‘শুনুন বলি’, জমিদার চালিয়ে গেলেন, ‘আমার পড়শী একজন কারবারী। এসেছিল আমার কাছে। আমরা বিষয়- সম্পত্তি বাগান সব ঘুরে দেখলাম। বলে, ‘না’ স্তেপান ভাসিলিচ, সবই আপনার ঠিকঠাক চলছে, কিন্তু বাগানটায় বড় অযত্ন।’ ঐ লিন্ডেন গাছগুলোকে কেটে ফেলতাম, শুধু রসটা বের করে নিয়ে। লিন্ডেন গাছ তো এখানে হাজার হাজার। প্রচুর চমৎকার বাকল হবে। আর বাকলের এখন ভালো দাম। আমি হলে কেটে ফেলতাম।’
‘আর সে টাকায় ও গরু-বাছুর বা জমি কিন্তু পানির দামে, চাষীদের তা খাজনায় বিলি করত’, হেসে কথাটা শেষ করলেন লেভিন, স্পষ্টতই এরকম হিসাব তাকে শুনতে হয়েছে একাধিকবার। ‘ও সম্পত্তি করবে আর সৃষ্টিকর্তা করুন, আপনার আমার যা আছে শুধু সেটুকু দরে রেখে ছেলেমেয়েদের যেন দিয়ে দিতে পারি।’
‘শুনেছি আপিন বিবাহিত?’ জিজ্ঞেস করলেন জমিদার।
‘হ্যাঁ’, সর্গব তৃপ্তিতে লেভিন বললেন; ‘কেমন যেন আশ্চর্য’, বলে চললেন তিনি, ‘আমরা হিসাবের পরোয়া না করে চলি। আমাদের এখানে বসানো হয়েছে ঠিক পুরাকালের ভেস্টালদের মত কোনরকমে আগুন আগলিয়ে রাখতে।’
সাদা মোচের মধ্যে মুচকি হাসলেন জমিদার।
‘আমাদের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন, যেমন অন্তত বন্ধুবর নিকোলাই ইভানিচকেই ধরুন কিংবা কাউন্ট ড্রস্কি, যিনি এখানে বসত পেতেছেন, তাঁরা চান কৃষি চালাতে শিল্পের কায়দায়, কিন্তু পুঁজি লোকসান দেওয়া ছাড়া এ যাবত কিছুই দাঁড়ায়নি।
কিন্তু কারবারীটার মত আমরা করছি না কেন? বাকলের জন্য কেন কেটে ফেলছি না বাগান? যে প্রশ্নটা লেভিনকে হতভম্ব করছিল, তাতে ফিরে এসে তিনি বললেন।
‘ঐ যে আপনি বললেন আগুন আগলিয়ে রাখা? নইলে অভিজাতদের কাজ আবার কি? আর অভিজাতদের কাজটা চলে এখানে নয়, নির্বাচনে নয়, সেখানে নিজের কোনটিতে। সামাজিক একটা সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদের একটা স্বতঃবোধও আছে কি করা উচিত, কি নয়। চাষীদেরও আছে; মাঝে মাঝে দেখি কি ভালো চাষী, যত পারে জমি করছে। সে জমি যত খারাপই হোক চষে যাচ্ছে। শুধু হিসাবের পরোয়া না করে। স্রেফ লোকসান দিয়ে।’
‘আমরাও তাই’, লেভিন বললেন আর তার দিকে সি্ভ্য়াজস্কিকে আসতে দেখে যোগ দিলেন, ‘দেখা হয়ে খুবই, খুবই আনন্দ হল।’
‘আপনার বাড়ির পর আমাদের আবার দেখা হল এই প্রথম’, জমিদার বললেন, ‘কথাবার্তাও হল।’
‘কি, নতুন ব্যবস্থার মুণ্ডপাত করলেন তো?’ হেসে প্রশ্ন করলেন সি্ভ্য়াজস্কি।
‘তাছাড়া কি চলে।’
‘বুক জুড়ালেন।’
আন্না কারেনিনা – ৬.৩০
ত্রিশ
সি্ভ্য়াজস্কি লেভিনের হাত ধরে তাকে সাথে করে চললেন নিজেদের লোকদের কাছে।
এখন আর ভ্রন্স্কিকে এড়ানো যায় না। অব্লোন্স্কি আর কজ্নিশেভের সাথে দাঁড়িয়ে তিনি সোজা তাকিয়ে ছিলেন লেভিনের দিকেই।
