“সে কী মশাই?”–আমি আকাশ থেকে পড়লাম একেবারে।
“ইজরায়েলী পয়গম্বরদের অভিশাপের কথা শোনেননি। তারা সময় দিয়ে গিয়েছিল দুই চাঁদ। ঠিক দুই চাঁদ পরে সারা দেশে সব জল রক্ত হয়ে গিয়েছে। কাল সারাদিন এক ফোঁটা জল খেতে পাইনি। এই একটু আগে রক্তের রাজ্য পেরিয়ে এল আমার বজরা। দেখুন নৌকার গায়ে রক্ত, আমার নিজের পোশাকে রক্তের ছিট, মাল্লাদের বসনেও তাই।”
“কিন্তু নদীর এ-অংশে তে রক্তের চিহ্ন নেই। এর কারণ কী তাহলে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম ভদ্রলোককে।
“বলতে পারব না। তবে রক্তবন্যাটা ধীরে ধীরে এগুচ্ছে, বজরার গতির চেয়ে তার বেগ মন্থর। আর মজা দেখুন, রক্তটা এগুচ্ছে নদীস্রোতের উলটো মুখে, উজানে। কিসের জোরে এগুচ্ছে, তা বুঝি না।”
একটু থেমে তিনি আরও বললেন–“সারাপথ জেলেদের হাহাকার শুনতে শুনতে আসছি। জলের মাছ রক্তের ভিতর বাঁচাবে কেমন করে? সারা নদী মরা, পচা মাছে ভর্তি। দুর্গন্ধে বমি আসে।”
রাজকর্মচারীটি বজরা চালিয়ে দিলেন। আমি মাল্লাদের বললাম সমস্ত জলপাত্র জলে পূর্ণ করে নিতে। তারা আদেশ পালন করল বটে, কিন্তু যেভাবে আমার দিকে চাইতে লাগল, তাতে মনে হল যে আমাকে পাগল ঠাউরেছে তারা।
বজরা আমরাও চালিয়ে যাচ্ছি। অল্প দূরেই দেখা পেলাম সেই রক্ত নদীর। লাল রেখাটা এগুচ্ছে উজানের পানে, ধীরে হলেও নিশ্চিতভাবে এগুচ্ছে। হতবুদ্ধিকর দৃশ্য। এপাশে কালো জল, ওপাশে লাল রক্ত, মাঝখান দিয়ে সুচিহ্নিত একটি সীমারেখা। আর সেই সীমারেখা যেন চোখের সামনেই একটু একটু করে উজানে হটে যাচ্ছে। আর মাছগুলোর কী রুদ্ধশ্বাস দৌড়! রক্তের এলাকা পেরিয়ে নির্মল জলে পালাবার জন্য কী তাদের আকুলিবিকুলি!
মেম্ফিসে পৌঁছোলাম। এখানে আর এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। সারা মেম্ফিসে সব জল রক্ত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু যুবরাজ শেঠির প্রাসাদে সব জল আগের মতোই নির্মল, স্বাভাবিক। এ-রহস্যের কারণও জানতে পারলাম যুবরাজের মুখ থেকেই। জ্যাবেজ এসেছিল, মেরাপির কাকা। ইজারায়েলী পয়গম্বরদের আশীর্বাদ এনেছিল যুবরাজের জন্য। তারা বলে দিয়েছিলেন–“যুবরাজ! তুমি ইজরায়েলীদের উপরে ন্যায্য ব্যবহার করতে চেয়েছিলে, সুপারিশ করেছিলে যে তাদের ফিরে যেতে দেওয়া হোক তাদের নিজের দেশে। সে-সুপারিশ যে অগ্রাহ্য হয়েছে, সেটা তোমার দোষ নয়। অগ্রাহ্য হওয়ার ফলে জাহভের কোপে তিলে তিলে ধ্বংস হবে মিশর, কিন্তু সে-ধ্বংসের গ্রাস থেকে তুমি যুবরাজ শেঠি, তুমি রেহাই পেতে থাকবে বরাবর।
জ্যাবেজ এই বার্তাই শুধু বহন করে আনেনি, শেঠি যাতে রেহাই পান, তার পাকা ব্যবস্থাও করে গিয়েছে। প্রাসাদের, খেত-খামারের চারিদিকে সে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছে মন্ত্রোচ্চারণ করে করে আর মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে। বলে গিয়েছে যে যুবরাজের অধিকৃত এলাকায় জাহভের কোনো অভিশাপ কোনো অশুভ প্রভাবই সঞ্চারিত হবে না কোনোদিন। প্রত্যক্ষ প্রমাণ, এ-প্রাসাদে জলের স্বাভাবিক অবস্থা।
