‘ভারি আনন্দ হল, বললেন বৃদ্ধ।
আপনার ভাই, সের্গেই ইভানিচকে জানার সৌভাগ্য হয়েছে আমার’, লম্বা লম্বা নখ সমেত সরু হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন গ্রিনেভিচ।
লেভিন ভুরু কোঁচকালেন, নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে করমর্দন করেই তৎক্ষণাৎ ফিরলেন অবলোনস্কির দিকে। সারা রাশিয়ায় নামকরা সাহিত্যিক তাঁর সৎভাইয়ের প্রতি তাঁর প্রচুর শ্রদ্ধা থাকলেও তাঁকে কনস্তান্তিন লেভিন না বলে বিখ্যাত কজনিশেভের ভাই বলা হলে তিনি সইতে পারতেন না।
না, আমি আর জেমস্তভো’র কর্মকর্তা নই। সবার সাথে ঝগড়াঝাটি করেছি, সভায় আর যাই না’, অবলোনস্কির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন।
‘এত তাড়াতাড়ি! হেসে বললেন অবলোনস্কি, কিন্তু কি করে? কেন?
‘সে এক লম্বা ইতিহাস। বলব পরে এক সময়’, লেভিন এ কথা বললেও সাথে সাথেই ইতিহাসটা জানাতে শুরু করলেন : মানে সংক্ষেপে বললে, জেমস্তভো’র কর্মকর্তা বলে কেউ নেই, থাকতেও পারে না। এমনভাবে উনি বললেন যেন এই মাত্র কেউ তাঁকে আঘাত দিয়েছে, একদিক থেকে ওটা খেলনা, পার্লামেন্ট-পার্লামেন্ট খেলা হচ্ছে, আর আমি তেমন তরুণও নই, তেমন বুড়োও নই যে খেলনা নিয়ে মাতব; অন্য (একটু তোতলালেন তিনি) দিকে এটা উয়েদের দুবৃত্ত দলের পক্ষে টাকা করার একটা উপায়। আগে ছিল তত্ত্বাবধান, বিচারালয়, আর এখন জেমস্তভো, উৎকোচের চেহারায় নয়, বিনা মোগ্যতায় বেতন হিসেবে’, বললেন উনি এত উত্তেজিত হয় যেন উপস্থিতদের কেউ আপত্তি করেছে তার মতামতে।
বটে! তুমি দেখছি আবার নতুন পর্যায়ে, রক্ষণশীল পর্যায়ে’, বললেন অবলোনস্কি, তবে সে কথা হবে পরে।
‘হ্যাঁ, পরে। কিন্তু তোমার সাথে দেখা করা আমার দরকার ছিল, বিদ্বেষের দৃষ্টিতে গ্রিনেভিচের হাতের দিকে তাকিয়ে লেভিন বললেন।
অবলোনস্কি প্রায় অলক্ষ্যে হাসলেন একটু।
‘তুমি যে বড় বলেছিলে আর কখনো ইউরোপীয় পোশাক পরবে না? তাঁর নতুন, স্পষ্টতই ফরাসি কাটের পোশাকের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, বটে! দেখছি নতুন পর্যায়!
হঠাৎ লাল হয়ে উঠলেন লেভিন, বয়স্ক লোকেরা যেভাবে লাল হয়ে হয়ে ওঠে নিজেরাই তা লক্ষ না করে, তেমন নয়, যেভাবে লাল হয়ে ওঠে বালকেরা, যখন তারা টের পায় যে তাদের সংকোচপরায়ণতায় তারা হাস্যকর, তার ফলে লজ্জা পেয়ে লাল হয়ে ওঠে আরো বেশি, প্রায় কান্না এসে যায়। আর এই বুদ্ধিমান পুরুষালী মুখখানাকে শিশুদের দশায় দেখতে পাওয়া এত বিচিত্র যে তার দিকে অবলোনস্কি আর তাকালেন না।
লেভিন বললেন, ‘তা কোথায় দেখা হবে? তোমার সাথে কথা বলা আমার কাছে খুবই জরুরি।’
অবলোনস্কি যেন চিন্তায় ডুবে গেলেন।
‘শোন, চল গুরিনের ওখানে প্রাতরাশ সারতে, সেখানে কথা হবে। তিনটা পর্যন্ত আমি ফাঁকা।
একটু ভেবে লেভিন বললেন, না, আমাকে তো আবার যেতে হবে।’
‘তা বেশ, তাহলে একসাথে লাঞ্চ করা যাক।
লাঞ্চ আমার যে দরকার শুধু দুটো কথা বলা, আর আলোচনা করা যাবে পরে।
‘তাহলে এখনই কথা দুটো বলে ফ্যালো, লাঞ্চে আবার আলাপ কি।
কথা দুটো এই’, বললেন লেভিন, তবে বিশেষ কিছু নয়।
মুখখানায় ওঁর হঠাৎ আক্রোশ ফুটে উঠল, যেটা দেখা দিয়েছে নিজের সংকোচশীলতা দমনের প্রয়াসে।
উনি বললেন, ‘শ্যেরবাৎস্কিরা কি করছে? সব আগের মতই?’
