রেলিঙের কাছে একটা খালি জায়গা পেয়ে তাতে ভর দিয়ে লেভিন দেখতে আর শুনতে লাগলেন।
অভিজাতরা সবাই নিজেদের উয়েদের জন্য আলাদা করা ঘের দেওয়া আসনগুলোয় বসে ছিলেন। হলের মাঝখানে উর্দি পরা একটি লোক তীক্ষ্ণ সরু গলায় ঘোষণা করলেন : ‘উপপ্রমুখ পদে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন স্টাফ- ক্যাপটেন ইয়েঙ্গেনি ইভানোভিচ আপুতিন!’
মৃত্যুবৎ স্তব্ধতা নামল, শোনা গেল একটা জরাজীর্ণ ক্ষীণ গলা : ‘প্রত্যাহার করছি!’
আবার শোনা গেল : ‘নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন প্রিভি কাউন্সিলর পিওত্র পেত্রবিচ বল!’
‘প্রত্যাহার করছি!’ শোনা গেল যুবকের একটা খেঁকখেঁকে গলা। আবার একই জিনিস শুরু হল এবং ‘আবার প্রত্যাহার করছি’। এই চলল প্রায় এক ঘণ্টা। রেলিঙে কনুই ভর দিয়ে লেভিন দেখছিলেন আর শুনছিলেন। প্রথমটা তাঁর অবাক লাগছিল, বুঝতে চেষ্টা করছিলেন—কি এর মানে; তারপর বুঝতে যে পারবেন না সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ায় তাঁর ব্যাজার লাগতে লাগল। তারপর সকলের মুখে তিনি যে উত্তেজনা আর আক্রোশ দেখেছেন, সেটা মনে পড়ায় ভারি মন খারাপ হয়ে গেল তাঁর। ঠিক করলেন, চলে যাবেন। নীচে নামতে গিয়ে দেখলেন, গ্যালারিতে এদিক- ওদিক পায়চারি করছে ফুলো-ফুলো চোখে জিমনাসিয়ামের এক ছাত্র। সিঁড়িতে দেখা হল এক যুগলের সাথে, খটখটিয়ে মহিলা দ্রুত উঠছিলেন আর সহ-অভিশংসক বলছিলেন।
‘আমি তো আপনাকে বলেছিলাম যে দেরি হবে না’, লেভিন তখন পাশে সরে গিয়ে মহিলার জন্য পথ করে দিচ্ছিলেন।
লেভিন বেরিয়ে যাবার সিঁড়ির কাছে এসে যখন ওয়েস্ট-কোট থেকে ওভারকোটের কুপন বের করছিলেন, সেক্রেটারি এসে ধরলেন তাঁকে; ‘অনুগ্রহ করুন কনস্তান্তিন দ্দ্মিত্রিচ, ভোট চলছে।’
অমন দৃঢ়ভাবে যিনি আপত্তি জানিয়েছিলেন সেই নেভোদোভস্কি দাঁড়িয়েছেন নির্বাচনে।
দরজার দিকে গেলেন লেভিন। হলের দরজা বন্ধ। সেক্রেটারি টোকা দিতে দরজা খুলে গেল, রক্তিম বদনে লেভিনের দিকে ছুটে এল দুজন জমিদার।
‘আমি আর পারছি না’, বলল রক্তিমবদনের একজন।
জমিদারের পেছনে উঁকি দিল গুবেনির্য়া প্রমুখের মুখ। আতংকে আর ক্লেশে সে মুখ ভয়াবহ।
‘আমি তোমাকে বলেছিলাম যে, কাউকে বেরোতে দেবে না!’ দারোয়ানের উদ্দেশে হুঙ্কার দিলেন তিনি। ‘আমি শুধু ঢুকতে দিয়েছি, হুজুর!’
