‘আমি গতযুদ্ধে সৈন্যদলে যোগ দিয়েছিলাম যুবরানি! হাতাহাতি লড়াইয়ে দুই-চারটা শত্রুকে নিপাতও করেছি।”
“বেশ, বেশ! তাহলে আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারব। মনে রেখো, যুবরাজের ঘরে-বাইরে সর্বত্রই বিপদের আশঙ্কা থাকবে ওখানে। বাইরে হিব্রুরা, ঘরে আমেনমেসিস।”
‘“আ-মে-ন মেসিস?”–আমি অবাক হয়ে গেলাম।
“শেঠি অপসারিত হলে সিংহাসনের দাবিদার তো সেই!” বললেন উসার্টি।
যথাকালে আমরা পৌঁছোলাম গোসেনে। একদল সৈন্য আছে সঙ্গে। আছেন রাজপুত্র আমেনমেসিস, আর আছি আমি, এই অধম লেখক। ছাউনি পড়ল শহরের বাইরে। এদিকে শেঠি, ওদিকে আমেনমেসিস হিব্রু মুরুব্বিদের ডেকে ডেকে আলাপ আলোচনা চালাতে থাকলেন তাদের সঙ্গে। কী তাদের অসন্তোষের কারণ? কী তাদের অসুবিধা গোসেনে? কী ধরনের অত্যাচার হয় তাদের উপরে?
প্রধান অভিযোগ অবশ্য এইটাই যে ইজরায়েলীদের জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, বহুদূরের সরকারী খামারে বেগার খাটবার জন্য। সেখানে জুলুম হয় তাদের উপরে, মার খেতে খেতে মরেও যায় অনেকে। এছাড়াও ছোটখাটো নালিশ আছে কিছু কিছু। সরকারী কর্মচারীরা বেগারের লোক সংগ্রহ করতে বা অন্য প্রয়োজনে যখনই আসে গোসেনে, যেখানে যা পারে উৎকোচ আদায় করে, আর সুযোগ পেলেই করে নারীদের সম্ভ্রমহানি। বস্তুত ফারাওয়ের লোক যখন আসে, তখন গোটা হিব্রু সমাজটাই তটস্থ হয়ে থাকে আতঙ্কে।
দুজনের তদন্তের ধারা দুই রকম, শেঠির আর আমেনমেসিসের। শেঠির আলাপ আলোচনা ধনী-দরিদ্র সকলেরই সঙ্গে। আমেনমেসিস এদিকে বাছাই করা কয়েকজন দলপতির বক্তব্যটা শুনে নিয়েই মনে করলেন যে তার কর্তব্য শেষ হয়েছে। শেঠি এসেই খোঁজ নিয়েছিলেন সেই পয়গম্বর মুসার। যিনি মেরাপিকে সঙ্গে নিয়ে মাত্র কয়েকদিন আগে ফারাওয়ের দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন, আর তারস্বরে অভিশাপ দিয়ে এসেছিলেন ফারাওকে এবং মিশরের সমস্ত জনগণকে।
পয়গম্বর নেই গোসেনে। ট্যানিস থেকেই তিনি তার সহচরকে নিয়ে যাত্রা করেছিলেন নিরুদ্দেশের পথে। হিব্রুরা বলে, তিনি বনে-কান্তারে বিচরণ করছেন জাহভের অন্বেষণ করে কৰে। কবে ফিরবেন, কেউ পারে না বলতে।
শেঠি কিন্তু মুসার অন্বেষণ করছিলেন অন্য প্রয়োজনে। ইজরায়েলীদের এই ধর্ম এবং এই দেবতা সম্বন্ধে অসীম কৌতূহল জেগেছে তার মনে। গোসেনে নিশ্চয়ই যথেষ্ট সুবিধা আছে সে-কৌতূহল চরিতার্থ করার। না পাওয়া যদি যায় মুসাকে, নাই বা গেল। শেঠি ডেকে পাঠালেন হিব্রু ধর্মমন্দিরের অন্যতম যাজক কোহাটকে। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর কাছ থেকে পাঠ নিতে থাকলেন ইজরায়েলীদের ধর্ম, দেবতা এবং শাস্ত্রগ্রন্থ সম্পর্কে। কোহাট লোকটি সৎ, ইহুদী হিসাবে গর্ব থাকলেও বিদ্বেষ নেই মিশরীদের উপরে। আন্তরিকতার সঙ্গেই তিনি যুবরাজের সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন।
তদন্ত এগুচ্ছে। সেদিন কত যে লোকের সঙ্গে কত কথা যে কইতে হয়েছে যুবরাজকে, তার লেখাজোখা নেই। শ্রান্ত বিরক্ত হয়ে দিনান্তে তিনি আমাকে নিয়ে রথে চড়ে বসলেন–“চল, গ্রামাঞ্চলে বেড়িয়ে আসি।” রাজপথ থেকে রথ মাঠে নেমে পড়ল। মাঠ শুধু নামেই মাঠ, আসলে এ একটা মরুভূমি বললেই চলে, চাষ-আবাদ এতে কিছুই হয় না। হয় না বলেই রথের গতিও অবাধ, অল্পক্ষণেই আমরা শহরসীমা ছাড়িয়ে চলে গেলাম।
ওদিকে সূর্যও ডুবে আসছে। আমি মাঝে মাঝে বলছি–“এইবার চলুন, ফেরা যাক যুবরাজ?”
