মস্কো আর পিটার্সবুর্গের অর্ধেকই ছিল অবলোনস্কির আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব। যেসব লোকের পরিবেশে তাঁর জন্ম, তাঁরা ছিলেন এবং হয়ে ওঠেন ইহজগতে প্রতিপত্তিশালী। সরকারি লোকদের এক-তৃতীয়াংশ যারা বৃদ্ধ, তাঁর ছিলেন তাঁর পিতার সুহৃদ, ওঁরা তাঁকে জানতেন তার বাল্যাবস্থা থেকে দুই-তৃতীয়াংশের সাথে তার তুমি বলে ডাকার সম্পর্ক, আর তৃতীয়দের সাথে তার পরিচয় ছিল ভালো; সুতরাং চাকরি, পারমিট ইত্যাদির বিতরণকারীরা স্বজনকে এড়িয়ে যেতে পারত না; একটা মোটা চাকরি পাবার জন্য অবলোনস্কিরও চেষ্টা করার প্রয়োজন ছিল না; তেমন প্রয়োজন ছিল শুধু আপত্তি না করা, ঈর্ষা না করা, ঝগড়া না বাধানো, আহত বোধ না করা, তাঁর প্রকৃতিগত সদয়তায় এটা তিনি কখনোই করেননি। কেউ যদি ওঁকে বলত যে ওঁর দরকারমত বেতনের কোন চাকরি তিনি পাবেন না, আরো এই জন্য যে বেশি বহরের দাবি তিনি করেননি, তাহলে সেটা তাঁর কাছে হাস্যকরই মনে হত; তার সমবয়সীরা যা পায় তিনি শুধু তাই পেতে চাইতেন, আর একই ধরনের কাজ তিনি করতেন অন্য কারো চেয়ে খারাপ নয়।
পরিচিতরা স্তিভা অবলোনস্কিকে ভালোবাসততা কেবল তার সদাশয়, হাসি-খুশি স্বভাব আর সন্দেহাতীত সততার জন্যই নয়, তার ভেতরে, তার সুদর্শন, সমুজ্জ্বল চেহারা, জ্বলজ্বলে চোখ, কালো ভুরু, চুল, মুখের শ্বেতাভা আর রক্তিমাভায় এমন কিছু ছিল যা লোকের ওপর আনন্দ প্রীতির একটা শারীরিক প্রভাব ফেলত। ওঁর সাথে দেখা হলে লোকে প্রায় সব সময়ই খুশির হাসিতে বলে উঠত, ‘আরে স্তিভা যে! অবলোনস্কি! সেই লোক! কখনো কখনো তার সাথে আলাপের পর দেখা গেল তেমন আনন্দের কিছু ঘটত না। তাহলেও তার পরের দিন, তৃতীয় দিনে তার সাথে দেখা হওয়ায় একই রকম খুশি হয়ে উঠত সবাই।
তিন বছর মস্কোর একটা অফিসে অধিকর্তার পদে থেকে অবলোনস্কি তাঁর সহকর্মী, অধীনস্থ, বড় সাহেব এবং তার সাথে যাদের সম্পর্ক ছিল তাদের সবার কাছ থেকে শুধু ভালোবাসাই নয়, শ্রদ্ধাও অর্জন করেছিলেন। চাকরির ক্ষেত্রে এই সর্বজনীন শ্রদ্ধা অবলোনস্কি পেয়েছিলেন যে প্রধান গুণাবলির সুবাদে, তা হল প্রথমত, নিজের ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন থাকায় অন্য লোকদের প্রতি প্রশ্রয়দান; দ্বিতীয়ত, একান্ত উদারনৈতিকতা, যা তিনি খবরের কাগজে পড়েছেন তা নয়, যা মিশে আছে তার রক্তে, যার দরুন অবস্থা ও পদ নির্বিশেষে সমস্ত লোকের সাথে তার ব্যবহার একেবারে একইরকম, আর তৃতীয়ত, যেটা প্রধান কথা, যে কাজ তিনি করছেন তার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীনতা, ফলে কখনো তিনি তাকে মেতে ওঠেননি এবং ভুল করেননি।
