মেরাপিকে বলতে শুনলাম–“তুমি ভুল করেছ খারেব কাই! আমি কোনো জাদুই জানি না। আমার ভিতর দিয়ে ভগবানের কোনো শক্তি যদি আত্মপ্রকাশ করে থাকে, ভগবানের ইচ্ছাতেই তা হয়েছে। ভগবানেরই মহিমা সেটা, আমার বা অন্য কারও কোনো কৃতিত্ব নয়।”
রুষ্টস্বরে কাই বলল–“আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছ তুমি? এরজন্য ঘোরতর অনুতাপ করতে হবে তোমায়।
“যা আমার নেই, তা আমার কাছে চাইলে আমি দেব কোথা থেকে? ওকে প্রত্যাখ্যান বল কী করে? অনুতাপ? জাহভের যদি সেই ইচ্ছা হয়, করব অনুতাপ!”
দুই দিন পরে দরবারে আবার ডাক পড়ল যুবরাজের। ফারাও বললেন “গোসেন পর্যটনের বিবরণী যা দিয়েছ, আগে থেকেই মৌখিক তোমার কাছে শুনেছিলাম যদিও, ভাল করে পড়লাম তবু। তুমি বলছ ইজরায়েলীরা যুগ যুগ ধরে অত্যাচারিত হচ্ছে মিশরে, তাদের এবারে নিজের দেশে যেতে দেওয়া উচিত। কেমন তো?”
“সম্রাট ঠিকই পড়েছেন আমার বিবরণী” বললেন যুবরাজ।
“এখন আমার বক্তব্য, আমি তোমার মতানুযায়ী কাজ করতে অক্ষম। আমি স্থির করেছি, ইহুদীদের আমি অসিমুখে শায়েস্তা করব। যুগ যুগ ধরে যারা মিশরে বাস করছে, মিশর ছাড়া অন্য কোনো দেশে তাদের থাকা উচিত নয়। আছে বলে যারা মনে করে, আমার চোখে তারা রাজদ্রোহী, দেশদ্রোহী। তারা দণ্ডনীয়, এই নীতি অনুসারেই ইহুদীদের এযাবৎ শাসন করা হয়েছে এদেশে, এখনও তাই হবে। এতে তোমার অনুমোদন আছে কিনা, বল।”
‘সম্রাট যখন আজ্ঞা করছেন, তখন বলি, নেই অনুমোদন।”
“তা হলে কাল যদি আমি মরে যাই, সিংহাসনে তুমি কর উপবেশন, তা হলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই তুমি ইজরায়েলীদের দেশ ছেড়ে যেতে অনুমতি দেবে?”
“তা তো অবশ্যই ফারাও!”
“আমি তা হতে দিতে পারি না। যুগ যুগ ধরে যে প্রশাসন নীতি চলে আসছে মিশরে, একটা জাদুকরীর মোহে পড়ে তুমি তা উলটে দেবে, এ আমি হতে দিতে পারি না।”
“জাদুকরী?”–এতক্ষণে তীক্ষ্ণ প্রতিবাদের সুর ফুটে উঠল যুবরাজের কণ্ঠে।
“জাদুকরী নয়? আমি সেই জাদুকরীর কথাই বলছি, যে পরশু রাত্রে আমনের মূর্তি বিচূর্ণ করেছে রাজধানীর বুকের উপরে বসে। তোমার উপরে সে যে অত্যন্ত অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। সে-প্রভাবের ফলে তোমার ব্যক্তিগত ক্ষতি যা হবার, তা তো হবেই, তা রোধ করার উপায় নেই আমার হাতে। কিন্তু মিশরেরও সর্বনাশ যাতে না হয় সে-প্রভাবের দরুন, তা আমি এক্ষুনি করছি। তোমায় আমি আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলাম, তুমি তবু সতর্ক হওনি। অতএব তোমাকে আমি সিংহাসনের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করছি। আমার পরে ফারাও হবে আমেনমেসিস।”
.
৭.
