সে কী উত্তেজনা! জীবন-মৃত্যু নির্ভর করছে যে কিসের উপরে, তা আমরা বুঝতে পারছি না, সমস্ত ব্যাপারটাই লাগছে যেন অবাস্তব, আজগুবি, ভূতুড়ে । কী হবে? ষাট গোনা শেষ হওয়া মাত্রই কি বর্জ নেমে আসবে ছাদ ফুঁড়ে? ভাবতেও যে হাসি পায়। হাসি? কথাটা পরিপূর্ণ সত্য হল না। হাসি অবশ্য পায়, কিন্তু সেই সঙ্গেই কপাল দিয়ে ঘামও ঝরে।
যা হোক, গোনা শেষ হল জ্যাবেজের, বজ্র নেমে এল না, কোনো চাঞ্চলেরই লক্ষণ দেখা গেল না জাহভের অধিষ্ঠান বেদীতে। তখন কোহাট ঘোষণা করলেন, মিশরীরা দোষী নয়, তারা যেতে পারে নিরাপদে ফিরে।
পরদিন ভোরবেলাতেই আমেনমেসিস অর্ধ সৈন্য নিয়ে ট্যানিসের পথ ধরলেন। পূর্ব রাত্রিতে ধর্মমন্দিরে যা ঘটেছিল, তা বোধ হয় তখনও তার কর্ণগোচর হয়নি। অন্ততপক্ষে তিনি কোনো উত্তেজনার বা দুশ্চিন্তার ভাব দেখলেন না বিদায় বেলায়। দেখাবেনই বা কেন? অর্ধেক সৈন্য তো রইলই যুবরাজের সঙ্গে। ইজরায়েলীরা যদি কোনো বেয়াড়া ব্যবহার করে, তাদের দমন করবার মতো লোকবল তো যুবরাজের রইলই!
কিন্তু কী আশ্চর্য! আমেনমেসিস যাত্রা করবার দুই দণ্ড পরেই যুবরাজ হুকুম জারি করলেন–“অ্যানা, সুযোগ পেয়েছি তো নিরিবিলি পর্যটনের আনন্দ উপভোগ করে নিই একটু, বাকি সৈন্যও সব রওনা করে দাও। তুমি আর আমি একখানি রথ নিয়ে দুপুরের পর রওনা হব গায়ে হাওয়া লাগাতে লাগাতে।”
“বলেন কী যুবরাজ? মাত্র আমরা দুইজন? শত্ৰুপুরী, জানেন তো? যুবরানি বলেছিলেন শত্ৰুপুরী–” প্রতিবাদ না করে পারলাম না আমি।
‘হয় যদি শত্ৰুপুরী তো হোক না। যুবরানিরই দেওয়া লৌহবর্ম আমার গায়েও আছে, তোমার গায়েও আছে। তা সত্ত্বেও আমরা কি এই চাষার দলকে ভয় পাব নাকি? গোটা চারেক ভৃত্য সঙ্গে রাখতে পার। সীমান্তের পাহাড়ে রথ অনেক সময় টেনে তুলতে বা নামাতে হয়, আসার সময় দেখেছ তো?”
আদেশ অলঙ্ঘ্য। তবু আমি ওরই ভিতর কারচুপি করলাম একটু। চারজন ভৃত্য না নিয়ে নিলাম চারজন পাকা সৈনিক, তারা অবশ্য যাবে ভৃত্য পরিচয়েই। আর বিশ্বাসী একজন সৈন্যাধ্যক্ষকে বললাম, দুশো সৈনিক নিয়ে আপাতত সে শহরে কোথাও লুকিয়ে থাকুক, যুবরাজ রওনা হয়ে যাওয়ার পরে সে অনুসরণ করবে এরকম দূরত্ব বজায় রেখে, যাতে যুবরাজ জানতে না পারেন যে তারা রয়েছে পিছনে।
জানি না কোন দেবতার প্রেরণায় এই কাজ দুটি আমি করেছিলাম। তারই দরুন জীবনরক্ষা হল যুবরাজের। তারই দরুন এবং মেরাপির দরুন।
গোসেন সীমান্তে এক দুর্গম পার্বত্য প্রদেশ। তার ভিতর দিয়ে পথ অতি সরু ও বন্ধুর। অনেক জায়গাতেই দুই ধারে খাড়া পাহাড়। পথের প্রান্তে সে পথ আবার মোড় ঘুরেছে একটা। এমনিই মোড় যে তার ওদিকে কী হচ্ছে, তা এদিক থেকে ঠাহর পাওয়া যায় না। আমরা সেই মোড়ের কাছাকাছি এসে পড়েছি যখন, দেখলাম যে পাহাড়ের উপর থেকে ছুটতে ছুটতে নেমে আসছে এক তরুণী। সে মেরাপি।
“যাবেন না, যাবেন না। মোড় ঘুরবেন না। ও পিঠেই শত্রু। হত্যা করবে আপনাকে।”
“কেন? হত্যা করবে কেন?”
