“কী প্রমাণ, বুঝলাম না ভদ্রে!”–বললেন যুবরাজ।
“যখন বিদেশে ফারাওয়ের বেগার খাটতে না যাই, তখনও দেশে বসেই খাঁটি তারই বেগার। ইট বানাই কাদা শুকিয়ে। তাতে মেশাতে হয় খড়ের কুচি। সেই খড়টা আগে সরকার থেকে দেওয়া হত। এখন আর হয় না। হুকুম হয়েছে, ‘যার যার প্রয়োজন মতো খড় নিজেরা কেটে নাও সরকারী জমি থেকে। সেই খড় কাটতেই আমি এসেছিলাম। কেটে বেঁধে বাড়ি ফিরছিলাম, এমন সময় ঐ ধারালো পাথরটাতে পা কেটে গেল।”
যুবরাজ আর দেরি করলেন না। নিজের রেশমী জামা থেকে একটা ফালি ছিঁড়ে বার করলেন চোখের পলকে, আর তাই দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন মেরাপির পায়ের ক্ষতস্থানে। হাঁটতে গেলে হয়তো ব্যান্ডেজ খুলেও যেতে পারে, এই ভয়ে নিজের একটা পিনও আটকে দিলেন তাতে। পিনটি সোনার, তার উপর দিকটার চেহারা অনেকটা মুকুটের মতো।
একথা আমি বলতে চাই না যে মেরাপি নীরবে বসে যুবরাজের এই সেবা ও সাহায্য উদাসীনভাবে গ্রহণ করছিল। ঠিক উলটো বরং। সে বিধিমতে চেষ্টা করে যাচ্ছিল যুবরাজকে নিরস্ত করবার। “একী যুবরাজ! আপনি কেন–আমি কী বলে আপনাকে আমার পা স্পর্শ করতে দেব–বাঁধা-ছাঁদার দরকার নেই– আমি এমনিই বেশ হাঁটতে পারব,” ইত্যাদি ইত্যাদি কত রকম কাকুতি যে বেরুচ্ছিল তার মুখ থেকে, তার ধারাবাহিক বিবরণ দেওয়াই শক্ত।
যা হোক, মেরাপির কোনো কথায় কান না দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ করলেন যুবরাজ, এবং হেসে বললেন–“ওঠো এইবার, তাকিয়ে দেখ, মিশরের রাজমুকুট তোমার পায়ের তলায়।”
ইঙ্গিতটা ঐ পিনের সম্পর্কে, যার চেহারা অনেকটা মুকুটের মতো। কিন্তু মেরাপি আঁতকে উঠল ঐ রসিকতা শুনে, আকুলভাবে বলল–“যুবরাজ! যুবরাজ! আমায় অপরাধী করবেন না।”
ও কথায় কর্ণপাত না করে যুবরাজ বললেন–“তোমার বাড়ি কতদূর?”
বিষণ্ণভাবেই মেরাপি জবাব দিল–“তা অনেক দূর। সন্ধ্যাও হয়ে এল, বোঝাটাও ভারী, তবে হ্যাঁ, আমার দেরি দেখলে কাকা খুঁজতে আসতে পারেন, আর লাবানও–“
কে লাবান? যুবরাজের প্রশ্নটার উত্তরই দিল না মেরাপি। যুবরাজও উত্তরের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলেন না, হাত বাড়িয়ে দিলেন মেরাপির দিকে, “আমার হাত ধরে ধরে মাঠে নামতে হবে তোমায়। রথ আছে সেখানে, তাইতে করে তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।”
‘যুবরাজ! যুবরাজ!”সুরটা প্রতিবাদেরই, কিন্তু এমন ভাষা মেরাপি খুঁজে পেলো না, যা দিয়ে প্রতিবাদটি সম্যক প্রকাশ করা যায়।
“অ্যানা, তুমি ভাই বোঝাটা দেখ’-এই, বলেই যুবরাজ মেরাপিকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। আমি অগত্যা, যুবরাজের বন্ধু যখন, বন্ধুত্বের দাম দিতে হবে তো! খড়ের বোঝা ঘাড়ে করে পিছু নিলাম তাদের। উঃ, ভারী তত কম নয়! মেরাপির মতো কোমলা অবলা কী করে বুইত এটা? বাড়ি তো নিকটেও নয় বলছে।
