মাতভেই জিজ্ঞেস করল, ‘একা, নাকি স্বামীর সাথে?
অবলোনস্কি কোন কথা বলতে পারলেন না। কেননা নাপিত তখন তার ওপরের ঠোঁট নিয়ে ব্যস্ত। উনি একটা আঙুল তুললেন। আয়নায় মাথা নাড়ল মাতভেই।
‘বেশ। ওপর তলায় ব্যবস্থা করব?
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনাকে বল, যেখানে বলবে সেখানে।
কেমন যেন সন্দিহান হয়ে পুনরুক্তি করল মাতভেই, দারিয়া আলেকসান্দ্রভনাকে?’
হ্যাঁ, ওঁকে বল। আর এই টেলিগ্রামটা নে, কি উনি বললেন–জানাস।
যাচাই করে দেখতে চাইছেন?’ মাতভেই বুঝল ব্যাপারটা। কিন্তু শুধু বলল, ‘জ্বি আচ্ছা।
মাতভেই যখন টেলিগ্রাম হাতে বুট জুতার কাঁচকেঁচে শব্দ তুলে ধীরে ধীরে পা ফেলে ঘরে ঢুকল, অবলোনস্কি ততক্ষণে বোয়া-পাকলা হয়ে চুল আঁচড়ে পোশাক পরার উপক্রম করছেন। নাপিত চলে গেছে।
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা জানাতে বলেছেন যে, উনি চলে যাচ্ছেন। ওঁর, তার মানে আপনার যা খুশি তাই করুন, সে বলল শুধু চোখ দিয়ে হেসে, পকেটে হাত ঢুকিয়ে, ঘাড় কাত করে মনিবের দিকে তাকিয়ে।
অবলোনস্কি চুপ করে রইলেন। পরে সহৃদয় কিন্তু খানিকটা করুণ হাসি ফুটে উঠল তাঁর সুন্দর মুখে।
তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘এ্যাঁ? মাতভেই?
মাতভেই বলল, ‘ও কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ঠিক হয়ে যাবে?
‘জ্বি হ্যাঁ।
দরজার ওপাশে মেয়েলী পোশাকের খসখস শব্দ শুনে অবলোনস্কি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর তাই মনে হচ্ছে? কে ওখানে?’
‘জ্বি, এটা আমি’, সাড়া এল দৃঢ় মোলায়েম নারীকণ্ঠে, দরজার বাইরে থেকে বসন্তের দাগ ধরা কঠোর মুখখানা বাড়ালেন আয়া মাত্রেনা ফিলিমনোভনা।
অবলোনস্কি দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হল, মাত্রেনা?’
অবলোনস্কি স্ত্রীর কাছে পুরোপুরি দোষী হলেও এবং নিজেও সেটা অনুভব করলেও বাড়ির সবাই, এমন কি দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার প্রধান বান্ধবী আয়া পর্যন্ত তাঁর পক্ষে।
তিনি ক্লান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তা কি হল?
‘মিটিয়ে নিন, নয় দোষ স্বীকার করুন। সৃষ্টিকর্তা দেখবেন। খুবই যাতনা পাচ্ছেন, দেখতে কষ্ট লাগে। বাড়ির সব কিছুই একেবারে এলোমেলো। ছেলেমেয়েগুলোর জন্য একটু মায়া হওয়া উচিত। দোষ মেনে নিন। কি করা যাবে। ভালোবাসার দায় অনেক।
‘আমাকে তো নেবে না…’
‘আপনার যা যা করার করুন না। সৃষ্টিকর্তা অসীম দয়ালু, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন! ক্ষমা চান!
