ঘরখানা ছোট্ট। বলতে গেলে আমি যে দীনহীন নকলনবিশ মানুষ, আমার লেখার ঘরখানাও এর চাইতে ছোট নয়। টেবিলে খাগড়ার কলম, স্ফটিকের দোয়াত, রং-দানি থরেথরে সাজানো। কাঠের ফ্রেমে পিন দিয়ে সাঁটা প্যাপিরাসের কাগজ*। [* প্যাপিরাস এক রকম খাগড়া গাছ-এর বাকলকে কাগজের মতো ব্যহার করা হত প্রাচীনকালে।] আর দেয়ালের গায়ে গায়ে কাঠের তাক, তাতে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো, প্যাপিরাসে লেখা তাড়া তাড়া পাণ্ডুলিপি।
ঘরে আগুন জ্বলছে সুগন্ধি সীডার কাঠের। আর সেই আগুনের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং যুবরাজ। আমি অবশ্য আগে কখনো দেখিনি তাকে। কিন্তু তা বলে চিনতে কেন অসুবিধা হবে? মেম্ফিসের উদ্যানে তার মূর্তি দেখেছি না?
যুবরাজের হাতে একখানা প্যাপিরাসের পাণ্ডুলিপি। তিনি সেটা মেলে ধরে আছেন চোখের সামনে, আর সেই সুযোগে আমি লক্ষ্য করছি তাকে। দেখতে তাকে আমার চেয়ে অন্তত তিন-চার বছরের ছোট দেখায়, যদিও তার আর আমার জন্ম হয়েছিল একই দিনে।
হ্যাঁ, এ-কথাটা আগেই বলে নেওয়া উচিত ছিল বোধ হয়–একই দিনের জাতক যুবরাজ ও আমি। আরও হয়তো কয়েক হাজার শিশু এদেশের। সেই জন্মসূত্রে আমরা সবাই এক ধরনের ভাই, মিশরীয় জবানে বলে আমন-ক্ষেত্রজ যমজ ভাই। যুবরাজকে দেবাদিদেব আমন-রা’র অবতার বলেই গণ্য করা হয়, এবং নরদেহে যতদিন তিনি বিদ্যমান থাকবেন, তিনিই থাকবেন আমনের সেবাইত ও প্রতিনিধি।
কিন্তু সে-কথা থাকুক। বয়স আমাদের একই, তবু যুবরাজকে অনেক তরুণ মনে হয় আমার চেয়ে। তার দেহের লালিত্য স্বভাবতই আমার চেয়ে বেশি, তা ছাড়া তিনি হলেন সুখৈশ্বর্যে লালিত রাজার দুলাল, আমি হলাম খেটে খাওয়া নকলনবিশ মাত্র।
বেশ দীর্ঘকায় পুরুষ যুবরাজ, একহারা, ফর্সা। মিশরীদের মধ্যে অত ফর্সা রং খুব কম লোকেরই আছে। এর কারণ আর কিছু নয়, তার দেহে আছে সিরীয় রক্ত, মাতৃকুল থেকে। চোখ তার ধূসর, ঐ খুব জমকালো, তার পিতা মেনাপটার মতো। চোখের কোণে কপালে কতকগুলি বলিরেখা না থাকত যদি, তাঁর মুখখানিকে বলা যেত নারীসুলভ লালিত্যমণ্ডিত।
বেশ কিছুক্ষণ পাম্বাসা দাঁড়িয়ে আছে প্রভুর সমুখে, তিনি পাণ্ডুলিপিতেই তন্ময়। অবশেষে হঠাৎ এক সময়ে তিনি চোখ তুলে চাইলেন তার পানে–“ঠিক সময়েই এসে পড়েছ দেখছি।”
কী কোমল মধুর স্বর যুবরাজের! অথচ কী পুরুষালি ব্যঞ্জক দৃঢ়তায় পূর্ণ।
“তোমার তো বয়স হয়েছে। আর বয়স হলেই মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি বেড়ে যায়, তাও তত জানে সবাই! তাহলে পাম্বাসা, তুমিও অবশ্যই জ্ঞানী লোক?”
