বোকেনঘোন্সু তখন বলছেন–একটা নতুন অনুজ্ঞার সুর তার কথায় এখন। বলছেন–“তাকিয়ে দেখ সিংহাসনের দিকে। তাহলেই তুমি নিজের চোখে দেখতে পাবে–পর্যায়ের পরে পর্যায়ে ও-সিংহাসনের ভবিষ্যৎ।”
আমি তাকিয়ে দেখলাম। প্রথমেই দেখলাম নিবিড় কুয়াশা সেখানে। তারপর ধীরে ধীরে অপসৃত হতে লাগল সে-কুয়াশা। অবশেষে সিংহাসন স্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হল আমার। কী আশ্চর্য! সে-সিংহাসনে যাঁকে উপবিষ্ট দেখলাম, তিনি যুবরাজ শেঠি নন। ঠাউরে দেখি, ক্ষণপূর্বে যাঁকে চলে যেতে দেখলাম সমুখ দিয়ে, সেই উদ্ধত আমেনমেসিসই বসেছেন সিংহাসনে।
কিন্তু কতক্ষণের জন্য? হঠাৎ পিছন থেকে ভেসে এল দলে দলে কালো কালো মানুষ, লম্বা তাদের দাড়ি, বঁড়শির মতো বাঁকানো তাদের নাক, তারা এসে আমেনমেসিসকে টেনে নামাল সিংহাসন থেকে, সে অভাগা কি জলের ভিতর পড়ল নাকি উলটে? ভারী জিনিস পড়লে জল যেমন ছকে ওঠে উঁচু হয়ে, ঠিক তেমনিই যেন উঠতে দেখলাম, আমেনমেসিসের পড়ার সময়।
আমেনমেসিস নেই, সিংহাসন কিন্তু খালিও নেই। সেখানে এবারে দেখছি আমার প্রভু ও বন্ধু যুবরাজ শেঠির শান্ত সৌম্য প্রসন্ন মূর্তিখানি–তার বামে সেই কাল রাত্রে যে-গর্বিতা রাজনন্দিনীকে দেখেছিলাম সেই উসার্টিই বসে আছেন পরিপূর্ণ রাজমহিমায়।
তারপর?
উসার্টি বসে আছেন তখনও সিংহাসনের অর্ধাংশ জুড়ে, কিন্তু বাকি আধখানায় শেঠি তো আর নেই! কখন তার মূর্তি সেখান থেকে অন্তর্ধান করেছে, টেরও পাইনি, কারণ আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল উসার্টির দিকে। শেঠি এখন নেই, তার জায়গায়, উসার্টির পাশটিতে এসে বসেছেন অন্য এক যুবক, তাকে আমি চিনি না, তবে লক্ষ্য করলাম তার একখানা পা খোঁড়া।
আরও কী দেখব কে জানে? অসীম আগ্রহ নিয়ে আমি তাকিয়েই আছি সিংহাসনের দিকে, এমন সময়ে হঠাৎ আমার স্বপ্নঘোর এক রূঢ় আঘাতে ভেঙে গেল। সে-আঘাত দূরত এক জয়ধ্বনির। বহু লোক একসাথে গর্জন করে উঠেছে–“জীবন! রক্ত! শক্তি! ফারাও। ফারাও! ফারাও!”
বুঝলাম–ফারাও এসে পড়েছেন। ভবিষ্যতের ছায়া ফারাওদের এবার ছেড়ে দিতে হবে সিংহাসন, সেখানে আসন গ্রহণ করবেন বর্তমানের ফারাও মেনাপ্টা।
পরপর তিনবার একই নির্ঘোষ–“জীবন! রক্ত! শক্তি। ফারাও! ফারাও। ফারাও!” তৃতীয় জয়ধ্বনির রেশ হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দরবারে প্রবেশ করলেন মহামহিম মিশর সম্রাট।
.
৪.
