‘কোথায় সে?
হয়ত বারান্দায় বেরিয়েছে। না হলে এখানেই তো কেবলি ঘোরাঘুরি করছিল। এই যে ওই লোকটা, কোঁকড়া দাড়িওয়ালা বলিষ্ঠগঠন বৃষ একজনকে দেখিয়ে বলল দারোয়ান। লোকটা তার ভেড়ার লোমের টুপি না খুলেই ক্ষিপ্র এবং লঘু পায়ে পাথুরে সিঁড়ির ক্ষয়ে যাওয়া ধাপগুলো বেয়ে ছুটে উঠল ওপরে। একজন রোগাটে রাজপুরুষ পোর্টফোলিও হাতে নিচে নামছিলেন, অননুমোদনের ভাব করে তিনি ছুটন্ত লোকটার পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন অবলোনস্কির দিকে।
অবলোনস্কি সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধেয়ে-আসা লোকটাকে চিনতে পেরে নক্শা-তোলা কলারের ওপর তাঁর ভালোমানুষি জ্বলজ্বলে মুখখানা আরো জ্বলজ্বল করে উঠল।
তার দিকে এগিয়ে আসা লেভিনের দিকে তাকিয়ে বন্ধুসুলভ ঠাট্টামিশ্রিত হাসি হেসে তিনি বলে উঠলেন, তাই তো বটে! শেষ পর্যন্ত দেখা দিল লেভিন!’ বন্ধুর সাথে করমর্দন বিনিময়ে যেন আশ মিটছিল না তার, লেখিনকে চুম্বন করে বললেন, ‘এই চোরের আড্ডায় আমাকে খুঁজতে আসতে তোমার গা ঘিনঘিন করল না যে বুড়ো?
‘আমি এইমাত্র এসেছি। তোমার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, লেভিন বললেন সসংকোচে, সেইসাথে রাগত আর অস্বস্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন চারদিক।
বন্ধুর আত্মাভিমানী রুষ্ট সংকোচের কথা জানা থাকায় অবলোনস্কি নাও, চলো যাই কেবিনেটে’ বলে তাকে নিয়ে গেলেন যেন বিপদ-আপদের মাঝখান দিয়ে।
পরিচিত প্রায় সকলের সাথেই অবলোনস্কির ‘তুমি’ সম্পর্ক ও ষাট বছরের বুড়ো, বিশ বছরের ছোকরা, অভিনেতা, মন্ত্রী, বেনিয়া-কারবারী, জেনারেল-অ্যাডজুট্যান্ট–সকলের সাথেই, তাঁর ‘তুমি’ সম্পর্কিত অনেকেই ছিল সামাজিক সোপানের দুই চরম প্রান্তে এবং অবলোনস্কির সাথে তাদের সাধারণ কিছু একটা আছে জেনে খুবই অবাক হত। যার সাথেই তিনি শ্যাম্পেন খেতেন তার সাথেই তার ‘তুমি’ সম্পর্ক, আর শ্যাম্পেন তিনি খেতেন সকলের সাথেই, তাই অফিসে নিজের অধীনস্থদের সামনে সংকুচিত ‘তুমি’র ঠাট্টা করে তিনি তাঁর অনেক বন্ধুদের যা বলতেন–সাথে সাক্ষাতের সময় তাঁর প্রকৃতিগত উপস্থিত বুদ্ধিতে অধীনস্থদের এই প্রসঙ্গে অপ্রীতিকর অনুভূতিটা হ্রাস করে আনতে পারতেন। লেভিন সংকুচিত ‘তুমি’র দলে ছিলেন না, কিন্তু অবলোনস্কি তাঁর সহজাত লোকচরিত্রবোধে অনুভব করছিলেন যে তার অধীনস্থদের সমক্ষে তাঁর ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ করতে না চাইতেও পারেন বলে লেভিন ভাবছেন, তাই তাড়াতাড়ি করে তাকে নিয়ে গেলেন কেবিনেটে।
