সিংহাসনের সমুখে গিয়ে শেঠি নতজানু হয়ে অভিবাদন করলেন–“জয় হোক মহারাজের।” ফারাও জানালেন আশীর্বাদ –“কল্যাণ, হোক পুত্র! আসন গ্রহণ
সিংহাসনের অতি নিকটেই একখানা স্বর্ণাসন, শেঠি তাইতেই বসলেন। আরও একখানা স্বর্ণাসনও আছে একটু দূরে, সেটাতে আগে থেকেই উপবিষ্ট আছেন আমেনমেসিস।
যুবরাজের ইশারা পেয়ে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম তার চেয়ারের পিছনে।
তারপর দরবারের কাজ শুরু হল। পেয়াদার আহ্বানে একে একে কত লোকই যে এল। প্রত্যেকের হাতে এক একটা প্যাপিরাসের তাড়া। তাতে দরখাস্ত লেখা। দরখাস্তগুলি গ্রহণ করছেন উজির, ফেলে দিচ্ছেন একটা চামড়ার বস্তার ভিতর।
এক কৃষ্ণকায় দাস সেই বস্তার মুখ মেলে ধরে আছে। অনেকদিন আগে যারা আর্জি দিয়েছে, তারা কেউ কেউ উত্তরও পেয়ে গেল এই সময়। দলিলখানা কপালে ঠেকিয়ে তারা দ্রুত বাইরে চলে গেল, ভিতরে দাঁড়িয়ে তা পড়বার হুকুম নেই।
তারপর একে একে দেখা দিতে লাগল দূর প্রদেশের শেখ সর্দারেরা, সিরিয়ার অসংখ্য কেল্লাদার ফৌজদারেরা, দস্যুহস্তে নিপীড়িত বণিকেরা, এমন কি রাজপুরুষদের অবিচারে নির্যাতিত কৃষকেরাও। প্রত্যেকেই আর্জি দাখিল করছে, দরবারের লেখকেরা প্রত্যেক আর্জির বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্তসার লিখে ফেলছে, উজির বা সচিবেরা কোনো কোনো আর্জির জবাবও তড়িঘড়ি দিয়ে দিচ্ছেন।
ফারাও নিজে বসে আছেন চিন্তাকুল, নীরব। পূজাবেদীর উপরে পাষাণ বিগ্রহের মতো। সুদীর্ঘ দরবার গৃহ পেরিয়ে তার দৃষ্টি মুক্ত দ্বারপথে বেরিয়ে দূর আকাশের দিকেই নিবদ্ধ, যেন তাঁর ইহ-পরলোকের সব কিছু সমস্যার সমাধান ঐ আকাশপটেই লেখা আছে দুর্বোধ্য ভাষায়।
যুবরাজ পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে চুপি চুপি আমাকে বললেন–“বন্ধু অ্যানা, দেখছ তো, দরবার বড় বিরক্তিকর জায়গা। এখানে না এসে তুমি যদি মেম্ফিসে বসে গল্পই রচনা করে যেতে একটার পর একটা, সেটা ভাল হত তোমারও পক্ষে, দুনিয়ারও পক্ষে।”
আমি আর এ-কথার উত্তর দেবার সময় পেলাম না, দরবারের ও-প্রান্তে একটা চাঞ্চল্য টের পাওয়া গেল। ভিড় ঠেলে দুজন লোক এগিয়ে আসছে সিংহাসনের দিকে। একজন আগে, একজন পিছে। লম্বা দাড়ি দুজনেরই মুখে। একজনের কঁচাপাকা, আর একজনের দুধের মতো সাদা। দীর্ঘ দেহে সাদা দিলে পোশাক তাদের, তার উপরে পশমী আঙরাখা এক একটা, এরকম আঙরাখা শুধু মেষপালকেরাই পরে বলে জানতাম। হাতে তাদের কাটা গাছের লাঠি এক একখানা, তার সবগুলো কাটা যে চেঁচে দেওয়া হয়েছে, তাও নয়।
নোক দুটি ধীরে ধীরে আসছে, ডাইনে বা বাঁয়ে একবারও তাকাচ্ছে না। সব লোক ঝটিতি সরে যাচ্ছে দুই দিকে, পথ ছেড়ে দিচ্ছে তাদের, যেন তারা রাজাগজা জাতীয় কেউ। বস্তুত এতখানি সমীহ কোনো রাজা বা রাজপুত্রকেও সচরাচর করে না লোকে।
“ইজরায়েলের পয়গম্বরেরা! ইজরায়েলের পয়গম্বরেরা।”–ধ্বনি উঠল একটা। প্রত্যেকেই চাপা গলায় কথা কইছে বটে, কিন্তু শত শত লোকের মিলিত চাপা গলার ধ্বনিত সিংহগর্জনের মতোই ভয়াবহ।
ওরা দুটি গিয়ে ফারাওয়ের সিংহাসনের সমুখে দাঁড়াল, কোনো অভিবাদন না করেই। ফারাও তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন, কথা কইছেন না। আর ফারাও যেখানে নির্বাক রয়েছেন, তার কর্মচারীরাই বা নীরবতা ভঙ্গ করে কী করে?
