‘মেয়েটা অসুস্থ আর ও চাইছিল কিনা আসতে। মেয়েটা অসুস্থ আর এ রকম একটা বিদ্বেষের সুর।’
নির্বাচনের এই নিরীহ আনন্দ আর যে বিমর্ষ, দুঃসহ প্রেমের কাছে তাঁকে ফিরতে হবে, দুইয়ের মধ্যে বৈপরীত্য অভিভূত করল তাঁকে। কিন্তু যেতে হবে, রাতের প্রথম ট্রেনে বাড়ি ফিরলেন তিনি
বত্রিশ
ভ্রন্স্কি প্রতিবার বাইরে চলে যাবার সময় যে কাণ্ডগুলো ঘটত, তা ভ্রন্স্কিকে তাঁর প্রতি আসক্ত না করে নিরাসক্ত করে তুলতে পারে, এটা ভেবে দেখে ভ্রন্স্কি নির্বাচনে যাবার আগে আন্না স্থির করেছিলেন যে শান্তভাবে বিচ্ছেদ সইবার জন্য নিজের ওপর সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেন। কিন্তু যাত্রার কথা ঘোষণা করতে এসে যে হিমশীতল কঠোর দৃষ্টিতে ভ্রন্স্কি তাকিয়েছিলেন তাঁর দিকে, তাতে আহত হন আন্না, ভ্রন্স্কি রওনা দেবার আগেই তাঁর সব প্রশান্তি চূর্ণ হয়ে যায়।
এই যে দৃষ্টিতে প্রকাশ পেয়েছিল স্বাধীনতার অধিকার, একাকিত্বে তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বরাবরের মত আন্না পৌঁছলেন নিজের সেই একই অবমাননাবোধে। ‘যখন আর যেখানে খুশি যাবার অধিকার তার আছে। শুধু নিজে যাবার নয়, আমাকে রেখে যাবারও। সব অধিকার ওর আছে, আমার কিছুই নেই। সেটা জানা থাকায় এটা করা তার অন্যায় হয়েছে। কিন্তু কি করল সে?… আমার দিকে সে চাইল হিমশীতল কঠোর মুখভাব নিয়ে। অবশ্য এখনো এটা অনিৰ্দিষ্ট, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, কিন্তু আগে এটা ছিল না, এ দৃষ্টি বোঝাচ্ছে অনেক কিছু’, ভাবলেন আন্না, ‘এ দৃষ্টি দেখাচ্ছে যে, প্রেম জুড়িয়ে যেতে শুরু করেছে।’
আর জুড়িয়ে যেতে যে শুরু করেছে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেও করার কিছু ছিল না, তাঁর প্রতি তাঁর মনোভাব বদলানো যায় না কোন দিক থেকেই। ঠিক আগের মতই তিনি ওঁকে ধরে রাখতে পারেন কেবল ভালোবাসা আর আকর্ষণী শক্তি দিয়ে। ভ্রন্স্কি যদি তাঁকে আর ভালো না বাসেন তাহলে কি হবে, এই ভয়াবহ চিন্তাটাকে তিনি দিনে কিছু-একটা নিয়ে ব্যস্ত থেকে আর রাতে মর্ফিয়া নিয়ে চাপা দিতে পারতেন ঠিক আগের মতই। অবশ্য আরো একটা উপায় ছিল : তাঁকে ধরে রাখা নয়,–এর জন্য আন্না তাঁর ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু চান না, কিন্তু ওঁর সাথে সন্নিহিত হওয়া এমন অবস্থায় থাকা যাতে ভ্রন্স্কি ওঁকে ত্যাগ না করেন। এই উপায়টা হল বিবাহবিচ্ছেদ আর দ্বিতীয় বিবাহ। এটাই চাইতে লাগলেন তিনি এবং ভ্রন্স্কি বা স্তিভা কথাটা প্রথম তুললেই তিনি রাজি হয়ে যাবেন ঠিক করলেন।
এসব ভাবনা-চিন্তায় আন্না ভ্রন্স্কিকে ছাড়া কাটালেন পাঁচ দিন, যে পাঁচ দিন ওঁর অনুপস্থিত থাকার কথা।
