আমি আর তখন প্রকাশ করলাম না যে কয়েক বৎসর আগে আমি যুদ্ধেও গিয়েছিলাম।
এইবার জোরে জোরে একবার হাততালি দিলেন যুবরাজ, আর তক্ষুনি সুদীর্ঘ শ্বেতশ্মশ্রুর পতাকা উড়িয়ে দোরগোড়ায় দেখা দিল সেই ঘুষখোর পাম্বাসা। যুবরাজ বললেন–“এঁকে সঙ্গে নিয়ে শোবার ঘর দেখিয়ে দাও। আমার পাশের ঘরটাই ইনি ব্যবহার করবেন। কোনো অসুবিধা যেন না হয় এঁর।”
আমি যুবরাজকে অভিবাদন করে বিদায় নিলাম রাত্রির মতো। আলো হাতে নিয়ে পাম্বাসা চলেছে আগে আগে, কিন্তু থেমেও যাচ্ছে মুহুর্মুহু, দাঁড়িয়ে পড়ছে আমার সমুখে, তোয়াজ করছে আমাকে নানানভাবে। “আপনি লেখক? হতেই পারে না তা, আপনি জাদুকর! খারের কাইয়ের চাইতেও বড় জাদুকর। নইলে এলেন, আর খোদ যুবরাজকে বশ করে ফেললেন তিন তুড়িতে? এ, ঐ কথাটা যদি আগে বলতেন, তাহলে কি আর আপনাকে এত ঘোরাঘুরি করতে হয় একবারটি যুবরাজের দেখা পাওয়ার জন্য? যা হোক, যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। এখন থেকে দেখতে পাবেন, বুড়ো পাম্বাসা আপনার একান্ত অনুগত ভৃত্য।”
ঘরের বিলিব্যবস্থা ঠিকমতো করে দিয়ে পাম্বাসা যখন বিদায় নেয়, তখনও তার কাকুতি-মিনতির বিরাম নেই–“দেখবেন জাদুর ওস্তাদ। রাতের বেলা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবেন না যেন, তা যদি যান, যুবরাজ ভাববেন–আমি গুম করেছি আপনাকে, আর হুকুম জারি করবেন আমার গুদানা নেবার।”
পরদিন বেলা এক প্রহরের মধ্যেই আমরা গিয়ে হাজির হলাম ফারাওর দরবারে, আমরা মানে যুবরাজ শেঠির পারিষদবর্গ সবাই। সভাগৃহটার আয়তন অতিবিশাল, মাঝে মাঝে কারুকর্মে খচিত কতকগুলি সুগোল স্তম্ভ। তাদেরই মাথায় বটে ছাদটা, কিন্তু কত ঊর্ধ্বে যে সে-ছাদ, নীচে থেকে সঠিক আন্দাজ করা যায় না। স্তম্ভগুলির ফাঁকে ফাঁকে স্বৰ্গত ফারাওদের অতিকায় সব মূর্তি-সমুচ্চ বেদীর উপরে দণ্ডায়মান।
রাজসিংহাসনের স্থান হল এই বিশাল দরবার গৃহের এক প্রান্তে। ঠিক সেই প্রান্তটিতেই যা হোক কিছু আলো আকাশ থেকে নেমে আসছে অদৃশ্য সব রন্ধ্রপথ দিয়ে। অন্য সব দিকেই ঘরটা প্রায় অন্ধকার। অন্ততপক্ষে আমার কাছে তোত
অন্ধকার বলেই মনে হচ্ছিল, কারণ এইমাত্র বাইরের খর রৌদ্র থেকে আমি আসছি, আর একরম আবছা আলোতে চলাফেরার অভ্যাসও আমার নেই।
আমরা অপেক্ষা করছি দুটো স্তম্ভের মাঝখানে। যুবরাজ ইচ্ছা করলে অবশ্য সিংহাসনের কাছাকাছি কোথাও গিয়ে বসতে পারতেন, বস্তুত যুবরাজের জন্য নির্দিষ্ট একটা স্বর্ণাসন বরাবরই থাকে ওখানে। কিন্তু যুবরাজের পছন্দ তাঁর পারিষদবর্গের মধ্যেই থাকা। সিংহাসনের কাছে যাওয়া? সে তখন যাবেন ফারাও এলে।
একটা স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শেঠি, আমরা নীরবে অপেক্ষা করছি তার পিছনে। হঠাৎ এক বপুম্মান পুরুষ আমাদের সমুখ দিয়ে সিংহাসনের দিকে চলে গেলেন। ভাবটা দেখালেন যেন যুবরাজকে দেখেননি তিনি। কিন্তু সেটা যে তাঁর ভানমাত্র, তা আমরা সকলেই বুঝলাম।
যুবরাজ আমাকে বললেন–“ঐ হল আমেনমেসিস, আমার জ্যাঠতুতো ভাই, তুমি তো নিশ্চয়ই এই প্রথম দেখলে ওকে? বল দেখি, ওর সম্বন্ধে কী রকম ধারণা ভোমার হল?”
