‘কারণ, আমি মনে করি সালিশী আদালত একটা নির্বোধ প্রতিষ্ঠান’, মন মরার মত জবাব দিলেন লেভিন এতক্ষণ তিনি ছিলেন ভ্রন্স্কির সাথে কথা বলার সুযোগের অপেক্ষায়, যাতে প্রথম সাক্ষাতেই তার রূঢ়তাটা ক্ষালন করে নিতে পারেন।
‘আমি তা মনে করি না, উল্টোটা ভাবি’, শান্ত বিস্ময়ে ভ্রন্স্কি বললেন।
‘এটা খেলনা’, লেভিন বাধা দিলেন তাকে, ‘সালিশীর আমাদের প্রয়োজন নেই। আট বছরের মধ্যে সালিশী আদালতের কাছে আমার কোন কাজ ছিল না, যা ছিল তাতে রায় হয়েছে উল্টো। আমার ওখান থেকে আদালত চল্লিশ ভাষ্ট দূরে। যে মামলার ফয়সালা হয় দুই রুলে তার জন্যে আমাকে এজেন্ট পাঠাতে হয় পনের রুবল দিয়ে।’
এবং তিনি একজন চাষীর কথা বললেন যে কল-মালিকের কাছ থেকে ময়দা চুরি করেছিল; কল-মালিক সে কথা তাকে বলতে যে কুৎসা রটনার দায়ে মামলা ঠোকে তার বিরুদ্ধে। সমস্ত কাহিনীটি অপ্রাসঙ্গিক এবং নির্বোধোচিত, বলার সময় লেভিন নিজেই সেটা টের পাচ্ছিলেন
‘ও ভারী অসাধারণ বটে’, মধুমাখা হাসি হেসে অব্লোন্স্কি বললেন, ‘কিন্তু চলুন, মনে হচ্ছে ভোট শুরু হয়েছে,…
ওঁরা ছড়িয়ে পড়লেন।
‘আমি বুঝি না’, ভাইসব কতকগুলি উদ্ভট কাণ্ড চোখে পড়ায় কজ্নিশেভ বললেন, ‘আমি বুঝি না, এই মাত্রায় সর্ববিধ রাজনৈতিক বোধ হারানো যায় কেমন করে। এ বোধ আমাদের রুশীদের নেই। গুবের্নিয়া প্রমুখ আমাদের শত্রু—তুমি তাঁর সাথে দহরম-মহরম করছো, দাঁড়াতে বলছো নির্বাচনে আর কাউন্ট ভ্রন্স্কি…ওঁকে আমি বন্ধু বানাব না; উনি ডেকেছেন ডিনারে, আমি যাব না; কিন্তু উনি আমাদের দলে, কেন শত্রু করে তুলতে হবে ওঁকে? তারপর নেভেদোভস্কিকে তুমি বলালে সে নির্বাচনে দাঁড়াবে কিনা। এসব কেউ করে না।
‘আহ, আমি কিছুই বুঝি না! এসবই নিরর্থক ব্যাপার’, বিষণ্ন বদনে বললেন লেভিন।
‘বলছ অনর্থক, কিন্তু তার মধ্যে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলো।
লেভিন চুপ করে রইলেন। তাঁরা দুজনেই বড় হলঘরে গেলেন।
গুবের্নিয়া প্রমুখ বাতাসে যদিও গন্ধ পাচ্ছিলেন কিছু-একটা প্যাঁচ কষা হচ্ছে, এবং যদিও সবাই তাঁকে দাঁড়াতে অনুরোধ করেনি, তাহলেও ঠিক করলেন দাঁড়াবেন। হলঘরে সবাই চুপ করে গেলেন আর সেক্রেটারি উচ্চৈস্বরে ঘোষণা করলেন যে, গুবের্নিয়া প্রমুখ পদের জন্য ভোটে দাঁড়াচ্ছেন গার্ড ক্যাপটেন মিখাইল স্তেপানোভিচ স্নেকোভ।
উয়েদ প্রমুখেরা তাঁদের টেবিল থেকে বল ভরা প্লেট নিয়ে গেলেন রাজ্যপালের টেবিলের দিকে, শুরু হল ভোটাভুটি।