‘ভারী আনন্দ হল। মনে হচ্ছে প্রিন্সেস শ্যেরবাৎস্কায়ার বাড়িতে…আপনার সাথে দেখা হবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার’, লেভিনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভ্রন্স্কি বললেন।
‘হ্যাঁ, আমাদের সাক্ষাৎটা আমার খুবই মনে আছে’, সিঁদুরে লাল হয়ে লেভিন বললেন এবং তখনই ফিরে কথা শুরু করলেন বড় ভাইয়ের সাথে।
সামান্য হেসে সি্ভ্য়াজস্কির সাথে আলাপ চালিয়ে গেলেন ভ্রন্স্কি, কিন্তু লেভিন বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে ক্রমাগত তাকাচ্ছিলেন ভ্রন্স্কির দিকে, ভাবছিলেন তার রূঢ়তা মোচনের জন্য কথা বলা যায় কি বিষয়ে
‘এখন তাহলে ব্যাপারটা কি নিয়ে?’ সি্ভ্য়াজস্কি আর ভ্রন্স্কির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
‘স্নেৎকোভকে নিয়ে। দরকার উনি হয় আপত্তি করুণ নয় সম্মতি দিন’, জবাব দিলেন সি্ভ্য়াজস্কি।
‘তা উনি সম্মতি দিয়েছেন, নাকি দেননি?
‘ব্যাপারটাই তো এই যে, তিনি কোনটাই করছেন না’, বললেন ভ্রন্স্কি।
‘উনি যদি আপত্তি করেন, কে দাঁড়াবে?’ ভ্রন্স্কির দিকে তাকিয়ে বললেন লেভিন।
‘যে চায়’, সি্ভ্য়াজস্কি বললেন।
‘আপনি দাঁড়াবেন?’ জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।
‘অন্তত আমি নই’, বিব্রত হয়ে কজ্নিশেভের কাছে দণ্ডায়মান বিষজিহ্ব ভদ্রলোকের দিকে সভয়ে দৃষ্টিপাত করে সি্ভ্য়াজস্কি বললেন।’
‘কে তাহলে? নেভেদোভস্কি?’ লেভিন জিজ্ঞেস করলেন। টের পাচ্ছিলেন যে তিনি একটা গোলমাল করে ফেললেন।
কিন্তু ব্যাপারটা আরো খারাপ। নেভেদোভস্কি আর সি্ভ্য়াজস্কি ছিলেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী।
‘আমি কোনক্রমেই নই’, জবাব দিলেন বিষজিহ্ব ভদ্রলোক।
বোঝা গেল ইনিই নেভোদোভস্কি। সি্ভ্য়াজস্কি তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন লেভিনের
‘কি, তোমারও আঁতে ঘা লেগেছে?’ ভ্রন্স্কির দিকে চোখ মটকে অব্লোন্স্কি বললেন, ‘এ যেন ঘোড়দৌড়, বাজিও রাখা যায়।’
‘হ্যাঁ, ঘা লেগেছে’, ভ্রন্স্কি বললেন, ‘ব্যাপারটা হাতে একবার নিলে তার হেস্তনেস্ত করার ইচ্ছে হয়। সংগ্রাম ভুরু কুঁচকে নিজের শক্ত চেপে বললেন তিনি।
‘কি কাজের লোক সি্ভ্য়াজস্কি! সব কিছু ওর কাছে পরিষ্কার।’
‘ও হ্যাঁ’, অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলেন ভ্রন্স্কি।
নীরবতা নামল আর সে সময় কিছু-একটার দিকে তাকাতে হয় বলে ভ্রন্স্কি তাকালেন লেভিনের দিকে। তার পা, তার উর্দি, তার মুখের দিকে তার বিষণ্ণ দৃষ্টি তাঁর দিকেই নিবদ্ধ দেখে কিছু-একটা বলতে হয় বলে মন্তব্য করলেন। ‘আপনি বরাবর গ্রামবাসি হয়েও সালিশ জজ নন কেন? সালিশ জজের উর্দি তো আপনি পরেননি দেখছি।’