“এইসব তুমি লিখেছ তোমার বিবরণীতে?”–ফারাও যেন তখন ক্রুদ্ধ সিংহের মতে ফুঁসছেন।
“ফারাও পড়ে দেখবেন অবশ্য–“ শান্ত ভাবেই জবাব দিলেন শেঠি।
“পড়ে অবশ্যই দেখব। কিন্তু সত্যই যদি এইসব সুপারিশই তুমি করে থাক, তা হলে তা যে আমি গ্রহণ করব না, তা তুমি এখনই জেনে যেতে পার। কারও সুপারিশে লক্ষাধিক দাসকে মুক্তি দেব না কদাচ।”
“আমার মত আমি জানিয়েছি ফারাওকে। সে-মত অনুযায়ী কাজ করা না করা আপনার ইচ্ছা–“ বললেন শেঠি।
“অবশ্যই। কিন্তু ঐ কথা বলেই তুমি রেহাই পাবে না। তোমার এই বিবরণী প্রত্যাহার করে একটা নতুন বিবরণী তোমায় পেশ করতে হবে! উঁচু স্তরের রাজনীতি সম্পর্কে ফারাও এবং তাঁর উত্তরাধিকারীর মধ্যে দুই মত থাকবে, এটা বাঞ্ছনীয় নয়, এটা এদেশের প্রথাও নয়। তুমি এখন বিশ্রাম কর গিয়ে। ধীরভাবে চিন্তা করে কর্তব্য স্থির কর।”
শেঠি গম্ভীর, আমেনমেসিস উৎফুল্ল, উসার্টি ক্রুদ্ধ। এই অবস্থায় সভাভঙ্গ হল সেদিন। আমেনমেসিস উৎফুল্ল। তার কারণ, ফারাও এবং শেঠি দুজন জেদী লোক। এ-দুইজনের ভিতর যদি মতদ্বৈধ হয়, মতদ্বৈধ যদি কলহে পর্যবসিত হয়, তাহলে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে, এমন কি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিতও হতে পারেন শেঠি। আর শেঠি বঞ্চিত হওয়া মানেই তো আমেনমেসিসের ভাগ্যোদয়! সিংহাসনের পরবর্তী দাবিদার তো আমেনমেসিসই!
উসার্টি ক্রুদ্ধ তার কারণও ঐ একই। এ-ব্যাপারের পরিণাম যদি হয় শেঠির ভাগ্যবিপর্যয়, তাতে ক্ষতি তত উসার্টিরই। অর্ধ সিংহাসন হারাতে হবে তাকে। ফারাও পদে অধিষ্ঠিত হন যদি আমেনমেসিস, শেঠির স্ত্রীর তো আর কোনো অধিকার থাকবে না সিংহাসনের উপরে।
শেঠি দরবারে ছিলেন গম্ভীর, কিন্তু গৃহে ফিরতেই স্বাভাবিক সদানন্দ ভাবটি তার ফিরে এল। হালকা ভাবে কথাবার্তা কইতে লাগলেন আমার সঙ্গে, পুরোনো পুঁথিপত্র সম্পর্কে। আমি অবাক। ফারাওয়ের ক্রোধ কি শেঠির বিবেচনায় অগ্রাহ্য করার মতোই বস্তু? সিংহাসনের উত্তরাধিকার কি মূল্যহীন তার চোখে? প্রথম যেদিন আমি দেখেছিলাম শেঠিকে, সেদিনই তার ভিতরে আবিষ্কার করেছিলাম এক বৈরাগী রাজর্ষিকে! আজ আবার সেই আবিষ্কারই নতুন করে করলাম যেন। সুখে-দুঃখে সমজ্ঞানী এই স্থিতধী পুরুষ, সাধারণ স্তরের মানুষ ইনি নন।
আমাদের পুঁথিপত্রের আলোচনায় হঠাৎ কিন্তু, ছেদ পড়ে গেল অতি অপ্রত্যাশিতভাবে। ভিতর মহল থেকে মেরাপি এল এক আবেদন নিয়ে ‘যুবরাজের অনুমতি হলে আমি একটা বাজি ধরতে চাই।”
“বা-জি?”- স্থিতধী পুরুষ শেঠিও বিস্ময়ে হাঁ করে ফেললেন এককথায়।
“হাঁ, বাজি। এই বাজি আমি ধরব যে মিশরের শ্রেষ্ঠ দেবতা আমন-রা, তার নিজের মন্দিরে বসেও আমার কোনো অনিষ্ট করতে পারবেন না। উপরন্তু আমিই করব তাকে অপমানিত, লাঞ্ছিত।”
“তুমি?”-এবারও একটার বেশি শব্দ যোগালোনা শেঠির মুখে।
‘‘আমি, মানে-বাহ্যত আমনের সমুখে আমিই দাঁড়াব তার প্রতিপক্ষ হয়ে। কিন্তু আসলে আমার ভিতর দিয়ে কাজ করবেন আমার দেবতা, ভগবান জাহভে।”
“কী করে জানলে যে জাহভের আবেশ হবে তোমার উপরে?”
