ইজরায়েলী পয়গম্বরদের উপরে তার আস্থা ও শ্রদ্ধা পূর্ববৎই অটুট এখনো, তাদের আদেশও সে পালন করবে নতশিরে, যেমন করেছিল সেই আমন মন্দিরে বাজি ধরার সময়। কিন্তু তা বলে তাদের আদেশেও মেরাপি লাবানকে আর আত্মদান করবে না। কেন? এ-প্রশ্নের আর উত্তর নেই।
গোসেনে যখন যাবে না, মেক্ষিসেই অগত্যা তাকে আসতে হল। যুবরাজ শেঠি সিংহাসনে বসছেন না আর, তা ঠিক। কিন্তু ইজরায়েলীদের ক্রোধ থেকে মেরাপিকে রক্ষা করবার মতো ক্ষমতা তার এখনও যথেষ্টই আছে। এখানে তাঁর মেম্ফিসের প্রাসাদ একটা কেল্লার মতোই সুরক্ষিত, তার চৌহদ্দির ভিতরে শেঠিই একচ্ছত্র রাজা, সেখানে তার অনুমতি বিনা প্রবেশ করবে, এমন সাধ্য কারও নেই।
ট্যানিস থেকে যুবরাজের ভৃত্যবর্গও অনেকে এসেছে তার সঙ্গে, যদিও সেই দাড়িওয়ালা পাম্বাসা বুড়ো আসেনি। যুবরাজ ফারাও হচ্ছেন না শুনেই সে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল তার, এখন শোনা যাচ্ছে সে ফারাও আমেনমেসিসের চাকরিতে ভর্তি হয়েছে। ঘুষখোর লোকের প্রভুভক্তি আর কত হবে?
মেম্ফিসে বসে সারা মিশরেরই খবর পাই আমরা। আমেনমেসিস বসেছেন সিংহাসনে। উসার্টি স্বামীর সঙ্গে আসেননি বটে, কিন্তু আমেনমেসিসকেও বিশেষ পাত্তা দিচ্ছেন না। শেঠিরই ট্যানিসের প্রাসাদে তিনি আছেন, নতুন ফারাওকে ভয়ও করেন না, ভক্তি দেখাবারও দরকার বোধ করেন না।
সব খবরই পাওয়া যায় এখানে বসে। আমেনমেসিস সিংহাসনে বসার অল্প কয়েকদিন পরেই ইজরায়েলের পয়গম্বরেরা আবার এসেছিলেন তাঁর দরবারে। এসে যথারীতি দাবি জানিয়েছিলেন যে ইজরায়েলীদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক। যা আশা করা গিয়েছিল, আমেনমেসিস তাই বললেন–“কদাপি দেব না অনুমতি। কেন দেব? কয়েক শতাব্দী ধরে যারা মিশরে বাস করছে, তারা মিশরেরই অধিবাসী। মিশর ছেড়ে যাওয়ার অধিকার তাদের নেই।”
“যদি যেতে না দেন, মিশরের সর্বনাশ হবে ভগবানের ক্রোধে।”
“ভগবান কি আমাদেরও নেই?”
“না, তোমাদের আছে শত শত পুতুল দেবতা। তাদের মধ্যে যে ছিল সবার প্রধান, তাকে তত জাহভের রোষবজ্ৰ বিচূর্ণই করে ফেলেছে তার নিজের মন্দিরে। যা বলছি, তা শোন ফারাও। ইজরায়েলীদের আটকে রাখলে মিশর ধ্বংস হয়ে যাবে। অভিশাপের পরে অভিশাপ এমনভাবে নেমে আসতে থাকবে এদেশের উপরে, শ্মাশান হয়ে যাবে এই সোনার দেশ। ঘটবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ঘটবে অনৈসর্গিক দুর্বিপাক, ক্ষুধার অন্ন পাবে না মিশরীরা, এক বিন্দু জলও পাবে না পান করবার জন্য।”
পান করবার জল পাবে না? ফারাও হেসে উঠলেন, হেসে উঠল তার সভাসদবর্গ। “এত বড় নীলনদ থাকতে?”
