মেরাপি এগিয়ে এসে নতজানু হল ফারাওর সমুখে, তারপরে বুঝি সে যুবরাজের পায়ের কাছেও অমনিভাবে প্রণিপাত করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে নিরস্ত করলেন যুবরাজই–“দরবারে একমাত্র প্রণম্য হলেন ফারাও। অন্য কাউকে এখানে সম্মান জানানো চলে না।”
তারপর মেরাপি তার পয়গম্বরের নির্দেশে পূর্ব-রজনীর কাহিনি বর্ণনা করে গেল আবেগের সঙ্গে এবং কাহিনি সমাপন করে ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল জনতার ভিতরে মিশে যাবার জন্য। পয়গম্বরেরা তখন নিজেদের দাবি আবারও উত্থাপন করলেন–“কী ধরনের অত্যাচার ইজরায়েলীদের উপরে হচ্ছে তা শুনলেন ফারাও। এর পরেও কি আপনি বলবেন যে ইজরায়েলীদের ধন-প্রাণ-সম্মান নিরাপদ মিশরভূমিতে?”
ফারাও ধীরে ধীরে বললেন–“কেন বলব না? হত্যাকাণ্ড তো আখছারই হচ্ছে। শুধু যে ইজরায়েলীরাই খুন হচ্ছে, তা নয়, হচ্ছে মিশরীরাও। তার জন্য দেশের সব লোক দেশত্যাগ করে যেতে চাইবে, এ তো অতি হাস্যকর কথা! হিব্রু নাথানের উপরে অত্যাচার করেছিল জনৈক সৈনিক, যুবরাজের সুবিচারে সঙ্গে সঙ্গেই সে যোগ্য দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে। সুতরাং ও ব্যাপারে আমারও আর কিছু করবার থাকতে পারে না, ইজরায়েলীদেরও আর কিছু অভিযোগ থাকতে পারে না। ঐ ব্যাপারের উপরে ভিত্তি করে কেউ যদি দাবি করে যে ইজরায়েলীদের মিশর থেকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে, তা হলে আমি বলব-উন্মাদ হয়েছে সে।”
এই পর্যন্ত বলে ফারাও থামলেন এক মুহূর্ত, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে মন্তব্য করলেন–“ফারাওয়ের যা বলবার তা তিনি বলেছেন। আপনারা যেতে পারেন।“
পয়গম্বরেরা নীরব। কিন্তু সেও কেবল এক মুহূর্তের জন্য। তারপরই তারা দুজনই সমস্বরে অভিসম্পাত দিতে শুরু করলেন ফারাওকে–“ভগবান জাহভের নামে আমরা অভিসম্পাত দিচ্ছি তোমাকে ফারাও। এই পাপের জন্য অচিরে তুমি মৃত্যুমুখে পতিত হবে। মিশরী জনগণকেও অভিশাপ দিচ্ছি আমরা। তারা ধ্বংস হবে। মরণ হবে তাদের খাদ্য, রক্ত হবে তাদের পানীয়। সারা দেশ আচ্ছন্ন হয়ে যাবে গভীর অন্ধকারে। তারপরে, অন্য ফারাও এসে মুক্তি দেবেন ইজরায়েলীদের।”
রাজদ্রোহ? সন্দেহ কী? কিন্তু ফারাও-দরবারে এ-কথা কারও মনে হল না যে এই ইজরায়েলী বিদ্রোহীদের এক্ষুনি দণ্ডিত করা উচিত যথোচিতভাবে। কেউ টু শব্দটিও করল না তাদের মুখের ঐ সব সর্বনাশা অভিশাপ শুনে, কেউ এগিয়ে এল না তাদের বন্দি করার জন্য। স্বয়ং ফারাও যেখানে নিশ্চল নির্বাক, তার ভূতেরা আর করবে কী?
