এই বোকাটে হাসিটার জন্য তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না; সেই হাসি দেখে ডল্লি যেন শারীরিক যন্ত্রণায় কেঁপে উঠলেন। তারপর তার স্বাভাবিক উত্তপ্ততায় চোখা চোখা কথার বন্যা তুলে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যান। তিনি সেই থেকে আর স্বামীকে দেখতে চাননি।
অবলোনস্কি ভাবলেন, ‘ওই বোকাটে হাসিটারই সকল দোষ।’ তিনি হতাশ হয়ে নিজেকেই বললেন, ‘কিন্তু কি করা যায়? কি করি?’ তবে এ কথার কোন উত্তর পেলেন না।
দুই
অবলোনস্কি নিজের প্রতি খুবই সত্যনিষ্ঠ মানুষ। তিনি তাঁর আচার-আচরণের জন্য অনুতপ্ত–এ কথা বলে তিনি নিজেকে ভোলাতে পারেন না। এখন তিনি অনুশোচনা করতে পারেন না যে তিনি, চৌত্রিশ বছরের সুদর্শন, প্রেমাকুল পুরুষ পাঁচটা জীবিত ও দুটো মৃত সন্তানের জননী, তার চেয়ে মাত্র এক বছরের ছোট তাঁর স্ত্রীকে ভালোবাসতেন না। তাঁর অনুশোচনা শুধু এজন্য যে, স্ত্রীর কাছ থেকে আরো ভালো করে তিনি লুকিয়ে থাকতে পারেননি। তবে তিনি নিজের অবস্থার গুরুত্ব সবই টের পাচ্ছিলেন। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এবং নিজের জন্য মায়া হচ্ছিল তার। খবরটা স্ত্রীর ওপর কেমন রেখাপাত করবে তা জানা থাকলে হয়ত তিনি তার অপরাধ আরো ভালো করে চাপা দিতে পারতেন। প্রশ্নটা নিয়ে তিনি কখনো পরিষ্কার করে ভাবেননি, কিন্তু ঝাপসাভাবে তার মনে হত যে, অনেকদিন থেকেই স্ত্রী আন্দাজ করেছেন যে তিনি তার প্রতি বিশ্বস্ত নন এবং সেটায় গুরুত্ব দেন না। তার এমন কি এও মনে হত যে শীর্ণা, বুড়িয়ে-আসা, ইতিমধ্যেই অসুন্দরী নারী, কোন দিক থেকেই যে উল্লেখযোগ্য নয়, সাধারণ, নিতান্ত সংসারের সহৃদয়া জননী; ন্যায়বোধে তার উচিত প্রশ্রয় দেওয়া। কিন্তু ঘটল তার উল্টোটা।
অবলোনস্কি বারবার নিজেকেই বললেন, ‘আহ্, ভয়ানক ব্যাপার! ইস্, ইস্, ইস্! ভয়ানক!’ কিন্তু কিছুই ভেবে উঠতে পারলেন না : ‘অথচ এর আগে পর্যন্ত সব কিছু কি ভালোই না ছিল! কি সুন্দর দিন কাটছিল আমাদের! উনি ছিলেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুখী, সন্তুষ্ট, কোন কিছুতে ওঁর অসুবিধা ঘটাইনি আমি। উনি যা চাইতেন, ছেলেমেয়েদের নিয়ে, সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগ ওঁকে দিয়েছি। তবে ঐ মেয়েটা যে আমাদের গৃহশিক্ষকা ছিল, সেটা ভালো হয়নি। ভালো নয়! গৃহশিক্ষিকার প্রতি প্রেম নিবেদনে কেমন একটা তুচ্ছতা, মামুলিপনা আছে। কিন্তু কেমন গৃহশিক্ষিকা! (জীবন্ত হয়ে ওঁর মনে ভেসে উঠল মাদমোয়াজেল রোলার কালো চোখ আর মিষ্টি হাসি)। কিন্তু যতদিন সে আমাদের বাড়িতে ছিল ততদিন আমি নিজেকে কিছু করতে দিইনি। সবচেয়ে খারাপ এই যে, ও এখন…এসব যেন ইচ্ছে করেই! উহ্, উহ্, উহ্! কিন্তু কি করা যায় এখন?’