অবশেষে কথা কইলেন বয়ঃকনিষ্ঠ পয়গম্বরই, দাড়ি যাঁর কঁচাপাকা। বললেন–“আপনি আমায় চেনেন ফারাও, কেন আমি এসেছি, তাও জানেন।”
ফারাও খুব ধীরে ধীরে জবাব দিচ্ছেন, চিবিয়ে চিবিয়ে–“না চিনে উপায় কী? ছেলেবেলায় একসাথে খেলা করেছি যে আমার স্বৰ্গতা ভগ্নী তোমাকে নীলনদের খাগড়াবন থেকে তুলে এনে দত্তক নিয়েছিলেন। হ্যাঁ, চিনি আমি তোমাকে। তোমার সঙ্গীকেও দেখেছি আগে। কিন্তু তোমাদের আগমনের উদ্দেশ্য আমি জানি না।”
“জানেন না যদি, তবে শুনুন আরও একবার। আমার আগমন আমার নিজের ইচ্ছায় নয়। আমি এসেছি, ইজরায়েলের ভগবান, একমাত্র ভগবান জাহভের আজ্ঞায়। তার দাবি হল এই যে তার উপাসকবৃন্দকে আপনি চলে যেতে দিন মিশর ত্যাগ করে। তারা বনে বনে কান্তারে কান্তারে তাদের ভগবানের অর্চনা করে বেড়াক গিয়ে।”
“কে তোমার জাভে? আমি জানি না তাকে। আমি আমন রা’র পূজক। মিশরে আরও বহু দেবদেবী আছেন, তাঁদেরও পূজক। জাইভের কথায় আমি কেন তোমাদের জাতিকে দেশ ছেড়ে যেতে দেব?”
“না যদি দেন ফারাও, তাহলে জাহভের রোষ যে কী বস্তু, তা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন। এদেশের সব দেবতার মিলিত-ক্ষমতাও জাহভের একার ক্ষমতার তুলনায় কিছু নয়। কেন যেতে দেবেন ইজরায়েলীদের, জিজ্ঞাসা করছেন? আমাকে জিজ্ঞাসা না করে বরং আপনার এই পুত্রকে জিজ্ঞাসা করুন। যুবরাজ শেঠিকে। জিজ্ঞাসা করুন, কাল রাত্রে এই নগরের রাজপথে কী ঘটনা তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন, আর সেই ঘটনার জের হিসাবে কী দণ্ডাজ্ঞা তিনি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন?”
যুবরাজ কেন ফারাওর আদেশ ব্যতিরেকে মুখ খুলতে যাবেন? তিনি নীরব রয়েছেন দেখে পয়গম্বর বললেন–“যুবরাজ যদি কিছু বলতে না চান, বলবার লোক আমার আরও আছে। এগিয়ে এস, মেরাপি! ইজরায়েল-চন্দ্রমা।”
তক্ষুনি ভিড়ের ভিতর থেকে ধীর পদে বেরিয়ে এল মেরাপি, আগের রাতে যাকে কেন্দ্র করে লোমহর্ষক সব ঘটনা ঘটে গিয়েছে বাজার চত্বরে, এবং আমন মন্দিরের চাতালে। ও যে এখানে আছে, তা আমরা ভাবতে পারিনি। ইজরায়েলী পয়গম্বরেরা মামলার বনিয়াদ পাকা করেই গেথে তুলেছেন দেখছি। ধর্মোন্মাদ তারা হতে পারেন হয়তো, কিন্তু বিষয়বুদ্ধিতেও তারা কোনো মিশরী বেনিয়ার চেয়ে কম যান না।