মেরাপি ইতিমধ্যে রথ থেকে নেমেছে, মাটিতে বসে পায়ের তলা থেকে মুকুটাকার পিনটা খুলবার চেষ্টা করছে। যুবরাজ দেখতে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন–“ও তুমি করছ কী? পিন খুললে ব্যান্ডেজ খুলে যাবে, তাতে ঘা সারতে দেরি হবে। ওটা এখন তোমার কাছেই থাকুক।”
তখন কি আর যুবরাজ জানেন যে ঐ পিন নিয়ে মেরাপির ভাবী বর লাবান হুলুস্থুল কাণ্ড করবে একটা? সে আগে খড়ের বোঝাটা নিজের বাড়িতে রেখে এসেছে, তারপর মেরাপির খোঁজ নিতে এসেছে জ্যাবেজের বাড়িতে। এসে যখন পিনের বৃত্তান্ত শুনল, সে রেগে আগুন। তার ধারণা হয়ে গেল, ব্যান্ডেজ বাঁধা অছিলা মাত্র, ঐ সূত্রে যুবরাজ একটা উপহার গছিয়ে গিয়েছেন তার বাগদত্তাকে। এসব কথা পরদিন আমরা শুনলাম জ্যাবেজের প্রমুখাৎ, যখন সে ভেড়ার দাম নিতে মিশরী ছাউনিতে এল।
শাবানের রাগারাগির কথা সবিস্তারে বর্ণনা করে জ্যাবেজ সবিনয়ে বলল “লাবান অতি বাগী লোক, যুবরাজ। যতক্ষণ আপনি আপনার সৈন্যদের ভিতর আছেন, ততক্ষণ অবশ্য তার সাধ্য নেই আপনার কোনো ক্ষতি করবার। কিন্তু আপনি তো অরক্ষিত অবস্থাতেও ঘোরাফেরা করেন দেখছি। আমার পক্ষে অবশ্য আপনাকে উপদেশ দিতে যাওয়া ধৃষ্টতাই হবে শুধু। কিন্তু লাবানকে আপনি জানেন না, আমি জানি। আর শুধু লাবানই বা কেন, গোসেনের সব হিব্রুই মিশরীদের উপরে খাপ্পা, সুযোগ পেলে তারা আপনাকে খুনও করতে পারে।”
যুবরাজ হেসেই উড়িয়ে দিলেন জ্যাবেজের কথা, যদিও তার সদিচ্ছা ও সদুপদেশের জন্য ধন্যবাদ দিতেও ভুললেন না।
তদন্ত শেষ হয়েছে। আমেনমেসিস নিত্য তাগাদা দিচ্ছেন–“এইবার ট্যানিস ফিরে চল।” অবশেষে যুবরাজ একটা দিন ধার্য করে দিলেন ফিরে যাওয়ার। অর্ধেক সৈন্য নিয়ে আমেনমেসিস যাবেন সকালবেলায়, গিয়ে ছাউনি ফেলবেন গোসেন সীমান্তের গিরিমালার ওধারে। যুবরাজ নিজে বেরুবেন অপরাহে বাকি অর্ধেক সৈন্য নিয়ে, গিয়ে ছাউনিতে পৌঁছোবেন সন্ধ্যাবেলায়। এ-বন্দোবস্তের হেতু কী, কে তা জিজ্ঞাসা করবে যুবরাজকে? রাজা বা রাজপুত্র যদি নিজের খেয়াল খুশিমতো কাজ করতে না পারেন, তা হলে লাভ কী তাদের রাজা বা রাজপুত্র হয়ে?