অবলোনস্কি চাকরিস্থলে এলে সম্ভ্রান্ত চাপরাশি তাঁকে এগিয়ে দিল, পোর্টফোলিও নিয়ে তিনি গেলেন তার ছোট কেবিনেটে, উর্দি চাপিয়ে এলেন অফিসে। কেরানি কর্মচারীরা সবাই উঠে দাঁড়াল, মাথা নোয়াল সানন্দে, সসম্মানে। অবলোনস্কি বরাবরের মত তাড়াতাড়ি করে গেলেন তার জায়গায়, সদস্যদের সাথে করমর্দন করে আসন নিলেন। কিছু রসিকতা করলেন, কথা বললেন ঠিক যতটা ভদ্রতাসম্মত হয় ততটা, তারপর কাজে মন দিলেন। স্বাধীনতা, সহজতা আর সানন্দে কাজ চালাবার জন্য যে আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন তাদের ভেতরকার সীমারেখাটা অবলোনস্কির চেয়ে সঠিকভাবে আর কেউ খুঁজে পেত না। অবলোনস্কির অফিসের সবার মতই স্মিত সসম্মানে কাগজপত্র নিয়ে এগিয়ে এল সেক্রেটারি এবং কথা বলল সেই অন্তরঙ্গ-উদারনৈতিক সুরে যার প্রবর্তন করেছিলেন অবলোনস্কি :
‘শেষ পর্যন্ত আমরা পেনজা গুবেনিয়ার কর্তাদের কাছ থেকে খবর পেয়েছি। এই যে, চলবে…’
‘পেয়েছেন তাহলে?’ কাগজটায় আঙুল দিয়ে বললেন অবলোনস্কি, তাহলে সাহেবরা…’ শুরু হল অফিসের কাজ।
রিপোর্ট শোনার সময় অর্থময় ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে তিনি ভাবলেন, যদি ওদের জানা থাকত আধ ঘন্টা আগে কি দোষী বালকই না হতে হয়েছিল সভাপতিকে!’ চোখ ওঁর হাসছিল। না থেমে কাজ চলার কথা বেলা দুটো পর্যন্ত। বেলা দুটোয় বিরতি আর আহার।
দুটো তখনো হয়নি, এমন সময় অফিস-কক্ষের কাঁচের বড় দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল এবং কে যেন ভেতরে ঢুকল। মনোযোগ বিক্ষেপে খুশি হয়ে পোর্ট্রেটের নিচে থেকে, আয়নার পেছন থেকে সমস্ত সভ্য চাইল দরজার দিকে; কিন্তু দরজার কাছে দণ্ডায়মান দারোয়ান তখনই আগন্তুককে বার করে দিল এবং কাঁচের দরজাটা বন্ধ করে দিল।
মামলাটা পড়া শেষ হলে অবলোনস্কি টানটান হয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং একালের উদারনৈতিকতার আদর্শে অঞ্জলি দিয়ে সিগারেট বের করে চললেন তার কেবিনেটে। তার দুজন বন্ধু পুরানো কর্মচারী নিকিতিন আর দরবারে পদস্থ গ্রিনেভিচও বেরোলেন তার সাথে।
অবলোনস্কি বললেন, ‘খাবারের পর শেষ করে ওঠা যাবে।
খুব পারা যাবে!’ বললেন নিকিতিন।
‘আর এই ফোমিনটি একটা তোফা হারামজাদা নিশ্চয়’, যে মামলাটা ওরা দেখছেন তাতে জড়িত জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করলেন গ্রিনেভিচ।
গ্রিনেভিচের কথায় অলোঙ্কি মুখ কোঁচকালেন, তাতে করে বুঝিয়ে দিলেন যে, আগেভাগেই রায় দিয়ে দেওয়া অশোন, তবে ওঁকে কিছু বললেন না।
তিনি দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, কে ঢুকেছিল?
‘কে-একজন লোক হুজুর জিজ্ঞাসাবাদ না করেই ঢুকে পড়ছিল, শুধু আমি ঘুরে দাঁড়াই। আপনাকে চাইছিল। বললাম : সদস্যরা যখন বেরোবেন তখন…’