লেভিন অবলোনস্কির প্রায় সমবয়সী, তাই তার সাথে ‘তুমি’ সম্পর্কটা শুধু শ্যাম্পেনের সুবাদে নয়। প্রথম যৌবন। থেকেই লেভিন তাঁর সাথী ও বন্ধু। চরিত্র ও রুচিতে পার্থক্য সত্ত্বেও তারা ভালোবাসতেন পরস্পরকে, যেমন প্রথম যৌবনে মিলিত বন্ধুরা পরস্পরকে ভালোবাসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়াকলাপের পথ নেওয়া লোকদের ক্ষেত্রে প্রায়ই যা হয়ে থাকে, অপরের কাজ বিচার করে তাকে সঙ্গত প্রতিপন্ন করলেও মনে মনে সেটাকে তারা ঘৃণা করে। প্রত্যেকেরই মনে হত যে জীবন, সে নিজে অতিবাহিত করছে সেটাই আসল জীবন, আর বন্ধুর জীবনটা কেবল ছায়ামূর্তি। লেভিনকে দেখে অবলোনস্কি ঈষৎ ঠাট্টা-মেশা হাসি চাপতে পারলেন না। গ্রাম থেকে মস্কোয় এলে কতবার তার সাথে দেখা হয়েছে, গ্রামে লেভিন কি একটা করছিলেন, কিন্তু ঠিক কি সেটা অবলোনস্কি কখনো ভালো করে বুঝে উঠতে পারেননি, তাছাড়া তাতে তার আগ্রহও ছিল না। লেভিন মস্কো আসতেন সব সময়ই উত্তেজিত, ব্যস্তসমস্ত হয়ে, কিছুটা সংকোচবোধ নিয়ে আর সে সংকোচবোধে বিরক্ত হয়ে ওঠে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সব কিছু দেখতেন একটা নতুন অপ্রত্যাশিত দৃষ্টিতে। এসবে হাসতেন অবলোনস্কি এবং ভালোবাসতেন এসব। ঠিক তেমনি লেভিনও মনে মনে বন্ধুর নাগরিক জীবনযাত্রা আর তাঁর কাজ–দুইই ঘৃণা করতেন, ও কাজটাকে তিনি মনে করতেন বাজে, হাসতেন তা নিয়ে। কিন্তু তফাৎটা এই যে লোকে যা করে তা সব কিছু করে অবলোনস্কি হাসতেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে এবং ভালো মনে আর লেভিনের আত্মবিশ্বাস ছিল না, মাঝে মাঝে রেগেও উঠতেন।
কেবিনেটে ঢুকে লেভিনের হাত ছেড়ে দিয়ে এবং তাতে করে এখানে আর বিপদ নেই এটা যেন বুঝিয়ে অবলোনস্কি বললেন, ‘আমরা অনেকদিন তোমার অপেক্ষায় আছি। ভারি, ভারি আনন্দ হল তোমাকে দেখে। কিন্তু কি ব্যাপার? কেমন আছো? এলে কবে?
লেভিন চুপ করে তাকিয়ে রইলেন তাঁর কাছে অপরিচিত অবলোনস্কির দু’বন্ধুর মুখের দিকে, বিশেষ করে ভারি লম্বা লম্বা সাদা আঙুল, ডগার দিকে বেঁকে যাওয়া হলদে হলদে নখ আর কামিজের বিরাট ঝকঝকে কফ-
বোম সমেত মার্জিত গ্রিনেভিচের হাতের দিকে, যে হাত দুখানা তাঁর সমস্ত মনোযোগ গ্রাস করেছে, চিন্তার ফুরসৎ দিচ্ছে না। অবলোস্কি তৎক্ষণাৎ সেটা লক্ষ্য করে হাসলেন। বললেনঃ
‘ও হ্যাঁ, পরিচয় করিয়ে দিই। আমার সাথি ও ফিলিপ ইনিচ নিকিতিন, মিখাইল স্তানিস্লাভিচ গ্রিনেভিচ,–আর লেভিনের দিকে ফিরে–জেমস্থভো’র কর্তকর্তা, জেমস্তুভো’র নতুন আমলের লোক, ব্যায়ামবীর–এক হাতে পাঁচ পুদ ওজন তোলেন, পশুপালক, শিকারী এবং আমার বন্ধু কনস্তান্তিন দৃমিত্রি লেভিন, সের্গেই ইনিচ কনিশেভের ভাই।