‘নীলনদে তখন জলস্রোত বইবে না, বইবে রক্তস্রোত।’ বললেন পয়গম্বরেরা। “দেখবে তোমরা?” দরবার গৃহের সমুখে একটা ফোয়ারায় জল উৎসারিত হচ্ছে, পয়গম্বরেরা হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করলেন সেই জলে। অমনি, কী এ বিভীষিকা? সমস্ত ফোয়ারাটা লালে লাল হয়ে গেল চোখের পলকে। কেউ কেউ সেই লাল জল মুখে দিয়েও দেখল–ঠিক রক্তের মতো নোনতা বিস্বাদ। থু থু করে ফেলে দিল মুখ থেকে।
পয়গম্বরেরা বিদায় হয়ে গেলেন। ভয়ার্ত ফারাও ডেকে পাঠালেন শ্রেষ্ঠ মিশরী জাদুকর কাইকে। আমন মন্দিরের খারেব সে। মেরাপির সঙ্গে জাদুর বাজি লড়তে গিয়ে সে আসল বিগ্রহকে রক্ষা করতে পারেনি বটে, কিন্তু এবারে সে আশ্বাস দিল–“জলকে রক্ত করে দেওয়া এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। ও আমরাও পারি। এই দেখুন—”
ফারাওকে অন্য একটা জলাশয়ের কাছে নিয়ে গিয়ে কাই নিজের লাঠি দিয়ে আঘাত করল তার জলে, অমনি সে-জলও পরিণত হল রক্তে। ফারাও উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তাই তো? আরও তত রয়েছে সব শক্তিমান জাদুকর! এরাও তো জলকে রক্ত বানিয়ে দিতে সক্ষম। তবে আর ভয় কী?
ভয় নেই? মূঢ় ফারাও! জলকে রক্ত বানাবার ফিকির কাইয়েরও জানা আছে বটে, কিন্তু রক্তকে আবার জলে পরিবর্তিত করার ক্ষমতা তার আছে কি? দরকার রক্তের নয়, দরকার তৃষ্ণার জলের। সেই জল যখন সবই রক্তে পরিণত হবে, কাইয়ের ইন্দ্রজালে তা আবার স্বরূপ ফিরে পাবে কি?
সে-প্রশ্নই ফারাও করলেন না কাইকে। মতিচ্ছন্ন না হলে এমন ভুল কেউ
এসব কত মেম্ফিসে বসেই শুনেছি আমরা।
ইতিমধ্যে আমাদের মেসি প্রাসাদে ঘটনাও ঘটেছে কিছু। শেঠি বিবাহ করেছেন মেরাপিকে। উসার্টি যখন ট্যানিস থেকে আসবেনই না এবং সিংহাসনহারা শেঠিকে যখন তার কোনো প্রয়োজনই নেই, তখন শেঠিই বা কতকাল আর নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করবেন?
মেরাপি রয়েছেন শেঠির অত্যন্ত কাছে। সৌন্দর্যে তিনি তো দেবী আইসিসেরই সমতুল। এদিকে শেঠির তিনি অনুরাগিনীও অতি মাত্র। এ-দুইয়ের বিবাহ হয়ে যাওয়া সর্বথা বাঞ্ছনীয়। এতে নির্বাসিত জীবনের যন্ত্রণা ভুলতে পারবে দুটি মহৎ প্রাণ।
এই বিবাহের পরে যুবরাজের বজরা নিয়ে আমি চলে গেলাম থিবিসে। সেখানকার গ্রন্থাগারে আছে কতকগুলি মূল্যবান প্রাচীন পুঁথি, সেইগুলির এক একটা নকল করে আনবার উদ্দেশ্য নিয়ে।
কাজ শেষ করতে আমার প্রায় দুই মাস লেগে গেল। ওদিকে যুবরাজও আমায় ঘন ঘন তাগিদ পাঠাচ্ছেন, মেম্ফিসে ফিরে যাওয়ার জন্য। অবশেষে আমি একদিন বজরায় চড়ে বসলাম আমার পুঁথির বোঝা সঙ্গে নিয়ে।
আমি যাচ্ছি নদীর ভাটিতে। উজান বেয়ে আসছে আর একখান বজরা। পাশাপাশি আসতেই লক্ষ্য করলাম–সে বজরার আরোহী আমার পরিচিত, ট্যানিমের জনৈক ভদ্রলোক, ফারাওয়ের কর্মচারী। নৌকা থামিয়ে আমরা পরস্পরে আলাপ করে নিলাম কিছুক্ষণ। সেই সময়ই তিনি আমায় চুপি চুপি বললেন “যতটা সম্ভব, পানীয় জল বোঝাই করে নিন বজরাতে। ভাটিতে সারা নদী রক্ত নদী হয়ে গিয়েছে, জল পাবেন না একবিন্দুও।”