অতঃপর উসার্টি বিদায় নিলেন, বিরক্তি আর ক্রোধ তিলমাত্র গোপন না করে। আর তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেঠি অত্যন্ত তিক্ত হাসি হাসলেন একটু। হেসে আমার পানে চেয়ে বললেন–“উসার্টি না তুলুক, দ্বিতীয় কথাটা যে কী, তা আমি আঁচেই বুঝে নিয়েছি। তুমি শুনতে চাও অ্যানা? শুনলে আমার বা উসার্টির ক্ষতি কিছু নেই। কারণ, শুধু তুমি কেন, মিশরবাসী একটা প্রাণীরও কাল বাকি থাকবে না সে-কথা শুনতে।”
‘যুবরাজ যদি সঙ্গত মনে করেন, বলুন। বললে যে আমি সম্মানিত মনে করব নিজেকে, তাও কি আর যুবরাজকে বলে দিতে হবে?”
“তবে শোন। কথাটা আমার আর উসার্টির বিবাহসংক্রান্ত। ফারাও বংশে ভাইবোনে বিয়ে হয়, তা অবশ্য শুনেছ তুমি?”
“শুনেছি যুবরাজ। এমন একটা ক্ষতিকর প্রথা কেন যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজকুলে এখনও চালু রয়েছে, অনেক চিন্তা করেও তা আমি বুঝতে পারিনি।”
“রাজরক্তের পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য হে! যাতে সাধারণ রক্তের কোনো রকম ভেজাল এসে সে-রক্তে মিশতে না পারে।
“ভেজাল রক্তই হল জোরালো রক্ত, একথা শুনেছি যেন কোথায়—”
‘শুনেছ ঠিকই। কিন্তু রক্তের ব্যাপারে আমরা শুধু পবিত্রতাকেই মূল্য দিয়ে থাকি, জোর-টোর দরকার নেই আমাদের। আমরা তো দেবতা হে, দৈবীশক্তি দিয়েই পৃথিবী শাসন করছি এবং করব। গায়ের জোর, রক্তের জোর–এসবের কাঙাল হয় তারাই, যারা দেবতা নয়।”
এ কথার উত্তরে আমার বলবার অনেক কিছুই ছিল হয়তো, কিন্তু বললে সেটা ধৃষ্টতা হয়ে পড়বে কিনা, বুঝতে পারলাম না। যুবরাজ যে মহৎ, তার অনেক পরিচয়ই আমি ইতিমধ্যে পেয়ে গেছি। কিন্তু এ-কথাও আমার ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ের বয়স কয়েক ঘণ্টা মাত্র, আভিজাত্য সম্পর্কে ওঁর মনে কোনো গর্ব আছে কিনা, এত সামান্য পরিচয়ে সে-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া চলে না। অতএব আমি চুপ করে গেলাম।
যুবরাজ কিন্তু চুপ করে নেই। ঠিক আমাকেই শোনাবার জন্য কিনা, তা বলতে পারি না, তবে নিম্নস্বরে বলে যাচ্ছেন কত কী। হয়তো নিজের মনকেই বোঝাচ্ছেন যে অনিবার্য যা, তা নিয়ে খেদ করা বুদ্ধির কাজ নয়। “দেশাচার, কৌলিক প্রথা, এ-সবের সঙ্গে লড়তে যাওয়া খুবই ঝুঁকির কাজ। ওঁ-বোঝা নিতে হবে কাঁধে তুলে, সেজন্য মন অনেকটা তৈরি হয়েই আছে আমার। একটা চিন্তাই এখন আমার মনে, ভয়ই বলতে পারি তাকে–যা, একটাই এখন ভয় আমার, বিয়ের পরে বনিবনাও হবে না বোধ হয় ওর সাথে। নমুনা তো এখনই দেখতে পাচ্ছি কিনা! সৈনিক খুয়াকার মৃত্যুটাকেই ও বড় করে দেখছে, বৃদ্ধ ইজরায়েলী নাথানের হত্যাকাণ্ডটাকে ও বাতিল করে দিতে চায় মামুলি দুর্ঘটনা বলে।”
হঠাৎ যুবরাজকে আমার দিকে চাইতে দেখে আমি অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে নিবেদন করলাম–“বিয়ের পরে অনেক স্ত্রী স্বামীর ছাঁচে নিজেকে নতুন করে গড়েও নেয় তো!”
