স্বামীকে দেখে তিনি শিফোনিয়েরকার ড্রয়ারে হাত ঢোকালেন যেন কি খুঁজছেন আর তার দিকে তাকালেন শুধু যখন স্বামী এসে পড়লেন একেবারে কাছে। কিন্তু যে মুখখানায় তিনি একটা কঠোর, অনমনীয় ভাব ফোঁটাতে চেয়েছিলেন, তাতে ফুটল বিহ্বলতা আর যাতনা।
‘ডল্লি! স্বামী বললেন মৃদু, ভীরু ভীরু গলায়। মাথাটা তিনি কাঁধের দিকে খুঁজলেন, চেয়েছিলেন একটা করুণ বশংবদ চেহারা দাঁড় করাবেন, তাহলেও জ্বলজ্বল করছিলেন তাজা আমেজ আর স্বাস্থ্যে। ক্ষিপ্ৰ দৃষ্টিপাতে তার জ্বলজ্বলে সতেজ স্বাস্থ্যবান মূর্তিটা ডল্লি আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। হ্যাঁ, ও সুখী, সন্তুষ্ট! ভাবলেন তিনি, আর আমি…আর ওর এই সদয়তাটাও বিছিরি যার জন্য সবাই ভালোবাসে তাকে, প্রশংসা করে, দেখতে পারি না ওর এই সদয়তা, ভাবলেন তিনি। বিবর্ণ, স্নায়বিক মুখের ডান দিককার পেশী কেঁপে উঠে ওর ঠোঁট চেপে বসল।
কি চাই আপনার?’ বললেন তিনি নিজের স্বাভাবিক নয়, দ্রুত, জোরালো গলায়।
‘ডল্লি! কাঁপা কাঁপা গলায় পুনরুক্তি করলেন স্বামী, আন্না আজ আসছে।
‘তাতে আমার কি? আমি ওকে বরণ করতে পারব না!’ চেঁচিয়ে উঠলেন উনি।
‘কিন্তু করতে হয় যে, ডল্লি…’
‘চলে যান, চলে যান, চলে যান! চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, যেন চিৎকারটা এল দৈহিক কোন যন্ত্রণা থেকে।
স্ত্রীর কথা মনে পড়ে শান্ত থাকতে পারতেন অবলোনস্কি, আশা করতে পারতেন যে মাততেইয়ের কথামত সব ঠিক হয়ে যাবে, এবং নিশ্চিন্তে কাগজ পড়তে আর কফি খেতে পারতেন; কিন্তু যখন তিনি দেখলেন স্ত্রীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট, আর্ত মুখ, শুনলেন ভাগ্য ও হতাশার কাছে আত্মসমর্পিত এই কণ্ঠধ্বনি তখন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল তার, গলায় কি যেন দলা পাকিয়ে উঠল, অশ্রুতে চোখ চিকচিক করে উঠল।
‘হায় সৃষ্টিকর্তা! এ আমি কি করলাম! ডল্লি! সৃষ্টিকর্তার দোহাই!…এ যে…’ কথাটা তিনি শেষ করতে পারলেন না, গলায় দেখা দিল একটা ফোঁপানি।
স্ত্রী শিফোনিয়েরকার ড্রয়ার বন্ধ করে তাকালেন তার দিকে।
‘ডল্লি, কি আর বলব? শুধু একটা কথা; ক্ষমা কর আমাকে ক্ষমা কর…ভেবে দেখো, নয় বছরের জীবনে কি এক মিনিট, এক মিনিটের খণ্ডন হয় না…’
চোখ নিচু করে স্ত্রী শুনে গেলেন, যেন অনুনয় করছিলেন স্বামী কোনরকমে তার সন্দেহ নিরসন করুক।
স্বামী বললেন, ‘এক মিনিটের মোহ…’ এবং আরো বলে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু এই কথাটাতেই যেন শারীরিক যন্ত্রণায় আবার চেপে বসল স্ত্রীর ঠোঁট, আবার মুখের ডান দিকে কেঁপে উঠল গালের পেশী।
‘চলে যান, চলে যান এখান থেকে!’ আরো তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, আপনার মোহ আর জঘন্যতার কথা আমাকে বলতে আসবেন না!