অবলোনস্কি হঠাৎ লাল হয়ে উঠে বললেন, ‘ঠিক আছে, যাও এখন। মাতভেইয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, যাক গে, পোশাক পরা যাক’, এবং দৃঢ় ভঙ্গিতে ছাড়লেন ড্রেসিং গাউনটা।
অদৃশ্য কি-একটা জিনিসকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে দিতে মাতভেই আগে থেকেই শার্টটা ধরে ছিল, সুস্পষ্ট তৃপ্তির সাথে মনিবের সযত্নমার্জিত শরীরে তা পরিয়ে দিল।
তিন
অবলোন্স্কি পোশাকটা পরার পর সেন্ট মেখে তার শার্টের হাতা ঠিক করে নিলেন এবং অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সিগারেট, মানিব্যাগ, দেশলাই, দুটো চেন আর পেন্ডেন্ট লাগানো ঘড়ি পকেটে ঢোকালেন, তারপর রুমাল ঝাড়া দিয়ে নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সুরভিত, সুস্থ আর নিজের দুর্ভাগ্যটা সত্ত্বেও শারীরিকভাবে উৎফুল্ল অনুভব করে দু’পা সামান্য নাচিয়ে নাচিয়ে ডাইনিং-রুমে ঢুকলেন। সেখানে তার জন্য ইতিমধ্যেই কফি প্রস্তুত আর কফির পাশে রয়েছে কয়েকটা চিঠি আর কর্মচারীদের দাখিলা। তিনি সেখান থেকে তুলে নিয়ে চিঠিগুলো পড়লেন। একটা চিঠি বড়ই অপ্রীতিকর, তার স্ত্রীর সম্পত্তির অন্তর্গত বন কিনছে যে বেনিয়া, সে লিখেছে। বনটা বিক্রি করা অত্যাবশ্যক ছিল; কিন্তু এখন, স্ত্রীর সাথে মিটমাট না-হওয়া পর্যন্ত সে কথাই ওঠে না। সবচেয়ে অপ্রীতিকর এই যে, এতে স্ত্রীর সাথে মিটমাটের ব্যাপারে আর্থিক স্বার্থ জড়িয়ে যাচ্ছে। এই স্বার্থে তিনি চালিত হতে পারেন, এই বিক্রির জন্য তিনি স্ত্রীর সাথে মিটমাট চাইবেন, এ ভাবনাটাই তার কাছে অপমানকর বলে মনে হল।
অবলোনস্কি চিঠি পড়া শেষ করে কর্মচারীদের দাখিলাগুলো টেনে নিলেন। দ্রুত পাতা উটিয়ে গেলেন দুটো মামলার, বড় একটা পেনৃসিলে কয়েকটা মন্তব্য টুকলেন, তারপর কাগজপত্রগুলো সরিয়ে শুরু করলেন কফি খেতে; কফির পর তিনি তখনো সোঁদা সোঁদা প্রভাতী কাগজ খুলে পড়তে লাগলেন।
যে সাহিত্যিক উদারনৈতিক সংবাদপত্রটি চরমপন্থী নয়, কিন্তু অধিকাংশই ছিল যার মতামতের পেছনে, অবলোনস্কি তা পেতেন এবং পড়তেন। বিজ্ঞান বা শিল্প বা রাজনীতি, কিছুতেই আসলে তার আগ্রহ না থাকলেও এসব ব্যাপারে অধিকাংশ লোকের এবং তার পত্রিকার যা মতামত তিনিও তাই পোষণ করতেন এবং সেটা পালটাতেন শুধু যখন অধিকাংশ লোক সেটা পালটাত, অথবা বলা ভালো, পালটাত না, নিজেরাই তাতে অলক্ষ্যে বদলে যেত।
অবলোনস্কি মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গি বাছবিচার করে গ্রহণ করতেন না। এগুলো তার কাছে আসত আপনা থেকেই। ঠিক যেমন টুপির আকৃতি বা ফ্রক-কোট তিনি তাই বেছে নিতেন লোকে যা পরে। আর উঁচু সমাজে যিনি বাস করছেন, যেখানে কিছুটা মস্তিষ্কচালনা যা পরিপক্বতার কালে সাধারণত বিকশিত হয়ে ওঠে, সেখানে তার একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকা একটা টুপি