“লাবান। তার হয়েছে ঈর্ষা। আর ইজরায়েলী ধর্মোন্মাদ কিছুসংখ্যক। কাল জাহভের বজ্রে আপনি যে দগ্ধ হননি, এতে তারা অখুশি। দেবতার ভুল তারা নিজেরা শুধরে দিতে চায়।”
মোড়ের ওধার থেকে গুপ্তঘাতকেরা ইতিমধ্যে মেরাপিকে দেখতে পেয়েছে গিরিসানুতে, তাকে কথা কইতেও শুনেছে আমাদের সঙ্গে। তাদের ষড়যন্ত্রের কথা যে আর গোপন নেই, তা বুঝতে পেরে অবিলম্বে আক্রমণ করাই তারা সাব্যস্ত করল। গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে গোটা চল্লিশ হিংস্র ইজরায়েলী মোড় ঘুরে এসে ধাবিত হল আমাদের দিকে। যুবরাজ আদেশ দিলেন–“রথ ঘোরাও সারথি।”
পথ অতি সংকীর্ণ, রথ ঘুরিয়ে উলটো মুখে চালানো সম্ভব হল না আর। তবে একটা উপকার হল ঘোরাতে গিয়ে, রথখানা আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল গিরিসংকট একেবারে রুদ্ধ করে, সেটা না টপকে আততায়ীরা আর পৌঁছোতে পারবে না আমাদের কাছে। ভৃত্যবেশে যে চারজন দক্ষ সৈনিক আমাদের সঙ্গে এসেছিল, তারা রথের তলা থেকেই লুক্কায়িত অস্ত্রশস্ত্র টেনে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে লাফিয়ে উঠল সেই রথের উপরে। তাদের সঙ্গে আগে বোঝাঁপড়া না করে শত্ৰুরা আর রথের প্রতিবন্ধক অতিক্রম করতে পারছে না।
দলে অবশ্য জনা চল্লিশ ওরা। ভোলা জায়গায় আমাদের পেলে চারদিক থেকে বেড় দিয়ে ওরা নিমেষে আমাদের কচুকাটা করে ফেলতে পারত। সেই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আমরা রক্ষা পেয়ে গেছি মেরাপির কৃপায় । এখন উদ্দেশ্য সিদ্ধি করা খুব অনায়াসসাধ্য নয় ওদের পক্ষে। কারণ গিরিপথ অতি সংকীর্ণ, পাশাপাশি চারজনের বেশি লোক সেখানে দাঁড়াতেই পারবে না, তা-লড়াই করা তো দূরের কথা।
সে-অসুবিধা যে কত মর্মান্তিক, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে আততায়ীরা। লোকবল তাদের কোনো উপকারেই আসছে না। এদিকে চার, ওদিকে চার, সমানে সমানে যুদ্ধ। তাও আমাদের সৈনিকেরা আবার পেশাদার সৈনিকইইজরায়েলীরা বলবান পুরুষ হলেও অস্ত্রধারণে অভ্যস্ত নয়। তার উপরেও বিবেচনা করতে হবে–আমাদের সৈনিকেরা আছে রথের উপরে, শত্রুরা আছে নীচে! হানাহানির ক্ষেত্রে নীচের লোকেরা যে অসুবিধায় পড়বে, তাতে সন্দেহ কী!
এদিকে রথ যে-মুহূর্তে আড়াআড়ি আটকে গেল গিরিপথে, আমি সারথিকে ছুটিয়ে দিয়েছি পিছন পানে–“দুশো সৈনিক আছে ওদিকে। রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যাও, রুদ্ধশ্বাসে তাদের ছুটে আসতে বল।”