“আপনি তো অনুমতি দিয়েছিলেন যে আমার সঙ্গে কেউ সাক্ষাৎ করতে চাইলে তাকে দেখা দেওয়ার পক্ষে কোনো বাধা আমার নেই। আমার কাকা এসেছিলেন- জ্যাবেজ। তাকে দিয়েই ইজরায়েলী পয়গম্বরেরা ঐ বার্তা পাঠিয়েছেন আমাকে। আমি তাদেরই কথার পুনরাবৃত্তি করছি-হয় আমি আমনের মূর্তি চূর্ণ করে ফেলব জাহভের শক্তিতে, নয় তো আমার জীবন বিসর্জন দেব আমনের বোষে।”
“বাজিটা কিছু অসম নয়, কী বল আনা?’-এতক্ষণে তার স্বাভাবিক নিরাসক্ত বাচন-ভঙ্গি ফিরে পেয়েছেন যুবরাজ–“একদিকে মূর্তি, অন্যদিকে প্রাণ।” তারপর মেপির দিকে ফিরে যুবরাজ তেমনি হালকা সুরেই বললেন–“তা তোমার পয়গম্বরদের আদেশ তুমি পালন করবে বই কি? আমন-রার আমিই প্রতিনিধি ও সেবাইত। আমি প্রধান পূজারীকে খবর দিচ্ছি–আজ রাত্রেই যাতে তোমাকে আমনের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়।”
মেরাপি চলে গেল তার বিশ্রামভবনে, পরে খবর নিয়ে জেনেছিলাম, সারাদিন সে উপবাস থেকে জাহভের আরাধনা করেছিল সেদিন নিজেকে শুচিশুদ্ধ করে তুলবার জন্য। যাতে ভগবানের অধিষ্ঠানের যোগ্য আসন হয়ে উঠতে পারে তার হৃদয়।
রাত্রি দ্বিপ্রহরে এই বাজির অনুষ্ঠান হবে। কী জানি কাদের দ্বারা বাজির ব্যাপারটা প্রচার হয়ে পড়েছে শহরে। সারা শহর ভেঙে পড়েছে আমন মন্দিরে। অবশ্য মন্দিরের হাতার ভিতরে কেউ ঢুকতে পারছে না, মন্দিরের দ্বারে দ্বারে সশস্ত্র সান্ত্রী বসেছে আজ। জনতা ভিড় করেছে বাইরে বাইরে, একটা চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে সহস্র কণ্ঠের। আমনের স্তুতিবাদ, ইজরায়েলীদের উপরে অভিশাপ, স্পর্ধিত মেরাপির অকুণ্ঠ নিন্দাবাদে সবাই মুখর।
মন্দিরের গর্ভগৃহে আমন-রার অতিকায় পাষাণ মূর্তি, কুটিভয়াল মুখ তার, ভঙ্গি তার নিষ্করুণ।
বিগ্রহের সমুখে এবং দুই পাশে লম্বমান রেখায় দণ্ডায়মান প্রধান পূজারী রয় এবং তার সহকারী অন্য পূজারীবৃন্দ। একটু স্বতন্ত্রভাবে দৃপ্তশিরে দাঁড়িয়ে আছেন প্রধান জাদুকর ‘খারেব’ পদবীধারী কাই। তারও সঙ্গে জাদুবিদ সহকারী দশ-বিশজন।
বিগ্রহের ঠিক সমুখে, পূজারী জাদুকরদের থেকে দূরে এক ক্ষীণ রমণীকে দেখা যাচ্ছে। মন্দিরের অনুজ্জ্বল আলোকেও তার মুখ ও মূর্তি এক অতি রহস্যময় আভায় মণ্ডিত। বলা বাহুল্য, সে-রমণী মেরাপি ছাড়া আর কেউ নয়। যুবরাজ আর আমি দাঁড়িয়ে আছি পাশের দিকের এক স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে। এমন একটা জায়গায়, যেখান থেকে আসল মূর্তিকে আর মেরাপিকে সমান ভাবে লক্ষ্য করা যায়।