“নিশ্চয়ই যুবরাজ! আপনার স্বর্গীয় জ্যাঠা খেমুয়াজ ছিলেন মস্ত বড় জাদুকর। ছেলেবেলায় তার জুতো পরিষ্কার করতাম আমি। তাহলে জ্ঞানী না হয়ে উপায় কী আছে আমার?”।
“তা হলে তুমি জ্ঞানী লোক, আঁ? সে জ্ঞান তাহলে তুমি এত যত্নে লুকিয়ে রেখেছ কেন বিজ্ঞবর? বিকশিত পদ্মের মতো মেলে দাও তোমার সে-জ্ঞানের ভাণ্ডার, আমাদের মতো দীনহীন মধুপেরা জ্ঞানমধু আহরণ করুক তা থেকে। যাক, এতদিন পরে এ-সুখবরটা পেয়ে আমি খুশি। খুশি হওয়ার কারণ কী, জান? এই যে বইখানা আমি পড়ছি, এটি জাদুবিদ্যার বই। এত জটিল, দুর্বোধ্য এর বিষয়বস্তু যে আমার ঐ স্বর্গীয় জ্যেষ্ঠতাত স্বর্গস্থ হওয়ার পরে ইদানীং আর বোধ হয় ধরাধামে এমন কেউ নেই যে তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারে। অবশ্য জ্যাঠার সম্পর্কে আমার মনে আছে শুধু এইটুকুই যে অতি হাস্যলেশহীন দুশমন চেহারার লোক ছিলেন তিনি, ঠিক যেমনটি আজকাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার ছেলে, আমার জ্যাঠতুতো ভাই আমেনমেসিস। তফাৎ শুধু এই যে তিনি ছিলেন জ্ঞানী, এদিকে আমেনমেসিসকে জ্ঞানী বলা, সে তার পরম শত্রুতেই বলতে পারবে না।”
“কিন্তু যুবরাজ যে খুশি হয়েছেন বললেন, খুশি হওয়ার কারণটা কী?”– পাম্বাসা জিজ্ঞাসা করল সেই রকম আদুরে সুরে, যে সুর অনেক প্রশ্রয় পাওয়া পুরাতন ভৃত্যের কথার মধ্যেই শুনতে পাওয়া যায়।
“আহা, কারণ তো স্পষ্ট।” বললেন যুবরাজ–“তুমি যখন পিতৃব্য খেমুয়াজের মতোই বিজ্ঞ, তখন এই দুর্বোধ্য বইটা তুমি আমায় অবশ্যই বুঝিয়ে দিতে পারবে। তুমি তো জানই পাম্বাসা, অকালে মরে না গেলে আমার বাবার বদলে ঐ জ্যাঠা খেমুয়াজই হতেন মিশরের ফারাও। তিনি যদি ফারাও হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই আগেভাগে সরে পড়ে থাকেন পৃথিবী থেকে, তা হলে বাবা পাম্বাসা, তার বিজ্ঞতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহই আর পোষণ করা যায় না। বোঝাই তো, কোনো সত্যকার বুদ্ধিমান লোক, নিতান্ত নিরুপায় না হলে কোনোদিনই মিশরের ফারাও হতে রাজি হতে পারে না।”
পাম্বাসা বিস্ময়ে হাঁ করে ফেলেছে একেবারে।
“ফারাও হতে রাজি হতে পারে না?”–এই পর্যন্তই সে বলেছে কেবল– যুববাজ বাধা দিলেন তাকে–“শোন হে জ্ঞানবৃদ্ধ পাম্বাসা, যা বলি তা শোন আগে। এই বইখানিতে দেওয়া আছে কিছু তুকতাকের বিবরণ, যাতে হৃদয়টা থেকে সব অবসাদ নিঃশেষে ধুয়ে মুছে বেরিয়ে যাবে। অবসাদ! বুঝেছ হে জ্ঞানবৃদ্ধ, অবসাদ! এ-বইয়ের মতে দুনিয়ার সব কিছু আধিব্যাধির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে সর্বজনীন ব্যাধি হল ঐটি, আর ও থেকে রেহাই পায় শুধু বেড়ালবাচ্চারা, কিছু কিছু শিশুরা এবং পাগলেরা। এ-বইয়ের মতে ও ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে রাত দুপুরে খুফুর পিরামিডের চূড়ায় উঠে পড়া। বছরের যে কোনো সময়ে উঠলে হবে না, উঠতে হবে সেই সময়টাতে যখন পূর্ণচন্দ্রকে দেখায় অন্য সময়ের চাইতে অনেক বড়। আর উঠবার পরে দাঁড়িয়ে থাকলেও চলবে না, স্বপ্নভৃঙ্গার থেকে কয়েক চুমুক স্বপ্নরস পান করে এই মন্ত্রটা পড়ে যেতে হবে গড়গড় করে। মন্ত্রটা বেশ বড়সড়, কিন্তু এমন এক ভাষায় লেখা, যা পড়বার মতো বিদ্যে আমার নেই!”