নাও, হয়েছে-হয়েছে। দাঁড়াও না, তুমিও এই পথেই আসবে। তোমার যে কারাজিনস্কি উয়েজুদে তিন হাজার দেসিয়াতিনা (এক দেসিয়াতিনা–১০,০০০ বর্গ মিটারের মত)। জমি আছে, এমন পেশী, বারো বছরের কুমারীর মত এমন তাজা আমেজ, তাহলেও আসবে তুমি আমাদের কাছেই। তা তুমি যা জিজ্ঞেস করেছিলে অদলবদল কিছু হয়নি, তুমি বহুদিন যাওনি সেখানে–এটাই শুধু আফসোসের কথা।
লেভিন ভীতভাবে বললেন, ‘কেন, কি হল?
‘ও কিছু না, জবাব দিলেন অবলোনস্কি। কথা হবে। কিন্তু সত্যি, কেন তুমি এলে বলো তোর ‘আহ্, এ নিয়েও কথা হবে পরে, আবার আকর্ণ রক্তিম হয়ে বললেন লেভিন।
তা বেশ। বোঝা গেল’, অবলোনস্কি বললেন। কি জানো, আমি তোমাকে নিজের বাড়িতেই ডাকতাম, কিন্তু স্ত্রী মোটেই সুস্থ নয়। আর শোনো, ওদের সাথে যদি দেখা করতে চাও, তাহলে ওরা নিশ্চয় এখন জু-পার্কে, চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত থাকবে। কিটি স্কেট করে। তুমি চলে যাও সেখানে, আমিও যাব, তারপর একসাথে খেয়ে নেব কোথাও।
চমৎকার, আবার দেখা হওয়া পর্যন্ত।
‘দেখো, আমি তো তোমাকে জানি, ভুলে যাবে কিংবা হঠাৎ চলে যাবে গায়ে!’ হেসে চিৎকার করে বললেন অবলোনস্কি।
না, সত্যি বলছি।
এবং অবলোনস্কির বন্ধুদের অভিনন্দন জানাতে যে ভুলে গেছেন কেবিনেট থেকে।
লেভিন চলে গেলে গ্রিনেভিচ বললেন, ‘নিশ্চয় খুব উদ্যোগী পুরুষ।
‘হ্যাঁ গো, মাথা দুলিয়ে বললেন অবলোনস্কি, সুখী লোক! কারাজিনস্কি উয়েজদে তিন হাজার দেসিয়াতিনা জমি, সবই পড়ে আছে ওর সামনে, আর কি তাজা! আমাদের মত নয় ভায়া।
‘অবলোনস্কি, আপনার নালিশ করার কি আছে?
অবলোনস্কি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আরে যাচ্ছেতাই, বিছছিরি।
ছয়
লেভিনকে অবলোনস্কি যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন ঠিক কেন সে এসেছে, তখন লেভিন লাল হয়ে ওঠেন, এবং লাল হয়ে উঠেছেন বলে রেগে ওঠেন নিজের ওপরেই, কেননা এ জবাব তিনি দিতে পারতেন না : ‘এসেছি তোমার শ্যালিকার পাণিপ্রার্থনা করতে, যদিও শুধু এজন্যই তিনি এসেছিলেন।
লেভিন আর শ্যেরবাৎস্কিদের বংশ মস্কোর বনেদি অভিজাত বংশ, সব সময়ই তাদের মধ্যে ছিল ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এ সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয় লেভিনের উচ্চশিক্ষার্থী জীবনে। ডল্লি আর কিটির ভাই তরুণ প্রিন্স শ্যেরবাৎস্কির সাথে একই সাথে তিনি প্রস্তুত হন এবং একসাথেই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। এই সময় লেভিন প্রায়ই শ্যেরবাৎস্কিদের বাড়িতে আসতেন, বাড়িটাকে তিনি ভালোবেসে ফেলেন। যতই এটা আশ্চর্য ঠেকুক, লেভিন ভালোবেসেছিলেন ঠিক বাড়িটাই, পরিবারটাকে, বিশেষ করে তার অন্দরমহলকে। নিজের মাকে লেভিনের মনে পড়ে না, আর বোন ছিল তাঁর চেয়ে বয়সে বড়, তাই শ্যেরবাৎস্কিদের বাড়িতেই তিনি প্রথম দেখেন সেই বনেদি, অভিজাত, সুশিক্ষিত ও সততাশীল সংসার, যা তিনি হারিয়েছিলেন