ওদিকে ফারাও বলে যাচ্ছেন–“তদন্ত করতে যাবেন যুবরাজ শেঠি। তবে তার সঙ্গে রাজপুত্র আমেনমেসিসও যাবেন। দুই ভাই একসঙ্গে গেলে ওঁদের সময় কাটবে ভাল। তাছাড়া দুইজনের দুটো মত পেলে আমি কর্তব্য নির্ধারণে সুবিধাও পাব অনেকখানি।”
শেঠি আবার কানে কানে বললেন আমায়–“আমায় বিশ্বাস করেন না ফারাও। বস্তুত তুমি দেখতে পাবে আমার আর আমেনমেসিসের দুটো মতে পার্থক্য দাঁড়িয়ে যাবে আকাশ-পাতাল, আর কার্যকালে ফারাও কাজ করবেন আমেনমেসিসেরই মতানুযায়ী, আমার নয়।”
আমি চমৎকৃত হয়ে বললাম–“তাহলে তো ফারাও একা আমেনমেসিসকে পাঠালেই পারতেন?”
“না, তা পারতেন না। আমেনমেসিসকে প্রাধান্য পেতে দেবেন না কিছুতেই, এমন একজন আছেন, যাঁর ইচ্ছাকে পদদলিত করার শক্তি থাকলেও রুচি নেই ফারাওয়ের। তিনি হচ্ছেন যুবরানি উসার্টি।”
ওদিকে ফারাও তুলেছেন নতুন একটা কথা। যা ইজরায়েলীদের সমস্যার চাইতেও গুরুতর ফারাও পরিবারের এবং জনসাধারণের পক্ষে। তিনি বলছেন ‘সম্ভব হলে আমি কালই রওনা হয়ে যেতে বলতাম রাজপুত্রদের। কিন্তু সম্ভব নয় সেটা। পক্ষকাল পরে ওঁদের যাত্রার দিন নির্দিষ্ট রইল। এই পক্ষকালের মধ্যে আর একটি কাজ আমাদের সেরে ফেলতে হবে। আনন্দোৎসব একটা। মিশর যুবরাজ শেঠির সঙ্গে মিশর যুবরানি উসার্টির শুভপরিণয়। আগামী তিন দিনের মধ্যেই হবে এই বিবাহ।”
যুবরাজ ভয়ানক চঞ্চল হয়ে উঠেছেন এই ঘোষণা শুনে। তা লক্ষ্য করে ফারাও পরিহাসের সুরে বলে উঠলেন–“তুমি যেন এমন একটা ভাব দেখাচ্ছ যে এ সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও তুমি জান না?”
“তা তো জানিই না! কানাঘুষো জল্পনা-কল্পনা অনেক হয়েছে অবশ্য এ-নিয়ে, কিন্তু ফারাওয়ের মুখ থেকে আচমকা এই প্রকাশ্য ঘোষণা নিঃসৃত হওয়ার আগে,
সরাসরি কোনো বার্তা বা ইঙ্গিত কেউ আমাকে দেয়নি।”
“সেকী? উসার্টিকে তো কাল রাত্রে এই কথা বলার জন্যই আমি তোমার মহলে পাঠিয়েছিলাম। উসার্টি কি লজ্জা পেয়েছিল বলতে?”।
হোক দরবার, উসার্টি ঝংকার দিয়ে উঠলেন–“লজ্জাশরম থাকে অবলাদের। আমি তাদের দলে নই। আমি গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু এমন তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত ছিল যুবরাজের কক্ষে, যার সম্মুখে এসব ব্যক্তিগত ব্যাপারে আলোচনা আমি সঙ্গত বা শোভন মনে করিনি। তা, নাই যদি বলে থাকি কাল, যুবরাজ বলতে পারেন না যে ফারাওয়ের এই ব্যবস্থাটি এমন কিছু অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। আবহমান কাল ফারাও পরিবারে ভাইবোনে বিবাহ হয়ে আসছে। আজ কি আমি নিজের ভাইকে ছেড়ে জ্ঞাতিভাই আমেনমেসিস বা সাপ্টাকে বিয়ে করতে যাব? বিশেষ যেখানে আমেনমেসিসের এক বৌ আগে থেকে আছে, আর সেখানে সাটার একখানা পা খোঁড়া?”