চলে যেতে চাইছিলেন তিনি, কিন্তু শরীর দুলে উঠল, ভর দেবার জন্য চেয়ারের পিঠটা ধরলেন। স্বামীর মুখ স্ফীত হয়ে উঠল, ফুলে উঠল ঠোঁট, অশ্রুতে সজল হয়ে উঠল চোখ।
‘ডল্লি!’ ফুঁপিয়ে বললেন তিনি, সৃষ্টিকর্তার দোহাই, ছেলেমেয়েদের কথা ভাবো। ওদের তো দোষ নেই, দোষী আমি, আমাকে শাস্তি দাও, সে দোষ স্থালন করতে বলে। আমি যতটা পারি, সব কিছুর জন্য আমি তৈরি! আমি দোষী, কতটা যে দোষী বলার নয়। কিন্তু ডল্লি, ক্ষমা কর।
স্ত্রী বসলেন। ওঁর গুরুভার, সজোর নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসছিল স্বামীর, স্ত্রীর জন্য অবর্ণনীয় মায়া হল তার। স্ত্রী কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। স্বামী অপেক্ষা করে রইলেন।
‘ছেলেমেয়েদের কথা তুমি ভাবছ ওদের সাথে খেলা করার জন্য, আর আমি ভাবছি আর জানি যে ওরা এবার মারা পড়ল’, বললেন স্ত্রী, বোঝা যায় এ তিন দিন একাধিক বার যেসব কথা তিনি মনে মনে বলেছেন, এটা তার একটা।
উনি বললেন, ‘তুমি’, এতে স্বামী কৃতার্থে মত চাইলেন ওঁর দিকে, এগিয়ে গেলেন ওঁর হাতটা ধরতে, কিন্তু উনি ঘৃণাভরে সরে গেলেন।
‘ছেলেমেয়েদের কথা আমার মনে হচ্ছে, তাই ওদের বাঁচাবার জন্য দুনিয়ায় সব কিছু করতে পারতাম; কিন্তু আমি নিজেই জানি না কি করে বাঁচাই; বাবার কাছ থেকে ওদের নিয়ে গিয়ে কি, নাকি ব্যভিচারী বাপের কাছে রেখে যেয়ে হ্যাঁ, ব্যভিচারী বাপ…বলুন তো, যা… ঘটেছে তার পরে কি আমাদের একসাথে থাকা সম্ভব? সে কি সম্ভব? বলুন-না, সে কি সম্ভব? গলা চড়িয়ে আবার বললেন তিনি, আমার স্বামী, আমার ছেলেমেয়েদের বাবা নিজের ছেলেমেয়েদের গভর্নেসের সাথে প্রেম সম্পর্কে যানার পর…’
‘কিন্তু কি করা যায়? কি করা যায়? স্বামী বললেন করুণ স্বরে, নিজেই জানতেন না কি বলছেন, ক্রমেই নুয়ে এল তার মাথা।
‘আমার কাছে আপনি একটা নচ্ছার লোক, ন্যক্কারজনক!’ ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে চেঁচালেন স্ত্রী, আপনার কান্না নেহাৎ পানি! কখনো আমাকে ভালোবাসেননি আপনি; আপনার হৃদয়ও নেই, উদারতাও নেই! আমার কাছে আপনি একটা নচ্ছার, নীচ, বাইরের লোক, হ্যাঁ, একেবারে বাইরের লোক! এই ভয়ঙ্কর বাইরের লোক’ কথাটা উনি উচ্চারণ করলেন যন্ত্রণায় আর আক্রোশে।
অবলোনস্কি স্ত্রীর দিকে তাকালেন আর তাঁর মুখে ফুঠে ওঠা আক্রোশ তাঁকে ভীত ও বিস্মিত করল। উনি বোঝেননি যে ওঁর মায়াটার স্ত্রীর পিত্তি জ্বলে গেছে। এতে তিনি দেখছেন অনুকম্পা, প্রেম নয়। আমাকে ও ঘৃণা করে। ক্ষমা করবে না, ভাবলেন স্বামী।