যুবরাজ সেকথা কানেও তুলছেন না–“কেন? তোমার কি ভয় করছে নাকি?”
“না করবে কেন যুবরাজ?”–বললাম আমি–যুবরানি বলে দিয়েছিলেন গোসেন আমাদের পক্ষে শত্ৰুপুরী। সন্ধ্যার অন্ধকারে কেউ যে চড়াও হবে না আমাদের উপরে, একথা নিশ্চয় করে বলা যায় কি?”
যুবরাজ কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই একটা অনুচ্চ আর্তনাদ কানে এল আমাদের। যেখান দিয়ে চলেছে আমাদের রথ, তার বাঁদিকে একটা উঁচু ডাঙা জমি, কী আছে সেখানে, রথ থেকে তা চোখে পড়ে না। আর্তনাদটা এসেছে সেইখান থেকে। এবং আর্তনাদটা রমণীকণ্ঠের বলেই মনে হল।
রথ থামাতে বললেন যুবরাজ। “দুনিয়ায় দুঃখের পার নেই মানুষের। দেখা যাক, এখানে আবার কার কী হল?
আগে আগে যুবরাজ, পিছনে পিছনে আমি, সেই উঁচু ডাঙায় উঠে পড়লাম হাঁচোড়-পাঁচোড় করে। এ যেন একটা বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, যতদূর দৃষ্টি চলে, একটানা খড়-ভুঁই। সেই দুইয়ের ভিতর একটি স্ত্রীলোক বসে আছে এবং কাতরাচ্ছে তখনও। তার অতি নিকটেই মস্ত এক বোঝা খড় পড়ে আছে, দড়ি দিয়ে বাঁধা।
“কে গো তুমি?”-যুবরাজ এ-কথা বলতেই স্ত্রীলোকটি চমকে চোখ তুলে তাকাল, উঠে দাঁড়াবার চেষ্টাও করল একটু।
“উঠো না, উঠো না”-নিষেধ করলেন যুবরাজ–“তোমার পা কেটে রক্ত পড়ছে দেখছি।”
যুবরাজ তার পায়ের দিকেই দৃষ্টিপাত করেছেন, আমি তাকিয়েছি তার মুখের দিকে। ফলে আমার মুখ থেকেই প্রথম বেরুলো অপরিসীম বিস্ময়ের স্বগত উক্তি “এ যে ইজরায়েলের চাঁদ সেই মেরাপি দেখছি।”
“মে-রা-পি?”-যুবরাজ এতক্ষণে চিনলেন তাকে, তারপরে নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিলেন–“মেরাপিই বটে। হবে নাই বা কেন? এই তো তোমার দেশ! কী বল?”
“নিশ্চয় যুবরাজ! এইটাই আমার দেশ বটে। তবে দাসজাতির দেশে-বিদেশে একই অবস্থা। ট্যানিসেও হিব্রুর উপরে মিশর সরকারের অত্যাচার অব্যাহত, গোসেনেও তাই। ঐ খড়ের বোঝাই তার প্রমাণ।