আগে আগে রথ চলে, পিছে চলি আমি। রথে দুই জনের বেশি ধরে না। সুতরাং আমাকেই পায়দলেই যেতে হবে। এবং বোঝা মাথায় নিয়েই। তবু এই লজ্জাকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও এমন কথা আমার একবারও মনে হয়নি সেদিন যে, এর চেয়ে সেই মেম্ফিসে বসে আমার নকলনবিশ করাই শ্রেয় ছিল।
মাঠ ছেড়ে রথ একটা রাস্তায় উঠল ক্রমশ। পাকা রাস্তাও নয়, চওড়া রাস্তাও নয়। রথ চলবার মতো রাস্তা তো নয়ই। পায়ে পায়ে ঠোক্কর খাচ্ছে ঘোড়ারা। সারথি তাদের মাথার উপরে চাবুক ঘোরাচ্ছে সাঁই সাঁই শব্দে, কিন্তু ঘোড়াদের পিঠে সে-চাবুক বসাতে পারছে না, কারণ সে তো জানে যে মানুষের উপরেই হোক আর জন্তুর উপরেই হোক, চাবুক হাঁকানোটা একদম পছন্দ করেন না যুবরাজ।
চাঁদ উঠেছে, বেশ বড়-সড় চাঁদ একটা। তা নইলে রথের ঘোড়ার মতো আমিও পায়ে পায়ে ঠোক্কর খেয়ে মরতাম। মাটির দিকে নজর রেখে সাবধানে পথ চলছি, এমন সময় পুরুষ কণ্ঠে ক্রুদ্ধ তর্জন শোনা গেল–“মেরাপি! কী হয়েছে তোমার? ঐ অচেনা লোকটার সঙ্গে রথে বসে তুমি করছ কী?”
মেরাপি বলে উঠল–“হস্-স্-স্! চুপ! চুপ! এ-রথ মিশর যুবরাজের। এই যে যুবরাজ রথেই আছেন–
এক মুহূর্তে বিস্ময়ে হতবাক লোকটা। কিন্তু পরক্ষণেই গর্জে উঠল–“হোক যুবরাজ! আমার বাগদত্তার সঙ্গে একা রথে কেন তিনি? নাম তুমি এক্ষুনি?”
মেরাপি আবারও হস্স্স্ করে উঠল, তারপর বলল–“নামার উপায় থাকলে উঠতামই না। আমার পা ভয়ানক কেটে গিয়েছে। গাড়িতে করেই বাড়ি পর্যন্ত যেতে হবে। তুমি বরং এক কাজ কর, ঐ খড়ের বোঝাটা তোমার মাথায় নাও। যুবরাজের বন্ধু ওটাকে বয়ে বয়ে হয়রান হয়ে পড়েছেন।”
লোকটা বোঝ তুলে নিল আমার মাথা থেকে। আর নিতে গিয়েই গজগজ করে উঠল–“এই কয়গাছি খড়? এতে আমার কাজ কতটুকু এগোবে?”
আমি কাঁধে মাথায় হাত বুলোত বুলোত বললাম–“তোমার কাজ এগিয়ে দেবার জন্যই কি মেরাপি খড় কাটতে গিয়েছিলেন?”
“কেন যাবে না?”–খেঁকিয়ে উঠল লোকটা। ও আমার বাগদত্তা না? বাগদান হয়ে গেলেই মেয়েরা স্বামীর সম্পত্তি হয়ে গেল। হ্যাঁ, বাগান আর বিয়েতে ফারাক কমই আমাদের সমাজে।”
নিজের পাড়ায় পৌঁছে যে-বাড়িটাতে নামতে চাইল মেরাপি, সেটা তার কাকার বাড়ি। কাকা জ্যাবেজই এখন তার অভিভাবক দাঁড়িয়েছে, নাথানের মৃত্যুর পরে। ভাইঝির ডাকাডাকি শুনে জ্যাবেজ বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। হিব্রুদের মধ্যে সে বেশ বর্ধিষ্ণুঃ লোক, আর কথাবার্তায় মনে হল বেশ চতুর ব্যবসায়ীও বটে। যুবরাজের পরিচয় পেয়ে সে বিস্ময় প্রকাশ করল, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল, আবার সঙ্গে সঙ্গেই নিবেদন করে রাখল যে সে ভেড়া বিক্রি করে থাকে, মিশরী পল্টনের রসদ হিসাবে ভেড়া নিশ্চয়ই দরকার হবে যুবরাজের, যদি অন্য স্থানে না কিনে জ্যাবেজের কাছ থেকে তা কেনা হয়, সে আগের চেয়েও অনেক বেশি কৃতজ্ঞ হবে।