আমি চিন্তা ভাবনার পেছনে অনেক বেশি সময় ব্যয় করতাম। অধিক চিন্তা সবকিছু খারাপের দিকে নিয়ে যায়। আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম সে সম্পর্কে আমি যতই ভেবেছি ততই ভীত হয়েছি। আপনার মস্তিষ্ক ঠিক এই কাজটিই করবে যখন আপনি কোন সমস্যা নিয়ে অধিক চিন্তা-ভাবনা করবেন। এটা আপনার সমস্যাগুলোকে আরো বড় করে তুলবে। আমি যত বেশি চিন্তা করছিলাম ঠিক ততবেশি অনিশ্চিত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম, ততবেশি বিবশ অনুভব করছিলাম।
প্রতি রাতে প্রচুর মদ্যপান করে পাড় মাতাল হয়ে আমি বিছানায় যেতাম এবং চোখ বোজামাত্র একটি ভিন্ন জীবনের স্বপ্ন দেখতাম যেখানে আমার কোনো কাজ করার নেই এবং আমাদের সমস্যাগুলো জাদুমন্ত্রের মতো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। এবং যে মুহূর্তে আমার ঘুম ভেঙে যেত, আমাকে মুখোমুখি হতে হতো কঠিন বাস্তবতার। মনে হতো যেন আমার জীবনটাই একটা দুঃস্বপ্ন।
এখানেই দেখা দিত ঘুমিয়ে পড় নামক বোতামটি যা প্রতিদিন ভোরে আমি দু-তিনবার কখনোবা চারবার পর্যন্ত টিপে দিতাম। ঘুমিয়ে পড় নামক বোতামটি টিপে দেবার পর এক মুহূর্তের জন্য মনে হতো সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রণেই আছে। এটা ছিল নিজেকে উল্টোপাল্টা বলার মতো–
ঠিক আছে, জীবন তুমি জাহান্নামে যাও। আমি উঠছি না। আমি এখন আবার ঘুমুতে চলেছি। আবার সেখানে।
শেষ পর্যন্ত আমি যখন জেগে উঠি, ইতিমধ্যে ক্রীস রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছে, বাচ্চারা স্কুলের পোশাক নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থায় আছে এবং তাদের স্কুলবাস অনেক আগেই ছেড়ে চলে গেছে। বলতে গেলে সকালগুলো ছিল বিশৃঙ্খলাপূর্ণ যা আরো কিছুটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যেতো। আমি সবসময় দেরি করতাম। যেহেতু খুব দ্রুত আমাকে বের হতে হবে, তা করতে গিয়ে প্রতিনিয়তঃ আমি দুপুরের খাবার, আমার ব্যাগ, জিমব্যাগ এবং কর্মস্থলে প্রবেশের অনুমতিপত্র সঙ্গে নিতে ভুলে যেতাম। আমার নিজের কাছেই খুব লজ্জা লাগতো। মনে হতো নিজেকে আমি কোনো প্রান্তরেখার দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
এই হলো বিষয়। সঠিকভাবে একটি দিন শুরু করতে কি কি করা প্রয়োজন তা আমার জানা ছিল। আমাকে ঠিক সময়ে ঘুম থেকে উঠতে হবে, নাশতা তৈরি করতে হবে এবং ঠিক সময়ে বাচ্চাদের স্কুলবাসে তুলে দিতে হবে। অতঃপর আমাকে একটি নতুন কাজের খোঁজ করতে হবে। এগুলো এভারেস্ট পর্বতে চড়ার মতো কোনো বড় ব্যাপার ছিল না। এটা ছিল সহজ বিষয়গুলোকে অকারণে জটিল করে তোলা। আমার কাছে এমন কোনো যুৎসই অজুহাত ছিল না যাতে করে আমি নিজেকে বোঝাতে পারি, ঠিক কি কারণে কাজগুলো আমি করতে পারছিলাম না। আমার আত্মবিশ্বাস সর্পিল গতি লাভ করেছিল। এটা (আমার আত্মবিশ্বাস) এমনকি সঠিক সময়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। কেমন করে এটা তাহলে আমার ভেতরে বিশ্বাস তৈরি করবে যে আমার আর্থিক সমস্যাগুলো এবং ক্রীস-এর সাথে আমার বৈবাহিক সমস্যাগুলো আমি সমাধান করতে পারি?