রাজকন্যার এই তর্জন-গর্জন শুনে অনেকে মুখ ফিরিয়ে হাসল, কিন্তু আমেনমেসিসের ওপাশ থেকে আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠল এক ল্যাংড়া যুবক “খোঁড়া তো হয়েছে কী? বরাতে থাকলে এই খোঁড়াও একদিন সিংহাসন পেতে পারে, আর পেতে পারে গর্বিতা উসার্টির বরমালাও।”
আবারও মুখ টিপে হাসছে সবাই। আমিই কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি সাপটার মুখের দিকে। কিছুক্ষণ আগে বোকেনঘোর মায়ামন্ত্রের বশে একে একে তিনটি পুরুষকে দেখতে পেয়েছিলাম আমি। ঐ সাপটাই সেই তৃতীয় পুরুষ।
২. যুবরাজ শেঠির বিবাহ
৫.
মহাসমারোহে যুবরাজ শেঠির বিবাহ হয়ে গেল রাজকন্যা উসার্টির সঙ্গে। শেঠির অনিচ্ছা যতই আন্তরিক হোক, দেশাচার, কুপ্রথা এবং পিতা তথা সম্রাটের আদেশের সমুখে নতি স্বীকার করতেই হল তাকে।
আর বিবাহের পরেই তোড়জোড় শুরু হল গোসেন অভিযানের। অনেকেই ভেবেছিল, উসার্টিও এ-অভিযানে যুবরাজের সঙ্গিনী হবেন। কিন্তু তারা যে কতখানি ভ্রান্ত, তা হৃদয়ঙ্গম করতে দেরি হল না তাদের। উসার্টি বললেন তার প্রথম কর্তব্য হল বৃদ্ধ পিতার শুশ্রূষা। ফারাওয়ের কাছ থেকে একদিনের জন্যও দূরে যাওয়ার কথা কল্পনা করতেই পারেন না তিনি।
“বৃদ্ধ পিতা?”-ব্যঙ্গ হাসি হাসলেন শেঠি, নিভৃত কক্ষে আমার কানে–“পিতা বলে নয়, ফারাও বলেই বৃদ্ধকে চোখে চোখে রাখা উসার্টির প্রয়োজন। কখন আছেন, কখন নেই, শেষ সময় কখন এসে পড়ে, আর সে-সময়ে কে তার মুখ থেকে কী আদেশ বার করিয়ে নেয়, ঠিক কী! চোখে চোখে রাখতে হবে বই কি!”
এ-কথাও অবশ্য খুবই ঠিক যে উসার্টিকে সঙ্গে না পাওয়াটা কিছুমাত্র ক্ষোভের কারণ হয়নি যুবরাজের পক্ষে। কোনোদিনই তিনি এই স্বার্থসর্বস্ব উচ্চাশিনী নারীকে সুনজরে দেখতে পারেননি। আজ বিবাহটা হয়ে গিয়েছে বলেই যে ওঁর সম্পর্কে যুবরাজের মনোভাব পালটে যাবে, এটা কে আশা করতে পারে?
তা সঙ্গে না যান, তিনি যে যুবরাজের একান্ত শুভার্থিনী, এর একটা প্রমাণ উসার্টি দিলেন যাত্রার প্রাক্কালে। যুবরাজকে পরিয়ে দিলেন যে-কোনো অস্ত্রের অভেদ্য একটি লৌহবর্ম। আর আমায়ও দিলেন সেইরকমই অন্য একটি–’জামার ভিতরে সর্বদা এটিকে পরে রাখবে”-কড়া নির্দেশ দিলেন আমাকে। আমি অবাক হয়ে বললাম–“আমাকে কেন যুবরানি?”
“তুমিই তো এখন যুবরাজের সারাক্ষণের সাথী!”–উত্তর দিলেন উসার্টি “আর লোকচরিত্র আমি যতটা বুঝি, যুবরাজের খুব অনুরক্তও তুমি। যাচ্ছ তোমরা গোসেনে। শত্ৰুপুরী আমাদের পক্ষে। সেখানে হঠাৎ যুবরাজের বিপন্ন হয়ে পড়াটা আশ্চর্য কিছু নয়। ঐ হিব্রুরা ধর্মোন্মাদ, ধর্মের নামে ওরা যে-কোনো দুষ্কর্ম করতে পারে। তাই বলছি, যুবরাজ যদি আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হন, স্বভাবতই তাকে সাহায্য করার প্রথম দায়িত্ব পড়বে তোমার উপরে। তাই তোমার আত্মরক্ষার এই ব্যবস্থা করে দিলাম, ভাল কথা, শুধু কলমই চালিয়েছ সারা জীবন? না তরোয়াল চালাতেও জান?”