পত্রিকা পড়া, দ্বিতীয় পাত্র কফি আর মাখন-লাগানো মিহি কুটি শেষ করে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ওয়েস্ট-কোট থেকে ঝেড়ে ফেললেন রুটির গুড়ো। ঝেড়ে ফেলে চওড়া বুক টান করে আনন্দে হাসলেন। সেটা এজন্য নয় যে, অন্তর তাঁর বিশেষ প্রীতিকর কোন কিছুতে ভরে উঠেছিল; সানন্দ হাসিটা এসেছিল খাদ্যের উত্তম পরিপাক থেকে।
এই সানন্দ হাসিটা তাকে তৎক্ষণাৎ সব কিছু মনে পড়িয়ে দিয়েছিল এবং চিন্তায় ডুবে গেলেন তিনি।
দরজার ওপাশে শোনা গেল দুটো শিশু কণ্ঠ (অবলোনস্কি চিনতে পারলেন ছোট ছেলে গ্রিশা আর বড় মেয়ে তানিয়ার গলা)। কি-একটা তারা নিয়ে যাচ্ছিল, সেটা পড়ে গেল।
‘আমি যে তোকে বলেছিলাম ছাদে প্যাসেঞ্জার বসাতে নেই’, মেয়েটা ইংরেজিতে চেঁচিয়ে উঠল, ‘নে, এখন কুড়োয়
সব তালগোল পাকিয়েছে। শিশুরা ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে একা একা, ভাবলেন অবলোনস্কি। দরজার কাছে গিয়ে তিনি তাদের ডাকলেন। যে কাসকেটটা ট্রেন হয়েছিল, সেটাকে ফেলে দিয়ে তারা বাবার কাছে এল।
মেয়েটা বাবার প্রিয়পাত্রী। সোৎসাহে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। আর বরাবরের মতই খুশি হয়ে উঠল সেন্টের পরিচিত গন্ধে, যা ছড়িয়ে পড়ছিল তাঁর জুলপি থেকে। নুয়ে থাকার ফলে আরক্ত আর কমনীয়তায় জ্বলজ্বলে মুখে বাবাকে চুমু খেয়ে মেয়েটা আবার ছুটে যেতে চাইল; কিন্তু বাবা তাকে ধরে রাখলেন।
মায়ের কি হল?’ মেয়ের মসৃণ নরম গালে হাত বুলিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হেসে তিনি তাকে স্বাগত জানালেন।
অবলোনস্কি জানতেন যে, ছেলেটাকে তিনি কম ভালবাসেন, সব সময় চেষ্টা করতেন সমান চোখে দেখতে; কিন্তু ছেলেটা তা টের পেত, বাবার নিষ্প্রাণ হাসির জবাব সে দিল না হাসি দিয়ে।
মেয়েটা জবাব দিল, মা? বিছানা ছেড়ে উঠেছেন।
অবলোনস্কি নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ভাবলেন, তার মানে আবার ঘুমায়নি সারা রাত!
মেজাজ ভালো?
মেয়েটা জানত যে বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। মা খুশি থাকতে পারছেন না, বাবার সেটা জানার কথা, কিন্তু বাবা ভান করে সে কথা জিজ্ঞেস করছেন অমন অনায়াসে। বাবার জন্য লজ্জায় সে লাল হয়ে উঠল। অবলোনস্কি
তখনই সেটা বুঝে নিজেও লাল হয়ে উঠলেন।
মেয়েটা বলল, কি জানি, মা পড়ায় বসতে বললেন না। বললেন আজ মিস হল-এর সাথে বেড়াতে যা নানীর কাছে।
‘তা যা-না, তানচুরোচকা (বিশেষ সাদরে বলা ‘তানিয়া’ নাম) আমার। ও হ্যাঁ, দাঁড়া’, মেয়েটাকে তখনো ধরে রেখে তার নরম হাতে হাত বুলোত বুলোতে তিনি বললেন।
তিনি গতকাল সন্ধ্যায় ফায়ার প্লেসের ওপর এক কৌটা মিষ্টি রেখেছিলেন। সেটা নিয়ে তা থেকে তার প্রিয় দুটো বনবন দিলেন মেয়েকে। একটায় চকোলেটের অন্যটায় পমেদকার প্রলেপ।
চকোলেটটা দেখিয়ে মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, গ্রিশাকে।
হ্যাঁ। তারপর আরেকবার তার কাঁধে হাত বুলিয়ে চুলের গোড়ায় আর গালে চুমু খেয়ে ছেড়ে দিলেন তাকে।
মাতভেই বলল, গাড়ি তৈরি, তারপর যোগ করল, তাছাড়া উমেদারনিও।
অবলোনস্কি জিজ্ঞেস করলেন, ‘অনেকক্ষণ?
‘আধঘণ্টা থেকে।
কতবার না তোকে বলা হয়েছে যে তখনই খবর দিবি!