সকল জটিল অমীমাংসেয় প্রশ্নের যে সাধারণ উত্তর দেয় জীবন, তাছাড়া অন্য কোন উত্তর ছিল না। সেটা এই: দিনের চাহিদা মত বাঁচতে হবে, অর্থাৎ বিভোর হয়ে থাকতে হবে। স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা চলে না, অন্তত রাত পর্যন্ত পানপাত্র নারীরা যে গান গেয়েছিল ফেরা যায় না তাতে; তাহলে জীবনের স্বপ্নেই বিভোর হয়ে থাকা উচিত।
অবলোনস্কি মনে মনে বললেন, তখন দেখা যাবে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে, নীল রেশমি আস্তর দেওয়া ধূসর ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে, থুপিতে বাঁধন দিয়ে, প্রশস্ত বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে খুশি হয়ে, তার পুরুষ্টু দেহ অত অনায়াসে বহন করে যে পদদ্বয়, তাতে তার অভ্যস্ত, উফুল্ল, পাক দেওয়া কদম বাড়িয়ে গেলেন জানালার কাছে। পর্দাটা সরিয়ে ঘণ্টি দিলেন। ঘণ্টি শুনেই তৎক্ষণাৎ ঘরে ঢুকল পুরানো বন্ধু, খাস চাকর মাতভেই, গাউন জুতা আর টেলিগ্রাম নিয়ে। মাতভেইয়ের পিছু পিছু ক্ষৌরকমের সাজসরঞ্জাম নিয়ে নাপিত এল।
অবলোনস্কি টেলিগ্রামটা নিয়ে আয়নার সামনে বসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অফিস থেকে কাগজ আছে।’
মাতভেই জবাব দিল, ‘টেবিলে আছে।’ তারপর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সহমর্মিতায় মনিবের দিকে তাকিয়ে ধূর্ত হেসে যোগ করল, ‘ঘোড়া গাড়ির মালিকের কাছ থেকে লোক এসেছিল।’
অবলোনস্কি কোন জবাব না দিয়ে আয়নায় তাকালেন মাতভেইয়ের দিকে; আয়নায় যে দৃষ্টি বিনিময় হল, তাতে বোঝা যায় পরস্পরকে তারা কতটা বোঝে। অবলোনস্কির দৃষ্টি যেন বলছিল, এ কথা কেন বলছিস? তুই কি জানিস না?
মাতভেই তার জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পা ফাঁক করে নীরবে, ভালো মনে, একটু-বা হেসে তাকিয়ে ছিল তার মনিবের দিকে।
সে বলল, ‘আমি বলেছিলাম ওই রবিবারে আসতে। এর মাঝখানে যেন আপনাকে আর নিজেকে মিছেমিছি বিরক্ত না করে।’ বোঝা যায় কথাটা আগে থেকেই তৈরি করা ছিল।
অবলোনস্কি বুঝলেন যে মাতভেই রসিকতা করতে, নিজের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছে। টেলিগ্রামটা ছিঁড়ে বরাবরের মত ছিন্ন শব্দগুলো অনুমান করে সেটা তিনি পড়লেন, তাঁর মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
‘মাতভেই, বোন আন্না আর্কাদিয়েভনা কাল আসছে’, তিনি মিনিটখানেক নাপিতের চেকনাই মোটা হাতের দিকে না তাকিয়ে বললেন। কোঁকড়া দুই গালপাট্টার মাঝখানে সে হাত গোলাপি সেতু রচনা করছিল।
মাতভেই বলল, হায় আল্লাহ্! জবাবটায় সে বোঝাতে চাইল যে মনিবের মত সেও বোঝে এই আগমনের গুরুত্ব। অর্থাৎ অবলোনস্কির স্নেহের বোন আন্না আর্কাদিয়েভনা স্বামী-স্ত্রীর মিল করিয়ে দিতে সাহায্য করতে পারেন।