মনোবল শব্দটি যতবার এসেছে এটি আমাকে তার চাইতে বেশি আগ্রহী করে তুলেছে এমন কোনো ঐতিহাসিক মুহূর্তের মুখোমুখি হতে যা আমাকে আরো ভালোভাবে মনোবলের প্রকৃতিটি বুঝতে সাহায্য করেছিল। প্রথম ব্যক্তি যার কথা আমার মাথায় এসেছিল সে হলো– রোসা পার্কস। আপনি হয়তো তার গল্পটি জানেন যে, কেমন করে তিনি ডিসেম্বর, ১৯৫৫ সালের এক শীতের সন্ধ্যায় আধুনিক আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করেছিলেন যখন তিনি বাসে একজন সাদা চামড়ার যাত্রীকে নিজের আসনটি ছেড়ে দিতে নীরবে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
মনোবল হলো, ইতিহাস ক্লাসে আমার কন্যার কলমটি নামিয়ে রেখে তার হাত উঁচিয়ে ধরা। এটা হলো আপনার প্রতি আপনার দলের মনোযোগ প্রদানের প্রয়োজন এবং আপনার বাচ্চাদের আপনাকে বলার প্রয়োজন যে আসলে কি ঘটতে চলেছে। ডেটিং সাইট-এ আপনার অনলাইন প্রোফাইল স্থাপন অথবা আপনার ফোনে কোনো প্রাক্তনকে ব্লক করা হলো একটি সাহসী পদক্ষেপ। মনোবল হলো– আপনার ব্যবসায় নতুন প্রযুক্তির আত্মীকরণ অথবা একগ্লাস মধ্যপান করা বা টেলিভিশনের সামনে বসে থাকার পরিবর্তে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি দাঁড়ানো।
আমি যখন এই বইটি লিখতে শুরু করি এবং বিশ্বব্যাপী যারা রুলটি ব্যবহার করেছেন তাদের গল্প সংগ্রহ করতে শুরু করি, এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে– যে কোনো সিদ্ধান্তের ভেতরেই রয়েছে একটি ৫ সেকেন্ড-এর মনোবল যা আমাদের জীবনের সবকিছু বদলে দিতে সক্ষম।
তার সাহসীকতার মুহূর্তটি আমাদের শিখিয়েছিল যে– সবকিছু বদলে দিতে খুব বড় কোনো পদক্ষেপ নয় বরং আমাদের জীবনের ক্ষুদ্রতম একটি সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। সেই সন্ধ্যায় তিনি যা করেছিলেন তার জন্য কোনো পূর্ব পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। মিসেস পার্কস নিজেকে বর্ণনা করেছেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে যে নিজেকে সব রকমের ঝামেলা থেকে দূরে রাখতে সবসময় সতর্ক থাকেন। একটি দীর্ঘ কর্মব্যস্ত দিনের শেষে সন্ধ্যায় তার একমাত্র পরিকল্পনা থাকে বাড়ি ফেরা এবং স্বামীর সঙ্গে রাতের খাবার খাওয়া। এটা ছিল আর সব সন্ধ্যার মতোই একটি সন্ধ্যা, যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি সিদ্ধান্ত সবকিছু বদলে দিয়েছিল।
আমি মিসেস পার্কস-এর ওপর গবেষণা করতে জাতীয় সংগ্রহশালা, আজীবনী, বেতার সাক্ষাৎকার ও সংবাদপত্রের নিবন্ধগুলো পড়ে দেখেছিলাম। যা পেয়েছিলাম তা ছিল অবিশ্বাস্য। গ্রেফতার হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর তিনি সিডনি রজার্সকে পেসিফিকা বেতারে একটি সাক্ষাৎকার দেন যা জাতীয় সংগ্রহশালা ওয়েবসাইট শব্দ ধারণ করে রাখে। তার নিজের ভাষায় সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের বর্ণনাটি লিপিবদ্ধ করা হলো :