বেরিয়ে, প্রিন্সেস ভারভারার সাথে আলাপ করে, হাসপাতালে গিয়ে আর প্রধান কথা বইয়ের পর বই পড়ে তাঁর সময় কাটল। কিন্তু ষষ্ঠ দিনে, কোচোয়ান যখন ফিরল তাঁকে ছাড়াই, তখন ভ্রন্স্কি সম্পর্কে, কি তিনি করছেন সেখানে, সে সম্পর্কে চিন্তাগুলো চাপা দেবার শক্তি তাঁর আর নেই বলে তিনি অনুভব করলেন। এ সময়েই অসুখ হল মেয়ের। তার সেবা-শুশ্রূষার ভার নেন তিনি, কিন্তু তাতে মন বসল না। বিশেষত তেমন গুরুত্বর ছিল না অসুখটা। যত চেষ্টাই করুন, মেয়েটাকে ভালোবাসতে পারেননি আন্না, আর ভালোবাসার ভান করা তাঁর পক্ষে ছিল অসম্ভব। সেদিন সন্ধ্যায় একা হয়ে ভ্রন্স্কির জন্য এতই ভয় হল তাঁর যে প্রায় ঠিক করে ফেলেছিলেন যে শহরে যাবেন, কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখে ভ্রন্স্কি যে স্ববিরোধী চিঠিটা পান সেটা লেখেন এবং বার্তাবাহক মারফত পাঠান। পরের দিন সকালে ভ্রন্স্কির চিঠি পেলেন আন্না আর নিজেরটার জন্য অনুতাপ হল তাঁর। যাবার সময় ভ্রন্স্কি যে কঠোর দৃষ্টিপাত করেছিলেন, বিশেষ করে যখন জানবেন যে মেয়ের অসুখটা গুরুতর নয়, তখন তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে ভেবে তাঁর আতংক হল। তাহলেও চিঠিটা লিখেছেন বলে তিনি খুশি। আন্না এখন মানেন যে উনি ভ্রন্স্কির ওপর একটা বোঝা, তাঁর কাছে আসার জন্য ভ্রনস্কি তাঁর স্বাধীনতা বিসর্জন দেন খেদের সাথে, তাহলেও তিনি আসছেন বলে আন্না খুশি। হোক আন্নাকে তাঁর ভার বোধ, কিন্তু এখানে তিনি আন্নার কাছেই থাকবেন, আন্না তাঁকে দেখতে পাবেন, জানবেন তাঁর প্রতিটি গতিবিধি।
ড্রয়িং-রুমে বাতির নিচে বসে আন্না তেঁ-র একটা নতুন বই পড়তে পড়তে শুনতে লাগলেন আঙিনায় বাতাসের আওয়াজ আর প্রতি মুহূর্তে রইলেন গাড়ি আসার অপেক্ষায়। কয়েকবার তাঁর মনে হয়েছিল যেন চাকার শব্দ শুনছেন, কিন্তু সেটা ভ্রমাত্মক। অবশেষে শোনা গেল শুধু চাকার শব্দই নয়, কোচোয়ানের চিৎকার, আচ্ছাদিত গাড়ি-বারান্দায় চাপা আওয়াজ। পেশেন্স খেলায় রত প্রিন্সেস ভারভারারও কানে গেল তা। আন্না লাল হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু আগে দু’বার যা করেছেন, সিঁড়ি দিয়ে নিচে না নেমে থেমে গেলেন। নিজের ছলনার জন্য লজ্জা হল তাঁর, কিন্তু ভ্রন্স্কি কিভাবে তাঁকে নেবেন, সেটা ছিল অনেক ভয়ের ব্যাপার। অপমানের জ্বালা আগেই মুছে গিয়েছিল তাঁর। ভ্রন্স্কির মুখে এখন অসন্তোষ ফুটবে কিনা শুধু এই তাঁর এখন ভয়। তাঁর মনে পড়ল মেয়ে আজ দ্বিতীয় দিন একেবারে সুস্থ। মেয়ের ওপর তাঁর রাগই হল যে চিঠি পাঠাতেই সে সুস্থ হয়ে উঠেছে। তারপর তাঁর মনে পড়ল ভ্রন্স্কিকে, তাঁর হাত চোখ নিয়ে গোটাটা তিনি এখানে। তাঁর কণ্ঠস্বর শুনলেন আন্না। অমনি সব কিছু ভুলে তিনি আনন্দে ছুটে গেলেন নিচে।