দিরে গেলে? বরং না গেলে ঐ ক্রুদ্ধ জনতা অনেক কিছু ক্ষতি করতে পারবে তার, আপনার ও আমাদের সবাইয়ের। আমার বিবেচনায় ওঁর একবার যাওয়াই ভাল।”
মেরাপির নিজের ঘোরতর অনিচ্ছা–“আমি পৌত্তলিক নই, আইসিস নাম্নী কোনো দেবীর অস্তিত্বে আমার বিশ্বাস নেই, আমি কেন যাব তার মন্দিরে তারই ভূমিকায় অভিনয় করতে? বিশেষত আমার শিশুপুত্রকে নিয়ে?”
কিন্তু শেঠির বিপদটা উপলব্ধি করলেন মেরাপি। তাই ঘোরতর অনিচ্ছাতেও তিনি রাজি হয়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত। জনতা আনন্দরোলে দশ দিক কম্পিত করে সপুত্র মেরাপিকে নিয়ে চলল আইসিস মন্দিরে।
একে প্রচণ্ড ভিড়, তায় নিবিড় অন্ধকার। আমাকে আর বোকেনঘোন্সুকে সঙ্গে নিয়ে শেঠিও মেরাপির সঙ্গে সঙ্গেই প্রাসাদ থেকে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু সিংহদ্বারের বাইরে পা দেওয়া মাত্রই অন্ধকারে দিভুল হয়ে গেল আমাদের। কাই যে জনতার বেষ্টনীতে ঘিরে কোথায় নিয়ে গেল মেরাপিকে, তা আর ঠাউরে উঠতেই পারলাম না আমরা। তাকে নিয়ে কী করেছিল জনতা, তা পরে আমরা মেরাপির মুখ থেকেই শুনেছিলাম।
আইসিসের মন্দিরে নিয়েই মেরাপিকে তুলল ওরা। কাই যে জাদুকর, আর মেরাপি যে তা নয়, তার প্রমাণ হাতে হাতেই পাওয়া গেল এইবার। মশালের আলোকে কাইয়ের চোখের দিকে একবার তাকিয়েই মেরাপি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ল। কাই তাকে পরিধান করতে বলল আইসিসের শাস্ত্রকথিত পরিচ্ছদ।
আমরা যখন অবশেষে মন্দিরে পৌঁছোলাম, সারি সারি মশালে মন্দিরের ভিতরটা আলোকিত। আইসিসের সিংহাসন থেকে দেবীর প্রস্তর বিগ্রহ অপসারিত হয়েছে, তার জায়গায় বসানো হয়েছে দেবীবেশিনী মেরাপিকে। শুধু তাই নয়, তার কোলে তার পুত্রও রয়েছে, আইসিসপুত্র হোরাসের বেশে সজ্জিত। এই অবস্থায় আইসিসবেশিনী মেরাপি কাইয়ের শিক্ষামতো উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করছে–“সৃষ্টি স্থিতি-সংহারকারিণী আমি আইসিস নিজস্ব দৈবীশক্তি বলে এই বিশ্বব্যাপী তমসাকে সংহরণ করে নিলাম। দিবালোক ফুটে উঠুক এইবার।”
আর কী বিস্ময়! কী বিস্ময়! সত্য সত্যই অন্ধকার কেটে যেতে লাগল মেরাপির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে, জনতা উঠল জয়ধ্বনি করে–“জয় মাতা আইসিসের জয়।”
আমরা যখন সপুত্র মেরাপিকে রথে তুললাম, তখন তার জ্ঞান নেই।
আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া কিন্তু কোথায় এই অন্ধকারে আলো ফোঁটানোর ব্যাপার উপলক্ষ করে মেসিবাসীরা কৃতজ্ঞ হবে মেরাপির উপরে, তা না হয়ে তারা অনুযোগ করতে লাগল নানা রকম–“উনি যখন ইচ্ছা করলেই ইজরায়েলী অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারেন আমাদের, তখন আগের আগের অভিশাপগুলোকেও কেন আগে থেকে নিরস্ত করেননি? ওঁর নিজের প্রাসাদের জল রক্তে পরিণত হল না, আমাদের বাড়ির জল হল। ওঁর ক্ষেতখামারের ফল বা ফসল নষ্ট হল না, আমাদের ক্ষেতখামারের হল। ওঁর একটাও ঘোড়া বা ভেড়া মারা গেল না, আমাদের গেল। এরকম পক্ষপাত কোনো দেবীর মধ্যে থাকা উচিত নয়। দেবী হয়েও উনি দানবীর মতো আচরণ করেছেন।”
বলা বাহুল্য, এসব অনুযোগেরও উৎস কাই। আইসিসবেশিনী মেরাপির আদেশেই সেদিন অন্ধকার কেটে গিয়েছিল মেম্ফিস থেকে, মেম্ফিসবাসীদের এ ধারণা একদম ভ্রান্ত। বাস্তবিকপক্ষে সে-ব্যাপারটা কাই নিজেই ঘটিয়েছিল নিজেরই জাদুশক্তি বলে। জাদুকর হিসাবে তার শক্তি, তত সে সত্যি সত্যি হারায়নি। ইজরায়েলী পয়গম্বরদের বৃহত্তর শক্তির কাছে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে যদিও, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেলে এখনও কাই অনেক অঘটন ঘটাতে পারে।
মেরাপি যে অসাধারণ শক্তিমতী জাদুকরী, এ-বিশ্বাস এখনও দৃঢ় কাইয়ের অন্তরে। তার ধারণা, ইচ্ছা করলেই ইজরায়েলী জাদুর গূঢ় রহস্যের সন্ধান তাকে দিতে পারত মেরাপি! দেয়নি যে, সে শুধু কাইকে পদানত রাখবার জন্যই। বেশ, কাইও দেখে নেবে তাকে। মেসিবাসীদের ক্ষেপিয়ে তুলে সর্বনাশ করে ছাড়বে মেরাপির।
দুর্ভাগিনী মেরাপি! এদিকে শত্রু তার কাই ও মেম্ফিসবাসীরা, ওদিকে শত্রু ইজরায়েলের ভগবান। জাহভের অপার করুণা ছিল তার উপরে, আইসিস সেজে পৌত্তলিক ধর্মের মহিমা ঘোষণা করতে গিয়ে সে-করুণা সে হারিয়েছে। পয়গম্বরদের আদেশ প্রচারিত হয়েছে, আগের আগের সব অভিশাপ থেকে মেরাপির স্বামী নিষ্কৃতি পেয়েছে যদিও, আসন্ন যে অভিশাপ অচিরেই মিশরের উপরে নেমে আসতে যাচ্ছে, তা থেকে আর নিস্তার পাবে না, সে।
সে-অভিশাপ এল, নিষ্ঠুর, ভয়াবহ, সর্বনাশা। অভিশাপটা এই যে, মিশরের প্রতি গৃহের প্রথম সন্তানটি একই দিনে একই সময়ে একসঙ্গে মৃত্যুমুখে পতিত হবে, বিনা ব্যাধিতে, বিনা দুর্ঘটনায়।