জলের বিকৃতি সাত দিন স্থায়ী হল। পয়গম্বরেরা বলেও ছিলেন সাত দিনের কথা। তারপর কিছুদিন সব শান্ত, হঠাৎ ঐ পয়গম্বরেরা আবারও দেখা দিলেন : ফারাওয়ের দরবারে–“এখনও তুমি যেতে দাও ইজরায়েলীদের। তা নইলে নতুন এক অভিশাপ নেমে আসবে অচিরে। গতবারে টের পেয়েছ যে তেষ্টার জলের অভাবে কী কষ্ট হয় মানুষের। এবারে টের পাবে ক্ষিধের যন্ত্রণা। এখনও দাও অনুমতি।”
“দেব না!”–গর্জন করে উঠলেন ফারাও। কী যেন এক দুর্দান্ত জেদ চেপে গিয়েছে তার, ইজরায়েলীদের কিছুতেই ছাড়বেন না তিনি। কী করবে তারা? জাদুমন্ত্রের খেল দেখিয়ে রাজশক্তিকে পরাজিত করবে? তা যে করা যায় না।
হাতে হাতে তা ওদের দেখিয়ে দেবেন ফারাও আমেনমেসিস। তিনি কাইকে ডেকে কড়া আদেশ দিলেন–“তোমার সকল বিদ্যে ঝালিয়ে নাও এই সময়। রুখতেই হবে ইজরায়েলীদের জাদুর শক্তি।”
কাই তো প্রতিজ্ঞায় কল্পতরু একেবারে। দরাজ প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল, মিশরে কোনো উৎপাতই সে হতে দেবে না অতঃপর। তোড়জোড় শুরু করে দিল, নানা আধা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে। আমন মন্দিরে নতুন এক আমন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এর মধ্যে, আগের মতোই অতিকায়, আগের চাইতেও ভয়াল। সেই মূর্তির আশেপাশে, সেই মূর্তিকেই কেন্দ্র করে তার যা কিছু ক্রিয়াকলাপ।
দুটো মাস অপেক্ষা করলেন ইজরায়েলের পয়গম্বরেরা। তারপর মিশরের উপরে নেমে এল আকাশজোড়া পঙ্গপালের ঝাক। সূর্য ঢেকে ফেলল সেই পঙ্গপালের মেঘ, দিনদুপুরে সারা পৃথিবী অন্ধকার। মাটিতে যখন নেমে এল ঐ কাল পতঙ্গেরা, ক্ষেতের ফসল খেয়ে শেষ করল তারা, বড় বড় গাছকে করে ফেলল নিষ্পত্র, একটা শিষ রইল না কোনো ঘাসের ডগায়। জনগণ হাহাকার করতে লাগল, সারা বৎসরের খাদ্য তাদের পঙ্গপালের উদরে চলে গেল কয়েক দিনের মধ্যে।
কিন্তু আশ্চর্য দেখ, মেম্ফিস শহরে যুবরাজ শেঠির প্রাসাদ উদ্যানে একটি পঙ্গপাল নামেনি, তার কোনো শস্যক্ষেত্রে এক কণা শস্য খোয়া যায়নি পঙ্গপালের দরুন। জ্যাবেজ ঠিক বলেছিল, অভিশাপের আওতা থেকে শেঠিকে রেহাই দিয়েছেন ইজরায়েলী পয়গম্বরেরা।
তারপর কিছুদিন যায়, এবার হল ব্যাংয়ের উৎপাত। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ব্যাং কোথা থেকে যে এল, কেউ তা বলতে পারে না। যেমন বীভৎস তাদের চেহারা, তেমনি বিকট তাদের আওয়াজ। সারা পৃথিবী জুড়ে যেন ঢাক পিটিয়ে যাচ্ছে কোনো দুর্জয় শত্রুসেনা। পথঘাট মাঠ নদীকূল গিরিসানু বনপ্রান্তর, সর্বত্র তারা গ্যাঙোর-গ্যাং আওয়াজে যেন শুনিয়ে যাচ্ছে মিশরীয়দের–“তোরা অভিশপ্ত, তোরা অভিশপ্ত, তোরা অভিশপ্ত।”