‘কেমন আছে আনি?’ সিঁড়ি দিয়ে তাঁর দিকে ছুটে আসা আন্নাকে তিনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
ভ্রন্স্কি বসে ছিলেন চেয়ারে। ভৃত্য তাঁর গরম হাই-বুট টেনে খুলছিল।
‘ও কিছু নয়, ভালো আছে।’
‘আর তুমি?’ গা ঝাড়া দিয়ে বললেন ভ্রন্স্কি।
নিজের দু’হাতে ভ্রন্স্কির একখানা হাত ধরে আন্না টেনে নিলেন নিজের কোমরের দিকে, দৃষ্টি সরালেন না তাঁর মুখ থেকে।
‘ভারি আনন্দ হল’, আন্নাকে, তাঁর কবরী, তাঁর পোশাকটা যা আন্না তাঁর জন্যই পরেছেন বলে জানেন, নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে এসব লক্ষ করে তিনি বললেন।
এসবই ভালো লাগল তাঁর, কিন্তু ভালো লেগেছে কত কত বার! আর আন্নার যাতে এত ভয়, মুখে তাঁর স্থির হয়ে রইল সেই পাষাণ-কঠোর ভাবটা।
‘ভারি আনন্দ হচ্ছে। তুমি ভালো তো?’ ভেজা দাড়ি রুমাল দিয়ে মুছে আন্নার হাতে চুমু খেয়ে বললেন ভ্রন্স্কি।
আন্না ভাবলেন, ‘এতে কিছু এসে যায় না। শুধু ও এখানেই থাকলেই হল। আর যতক্ষণ সে এখানে, ততক্ষণ আমাকে ভালো না বাসার সাহস হবে না তার।’
সন্ধ্যা কাটল আনন্দে, ফুর্তিতে, প্রিন্সেস ভারভারার উপস্থিতিতে। তিনি অনুযোগ করলেন যে ভ্রন্স্কি না থাকার সময় আন্না মর্ফিয়া নিয়েছেন।
‘কি করা যাবে, ঘুম আসত না যে… ভাবনা-চিন্তায় ব্যাঘাত হত। ও থাকলে আমি মর্ফিয়া নিই না। প্রায় নিই না।‘
‘নির্বাচনের গল্প করলেন ভ্রন্স্কি আর প্রশ্ন করে আন্না তাঁকে নিয়ে এলেন প্রধান কথাটায় যা আনন্দ দিয়েছে তাঁকে, যথা তাঁর সাফল্যে। আর বাড়িতে ভ্রন্স্কির যাতে আগ্রহ, সে সব গল্প করলেন আন্না, আর সব কথাই হল অতি মনোরম।
কিন্তু ভর সাঁঝে, প্রিন্সেস ভারভারা চলে যাবার পর আন্না যখন দেখলেন যে ভ্রন্স্কি পুরোপুরি তাঁর করতলগত, তাঁর ইচ্ছে হল চিঠির দরুন সেই দুঃসহ ভাবটা মুছে দিতে। বললেন : ‘স্বীকার কর, চিঠি পেয়ে তোমার ভারি রাগ হয়েছিল, আমার কথা বিশ্বাস করোনি, তাই না?’
এ কথা বলা মাত্র তিনি বুঝতে পারলেন, এখন তাঁর প্রতি ভ্রন্স্কির যত ভালোবাসাই জাগুক, এটা তিনি ক্ষমা করেননি। ভ্রন্স্কি বললেন : ‘হ্যাঁ, চিঠিটা ছিল ভারি অদ্ভুত। এই আনির নাকি অসুখ, এই আবার তুমি আসতে চাইছ।’
‘এ সবই ছিল সত্যি।’
‘আমি তাতে সন্দেহ করিনি।’
‘না, করেছ। দেখতে পাচ্ছি তুমি অসন্তুষ্ট’।
‘এক মিনিটের জন্যেও নয়। তবে সত্যি, এটা আমার ভালো লাগে না যে তুমি যেন মানতে চাও না যে কিছু কর্তব্য আছে…’
‘কনসার্টে যাবার কর্তব্য…
ভ্রন্স্কি বললেন, ‘যাক গে, এ নিয়ে কিছু আর বলব না।‘
আন্না বললেন, ‘কেন বলব না?’
‘আমি শুধু বলতে চাই যে, অবশ্যপ্রয়োজনীয় কাজ সামনে আসতে পারে। যেমন আমার মস্কো যাওয়া দরকার, বাড়িটার ব্যাপারে… হ্যাঁ, তুমি একদিনের জন্যে এসেই চলে যাও, যেভাবে…
‘আন্না, এটা নিষ্ঠুরতা। আমি সমস্ত জীবন দিতে প্রস্তুত…’
কিন্তু আন্না ওঁর কথা আর শুনছিলেন না।
‘তুমি যদি মস্কো যাও, আমিও যাব। এখানে পড়ে থাকব না আমি। হয় আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাক, নয় একসাথে থাকব।’
‘তুমি তো জানো যে শুধু এটাই আমার কামনা। কিন্তু তার জন্যে…’
‘দরকার বিবাহবিচ্ছেদ? বেশ, আমি লিখব ওকে। আমি দেখতে পাচ্ছি যে, এভাবে আমি থাকতে পারি না… তবে আমি মস্কো যাচ্ছি তোমার সাথে।’
‘ঠিক যেন হুমকি দিচ্ছ আমাকে। তোমার সাথে আমার যেন বিচ্ছেদ না হয়, এর চেয়ে আর কিছুই তো আমি চাই না’, হেসে বললেন ভ্রন্স্কি।
কিন্তু এই নরম কথাগুলো যখন বললেন, চোখে তাঁর দেখা গেল শুধু শীতল নয়, নির্যাতিত, নিষ্ঠুর হয়ে ওঠা মানুষের ক্ষিপ্ত ঝলক।
সে দৃষ্টি চোখে পড়ল আন্নার এবং তার অর্থ ঠিক করলেন তিনি।
‘তাই যদি হয়, তাহলে সেটা মহা দুঃখ!’ বলল দৃষ্টিটা। এটা মুহূর্তের একটা অনুভূতি, কিন্তু আন্না কখনো ভোলেননি সেটা।
বিবাহবিচ্ছেদ চেয়ে আন্না চিঠি লিখলেন স্বামীকে। পিটার্সবুর্গে যাবার দরকার ছিল প্রিন্সেস ভারভারার। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভ্রুনস্কির সাথে তিনি চলে গেলেন মস্কোয়। প্রতিদিন কারেনিনের জবাব এবং তারপর বিবাহ বিচ্ছেদের আশায় তাঁরা এবার বাসা নিলেন স্বামী-স্ত্রীর মত।