জীবন! রক্ত! শক্তি! প্রতিধ্বনি উঠল প্রতি সভাসদের কণ্ঠ থেকে।
প্রতি সভাসদ নতজানু হয়ে বসে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে, প্রণিপাত করল মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে প্রতি সভাসদ। এমন কি, যুবরাজও। এমন কি, অতি বৃদ্ধ বোকেনঘোন্সুও। দেবতা প্রণামের মতোই ভক্তিপূর্ণ সে প্রণাম। আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই তাতে। ফারাও মেনাটাকে সেই মুহূর্তে দেবতার মতোই মহীয়ান মনে হচ্ছিল। সিংহাসনের আশেপাশে যেখানে উপর থেকে এসে পড়েছে ঝলকের পরে ঝলক প্রখর সূর্যালোক, সেইখান দিয়ে আলোকপাতে স্নান করতে করতে যখন তিনি এগিয়ে আসছিলেন, মাথায় ঊর্ধ্ব মিশর আর নিম্ন মিশরের যুগ্ম রাজমুকুট, পরিধানে স্বর্ণখচিত রাজ পরিচ্ছদ আর হীরামাণিক্যের চোখ-ধাঁধানো অলঙ্কার, তখন কোনো দেবদেবীর চাইতে দৈবী মহিমায় এতটুকু নতুন বলে কেউ তাকে মনে করতে পারেনি। বুড়ো মানুষ, বার্ধক্যের আর দুশ্চিন্তার ছাপ সারা মুখে সুস্পষ্ট, কিন্তু তাঁর প্রতি অঙ্গ থেকে নিয়ত বিচ্ছুরিত হচ্ছে কী সর্বময়ী রাজমর্যাদা!
ফারাওয়ের দুই-এক পা পিছনে পিছনে আসছেন উজির নেহেসি, এক শুকনো, কোকড়ানো রাজপুরুষ, মুখখানা তার ঠিক যেন ভেড়ার চামড়ার কাগজ একখণ্ড। প্রধান পুরোহিত রয় আনছেন নেহেসির কাঁধে কাধ মিলিয়ে, আর রাজকীয় ভোজ টেবিলের তত্ত্বাবধায়ক হেরা। তারপর আরও অগুন্তি হোমরা-চোমরা মনিষ্যি, বোকেনঘোনসু সকলেরই নাম আর পদবী বলেছিলেন আমাকে, আমি আর অত শত মনে রাখিনি। সকলের পরে রক্ষীসেনা, কিছু মিশরী, কিছু বা কেশ-প্রদেশের কৃষ্ণাঙ্গ।
এই বিরাট দঙ্গলের ভিতর নারী মাত্র একজন, তিনি উসার্টি। ফারাওর ঠিক পিছনেই তিনি আছেন, উজিরেরও আগে আগে। ফারাও সিংহাসনের নিকটস্থ হলেন যখন, উজির নেহেসি আর প্রধান পুরোহিত রয় দুজনে দুই দিক থেকে এগিয়ে এলেন তাকে সিংহাসনে বসিয়ে দিতে। কিন্তু ফারাও হাত নেড়ে হটিয়ে দিলেন তাদের, কাছে ডাকলেন কন্যা উসার্টিকে, আর তারই কাঁধে হাত রেখে উঠে বসলেন নিজের স্থানে। অনেকেরই মনে হল যে ফারাও ইঙ্গিতে তাঁদের বুঝিয়ে দিতে চাইছেন যে এই রাজনন্দিনীকে অবলম্বন করেই টিকে থাকবে মিশরের রাজশক্তি। রাজার আসন গ্রহণের পরে উসার্টিও বসলেন, সিংহাসনের পাদপীঠের প্রথম ধাপে।
আবার সেই বহুকণ্ঠের জয়ধ্বনি–“জীবন! রক্ত! শক্তি! ফারাও!”
তারপর সব নীরব। ফারাও মৃদুস্বরে বলছেন উসার্টিকে–“আমেনমেসিসকে আমি দেখতে পাচ্ছি, রাজবংশের আর আর সবাইও আছে। কিন্তু কই? — মিশরের যুবরাজ কোথায়? পুত্র শেঠিকে তো দেখতে পাচ্ছি না কোথাও।”
“নিশ্চয়ই ভিড়ের ভিতর দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছেন আমাদের। আমার ভাই রাজকীয় আড়ম্বর থেকে দূরে থাকতেই ভালবাসেন।”
মৃদুস্বরেরই কথাবার্তা, তবু নীরবতা অতি গভীর বলে শেঠি সবই শুনতে পেয়েছেন। এখন আর লুকিয়ে থাকার উপায় নেই, একটা নিঃশ্বাস ফেলে তিনি এগিয়ে গেলেন সিংহাসনের দিকে। তার ঠিক পিছনে বোকেনঘোন্সু ও আমি। অন্য পারিষদেরা কয়েক পা পিছনে। যুবরাজ এগিয়ে যাচ্ছেন, আর ডাইনে-বাঁয়ে জনগণ মাথা নুইয়ে তাকে সম্মান জানাচ্ছে।