বহুদিন থেকে লেভিন তার শ্যালিকা কিটির প্রেমাসক্ত, সেটা জানা থাকায় অবলোনস্কি সামান্য হাসলেন, চোখ তার আমোদে চকচক করে উঠল।
‘তুমি বললে দুটো কথা, কিন্তু দুটো কথায় আমি জবাব দিতে পারব না, কেননা…মাপ কর, এক মিনিট…’.
অন্তরঙ্গতা মেশা সম্মান দেখিয়ে ঘরে ঢুকল সেক্রেটারি, সমস্ত সেক্রেটারির পক্ষেই যা সাধারণ, কর্তার চেয়ে সে, যে কাজটা ভালো বোঝে তেমন একটা বিনীত চেতনাসহ, কাগজপত্র নিয়ে সে গেল অবলোনস্কির কাছে এবং প্রশ্নের আড়ালে কি একটা মুশকিলের কথা বোঝাতে শুরু করল। অবলোনস্কি সেটা পুরো না শুনে সস্নেহে তাঁর হাত রাখলেন সেক্রেটারির আস্তিনে।
না, আমি যা বলেছিলাম তাই করুন’, হাসিতে তার মন্তব্যটাকে নরম করে তিনি বললেন, এবং ব্যাপারটা তিনি কিভাবে বুঝছেন সেটা ব্যাখ্যা করে কাগজগুলো সরিয়ে দিয়ে বললেন, এই করুন অনুগ্রহ করে, এই ধারায়, জাখার নিকিতিচ।
অপ্রস্তুত হয়ে সেক্রেটারি চলে গেল। তার সাথে যখন কথাবার্তা হচ্ছিল, লেভিন তার মধ্যে তাঁর সংকোচ সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠে চেয়ারে দু’হাতের কনুই ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, মুখে তার দেখা দিয়েছিল বিদ্রুপাত্মক মনোযোগ। বললেন, বুঝি না, একেবারে বুঝি না।
‘কি বুঝতে পারছ না?’ তেমনি আমুদে হাসি হেসে, সিগারেট বের করে বললেন অবলোনস্কি। লেভিনের কাছ থেকে তিনি কোন একটা বিদঘুঁটে কাণ্ড আশা করছিলেন।
‘কি যে তোমরা করে যাচ্ছ কিছুই বুঝি না, লেভিন কাঁধ কুঁচকে বললেন। গুরুত্বসহকারে এটা তুমি করতে পারো কি করে?
কি জন্য?’
‘এজন্য যে, করার কিছু নেই।
‘তুমি তাই ভাবছ, কিন্তু আমরা কাজে আকণ্ঠ ডুবে আছি।
‘কাগজে ডুবে আছ। তা এ ব্যাপারে তোমার গুণ আছে বৈকি, যোগ করলেন লেভিন।
তার মানে তুমি ভাবছ আমার কোন একটা ঘাটতি আছে?’
হয়ত সত্যিই আছে’, লেভিন বললেন। ‘তাহলেও তোমার উদারতায় আমি মুগ্ধ হই এবং গর্ববোধ করি যে এমন উদার মানুষ আমার বন্ধু। কিন্তু তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দিলে না’, অবলোনস্কির চোখে চোখে তাকাবার মরিয়া চেষ্টা করে তিনি যোগ দিলেন।