প্রিয় পুত্রকে সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করলেন ফারাও মেনাটা। কেন করলেন? দৈবতাড়িত হয়েই করলেন বলতে হবে। মিশরের ভাগ্যে অশেষ দুর্গতি আছে বলেই তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেন এইভাবে। শেঠির বদলে আমেনমেসিস। এ যেন যেচে শান্তির বদলে অশান্তি বরণ করে নেওয়া, প্রীতির বদলে হিংসা, অমৃতের বদলে নরকাগ্নি।
শেঠিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার পরেই জ্ঞান হারালেন মেনাপ্টা। সে-জ্ঞান আর মৃত্যুর পূর্বে ফিরে আসেনি তাঁর। বেঁচে ছিলেন অবশ্য অজ্ঞান অবস্থায় পুরো একটা দিন, এবং সেই একদিন উসার্টির কর্মতৎপরতার বিরামও ছিল না অবশ্য, কিন্তু শেঠির নিজের উদাসীনতার দরুনই পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়ে গেল।
উসার্টি চেয়েছিলেন–সৈন্যবাহিনীর এবং অভিজাতবর্গের সাহায্য নিয়ে ফারাওয়ের আদেশ তিনি নাকচ করিয়ে দেবেন। সে-প্রয়াসে শেঠির অনুমোদন থাকত যদি, আমেনমেসিসকে বন্দি বা নির্বাসিত করা কঠিন হত না। কারণ জনসমাজের সর্বস্তরে শেঠির জনপ্রিয়তা অসাধারণ, তার একটি মাত্র ইঙ্গিতে আমেনমেসিস ফুৎকারে উড়ে যেত মিশরের সীমার বাইরে।
কিন্তু যুবরাজ নিস্পৃহ। “পিতৃআজ্ঞার বিরোধিতা করব না। রাজ্য সিংহাসন এমন কী জিনিস, যার জন্য বিবেকবিরুদ্ধ কাজ করব?” উসার্টির শত অনুনয় ব্যর্থ হল। ওদিকে ফারাও মেনাটা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তাঁর শেষ ঘোষণা অনুযায়ী আমেনমেসিস উপবেশন করলেন মিশর সিংহাসনে। অনায়াসে, মসৃণভাবে। কোনো তরফ থেকে কোনো প্রতিবাদ উত্থিত হল না। অথচ শেঠি যদি উসার্টির পরামর্শে কর্ণপাত করতেন তা তিনি করলেন না। পিতার দেহান্ত হল যখন, তিনি ত্যাগ করে গেলেন ‘ট্যানিস রাজধানী। এখন থেকে তিনি বাস করবেন মেম্ফিস নগরে। সেখানে বিশাল প্রাসাদ ও জমিদারি আছে তার। এগুলি তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। ফারাওয়ের ঘোষণায় সিংহাসন তিনি হারিয়েছেন বটে, কিন্তু সে-ঘোষণা, এ-সম্পত্তিকে স্পর্শ করতে পারেনি।
যুবরাজের সঙ্গে মেম্ফিস এসেছি আমি, অ্যানা। ফিরে এসেছি। এই মেক্ষিসেই জন্ম আমার, ট্যানিসে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এইখানেই সুখে-দুঃখে আমার দিন কেটেছিল। আবার এখানে ফিরে এসে আমি সুখী হয়েছি। তবে আগের মতো দরিদ্র পল্লীতে এখন আর বাস করছি না আমি, করবার উপায় নেই। বাস করতে হচ্ছে যুবরাজের প্রাসাদ ভবনে, ভোজন করতে হচ্ছে যুবরাজেরই টেবিলে। তা বলে দুই বেলা রাজভোগই যে খাচ্ছি, তা নয়। কারণ যুবরাজ নিজেই স্বল্পাহারী, সাদাসিধে উপকরণেই তৃপ্তি সহকারে তার ভোজন সমাধা হয়।
যুবরাজের সঙ্গে আর এসেছে সেই মেরাপি, ইজরায়েলের চন্দ্রমা। যুবরাজের ইচ্ছায় বা অনুরোধে নয়, তার নিজেরই ইচ্ছাতে, যাওয়ার অন্য স্থান নেই বলেই সে এসেছে যুবরাজের সঙ্গে। অন্যস্থান নেই। কারণ গোসেন তার জন্মভূমি, তার আত্মীয়পরিজন জ্ঞাতিগোত্র সবাই রয়েছে যেখানে, সেটা আজ মেরাপির পক্ষে নিরাপদ নয় মোটেই। দুটো মারাত্মক অপরাধে তাকে অপরাধী বিবেচনা করছে ইজরায়েলীরা। প্রথমত, গোসেন সীমান্তের ইহুদীরা সেই চোরা আক্রমণ যখন চালিয়েছিল যুবরাজের উপরে, তখন মেরাপিই রক্ষা করেছিল তাকে। ইহুদীদের বিচারে নির্ভেজাল বিশ্বাসঘাতকতা ও জাতিদ্রোহিতা। দ্বিতীয়ত, লাবান যদিও তার বাগদত্ত স্বামী, মেরাপি ইদানীং তাকে বিবাহ করতে অস্বীকার করেছে। কেন? সে-প্রশ্নের উত্তর সে দেয়নি।