যুদ্ধ চলছে। চারজনের বিরুদ্ধে চারজন। ইজরায়েলীরা পড়ছে, হতাহত হয়ে। কিন্তু যতই দক্ষ সৈনিক হোক, আমাদের চারজনও রক্তমাংসের মানুষ তো। তারাও আহত হচ্ছে বই কি! অবশেষে ধরাশায়ী হল তাদের দুইজন। অমনি তাদের শূন্যস্থান দিয়ে লাফিয়ে ভিতরে এসে পড়ল দুটো ইজরায়েলী। তাদের বাধা দিতে এবার এগিয়ে গেলাম যুবরাজ আর আমি। আমার শত্রুকে আমি বধ করলাম অক্লেশে। যুবরাজও অক্লেশেই পারতেন তাঁর আততায়ীকে খতম করতে। কারণ উসার্টির লৌহবর্মের কল্যাণে আমাদের দেহ তত অস্ত্রের অভেদ্য!
পারতেন, কিন্তু পারলেন না অন্য কারণে। তার প্রতিপক্ষটা ছিল একটা দৈত্যকার প্রকাণ্ড মানুষ। অথচ যুবরাজ মোটামুটি বলবান পুরুষ হলেও কলেবরের দিক দিয়ে তাকে কৃশই বলা যায়। আততায়ী যখন লাফিয়ে পড়ল তার উপরে, তার দেহের ভারেই যুবরাজ মাটিতে পড়ে গেলেন, আর শত্রু দুই হাতে তার গলা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। ওদিকে আমাকে তখন নতুন এক শত্রু এসে আক্রমণ করেছে, আমি যে যুবরাজকে সাহায্য করতে আসব, এমন উপায় নেই।
আমার দ্বিতীয় শত্রুও যখন পড়ে গেল আমার পায়ের তলায়, আমি যুবরাজের দিকে চাইবার সময় পেলাম শুধু তখনই। চাইলাম ভয়ে ভয়ে। এই ভয় যে হয়ত যুবরাজকে মৃত অবস্থাতেই দেখতে পাব। এতক্ষণ কি আর তার দম আটকে যেতে বাকি আছে?
কিন্তু যা দেখলাম, তা দেখবার আশা করিনি। কল্পনা করতেই পারিনি, যুবরাজের দেহে প্রাণ আছে কিনা তখনও, তা অবশ্য হঠাৎ বোঝার কোনো উপায় ছিল না। তিনি তখনও ধরাশায়ী, দৈত্যাকার শত্রুটা তখনও চেপে ধরে আছে তার গলা। কিন্তু সেই দৈত্যের মাথায় উপরে নেমে আসছে, নেমে এল এক বিশাল তরোয়াল। দুই হাতে উঁচু করে ধরে সেই তরোয়াল তার মাথায় বসিয়ে দিল এক কোমলা রমণী।
সে-রমণী মেরাপি।
আর ঐ যে অদূরে বহুকণ্ঠের জয়ধ্বনি শোনা যায়, ও আমাদেরই সেনার জয়ধ্বনি, পার্শ্ববর্তী সেই দুইশো মিশরীর।
.
৬.
যুবরাজ শেঠির গোসেন পরিদর্শনে মিশরের ইতিহাসটারই মোড় ঘুরিয়ে দিল। সেই সঙ্গে একটা সাময়িক বিপর্যয় এনে দিল তার ব্যক্তিগত জীবনেও।
প্রথমেই বলে রাখা যাক, মেরাপিকে যুবরাজ সঙ্গে আনতেই বাধ্য হয়েছেন। কারণ তাকে রক্ষা করতে গিয়েই সে হয়ে পড়েছে জাতির ও ধর্মের কাছে বিশ্বাসহন্ত্রী বিদ্রোহিনী, গোসেনে থাকলে তার ভাগ্যে অশেষ দুঃখ তো আছেই, এমন কি তার জীবন যাওয়ারও বাধা নেই কিছু। নিয়ে এসেছেন সাথে, তাকে আশ্রয় দিয়েছেন নিজের প্রাসাদ উদ্যানের এক বিশ্রামভবনে, সেখানে নিজের কয়েকটি পরিচারিকা নিয়ে সে স্বতন্ত্রভাবে থাকে।
ইতিমধ্যে রাজসভায় গিয়ে যুবরাজ ও আমেনমেসিস দুজনেই প্রণিপাত জানিয়ে এসেছেন ফারাওকে, স্বতন্ত্রভাবে দুজনে দুটো বিবরণী দাখিল করেছেন গোসেন সম্পর্কে। ঐ বিবরণ সংগ্রহ করার জন্যই তো তাদের পাঠানো হয়েছিল গোসেনে।
