এখন উৎসব হচ্ছে সেই বিজয়ী জকিকে নিয়ে। ভ্রন্স্কি বসে ছিলেন টেবিলের শিয়রে, ডান দিকে যুবক রাজ্যপাল, জার সুইটের অন্তর্ভুক্ত জনৈক জেনারেল। যে রাজ্যপাল গুরুগম্ভীরভাবে নির্বাচনের উদ্ভোধন করেন, বক্তৃতা দেন, অনেকের মধ্যেই সম্মান ও পদলেহনের মনোভাব জাগান—যা ভ্রন্স্কি দেখতে পাচ্ছিলেন, সবার কাছে তিনিই গুবের্নিয়ার কর্তা; ভ্রন্স্কির কাছে কিন্তু ইনি নিতান্তই কাকা মাসলভ—পেজ কোরে এই ছিল তার ডাকনাম, ভ্রন্স্কির সামনে তিনি অপ্রস্তুত বোধ করছিলেন আর তাঁকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছিলেন ভ্রন্স্কি। তার বাঁ দিকে তার তরুণ, অটল বিষাক্ত মুখ নিয়ে নেভদোভস্কি। তার সাথে ভ্রন্স্কির ব্যবহার ছিল সহজ, সশ্রদ্ধ।
সি্ভ্য়াজঙ্কি তাঁর পরাজয়টা মেনে নিলেন ফুর্তি করেই। তাঁর কাছে এটা পরাজয়েই নয়, যা তিনি নিজেই বলেন নেভেদোভস্কির উদ্দেশে পানপাত্র তোলার সময় : অভিজাতবৃন্দকে নতুন ধারা অনুসরণ করতে হবে। এর মত তার সেরা প্রতিনিধি আর পাওয়া যাবে না। সেই কারণে সমস্ত সাধু ব্যক্তিই তাঁর বর্তমান সাফল্যের পক্ষে থেকেছে, বিজয়োৎসব করছে তাঁকে নিয়ে।
ফুর্তি করে সময় কাটল আর সবাই আনন্দ করছে বলে অব্লোন্স্কি খুশি ছিলেন। অপূর্ব খাদ্যের সাথে সাথে চলছিল নির্বাচনের ঘটনাবলির বিবরণ। প্রাক্তন গুবেনির্য়া প্রমুখের অশ্রুসজল বক্তৃতাটা সি্ভ্য়াজ্স্কি শোনালেন কৌতুক করে। তারপর নেভেদোভস্কিকে লক্ষ করে ফোড়ন কাটলেন : হিসাব পরীক্ষার জন্য চোখের পানির চেয়ে আরো জটিল কোন পদ্ধতি নিতে হবে হুজুরকে। আরেকজন রসিক ভদ্রলোক বললেন যে, গুবের্নিয়া প্রমুখের নির্বাচন উপলক্ষে বলনাচের জন্য মোজা পরা চাপরাশিদের বরাত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন তাদের ফেরত পাঠাতে হচ্ছে যদি অবশ্য নতুন গুবের্নিয়া প্রমুখ মোজা পরা চাপরাশিদের নিয়ে বলনাচের আয়োজন না করেন
ডিনারে সময় নেভেদোভস্কিকে সম্বোধন করা হচ্ছিল আমাদের গুবের্নিয়া প্রমুখ আর হুজুর বলে।
‘তা কেবল তারা সেই রকম আনন্দ পাচ্ছিলেন যেমন লোকে পেয়ে থাকে নববিবাহিত তরুণীকে ‘মাদাম অমুক’ বলতে পেরে। নেভেদোভস্কি ভাব করলেন খেতাবটা তার কিছু এসে যায় না। তাই শুধু নয় এটাকে তিনি ঘৃণাই করেন, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। যে উনি খুশিই হচ্ছেন, তবে যে নতুন উদারনৈতিক পরিবেশের মধ্যে সবাই রয়েছেন, তার পক্ষে অশোভন একটা উল্লাস প্রকাশ না করার জন্য সংযত রাখছিলেন নিজেকে।
