যুবরাজকে আমনের প্রতিনিধি হিসাবে তো থাকতেই হবে উপস্থিত এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে। আর আমি? আমি উপস্থিত থাকবার সুযোগ পেয়েছি প্রতিনিধির সহকারী হিসাবে।
বাইরে যতই কলরব থাকুক, মন্দিরের ভিতর সব নিস্তব্ধ। যে যখন কথা কইছে, কানে কানে কইছে ফিসফিস করে। একটা নিদারুণ কিছু ঘটবে, এই প্রত্যাশায় সবাই অধীর। নেপথ্যে কোথাও একটা ঐকতান বাজছে নিচু পর্দায়। সে-তালে আনন্দের বদলে ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে শ্রোতার প্রাণে।
অকস্মাৎ একটা প্রচণ্ড আওয়াজে চমকে উঠলাম আমরা। কী এ আওয়াজ? কোনো অনুমানে পৌঁছোবার আগেই একটা বিদ্যুৎ চমকে গেল মন্দিরের মধ্যে চকিতের জন্য। আর প্রধান পূজারী রয় মেরাপির সমুখে দাঁড়িয়ে গম্ভীর বিরস কণ্ঠে বললেন–“ইজরায়েল-দুহিতা! তুমি কী কথা বলবার জন্য এই রজনীতে দেবাদিদেব আমন-রার সাক্ষাৎপ্রার্থিনী হয়েছ?”
মেরাপি জবাব দিল ধীর কিন্তু দৃপ্ত কণ্ঠে–“এই কথা বলবার জন্য যে আমন রার দেবাদিদেব নন, আসলে কোনো দেৰতাই নন তিনি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একমাত্র দেবতা, একমাত্র ভগবান হচ্ছেন প্রভু জাহভে, আমরা ইজরায়েলীরা যাঁর পূজা করি। এই পরম সত্য কথার প্রতিবাদ যদি করতে চান আমন-রা, তিনি তা করতে পারেন, আমাকে নিহত করে। আমি এই দাঁড়িয়ে আছি আমনের সমুখে, আমন পরিচয় দিন নিজের শক্তির।”
মেরাপি তার কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই আবার সেই বিকট আওয়াজটা গমগম করে বেজে উঠল সারা মন্দিরে। আমাদের মনে হল সারা মন্দিরটা যেন থরথর করে কাঁপছে। সবগুলো আলো হঠাৎ নিষ্প্রভ হয়ে গেল, প্রায়ান্ধকার মন্দিরে আমনের পাষাণ মূর্তি যেন দুলতে লাগল মৃদু মন্থর তালে, তার বাহু আর বক্ষে যেন সজীব মাংসপেশী সব ফুলে ফুলে উঠতে লাগল অদম্য আবেগে। পুরোহিতেরা সমস্বরে স্তোত্রগান শুরু করে দিল–“জাগো দেবতা আমন-রা, অবিশ্বাসীকে ধ্বংস কর, ধ্বংস কর, ধ্বংস কর।”
একি আমাদের দৃষ্টির বিভ্রম? সামনের পাষাণ বাহু দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে ক্রমশ, প্রসারিত হচ্ছে মেরাপির দিকে, মেরাপি তবু দাঁড়িয়ে আছে, দৃপ্তশিরে, মুখে তার অবজ্ঞার মৃদু হাসি। পাষাণ বাহু ক্রমে স্পর্শ করল মেরাপিকে, যেন তার কণ্ঠনলী চেপে ধরতে গেল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না করে সে-বাহু নেমে এল মেরাপির বুকের কাছে। বুকে ছিল একটা সোনার পিন লাগানো, টেনে সেইটি ছিঁড়ে নিল পরিচ্ছদ থেকে ফেলে দিল মেরাপির পায়ের কাছে। তারপরে ধীরে ধীরে গুটিয়ে যেতে লাগল সে-হাত, ফিরে গেল চিরদিনের স্বাভাবিক দৈর্ঘে।
একটা চাপা গুঞ্জন শোনা গেল পূজারী আর জাদুকরদের ভিতরে। তারা কোথায় আশা করেছিল, মেরাপির নিষ্প্রাণ দেহ কক্ষতলে লুণ্ঠিত হবে এক্ষুনি, তার বদলে এ কী? সামান্য একটা সোনার পিন ছিঁড়ে ফেলে দিতেই কি দেবাদিদেবের দৈবশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল?
