তিনি বললেন, কি ভয়ঙ্কর! ভয়ঙ্কর!
এই সময় অন্য ঘরে, সম্ভবত পড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল শিশু; দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা কান পেতে শুনলেন, মুখখানা তার হঠাৎ নরম হয়ে এল। বোঝা যায় কয়েক সেকেন্ড লাগল তার চেতনা ফিরতে, যেন বুঝতে পারছিলেন না কোথায় তিনি আছেন, কি তাকে করতে হবে, তারপর দ্রুত উঠে গেলেন দরজার দিকে।
‘আমার ছেলেটাকে ও যে ভালোবাসে, শিশুর চিৎকারে ওঁর মুখের ভাব পরিবর্তন লক্ষ্য করে স্বামী ভাবলেন, : ‘আমার ছেলে; কি করে সে ঘৃণা করতে পারে আমাকে?
তিনি স্ত্রীর পিছু পিছু গিয়ে বললেন, ‘ডল্লি, আরো একটা কথা।’
‘আপনি যদি আমার পেছন পেছন আসেন, তাহলে আমি লোকদের, ছেলেমেয়েদের ডাকব! সবাই জানুক যে আপনি একটা বদমায়েস। আজ আমি চলে যাব আর আপনি এখানে থাকবেন আপনার প্রণয়িনীর সাথে!
দড়াম করে দরজা বন্ধ করে উনি বেরিয়ে গেলেন।
অবলোনস্কি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, মুখ মুছলেন, মৃদু পায়ে গেলেন ঘর বরাবর। মাতভেই বলছে ঠিক হয়ে যাবে; কিন্তু কেমন করে? এমন কি তার লক্ষণও আমি দেখছি না। উহ্, কি ভয়ংকর! আর কি হেঁদোভাবেই না চেঁচাল, চিৎকার আর বদমায়েশ ও প্রণয়িনী কথা দুটো স্মরণ করে মনে মনে ভাবলেন তিনি, হয়ত-বা মেয়েগুলোর কানে গেছে! সাংঘাতিক, ছেঁদো, সাংঘাতিক!’ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলেন অবলোনস্কি, চোখ মুছলেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বুক টান করে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
দিনটা শুক্রবার, ডাইনিংরুমে জার্মান ঘড়ি-বরদার দম দিচ্ছিল ঘড়িতে। এই টেকো জার্মান ঘড়ি-বরদার সম্পর্কে নিজের রসিকতাটা মনে পড়ল তাঁর : ঘড়িতে দম দেওয়ার জন্য জার্মানটিকেই দম দেওয়া হয়েছে সারা জীবনের জন্য, মুখে হাসি ফুটল। ভালো ভালো রসিকতা অবলোনস্কি ভালোবাসতেন। আর হয়ত ঠিক হয়েই যাবে! ঠিক হয়ে যাবে–বেশ কথাটি’, ভাবলেন তিনি, তা বলতেই হবে।’
মাতভেই! হাঁক দিলেন তিনি। মাতভেই আসতে বললেন, তাহলে আন্না আর্কাদিয়েভনার জন্য সোফার ঘরে সব গোছগাছ করে রাখ।
‘জ্বি আচ্ছা।’
অবলোনস্কি তার কোট চাপিয়ে গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।
মাতভেই তাকে এগিয়ে দিতে এসে জিজ্ঞেস করল, বাড়িতে যাবেন না?’
‘যেমন দাঁড়াবে। হ্যাঁ, এই নে খরচার জন্য, মানিব্যাগ থেকে বের করে দশ রুল ওকে দিয়ে বললেন তিনি। ‘এতে হবে তো?