যাত্রার আগের রাতে কিন্তু একটা অপ্রীতিকর ব্যাপার ঘটে গেল। অতি সহজেই বিয়োগান্ত হয়ে পড়তে পারত, যুবরাজের প্রাণ রক্ষা হল অল্পের জন্যই। সেই যাজক কোহাট! যিনি ইজরায়েলী ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে দুই-চার কথা যুবরাজকে শেখাচ্ছিলেন এই কয়েকদিন ধরে, তিনি নিমন্ত্রণ করলেন–“যাওয়ার আগে যুবরাজ আমাদের ধর্মমন্দির দেখে যান একটিবার। সান্ধ্য উপাসনার সময় এলে উপাসনার পদ্ধতিও লক্ষ্য করতে পারবেন বাইরে থেকে।”
বলা বাহুল্য, এসব ব্যাপারে যুবরাজের কৌতূহল অপরিসীম, তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন। গোসেন ত্যাগের আগের সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে উপস্থিতও হলেন গিয়ে ইজরায়েলী ধর্মমন্দিরে।
অনর্থ ঘটল অপ্রত্যাশিতভাবে। কোহাট বলে রেখেছিলেন, একমাত্র গর্ভগৃহ অর্থাৎ জাহভের অধিষ্ঠান বেদী ছাড়া আর সব কিছুই সবাই দেখতে পারে, তাতে বাধানিষেধ কিছু নেই। এখন সেই অধিষ্ঠান বেদীই দৈবাৎ দৃষ্টিপথে পতিত হয়ে গেল আমাদের।
একটা প্রায়ান্ধকার বারান্দা দিয়ে কোহাট আমাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ হোঁচট খেলেন যুবরাজ। পড়ে যেতে যেতে তিনি আঁকড়ে ধরলেন পাশের দেয়ালের গায়ে লম্বমান একটা পর্দা। তার টানে পর্দাটা পড়ল ছিঁড়ে। আমরা দেখতে পেলাম, ভিতরে একখানা ঘর, সেই ঘরও প্রায়ান্ধকার, আর সেই অন্ধকারের মধ্যে উপাসনারত অবস্থায় অনেকগুলি লোক।
পর্দা যখন ছিঁড়ে পড়ল, টু শব্দটি কোথাও নেই এক মুহূর্ত। কিন্তু সেই এক মুহূর্ত পরে সেই অন্ধকার ঘরে যেন শুরু হয়ে গেল একটা প্রেতনৃত্য। উপাসকেরা সবাই চিৎকার করছে, লাফাচ্ছে, “ধর্মের অপমান করেছে ঐ পামর, ওকে হত্যা কর” বলে শাসাচ্ছে।
কোহাট আগলে দাঁড়িয়েছেন যুবরাজকে, ক্রুদ্ধ উপাসকদের বোঝাবার চেষ্টা করছেন যে পর্দাটা দৈবাই ছিঁড়ে পড়েছে, এটা ইচ্ছাকৃত ধর্মাবমাননা নয় মোটেই। নাঃ, কিছুতেই তাদের ক্রোধ শান্ত হয় না। তারা তারস্বরে চাঁচাচ্ছে–“হত্যা করব। রক্ত নেব! যুবরাজ বলে ক্ষমা করব না। ধর্মের অপমান করে কেউ নিস্তার পাবে না।”
সে বিপদে আমরা রক্ষা পেলাম শুধু জ্যাবেজের বেনিয়া বুদ্ধির দৌলতে। সে সবাইকে বলল–“অপমান যা হওয়ার, তা হয়েছে জাহভের। সাজা যদি ওর প্রাপ্য হয়, জাহতেই তা দেবেন। আমরা কেন নিজেদের মাথায় দায়িত্ব নিতে যাই? এস, আমরা সবাই মিলে একমনে নীরবে ভগবানকে ডাকি এই বলে যে বিধর্মী ঐ মিশরী যুবরাজ যদি ইচ্ছা করে ধর্মস্থান কলুষিত করে থাকেন, তাহলে জাহভের ক্রোধাগ্নি তাকে এক্ষুনি দগ্ধ করুক। আর যদি তার অপরাধটা অনিচ্ছাকৃত হয়ে থাকে, তবে তাকে যেন সে ক্রোধাগ্নি স্পর্শ না করে।
এটা মোটের উপর মনঃপূত হল অনেকেরই। জ্যাবেজ এক, দুই করে যাট পর্যন্ত শুনে যাবে জোরে জোরে। ষাট গুনবার পরেও যদি বজ্রাঘাতে যুবরাজ মারা না পড়েন, তবে বুঝতে হবে যে তিনি নির্দোষ, ছাড়া পাবেন তিনি।
সেই অনুসারেই হল ব্যবস্থা। ইজরায়েলী উপাসকেরা নীরবে বসে আছে অন্ধকারে, একমনে জাহভেকে ডাকছে–“দোষীর সাজা দাও, নির্দোষকে মুক্তি দাও, হে ভগবান!” আর ওদিকে জ্যাবেজ থেমে থেমে ধীরে ধীরে গুনে যাচ্ছে “এক, দুই, তিন, দশ, বারো—”