ঐ যে মেরাপি নিচু হয়ে পিনটা তুলে নিল, আবার তা পরে নিল বুকে। আমরা চিনলাম, এ সেই যুবরাজের পিন, যা নিজের হাতে যুবরাজ এঁটে দিয়েছিলেন মেরাপির পায়ের ব্যান্ডেজে, গোসেনের তৃণভূমিতে।
পিন বুকে পরে মেরাপি এবার আমন-রার মূর্তির দিকে চাইল দৃপ্তনেত্রে। দৃপ্তকণ্ঠে বলল–“তোমার শক্তির পরিচয় তুমি দিয়েছ মিশরী দেবতা! এইবার আমি তাহলে আমার ভগবানকে প্রার্থনা জানাই, তার শক্তির পরিচয় দেবার জন্য?”
নীরব, অতগুলো মানুষ ভীত, স্তব্ধ। কী যেন আসন্ন সর্বনাশের ভয়ে অন্তরে অন্তরে কম্পমান। যুবরাজের মনের অবস্থা জানবার উপায় ছিল না, কিন্তু আমি, অ্যানা, আমি অকপটে স্বীকার করছি–আমারও মন ভয়-সংশয় থেকে মোটেই বিমুক্ত ছিল না সেই মুহূর্তে।
এদিকে মেরাপি নিষ্ক্রিয় নেই, নীরবও নেই। এলায়িত কৃষ্ণকবরী কটি ছাপিয়ে জানু পর্যন্ত ঝুলছে তার, পদ্মফুলের মতো মুখখানি ঈষৎ উন্নমিত করে তীক্ষ্ণ সতেজ কণ্ঠে সে আহ্বান জানাচ্ছে তার সেই রহস্যময় ভগবান জাহভেকে–“হে প্রভু! হে ইজরায়েলের ভগবান! তোমারই পয়গম্বরের নির্দেশে তোমার এই দীনা দাসী ভিক্ষা চাইছে–তোমার অপরিসীম বিভূতির এক কণা পরিচয় আজ তুমি দাও এই অবিশ্বাসীদের সমুখে। চূর্ণ করে দাও ওদের ঐ কুশ্রী পাষাণ বিগ্রহকে, তোমার রোষদৃষ্টির বজ্ৰানলে, হে ভগবান! এস প্রভু! আবির্ভূত হও জাহভে! সত্যকে প্রকাশ হতে দাও মিথ্যার জগতে!”
মেরাপির এই রোমাঞ্চকর প্রার্থনা তখনও সমাপ্ত হয়নি, দূরত বর্জনাদের মতো একটা শব্দ আমরা শুনতে পেলাম মন্দিরে দাঁড়িয়ে। এরকম শব্দ আগেও আমরা শুনেছি, শক্তি প্রকাশের পালা যখন আমনের ছিল। তারপর এল বিদ্যুৎস্ফুরণ, এও আমরা আগেই দেখেছি। চঞ্চল হওয়ার মতো কিছু নয় এসব। তবু চাঞ্চল্য আমাদের বেড়েই যাচ্ছে যে!
বজ্র! বিদ্যুৎ! এবার কী তাহলে?
আর কিছু নয়। কী যেন একটা ভারী কঠিন জিনিস গুড়ো হয়ে যাচ্ছে প্রলয় সংঘাতে, এমনি একটা গুরু গুরু শব্দ। সহসা আমাদের চোখের সমুখে গুড়ো হয়েই ছড়িয়ে পড়ল গ্রানাইট পাথরের অতিকায় আমন বিগ্রহ। শূন্য! আমনের সিংহাসন শূন্য! সমস্ত মন্দির টুকরো টুকরো পাথরে আকীর্ণ।
তখনও মন্দির আবছা অন্ধকার! যুবরাজকে কাছে দেখছি না। তাকে খুঁজবার জন্য এগিয়েছি, সমুখে পড়ল দুটি মানুষ। একটি পুরুষ, একটি নারী। কাই আর মেরাপি।
কাই মৃদুস্বরে বলছে–“আমি পরাজয় স্বীকার করছি। হে বিশ্বের শ্রেষ্ঠা জাদুকরী। জাদুর শক্তিতে বজ্রবিদ্যুৎ আমরা আখছার নামাই বটে, কিন্তু পাহাড় সমান পাষাণ বিগ্রহকে সত্যি সত্যি গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো জাদু আমরা জানি না। আমাকে তোমার শিষ্য করে নাও, তোমার বিদ্যা আমাকে দাও। বিনিময়ে আমিও তোমাকে দেব, আমার যা কিছু বিদ্যা আছে। দুইজনের ভিতরে সন্ধি যদি হয়, তুমি আর আমি সারা পৃথিবী শাসন করতে পারব যৌথভাবে।”