‘হায় সৃষ্টিকর্তা!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে সাদা পেন্টালুন পরা গুবের্নিয়া প্রমুখ ক্লান্ত ভঙ্গিতে ফিরে গেলেন হলের মাঝখানে পাতা বড় টেবিলটার কাছে।
যা হবার করা হয়েছিল, নেভেদোভস্কিকে এত বেশি ভোট দেওয়া হয়েছিল যে তিনিই হলেন নতুন গুবের্নিয়া প্রমুখ। অনেকেরই ফুর্তি হল, অনেকেই সন্তুষ্ট, সুখী, অনেকে উল্লসিত, অনেকে আবার অসন্তুষ্ট, অসুখী। একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন গুবের্নিয়া প্রমুখ, সেটা তিনি লুকাতেও পারছিলেন না। নেভেদোভস্কি যখন হল থেকে বেরোলেন, জনতা ঘিরে ধরল তাঁকে এবং সোল্লাসে তাঁর অনুগমন করতে লাগল ঠিক যেভাবে নির্বাচন উদ্বোধনের পর তারা অনুগমন করেছিল রাজ্যপালের এবং স্নেৎকোভ যখন নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন যেভাবে তারা তার অনুগমন করেছিল।
একত্রিশ
ভ্রন্স্কি সেদিন নবনির্বাচিত গুবের্নিয়া প্রমুখ এবং নতুনদের বিজয়ী পার্টির অনেকের জন্য ডিনারের আয়োজন করলেন।
ভ্রন্স্কি নির্বাচনে এসেছিলেন। কারণ গ্রামে একঘেয়ে লাগছিল। তাছাড়া আন্নার কাছে নিজের স্বাধীনতার অধিকার ঘোষণা করতে হত এবং জেমভো পরিষদের নির্বাচনে সি্ভ্য়াজস্কি তাঁর জন্য যত কিছু করেছেন; এই নির্বাচনে তাঁকে সমর্থন করে তা পরিশোধ করা। আর সর্বোপরি অভিজাত ও ভূস্বামীর যে ভূমিকাটা তিনি বেছে নিয়েছেন, তজ্জনিত সমস্ত কর্তব্য কঠোরভাবে পালনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তিনি মোটেই আশা করেননি যে, নির্বাচনের ব্যাপারটা তাঁকে এমন মাতবে, উত্তেজিত করবে, আর ব্যাপারটা তিনি এত ভালোভাবে নির্বাহ করতে পারবেন। অভিজাদের মহলে তিনি একেবারে নতুন, কিন্তু স্পষ্টতই সেখানে প্রতিষ্ঠা করে নিতে পারেন এবং এ কথা ভেবে ভুল করেননি যে, অভিজাতদের মধ্যে ইতিমধ্যেই প্রভাব বিস্তার করেছেন তিনি। এ প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করে : তাঁর ধন-সম্পত্তি এবং কাউন্ট পদ; শহরে চমৎকার একটা বাসা বা তাঁর জন্য ছেড়ে দেন তাঁর পুরানো পরিচিত শিকভ, যিনি আর্থিক ব্যাপারে নিয়োজিত, এবং কাশিনে উন্নতিশীল একটি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা; গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ভ্রন্স্কির চমৎকার পাচক; রাজ্যপালের সাথে আগেই যিনি ছিলেন ভ্রন্স্কির বন্ধু ও তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ধন্য; কিন্তু সবচেয়ে বেশি সবার সাথে তাঁর সহজ সমান ব্যবহার যাতে তাঁর কল্পিত অহংকার সম্পর্কে অধিকাংশ অভিজাতের ধারণা বদলায়। ভ্রন্স্কি নিজেই টের পাচ্ছিলেন যে, কিটি শ্যেরবাৎস্কায়ার স্বামী এই যে খেপাটে ভদ্রলোকটি কথা নেই, বার্তা নেই উন্মাদ আক্রোশে তাঁকে রাজ্যের আজেবাজে কথা বলে মনে ঝাল ঝেড়েছেন, তিনি ছাড়া যার সাথেই তাঁর পরিচয় হয়েছে, তেমন প্রতিটি অভিজাতই হয়েছেন তাঁর পক্ষপাতি। তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন এবং অন্যরা স্বীকার করছিল যে, নেভোদোভস্কির সাফল্যে তার অবদান যথেষ্ট। আর এখন নিজের বাড়িতে খাবারের টেবিলে বসে নেভেদোভস্কির জয়োৎসব উপলক্ষে নিজের নির্বাচিতের বিজয়ের জন্য তার একটা মধুর অনুভূতি হচ্ছিল। নির্বাচনে তিনি এত বেশি মেতে উঠেছিলেন যে, তিন বছরের মধ্যে যদি তিনি বিবাহিত লোক হন, তাহলে নিজেই ভোটে দাঁড়াবেন বলে ভাবছিলেন—জকি পুরস্কার পাবার পর যেমন নিজেরই ইচ্ছা হয় ঘোড়া ছোটাবার।