আমি যুবরাজের কানে কানে বললাম “উনি আপনাকে পছন্দ করেন না। ওঁর মুখখানাও কালো, মনটাও কালো। আপনার অনিষ্ট করতে পারলে উনি ছাড়বেন না।”
শেঠি মাথা নাড়লেন, অর্থাৎ সায় দিলেন আমার কথায়। তারপর রহস্যের সুরে বললেন–“এটা তুমি বলেছ ঠিক। অমনি আর একটা কথাও ঠিক ঠিক বলতে পার কিনা, দেখ না চেষ্টা করে। আমার অনিষ্ট চেষ্টায় ও সাফল্যলাভ করবে কি? অর্থাৎ আমাকে হটিয়ে ও পারবে কি সিংহাসনে বসতে?”
“একথা আমি কী করে বলব যুবরাজ?”–প্রায় আঁতকে উঠেই আমি নিবেদন করলাম–“আমি তো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নই?”
“বাজে কথা। কাই তো বলে অন্যরকম’–হঠাৎ বলে উঠল তৃতীয় একটা কণ্ঠস্বর। চমকে উঠলাম আমি। এমন কি যুবরাজ পর্যন্ত চমকে উঠলেন–“একী? তুমি এখনও মরনি বোকেনঘোন? থিবিসে যখন সেবার বিদায় নিলাম তোমার কাছ থেকে, তখনই তো ভেবেছিলাম তুমি এক পা নামিয়েই রয়েছ কবরের ভিতর।”
তাকিয়ে দেখি, এক সুপ্রাচীন বৃদ্ধ। ফোকল্লা মুখে একগাল হেসে সে বলছে।–“কবরে এক পা? কোন দুঃখে? মোটে তো এই একশো সাত বছর বয়স আমার। জন্মেছি তোমার ঠাকুর্দারও যিনি ঠাকুর্দা, সেই প্রথম রামেসিসের আমলে। দ্বিতীয় রামেসিস, অর্থাৎ মহান রামেসিস, অর্থাৎ তোমার ঠাকুর্দার সঙ্গে খেলা করেছি ছেলেবেলায়। এখন আশায় আছি, কবরে পা দেবার আগে তোমার নাতিরও মুখ দেখে যাব। কিন্তু এ-ছেলেটি বাজে ওজর দেখাচ্ছে। ভবিষ্যৎ দর্শনের ক্ষমতা ওর আছে। স্বয়ং কাই বলেছে এ-কথা । আমন দেবতার ওস্তাদ জাদুকর।”
“কে কাই? তিনি আমার সম্পর্কে কী জানেন?”–বিরক্তভাবেই উত্তর দিলাম আমি।
“সকলের সম্পর্কে সকল কথাই জানেন কাই, যেমন জানেন তোমার আর যুবরাজের মধ্যে একটা স্ফটিক পেয়ালা ভাগাভাগির কথা।”
চমকে উঠলাম আমি, চমকে উঠলেন যুবরাজও। আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক হল কাল রাত্রে কি যুবরাজের খাওয়ার ঘরে এদের কোনো চর আত্মগোপন করেছিল?
বোকেনঘোন্সু তখন এসে হাত ধরেছেন আমার, মমির হাতের মতো শীর্ণ শুনো একখানা হাত বাড়িয়ে। আর সেই হাতেরই স্পর্শে একটা যেন বিদ্যুত্তরঙ্গ প্রবাহিত হতে শুরু করেছে আমার ধমনীতে ধমনীতে।