যেমন এসেছিলেন পয়গম্বর যুগল, তেমনি ধীর পদক্ষেপে তারা বেরিয়ে গেলেন দরবার থেকে। সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
কথা কইলেন ফারাও। বেশ একটু উত্তেজনার সঙ্গেই–“ইজরায়েলীদের ও দাবি নতুন কিছু নয়। নিমকহারামের জাত ওরা। কয়েক শতাব্দী আগে ওদের দেশে হয়েছিল দারুণ দুর্ভিক্ষ। খেতে না পেয়ে ওরা হাজারে হাজারে চলে এসেছিল মিশরে, শরণার্থী হয়ে। তখন ইউসুফ ছিলেন মিশরের উজির, জাতিসূত্রে তিনি আবার ইজরায়েলী। ফারাওকে অনুরোধ করে তিনিই নিজের জ্ঞাতি-গোত্রীদের ঠাই করে দেন গোসেনে। সেই থেকে ঐ উর্বর প্রাদেশে বসবাস করছে ওরা, বংশবৃদ্ধি হয়েছে ওদের আশাতীত রকম, ধনেধান্যে ঐশ্বর্যবান হয়েছে জনে জনে, যেমনটা নিজেদের মরুদেশে হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না ওদের।
“এইসব দাক্ষিণ্য আমাদের হাত থেকে অম্লান বদনে ওরা হাত পেতে নিয়েছে, বিনিময়ে করেছে শুধু একটি কাজ, ফসল তোলার সময়ে বিনা পারিশ্রমিকে ওদের কিছু লোক এসে খেটে দিয়েছে, দিচ্ছে আমাদের ক্ষেতে। চিরদিন দিয়েছে বিনা ওজরে, ইদানীংই ওরা বেসুরো গাইছে–খুব নাকি অত্যাচার হচ্ছে ওদের উপরে। হয়তো কোথাও কিছু হয়েও থাকতে পারে অত্যাচার, এই রাজধানী ট্যানিসে বা থিবিস মেফিসেই কি হচ্ছে না তা? সেই তিলকে তাল করে ঐ ধৃষ্ট পয়গম্বরেরা যদি দরবার কক্ষে এসে ফারাওকে অভিশাপ দিয়ে যায়, তা হলে রাজমর্যাদার আর রইল কী?”
দরবারে হোক বা অন্যত্র হোক, ফারাওয়ের উপস্থিতিতে তার অনুমতি বিনা অন্য কেউ কোনো মন্তব্য করতে পারে না। করে যদি, তাহলে ফারাওয়ের নিজের ভাষাতেই বলা যায় যে রাজমর্যাদার আর থাকে না কিছু। এক্ষেত্রেও তাই নীরব রয়েছে সকলে। এবং প্রতীক্ষা করছে ফারাও কতক্ষণে তার বক্তৃতা শেষ করবেন। কতক্ষণে ও কীভাবে?
অচিরেই শেষ করলেন, এবং একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে। বললেন—“রাজমর্যাদা ওরা ক্ষুণ্ণ করে গেল, তা আমি মনে রেখেছি। তার জন্য সাজাও ওরা পাবে। কিন্তু সাজা দেবার আগে আমি নিশ্চিত হতে চাই যে সত্যকার অভিযোগ ওদের কিছু আছে কিনা। যদি থাকে, তাহলে, স্বভাবতই সাজার কঠোরতা হ্রাস পাবে। এখন সেই নিশ্চিত হওয়াটা হয় কী করে? সরেজমিনে তদন্ত ছাড়া তো অন্য উপায় নেই। উজির, তুমি কী বল?”
উজির নেহেসি অথঘটিত ব্যাপারে ছাড়া নিজস্ব মতামত সহজে প্রকাশ করেন না, তিনি প্রভুর কথাতেই সায় দিলেন–সরেজমিনে তদন্ত ভালই। কাকে পাঠাতে চাইছেন ফারাও?”
“সারা মিশরে সবচেয়ে দয়ালু, সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি হচ্ছেন আমার প্রিয় পুত্র মিশর-যুবরাজ শেঠি, একথা নিশ্চয় স্বীকার করবেন সকলে।”
“নিশ্চয়! নিশ্চয়?” শতকণ্ঠে সমস্বরে ধ্বনিত হল অকুণ্ঠ সমর্থন। শেঠি আমার কানে কানে বললেন–“ফারাও ঠাট্টা করছেন আমাকে। কাল খুয়াকার যে প্রাণদণ্ড দিয়েছি আমি, তারই দিকে ইঙ্গিত এটা, প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ।”