“ওঃ, উসার্টি? কক্ষনো তা নেবে না। ভয়ানক জেদী, সাংঘাতিক গোঁয়ার। তার উপরে ও আবার বয়সেও দুই বছরের বড় আমার চেয়ে। তুমি হয়তো জান না। উসার্টি সহোদরা নয় আমার, বৈমাত্রেয় বোন। ওর জন্মের পরেই মারা যান ওর মা। তিনিও ছিলেন এই রাজবংশেরই দুহিতা। সেদিক দিয়ে ওরই আভিজাত্য আমার চেয়ে বেশি বলে ও মনে করে। কারণ আমার মাও রাজকন্যা ছিলেন যদিও, সে-রাজবংশ হল সিরিয়ার, মিশরের নয়।”
আমি আর বলবার মতো কিছু খুঁজে পাই না। অবশ্য আমি কিছু বলব বলে প্রত্যাশাও যুবরাজ করছেন না। কারণ এ একটা এমন সমস্যা, যার ভিতরে মতামত প্রকাশ করতে যাওয়া বাইরের লোকের পক্ষে অনুচিত ও অশোভন। যে মহিলা আজ বাদে কাল মিশরের রানি হবেন, তাঁকে রাখা দরকার সমালোচনার ঊর্ধ্বে।
হঠাৎ যুবরাজ যেন স্বপ্নলোক থেকে বাস্তব জগতে ফিরে এলেন, তটস্থ হয়ে বলে উঠলেন–“আরে, রাত যে দুপুর পেরিয়ে যায়। যাও, যাও, শুয়ে পড়। দেহের উপর দিয়ে ধকল তো কম যায়নি তোমার! কাল আবার ভোরবেলাতেই উঠতে চাও। দরবারে তো তোমাকেও যেতে হবে। ফারাও কী বলছেন, আমি বা কী বলছি, উসার্টি আমেনমেসিসরাও কিছু কিছু বলবেন সবাই, তার উপর রয়েছে বুড়ো শেয়াল ঐ উজির নেহেসি, যে যা বলবে, লিখে নেবে সঙ্গে সঙ্গে। দরবারের নিজস্ব লেখক তো আছেই। তবু ভাবী ফারাও হিসাবে আমারও অধিকার আছে নিজের লেখক দিয়ে সব কথা লিপিবদ্ধ করে নেওয়ার।”
হঠাৎ আমার পানে তাকিয়ে বললেন–“তুমি পারবে তো? খুব তাড়াতাড়ি লিখতে হয় কিন্তু। যাদের অভ্যেস নেই, তাদের পক্ষে কঠিন কাজ। আগেও লেখক ছিল আমার, সে ঠিকমতো কাজ চালাতে পারত না বলে সম্প্রতি পালিয়েছে কাজ ছেড়ে।” বলে হা-হা করে হেসে উঠলেন।
আমি মৃদু হেসে বললাম–“আমি পালাব না যুবরাজ! আপনাদের বরং কথা ) বলতে দেরি হবে, কিন্তু লিখতে আমার দেরি হবে না। আমার নিজের আবিষ্কৃত একটা সাংকেতিক লিখন পদ্ধতি আছে। আমি লিখি না, স্রেফ সাংকেতিক চিহ্ন বসিয়ে যাই প্যাপিরাসে। পরে অবসর সময়ে সেই সব চিহ্নের পাঠোদ্ধার করি। কোনোদিন কেউ ভুল ধরতে পারেনি।”
‘আরে বল কী?”–সোৎসাহে বলে উঠলেন যুবরাজ–“তুমি তো একটি রত্ন দেখছি! কমে তরোয়ালে সমান দক্ষ।
আমি হেসে বললাম–“আমার তরোয়ালের হাত তো দেখেননি যুবরাজ! দেখেছেন একটুখানি কুস্তিবাজি।”
“তা বটে। কিন্তু দুটোই এক গোত্র তো!”