আপনি কি কখনো খেয়াল করেছেন ছোট বিষয়গুলো কেমন করে এতটা কঠিন মনে হয়? অনেকের কাছ থেকে শুনে আমার এটা মনে হয়েছে যে, এই ব্যাপারে আমি একা নই। এই ছোট অথচ কঠিন বিষয়গুলোর তালিকা সারা পৃথিবীতে আশ্চর্যজনকভাবে একই। যেমন :
*মিটিং-এ কথা বলা
*ইতিবাচক থাকা
*সিদ্ধান্ত গ্রহণ
* নিজের জন্য সময় ব্যয় করা
* প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করা
* হাত তোলা
* উঠে দাঁড়ানো
* নিজের প্রতি সন্দেহের অবসান
*আত্মোন্নয়ন
*ই-মেইলগুলো পাঠিয়ে দেওয়া
*নিজের পরিকল্পনায় স্থির থাকা
*ঘর থেকে বের হওয়া
*স্বেচ্ছাসেবী হওয়া
*পূণর্মিলনীতে যোগ দেওয়া
* কোনো প্রাক্তনকে সামাজিক মাধ্যমে ব্লক করা
*আকর্ষণীয় কারো সাথে কথা বলা
*আনন্দ উচ্ছ্বাসে যোগ দেওয়া
*নিজের কাজ প্রকাশ করা
*জিমনেসিয়াম যাওয়া
*আহারে সংযমী হওয়া
* “না” বলা
* সাহায্য প্রার্থনা করা
* নিজেকে পাহারা দেওয়া
*ভুল স্বীকার করা
*শোনা
আমার ক্ষেত্রে এমন হয়েছিল যে প্রতিরাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করছি– আগামীকালই আমি নিজেকে পরিবর্তন করবো। আমার প্রতিজ্ঞাগুলো এমন হতো যে–
আমি বদলে যাবো। ভোরে ঠিক সময়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়বো। আগামীকাল আমি ভালো ব্যবহার করব এবং একটু কঠিন চেষ্টা করবো। জিমনেসিয়াম যাবো। স্বামীর প্রতি দৃষ্টি দেবো। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাব। অতিরিক্ত মদ্যপান ছেড়ে দেবো। আগামীকাল আমি ভবিষ্যতের আমি হবো।
এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং আশা-পূর্ণ হৃদয় নিয়ে আমি ভোর ৬টায় আমার ঘড়ির অ্যালার্ম সেট করে ঘুমুতে যেতাম। এবং প্রাকৃতিক নিয়মে আবার সেই পুরনো চক্রে আমার দিন শুরু হতো। ভোরবেলা যখন আমার ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে উঠতো, আমি ভবিষ্যতের আমাকে অনুভব করতাম না। বরং মনে হতো আমি সেই একই আছি যে কিনা আবার ঘুমিয়ে পড়তে চায়।
হ্যাঁ, আমি উঠে পড়ার কথা ভেবেছি এবং তারপর আবার দ্বিধান্বিত হয়েছি। একদিকে ঘড়ির অ্যালার্ম এবং অন্যদিকে ঘুমিয়ে পড় নামক বোতাম। নিজেকে এর বাইরে বের করে আনতে আমার মাত্র ৫ সেকেন্ড সময় লেগেছিল। বিছানা থেকে আমার উঠতে না পারার কারণটি ছিল খুবই সহজ। আমি শুধু এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারছিলাম না। পরবর্তীতে আমি জানতে পেরেছিলাম, এটা ছিল গবেষকরা যাকে বলে থাকেন অভ্যাসের বৃত্তে আটকা পরা। ঘুমিয়ে পড় নামক বোতামটি ভোরবেলা আমি এতবার টিপেছি যে একটা সময় এটা আমার মস্তিষ্কে প্রাত্যহিক নিয়ম হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে গিয়েছিল।