ডিনারের মধ্যেই নির্বাচনের ফলাফলে আগ্রহী কিছু লোকের কাছে টেলিগ্রাম পাঠানো হল। খুবই শরিফ মেজাজে ছিলেন অব্লোন্স্কি। তিনিও দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার কাছে এই মর্মে এক টেলিগ্রাম পাঠালেন; নেভেদোভস্কি নির্বাচিত হয়েছেন বারো ভোটে। অভিনন্দন। খবরটা অন্যদের দিও। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তিনি টেলিগ্রামের বয়ান দিতে থাকলেন। এবং মন্তব্য করলেন, ‘ওরাও আনন্দ করুক।’ বার্তা পেয়ে দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা কিন্তু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, টেলিগ্রামের পেছনে যে এক রুব্ল খরচ হয়েছে তার জন্য এবং বুঝলেন, এটা ডিনারের শেষদিককার ব্যাপার। তিনি জানতেন যে ভালো একটা ডিনারের শেষে টেলিগ্রাফের অপব্যবহার করা স্তিভার একটা দুর্বলতা।
উৎকৃষ্ট আহার এবং রুশী নয়, সোজা বিদেশে বোতলজাত করা সুরা মিলিয়ে সবই হয়েছিল বেশ সম্ভ্রান্ত, সহজ আর হাসি-খুশি। একমতাবলম্বী, উদারনৈতিক, কিন্তু সেই সাথে সুরসিক সজ্জন নতুন কর্মকর্তাদের নিয়ে সি্ভ্য়াজ্স্কি বেছেছিলেন জনা বিশেক লোকের একটা দল। নতুন গুবের্নিয়া প্রমুখ, রাজ্যপাল, ব্যাংকের ডিরেক্টার আর ‘আমাদের অমায়িক গৃহস্বামীর’ স্বাস্থ্যপান করা হল, তাও অর্ধেক রহস্য করে।
ভ্রন্স্কি খুশি হয়েছিলেন। মফস্বলে যে এমন একটা মধুর পরিবেশ সম্ভব তা আশা করেননি তিনি।
ডিনারের শেষে ফুর্তি জমল আরো বেশি। সার্ব ভ্রাতাদের সাহায্যের জন্য তাঁর স্ত্রী কর্তৃক আয়োজিত একটি কনসার্টে আসতে রাজ্যপাল আমন্ত্রণ জানালেন ভ্রন্স্কিকে, স্ত্রী তাঁর সাথে পরিচিতও হতে চান।
‘বলনাচের ব্যবস্থা আছে, সেখানে দেখতে পাবে আমাদের সুন্দরীকে। সত্যিই অপরূপা।’
‘ওটা আমার ধারায় নেই’, তাঁর মনে ধরে যাওয়া বুলিটা ভ্রন্স্কি ইংরেজিতে বললেন বটে, তাহলেও হেসে কথা দিলেন যে, যাবেন। টেবিল ছেড়ে যাবার আগে সবাই যখন ধূমপান করছে ভ্রন্স্কির সাজভৃত্য ট্রে-তে করে একটা চিঠি এনে দিল।
‘ভজ্ভিজেন্স্কয়ে থেকে একজন লোক নিয়ে এসেছে’, সে বলল অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে
ভ্রন্স্কি যখন ভুরু কুঁচকে চিঠিটা পড়ছিলেন, অতিথিদের মধ্যে কে-একজন তাঁর সাজভৃত্য সম্পর্কে বলে উঠলেন ফরাসিতে : ঠিক আমাদের অভিশংসক সেক্তিৎস্কির মত দেখতে, আশ্চর্য।’
চিঠি পাঠিয়েছেন আন্না। পড়ার আগেই ভ্রন্স্কি জানতেন, কি তাতে লেখা আছে। নির্বাচন পাঁচ দিনের মধ্যে শেষ হবে ধরে নিয়ে তিনি কথা দিয়েছিলেন ফিরবেন শুক্রবারে। আজ শনিবার এবং তিনি জানতেন যথাসময়ে না ফেরার জন্য তিরস্কার আছে চিঠিতে। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি যে চিঠিটা পাঠিয়েছেন সম্ভবত তা এখনো পৌঁছায়নি।
যা ভেবেছিলেন, চিঠির বক্তব্য তাই-ই। কিন্তু তার প্রকাশটা তাঁর কাছে অপ্রত্যাশিত এবং অতি বিশ্রী লাগল। আনি খুব অসুস্থ, ডাক্তার বলছে নিউমোনিয়া হতে পারে। আমি একা, মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়। প্রিন্সেস ভারভারা কোন সাহায্য নন, বাধা। গত পরশু, গতকাল আমি তোমাকে আশা করেছিলাম, এখন লোক পাঠাচ্ছি জানতে কোথায় তুমি, কি ব্যাপার। আমি নিজেই ভেবেছিলাম যাব, কিন্তু তোমার ভালো লাগবে না, জানা থাকায় গেলাম না। কিছু-একটা জবাব দিয়ো যাতে বুঝতে পারি কি করতে হবে আমাকে।’