কিন্তু আগেও যেমন, এবারেও তেমনি। মেসি নগরে শেঠির প্রাসাদে। শেঠির শস্যক্ষেত্রে নেই একটিও ব্যাং। শেঠির অধিকারের ঠিক ওপারে তারা চেঁচিয়ে আকাশ ফাটাচ্ছে, কিন্তু এপারে তারা কেউ আসবে না।
ব্যাংয়ের পরে এল উকুন, তারও পরে হল এক মহামারী। অন্য কিছু ব্যাধি নয়, প্রত্যেকটা মানুষের সারা অঙ্গ ছেয়ে গেল দূষিত ক্ষতে। প্রাণহানি কারও হল না তাতে, কিন্তু জনে জনে কষ্ট পেল অশেষ। ঘা যতদিন না শুকলো, কোনো কাজ করতে পারল না কেউ হাত-পা নেড়ে ।
অবাক কাণ্ড! শেঠির প্রাসাদের বাইরে থাকে একদল রক্ষী, ভিতরে থাকে আর একদল । দুই দলের বাসগৃহের মধ্যে ব্যবধান মাত্র বিশ পা। সেই বাইরের রক্ষীরা আক্রান্ত হল মহামারীতে, ভিতরের রক্ষীরা পেল তা থেকে অব্যাহতি। তা নিয়ে দুই দলের কী কলহ আবার!
তার পরে এল পশুর মড়ক। যেখানে যত পশু আছে মিশরে, কী এক অজানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মরতে লাগল হাজারে হাজারে। রক্ষা পেয়ে গেল শুধু যুবরাজ শেঠির পশুবৃন্দ।
এই সময়ে প্রথমে বৃদ্ধ বোকেনঘোনসু, পরে খারেব কাই মেম্ফিস থেকে চলে এলেন, যুবরাজ শেঠির কাছে আশ্রয় নেবার জন্য। বোকেনঘোনসুকে সমাদরেই গ্রহণ করলেন যুবরাজ, কিন্তু কাইয়ের সম্বন্ধে তার যথেষ্ট আপত্তি দেখা গেল। আপত্তির কারণ অবশ্য মেরাপি। মেরাপি যেদিন আমন মন্দিরে বাজি ধরেছিল, সেদিন বিগ্রহ চুর্ণ হয়ে যাওয়ার পরে কাই করে একটা সন্ধির প্রস্তাব মেরাপির কাছে। আর সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরে সে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শাসায় মেপিকে। সে সব কথা তো যুবরাজ শুনেছেন।
কিন্তু কাই অনুনয় করছেন অতি সকাতরে–“অপদার্থ বলে ফারাও আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। মিশরের উপরে এই অভিশাপ পরম্পরার একটাও আমি রুখতে পারিনি, এই আমার অপরাধ। কিন্তু আমি কী করব বলুন! স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, ইজরায়েলের দেবতা জাহভে আমাদের দেবতা আমন অসিরিস আইসিসের চেয়ে বেশি শক্তি রাখেন। ফারাও তা কিছুতেই বুঝতে চান না। বিনা দোষে তাড়িয়ে দিলেন আমাকে। আমি তাই আপনার কাছে এলাম আশ্রয় নিতে। যুবরাজ শেঠি কি শরণার্থীকে বিমুখ করবেন?”
কোমল হৃদয় শেঠির। একটুখানি কাতরতা দেখেই গলে গেলেন। খাল কেটে কুমীর আনা হচ্ছে জেনেও আশ্রয় দিলেন কাইকে।
বলা হয়নি, শেঠির হৃদয় ঠিক এই সময়টাতে একটু বেশিই কোমল ছিল এক বিশেষ কারণে। ইজরায়েল চন্দ্রমা মেরাপি তার কয়েকদিন আগে একটি পুত্র উপহার দিয়েছেন শেঠিকে।
.
৮.