থাকার মতই সমান প্রয়োজন। তাঁর মহলের অনেকেও রক্ষণশীল মতবাদ পোষণ করত, তার বদলে তিনি কেন উদারনৈতিক ধারা পছন্দ করলেন তার যদি কোন কারণ থেকে থাকে, তাহলে সেটা এই নয় যে উদারনৈতিক মতবাদ তাঁর কাছে বেশি যুক্তিযুক্ত বলে ঠেকেছিল, উদারনৈতিক ধারাটার মিল ছিল তাঁরই জীবনযাত্রার সাথে । উদারনৈতিক পার্টি বলত যে রাশিয়ায় সবই খারাপ এবং সত্যিই অবলোনস্কির ঋণ ছিল প্রচুর আর টাকায় একেবারে কুলাচ্ছিল না। উদারনৈতিক পার্টি বলত যে বিবাহ একটা অচল প্রথা, ওটাকে ঢেলে সাজা দরকার আর সত্যিই পারিবারিক জীবন অবলোনস্কিকে তৃপ্তি দিয়েছে কম, তাকে মিথ্যা কথা বলতে, ভান করতে বাধ্য করেছে যা তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ। উদারনৈতিক পার্টি বলত, অথবা বলা ভালো ধরে নিত যে ধর্ম হল কেবল অধিবাসীদের বর্বর অংশকে বলগায় টেনে রাখার ব্যাপার, এবং সত্যিই ছোট একটা প্রার্থনাতে অবলোনস্কির পা ব্যথা করে উঠত এবং তিনি বুঝতে পারতেন না কেন পরলোক নিয়ে ঐ সব ভয়াবহ, বড় বড় কথা, যখন ইহলোকেই দিন কাটানো এত আনন্দের। সেই সাথে হাসি-খুশি রসিকতার ভক্ত অবলোনস্কি নিরীহ কোন লোককে এই বলে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়াতে আনন্দ পেতেন যে বংশ নিয়ে গর্ব যদি করতেই হয়, তাহলে রিউরিকেই থেকে গিয়ে প্রথম বংশপিতা বানরকে অস্বীকার করা অনুচিত। এভাবে উদারনৈতিক মতবাদ একটা অভ্যাস হয়ে ওঠে অবলোনস্কির কাছে এবং নিজের কাগজটিকে তিনি। ভালোবাসতেন আহারের পর একটা চুরুটের মত, মাথায় যে একটা হালকা কুয়াশা তাতে দেখা দিত, তার জন্য। সম্পাদকীয় প্রবন্ধটি পড়লেন, তাতে বলা হয়েছে যে আমাদের কালো খামোকাই এই বলে চিৎকার তোলা হচ্ছে যে র্যাডিকেলিজম বুঝি সমস্ত রক্ষণশীল উপাদানকে গ্রাস করে ফেলার বিপদস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সরকারের নাকি উচিত বৈপ্লবিক সর্পদানবকে দমন করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া, উলটে বরং আমাদের মতে বিপদটা সর্পদানবে নয়, সমস্ত প্রগতি রুদ্ধ করা সনাতনতার একগুয়েমিতে’, ইত্যাদি। অর্থ বিষয়ে আরেকটা প্রবন্ধ তিনি পড়লেন, যাতে বেন্থাম ও মিল-এর উল্লেখ করে খেচা দেওয়া হয়েছে মন্ত্রিদপ্তরকে। নিজের প্রকৃতিগত দ্রুত কল্পনাশক্তিতে প্রতিটি খেচার অর্থ তিনি বুঝতেন : কার কাছ থেকে, কার উদ্দেশে, কি উপলক্ষে এসব খোঁচা শাণিত আর বরাবরের মত এতে তিনি। খানিকটা তৃপ্তি পেতেন। কিন্তু আজ এ তৃপ্তি বিষিয়ে গেল মাত্রেনা ফিলিমনোভনার উপদেশে আর বাড়িটা যে কি অশান্তিকর হয়ে উঠেছে সে কথা মনে পড়ে গিয়ে। তিনি আরো পড়লেন যে শোনা যাচ্ছে কাউন্ট বেইস্ট ভিসবাডেনে গেছেন, সাদা চুল আর নেই, হালকা ঘোড়াগাড়ি বিক্রি হচ্ছে, তরুণ জনৈক ব্যক্তি কি প্রস্তাব দিয়েছে; কিন্তু এসব খবরে আগের মত মৃদু অন্তর্ভেদী আনন্দ আর পেলেন না।