সব সৈন্য আগেভাগে পাঠিয়ে দিয়ে একা পিছনে পিছনে আসছিলেন যুবরাজ, এবং সেই সুযোগ নিয়ে ইজরায়েলীরা চেষ্টা করেছিল যুবরাজকে হত্যা করতে, একথা শুনে ফারাও যুবরাজকে তিরস্কার করলেন না। কিন্তু আমাকে করলেন পুরস্কৃত। একটি রত্নহার আমায় খুলে দিলেন নিজের কণ্ঠ থেকে, আর আমাকে উপাধি দিলেন রাজবন্ধু। এ-পদবীর অধিকারীরা সর্বদা সর্বক্ষেত্রে দরবারে আসন পাওয়ার অধিকারী।
যুবরাজকে তিরস্কার করলেন না, উলটে প্রসন্ন হাস্যে অভিষিক্ত করলেন তাকে। “এই তত সিংহপুরুষের মতো কাজ! সাহস যার নেই, সে সিংহাসনে বসে করবে কী?” তা ছাড়াও তিনি বললেন—”ইজরায়েলীরা যে কত বড় নরাধম, তাদের এই সর্বশেষ আচরণেই তা প্রকাশ পেয়েছে। এবার আমি যদি তাদের ঝাড়েবংশে কোতল করি, কেউ নিন্দা করতে পারবে না আমায়। আশা করি, সেই রকম সুপারিশই করেছ তোমরা তোমাদের বিবরণীতে।”–এই শেষ কথাটা বলার সময়ে ফারাও, শেঠি ও আমেনমেসিস উভয়ের মুখের দিকেই চাইলেন।
আমেনমেসিস জবাব দিলেন ফারাওয়ের মুখের কথা মুখ থেকে না খসতেই। “নিশ্চয়, ফারাও, তাতেও কি আর সন্দেহ থাকতে পারে? পাঁচশো বছর ধরে ওরা পরম সুখে বাস করছে মিশরে। এসেছিল মুষ্টিমেয় দুই-একশো লোক, এখন ওরা লক্ষাধিক। এসেছিল ভিখারী বেশে, এখন ওরা জনে জনে বিত্তবান। আর আজ দেখুন কিনা, কী কৃতঘ্ন ওরা, বিনা কারণে ওরা হত্যা করতে গিয়েছিল মিশর-সিংহাসনের উত্তরাধিকারীকে। ইজরায়েলী বংশে বাতি দিতে কাউকে যেন আর না রাখেন ফারাও।”
কিন্তু শেঠি জবাব দিলেন অনেক পরে বিষঃ-দৃঢ় সুরে–“আমাকে হত্যার যে চেষ্টা হয়েছিল, সেটা অল্প কয়েকজন ধর্মোন্মাদের কাজ। তার জন্য সমগ্র জাতিটাকে দোষী সাব্যস্ত করা উচিত হবে না। যারা দোষী ছিল, তারা অনেকেই হতাহত হয়েছে। কাজেই চরম দণ্ড বলতে গেলে হয়েই গিয়েছে তাদের। অন্য সব ইজরায়েলীকে খগের মুখে নিক্ষেপ করার কোনো যুক্তি আমি দেখতে পাইনি, করিনিও সে-রকম সুপারিশ।” ফারাও বিস্মিত, বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন “কী রকম সুপারিশ তাহলে করেছ তুমি? ওদের জনে জনে মিষ্টান্ন খাওয়াবার?”
“না, সম্রাট, অতটা নয়”–মৃদুস্বরে জবাব দিলেন শেঠি–“শুধু এইটুকু বলেছি যে যুগ যুগ ধরে ওদের পয়গম্বরেরা যে দাবি করে আসছেন, সেইটি মঞ্জুরও করা হোক কালবিলম্ব না করে। ওদের যেতে দেওয়া হোক মিশর ছেড়ে। যে দেশের মানুষ ওরা, যে দেশে যেতে চাইছে ওরা, চলে যাক সেই দেশেই। ওরা মিশরে থাকলে মিশরের কী লাভ? ফসল কেটে দেবে? ইট বানিয়ে দেবে? কেন, সে-সব কাজ কি মিশরীরা করতে জানে না নাকি? ওদের রেখে লাভ কারও হচ্ছে না, না আমাদের, না ওদের। ওরা শক্তি বৃদ্ধি করছে না মিশরের, মিশরকে দুর্বল করে ফেলছে দিন দিন।”