পিতা-মাতার মৃত্যুতে। এ পরিবারের সমস্ত সভ্য, বিশেষ করে মেয়েরা ছিল কেমন একটা রহস্যময় কাব্যধর্মী অবগুণ্ঠনে ঢাকা, আর তিনি তাদের ভেতর কোন ত্রুটি দেখেননি তাই নয়, এই অবগুণ্ঠনের তলে সবচেয়ে সমুন্নত অনুভূতি, সবরকমের পূর্ণতা আছে বলে ধরে নিতেন। একদিন পর পর কেন এই তিন দ্ৰ কন্যার প্রয়োজন হত ফরাসি আর ইংরেজিতে কথা বলার; কেন একটা নির্দিষ্ট সময়ে তারা পালা করে বাজাতো পিয়ানো যার ধ্বনি পৌঁছতো ওপরতলায় ভাইয়ের ঘরে যেখানে পড়াশুনা করত ছাত্ররা; কেন আসততা ফরাসি সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নৃত্যের এই শিক্ষকেরা; কেন একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই তিন কন্যাই মাদমোয়াজেল লিনোর সাথে গাড়ি করে তভেঞ্চয় বুলভারে যেত তাদের বিলিতি কোট পরে–ডল্লিরটা লম্বা, নাটালির আধা-লম্বা, আর কিটিরটা একেবারেই খাটো, ফলে টানটান লাল মোজা পরা তার সুঠাম পা-দু’খানা চোখে পড়ত; সোনালি তকমা লাগানো টুপি পরা চাপরাশি সমভিব্যাহারে কেন তাদের রহস্যময় জগতে আরো যা যা ঘটত তার অনেককিছুই তিনি বুঝতেন না, কিন্তু জানতেন যে এখানে যা কিছু ঘটছে তা সবই অপরূপ আর প্রেমে পড়ে যান ঠিক এই রহস্যময়তার সাথে।
ছাত্রজীবনে উনি প্রায় বড় বোন ডল্লির প্রেমে পড়তে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শিগগিরই তার বিয়ে হয়ে গেল অবলোনস্কির সাথে। পরে তিনি মেজো বোনের প্রণয়াসক্ত হতে থাকেন। উনি কেমন যেন অনুভব করতেন যে, বোনদের একজনের প্রেমে তার পড়া দরকার, শুধু ঠিক কার প্রেমে সেটা স্থির করে উঠতে পারতেন না। কিন্তু নাটালিও সমাজে দেখা দিতে না দিতেই কূটনীতিক ভভের সাথে বিয়ে হয়ে গেল তার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেভিন যখন পাশ করে বেরোলেন, কিটি তখনো হোট। তরুণ শ্যেরবাৎস্কি যোগ দিলেন নৌবহরে এবং বালটিক সাগরে সলিলসমাধি নেন। অবলোনস্কির সাথে বন্ধুত্ব সত্ত্বেও শ্যেরবাৎস্কি পরিবারের সাথে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে এল। কিন্তু এক বছর গ্রামে গ্রামে কাটিয়ে এ বছর শীতের প্রারম্ভে লেভিন যখন মস্কো আসেন এবং দেখা হয় শ্যেরবাৎস্কিদের সাথে, তিনি বুঝলেন, এই তিনজনের মধ্যে সত্যি-সত্যিই কাকে ভালোবাসা ছিল তাঁর নিবন্ধ।
ভালো বংশের লোক, গরিবের চেয়ে বরং বড়লোক বলাই উচিত, বত্রিশ বছর বয়স, তার মত এমন একজনের পক্ষে প্রিন্সেস শ্যেরবাৎস্কায়ার পাণিপ্রার্থনা করার চেয়ে সহজ আর কিছু হতে পারে না বলেই মনে হতে পারত; একান্ত সম্ভব ছিল যে তাকে তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করা হত উত্তম পাত্র হিসেবে। কিন্তু লেভিন প্রেমে পড়েছিলেন এবং তাঁর মনে হত যে কিটি সব দিক দিয়ে এতই সুসম্পূর্ণ, পার্থিব সব কিছুর উর্ধ্বে এমন এক জীব আর তিনি এতই পার্থিব ও হীন যে অন্যেরা এবং কিটি স্বয়ং তাকে তার যোগ্য বলে স্বীকার করবে এমন কথা ভাবাই যায় না।