উয়েদ প্রমুখের পেছনে পেছন বড় ভাইয়ের সাথে লেভিন যখন টেবিলের দিকে যাচ্ছিলেন ফিসফিস করে অব্লোন্স্কি তাকে বললেন : ‘ডান দিকে ফেলো।’ যে সব কারণ তাঁকে বোঝানো হয়েছিল ইতিমধ্যে সে সব ভুলে গিয়ে তাঁর ভয় হল, ‘ডান দিকে’ বলে অব্লোন্স্কি ভুল করেননি তো? স্নেৎকোভ তো তাদের শত্রু। ডান হাতে বল নিয়ে বাক্সের কাছে গিয়ে ভুল করছে ভেবে একেবারে শেষ মুহূর্তে সেটা পাচার করলেন বাঁ হাতে এবং বোঝাই যায় যে তা বাঁয়েই ফেললেন। ওয়াকিবহাল যে ভদ্রলোকটি বাক্সের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন কনুইয়ের এক ভঙ্গিতেই যিনি বুঝে নেন—কে কোথায় বল ফেলছে, তিনি অপ্রসন্ন হয়ে মুখ কোঁচকালেন। নিজের অন্তর্ভেদী ক্ষমতা জাহির করার অন্য কোন উপায় ছিল না তাঁর।
যখন ভোট গণনা হচ্ছিল তখন সবাই চুপ করে গেলেন। পরে একক একটি কণ্ঠ ঘোষণা করল পক্ষে-বিপক্ষে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা।
গুবের্নিয়া প্রমুখ নির্বাচিত হয়েছেন রীতিমত সংখ্যাধিক্য ভোটে। সবাই কলরব করে উঠলেন, সবেগে ছুটলেন দরজার দিকে। স্নেৎকোভ ভেতরে এলেন, অভিজাতরা অভিনন্দন জানিয়ে ঘিরে ধরলেন তাঁকে
‘এখন শেষ তো?’ কজ্নিশেভকে জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।
‘মাত্র শুরু হচ্ছে’, হেসে কজ্নিশেভের হয়ে জবাব দিলেন সি্ভ্য়াজস্কি। উপপ্রমুখ পেতে পারে আরো বেশি ভোট।’
আবার এ কথাটা মনে ছিল না লেভিনের। কেবল এখন তাঁর স্মরণ হল কি-একটা যেন সূক্ষ্ম চাল ছিল এর পেছনে, কিন্তু সেই সূক্ষ্মতাটা কিসে তা ভাবতে বেজার লাগল তাঁর; মন খারাপ হয়ে গেল, ইচ্ছে হচ্ছিল এই জটলা থেকে বেরিয়ে যান।
কেউ যেহেতু মন দিচ্ছিল না তাঁর দিকে, এবং মনে হল কারো প্রয়োজন নেই তাঁকে, চুপি চুপি তিনি রওনা দিলেন জলযোগের ছোট হলটায় এবং আবার পরিচারকদের দেখে ভারি হালকা লাগল তাঁর। বৃদ্ধ পরিচারক তাঁকে আমন্ত্রণ করল কিছু মুখে তুলতে, লেভিন রাজি হলেন। বরবটি সহযোগে একটা কাটলেট খেয়ে, এবং পরিচারকের সাথে তার আগেকার মনিবদের নিয়ে আলাপ করার পর লেভিনের ইচ্ছে হল না তাঁর কাছে অপ্রীতিকর হলঘরটায় ঢোকেন, গেলেন গ্যালারিতে।
গ্যালারি সুসজ্জিত মহিলায় ভরা, নিচে যে আলোচনা হচ্ছিল, রেলিঙে ভর দিয়ে তার একটা ফসকে না-যেতে দিতে তারা সচেষ্ট। মহিলাদের কাছে বসে অথবা দাঁড়িয়ে ছিলেন সুবেশী সব অ্যাডভোকেট, চশমাধারী জিমনাসিয়াম শিক্ষক, সামরিক অফিসার। সর্বত্রই আলোচনা হচ্ছিল নির্বাচন নিয়ে, গুবের্নিয়া প্রমুখ কি রকম জেরবার হয়ে পড়েছিলেন আর কি চমৎকার হয়েছিল বিতর্ক, তাই নিয়ে। একটা দলে লেভিন শুনলেন তাঁর প্রশংসা। একজন মহিলা অ্যাডভোকেটকে বলছিলেন : ‘কজ্নিশেবের বক্তৃতা শুনে কি যে আনন্দ হল! খাওয়া ফেলে রেখে তা শোনার মত। চমৎকার! সব কিছু পরিষ্কার, সুস্পষ্ট! আপনাদের আদালতে কেউই এমন করে বলতে পারে না। হয়ত-বা শুধু এক মেইডেল। কিন্তু তিনিও মোটেও এমন বাকপটু নন। ‘