বাসটি শহরের বাইরের দিকে বেরিয়ে যাবার পথে তৃতীয় স্টপেজে ছিল এবং এর সামনের অংশ সাদা চামড়ার যাত্রী দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। আমি যখন বাসটিতে উঠি, এর পেছনের অংশ বিভিন্ন গাত্রবর্ণের যাত্রী দ্বারা ভরে গিয়েছিল এবং তারা দাঁড়িয়ে যেতে শুরু করেছিল। আমি যে আসনটি দখল করেছিলাম তা ছিল কালো চামড়ার যাত্রীরা যেখানে বসে তার প্রথমটি, হ্যাঁ, এই পথের এটাই ছিল স্বাভাবিক নিয়ম। বাসের চালক লক্ষ্য করল যে বাসের সামনের অংশ সাদা যাত্রীদের দ্বারা পূর্ণ এবং দুতিনজন যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। তিনি পেছনের দিকে তাকিয়ে আমরা কালো যাত্রীরা যে আসলগুলোতে বসেছিলাম তা ছেড়ে দিতে বললেন। অন্য যাত্রীরা অত্যন্ত নিরুৎসাহের সঙ্গে কাজটি করছিল কিন্তু আমি তা করতে অস্বীকৃতি জানাই। চালক আমাকে বলে যে, আমি যদি আসনটি ছেড়ে না দিই তবে তিনি পুলিশ ডাকবেন। আমি তাকে বলি– ঠিক আছে পুলিশ ডাকুন।
এরপর বেতার উপস্থাপক তাকে কোটি টাকা মূল্যের প্রশ্নটি করেন :
জিম ক্রো এবং বিচ্ছিন্নতার সেই সব বছরগুলো পেরিয়ে কখন আপনি এমন ব্যক্তিত্ব হতে এবং সেই বিশেষ মুহূর্তে বাসের আসনটি ধরে রাখতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন?
মিসেস পার্কস খুব সহজভাবে জবাব দিলেন :
আমি অনুভব করেছিলাম যে আমার সাথে একজন যাত্রী হিসেবে সঠিক আচরণ করা হয়নি এবং আমার অধিকার আছে বাসের একজন যাত্রী হিসেবে আসনটি ধরে রাখার।
উপস্থাপক আবার তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন– বছরের পর বছর ধরে তো আপনি এভাবেই নির্যাতিত হয়েছেন, তাহলে ঠিক ঐ মুহূর্তে কেন আপনি সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন? একটি দ্বিতীয় উত্তরের জন্য তাকে বলা হলো এবং তার জবাব ছিল :
যখন সময় এসেছে, আমি নিজেকে ধাক্কা মেরে দাঁড় করাতে যতটুকু প্রয়োজন ধাক্কা মেরেছি, আমার মনে হয়।
উপস্থাপক প্রশ্ন করলেন– আপনার পূর্ব পরিকল্পনা ছিল?
উত্তর : না।
উপস্থাপক জানতে চাইলেন– এটা কি তবে হঠাৎ ঘটেছিল?
উত্তর : ঠিক, এটা ছিল একটি হঠাৎ করে সংঘটিত ঘটনা।
এটি ছিল একটি সমালোচনামূলক ঘটনার বর্ণনা। রোসা পার্কস দ্বিধা করেননি অথবা কি ঘটবে চিন্তা করেননি। তিনি শুধু তার প্রবৃত্তির কথা শুনেছিলেন যা তাকে বলেছিল –তোমার সাথে সঠিক আচরণ করা হচ্ছে না এবং তিনি নিজেকে তা অনুসরণ করতে ধাক্কা মেরেছিলেন।
যেহেতু তিনি দ্বিধা করেননি, এ ব্যাপারে নিজের সঙ্গে কথা বলার সময় তার ছিল না।
কাকতালীয়ভাবে, চারদিন পর, ডিসেম্বর ৫, ১৯৫৫ সালে একই শহর এলাবামার মন্টেগোমেরিতে ৫ সেকেন্ডের ইতিহাস বদলে দেয়া একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। মিসেস পার্কস-এর গ্রেফতারের প্রতিক্রিয়ায় মন্টেগোমেরি উন্নয়ন সমিতি গঠিত হয়েছিল এবং একজন ২৬ বৎসর বয়স্ক কালো ধর্মপ্রচারককে তার সহকর্মীরা ভোট দিয়ে মনোনীত করেছিল সেই সময় সংঘটিত ৩৮১ দিনের বাস বয়কট কর্মসূচির নেতৃত্ব দেয়ার জন্য।