আপনাকে অন্তত কফি খেতেও তো দিতে হয়, মাতভেই বলল এমন একটা ভালোমানুষি রূঢ় গলায় যাতে রাগ করা চলে না।
‘নে, তাড়াতাড়ি ডেকে আন’, বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললেন অবলোনস্কি।
উমেদারনি স্টাফ-ক্যাপ্টেন কালিনিনের স্ত্রী। তিনি যা চাইলেন সেটা অসম্ভব ও অর্থহীন; কিন্তু তাঁর যা স্বভাব অবলোনস্কি বাধা না দিয়ে মন দিয়ে তার কথা শুনলেন এবং বিস্তারিত পরামর্শ দিলেন কার কাছে কিভাবে আবেদন করতে হবে, এমন কি নিজের বড় বড় দীর্ঘায়ত, সুন্দর এবং নিখুঁত হস্তাক্ষরে একটা চিরকুট লিখে দিলেন জনৈক ব্যক্তির কাছে যিনি তাকে সাহায্য করতে পারেন। স্টাফ-ক্যাপ্টেনের স্ত্রীকে বিদায় দিয়ে অবলোনস্কি টুপি তুলে নিলেন, তারপর থেমে গিয়ে মনে করার চেষ্টা করলেন কিছু ভুলে যাননি তো। দেখা গেল যেটা তিনি ভুলতে চাইছিলেন– স্ত্রীকে–সেটা ছাড়া কিছুই তিনি ভোলেননি।
‘হুঁ। মাথা নিচু করলেন তিনি, তাঁর সুন্দর মুখে ফুটে উঠল কষ্টের ছাপ। মনে মনে তিনি বললেন, যাব কি যাব না? আর ভেতরের একটা কণ্ঠস্বর তাঁকে বলছিল, যাবার দরকার নেই। মিথ্যাচার ছাড়া এক্ষেত্রে আর কিছুই হবার নয়। তাদের সম্পর্ক শোধরানো, ঠিকঠাক করে নেওয়া সম্ভব নয়। কেননা অসম্ভব আবার ওকে আকর্ষক উন্মাদক প্রেম দেওয়া অথবা নিজেকে ভালোবাসতে অক্ষম বৃদ্ধ করে তোলা। এখন অসত্য আর মিথ্যা ছাড়া কিছুই দাঁড়াবে না; কিন্তু অসত্য আর মিথ্যা তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল।
কিন্তু এক সময় তো ওটা দরকার; এটা যে এভাবেই থেকে যাবে সেটা তো হতে পারে না, নিজেকে সাহস দেবার চেষ্টা করে তিনি বললেন। বুক টান করলেন তিনি। সিগারেট ধরিয়ে দু’বার টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন ঝিনুকের ছাইদানিতে, দ্রুত পায়ে বিষণ্ণ ড্রয়িংরুম পেরিয়ে অন্য দরজাটা খুললেন–স্ত্রীর শয়নকক্ষে।
চার
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা রাউজ পরে আছেন। এককালের ঘন সুন্দর চুল এখন পাতলা হয়ে এসেছে। মাথার পেছনে তার বিনুনি কাঁটা দিয়ে গোঁজা। ভয়ানক শুকিয়ে যাওয়া রোগা মুখে আর মুখের শীর্ণতার ফলে সুপ্রকট হয়ে ওঠা ভীত চোখে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘরময় ছড়ানো-ছিটানো জিনিসপত্রের মধ্যে খোলা শিফোনিয়েরকার সামনে, যা থেকে তিনি কি সব বাঁচাই করছিলেন। স্বামীর পদশব্দ শুনে তিনি থেমে গেলেন, দরজার দিকে তাকিয়ে তিনি বৃথাই চেষ্টা করলেন মুখে একটা কঠোর, ঘৃণাব্যঞ্জক ভাব ফুটিয়ে তুলতে। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে, স্বামীকে তিনি ভয় পাচ্ছেন এবং ভয় পাচ্ছেন আসন্ন সাক্ষাৎ। এইমাত্র তিনি যার চেষ্টা করছিলেন, এই তিন দিনে সেটা তিনি করেছেন দশবার; ছেলেমেয়েদের এবং নিজের জিনিসপত্র বেছে তা নিয়ে চলে যাবেন মায়ের কাছে–এবং আবার মনস্থির করতে পারলেন না; কিন্তু আগের মত এখনো তিনি মনে মনে বলছিলেন, এটা এভাবেই থাকতে পারে না, কিছু-একটা তাকে করতে হবে, শাস্তি দিতে, কলঙ্কিত করতে হবে ওঁকে। স্বামী তাকে যে যাতনা দিয়েছে তার খানিকটার জন্যও অন্তত প্রতিহিংসা নিতে হবে। তিনি তখন বলছিলেন যে স্বামীকে ছেড়ে যাবেন, কিন্তু টের পাচ্ছিলেন যে সেটা অসম্ভব; ওঁকে স্বামী বলে ভাবায় এবং ভালোবাসায় অনভ্যস্ত হয়ে তিনি অক্ষম। তাছাড়া তিনি টের পাচ্ছিলেন, এখানে, নিজের বাড়িতেই যদি তাঁর পাঁচটি ছেলেমেয়ের দেখাশোনা করে ওঠা সহজ না হয়, তাহলে ওদের সবাইকে নিয়ে তিনি যেখানে যাবেন সেখানে তো আরো খারাপই দাঁড়াবে। আর এই তিন দিন ছোটটার জন্য তার কষ্ট হচ্ছিল কারণ ছোটটাকে খাওয়ানো হয়েছে বিছিরি বুলিয়ন আর বাকিগুলো তো কাল সন্ধ্যায় না খেয়েই ছিল। তিনি টের পাচ্ছিলেন যে চলে যাওয়া অসম্ভব; কিন্তু তাহলেও আত্মপ্রতারণা করে তিনি জিনিসপত্র বাছছিলেন, ভান করছিলেন যে চলে যাবেন।