‘হোক না-হোক, দেখা যাবে, চালিয়ে নিতে হবে, এই বলে গাড়ির দরজা বন্ধ করে মাতভেই গাড়ি বারান্দায় উঠে এল।
ইতিমধ্যে ছেলেটাকে শান্ত করে গাড়ির শব্দে দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা বুঝলেন যে উনি চলে গেলেন। আবার নিজের শোবার ঘরে ফিরলেন তিনি। বেরোতেই যেসব সাংসারিক ঝামেলা হাজির হত, তা থেকে এটাই ছিল তাঁর একমাত্র আশ্রয়। এমন কি এখনো, অল্প সময়ের জন্য যখন তিনি শিশুদের ঘরে গিয়েছিলেন, ইংরেজ মহিলাটি আর মাত্রেনা ফিলিমনোভনা তার ভেতর এমন কিছু ব্যাপার তাঁকে জিজ্ঞেস করে ওঠার ফুরসত করে নিলেন যা মুলতবি রাখা যায় না এবং একমাত্র তিনি যার উত্তর দিতে পারেন : বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্য বাচ্চাদের কি পোশাক পরানো হবে? দুধ খেতে দেব কি? অন্য একটা বাবুর্চি ডাকলে হয় না?
‘আহ, আমাকে রেহাই দাও, রেহাই দাও!’ এই বলে তিনি ফিরলেন শোবার ঘরে। স্বামীর সাথে যেখানে বসে কথা কয়েছিলেন আবার বসলেন সেই চেয়ারেই, অস্থিল আঙুল থেকে খসে পড়ো-পড়া কয়েকটা আংটি সমেত হাত জড়ো করে মনে করতে লাগলেন ভূতপূর্ব কথাবার্তাটা। চলে গেল! কিন্তু তার সাথে দেখা করবে? কেন জিজ্ঞেস করলাম না ওকে? না-না, মিলন চলে না। আমরা যদি এক বাড়িতেও থাকি, তাহলেও আমরা হব বাইরের লোক। বরাবরের মত বাইরের লোক!’ তার কাছে ভয়ংকর এই কথাটায় বিশেষ অর্থ দিয়ে তিনি আবার পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘আর কি ভালোই না তাকে বেসেছিলাম, ভালোবেসেছিলাম…সৃষ্টিকর্তা, কি ভালোই না বেসেছিলাম। আর এখন কি ওকে ভালোবাসি না? আগের চেয়ে বেশি ভালোবাসি না কি? কিন্তু সবচেয়ে যেটা ভয়ংকর…’ নিজের চিন্তা শুরু করলেও সেটা শেষ হল না, কেননা মাত্রেনা ফিলিমনোভনা ঢুকল দরজা দিয়ে।
বলল, আমার ভাইকে ডেকে আনার হুকুম দিন। সে খাবার রান্না করে দেবে। না হলে গতকালের মত ছেলেমেয়েরা না খেয়ে থাকবে।’
‘ঠিক আছে, আমি এখনই বেরিয়ে সব দেখছি। হ্যাঁ, টাটকা দুধের জন্য লোক পাঠানো হয়েছে?
এবং ডলি সংসারের নানা কাজে ডুবে গিয়ে তাতে নিজের দুঃখ সাময়িকভাবে ভুলে গেলেন।
আন্না কারেনিনা – ১.৫
পাঁচ
অবলোনস্কি ভালো মেধা থাকার দরুন স্কুলে পড়াশুনা করেছিলেন ভালোই। কিন্তু আলসে আর দুরন্ত হওয়ায় পাশ করে বেরোন শেষ সারিতে; কিন্তু সব সময় আড্ডা মেরে বেড়ানো জীবন, অনুচ্চ র্যাঙ্ক আর অপ্রবীণ বয়স সত্ত্বেও মস্কোর একটা সরকারি অফিসে চাকরি পেয়েছিলেন ভালো বেতনের। চাকরিটা পেয়েছিলেন তাঁর বোন আন্নার স্বামী আলেকসেই আলেক্সান্দ্রভিচ কারেনিন-এর সাহায্যে। তিনি মন্ত্রীদপ্তরে একজন পদস্থ ব্যক্তি, অফিসটি এই দপ্তরেরই অধীনে। কারেনিন তার শ্যালককে এই চাকরিটা না দিলেও শত শত অন্য লোক, ভাই-বোন, নিকট-আত্মীয় মারফত এই চাকরিটাই অথবা হাজার ছয়েক বেতনের অমনি একটা চাকরিই তিনি পেতেন, যা তার দরকার ছিল। কেননা স্ত্রীর যথেষ্ট সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও তাঁর হাল দাঁড়িয়েছিল খারাপ।