এর পরে সারা মিশরে নেমে এল নিবিড় অন্ধকার। দিবারাত্রি ভেদজ্ঞান হারিয়ে ফেলল মানুষে, আকাশে না দেখা দেয় সূর্য, না ওঠে একটা নক্ষত্র। ভয়ার্ত মিশরীরা তারস্বরে ডাকছে তাদের বহু দেবতার মধ্যে কাউকে না কাউকে, বাড়ি থেকে বেরুবার সাহসও নেই তাদের। তবে হ্যাঁ, সূর্যচন্দ্রহীন আকাশের নীচেও শেঠির বাড়িটা কী এক রহস্যময় আলোকে যেন উদ্ভাসিত।
কাই নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে নেই। বুকে বসে দাড়ি ওড়াচ্ছে শেঠির। গোপনে গোপনে সে ক্ষেপিয়ে তুলছে মেসিবাসীদের। এই যে নরকের অন্ধকারে আচ্ছন্ন সারা পৃথিবী, এর ভিতরেও সে অনায়াসে সারা শহর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতি গৃহে ঢুকে মানুষকে বোঝাচ্ছে যে পরপর এই যে এতগুলি দৈবী উৎপাত ঘটে গেল মিশরের উপর দিয়ে, এর জন্য দায়ী আর কেউ নয়, যুবরাজ শেঠির আশ্রিতা ঐ ইহুদিনী জাদুকরী মেরাপি, ইজরায়েলরা যাকে ডাকে ইজরায়েলের চঁদ বলে। মনে নেই, ঐ মায়াবিনী ইহুদিনীই আমন মন্দিরে ঢুকে বিচূর্ণ করেছিল আমন-রার বিগ্রহ? ওর জাদুর কাছে আমরা সব শিশু মাত্র। এই যে অনন্ত অন্ধকারের রাজত্ব চলছে মিশরে, এর প্রতিকারের বিদ্যে মিশরের কোনো জাদুকরের নেই। এর অবসান ঘটাতে পারে একমাত্র ঐ নারীই। তোমরা সবাই গিয়ে যুবরাজ শেঠিকে যদি বল
কী যে বলতে হবে যুবরাজকে, তা আর ধৈর্য ধারণ করে শুনল না মেসিবাসীরা। দল বেঁধে তারা বেরিয়ে পড়ল মশাল হাতে নিয়ে, শেঠির প্রাসাদের দ্বারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল–“এ আঁধারের অবসান করুন। আমরা পাগল হয়ে গেলাম এর দরুন।”
শেঠি স্তম্ভিত। “কে অবসান করবে এ-অন্ধকারের?’–প্রশ্ন করলেন অলিন্দে দাঁড়িয়ে। করবেন তিনি, যাঁর মন্ত্রবলে এতগুলো দৈবদুর্বিপাকের হাত থেকে আপনার প্রাসাদ অক্ষত দেহে বেরিয়ে এসেছে। জলের বদলে আমরা খেয়েছি রক্ত, আপনার প্রাসাদের বাসিন্দাদের জল রক্তে পরিণত হয়নি। লাখে লাখে ব্যাং ডেকেছে সারা মিশরে, আপনার জমিতে তারা ডাকেনি। পঙ্গপালে উজাড় করেছে আমাদের শস্যক্ষেত্র, আপনার একটি কণা ফসল খোয়া যায়নি। এসবই আপনার রানি মেরাপির মন্ত্রবলে হয়েছে, যাঁকে ইজরায়েলীরা ডাকে ইজরায়েলের চাঁদ বলে। সে-চাঁদ এবার আমাদের উপরে এক কণা করুণার জ্যোছনা বিতরণ করুন, অন্ধকারের কবল থেকে আমাদের রক্ষা করুন। ঐ দেখুন, সারা মেম্ফিস নিবিড় আঁধারে আচ্ছন্ন, কেবল এই আপনারই প্রাসাদটি আলোয় আলোয় ঝলমল করছে।”
‘যুবরানি মেরাপিকে দিয়ে তোমরা কী করতে চাও?”–জিজ্ঞাসা করলেন শেঠি।
“কী করলে অন্ধকার কাটবে, তিনিই তো ভাল জানেন”–বলল একজন।
“না, জানেন না তিনি”–দৃঢ়স্বরে জবাব দিলেন শেঠি।
তখন কাইয়ের শিক্ষামন্তত একজন বলল–“তিনি একবারটি আইসিস মন্দিরে চলুন। তিনিও চন্দ্রমা, আইসিসও চন্দ্রমা। আমাদের বিশ্বাস যে তিনিই দেহধারিণী আইসিস। মন্দিরে গিয়ে আইসিসের আসনে তিনি বসুন একবার, তাহলেই অন্ধকার কেটে যাবে বলে বিশ্বাস আমাদের।”