Site icon BnBoi.Com

আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

আলস্যের জয়গান - বার্ট্রান্ড রাসেল

আলস্যের জয়গান

০১. আলস্যের জয়গান

আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

মুখবন্ধ

রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে অনেক সামাজিক প্রশ্ন অনুকম্পায়ী বিবেচনার সুযোগ পায় না; উপেক্ষিত থেকে যায়। বর্তমান পুস্তকের নিবন্ধগুলোর বিষয় উপেক্ষিত সামাজিক প্রশ্নসমূহ। এখানে চিন্তারাজ্যে অতি-সংগঠনের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে অতিরিক্ত কর্মোদ্যোগের বিপদ সম্পর্কে। এখানে আমি ব্যাখ্যা করে বলেছি কেন আমার পক্ষে কী সাম্যবাদ কী ফ্যাসিবাদ কোনোটার পথ অনুসরণ করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে এই মতবাদ দুটি যে সব ক্ষেত্রে অভিন্ন অভিমত পোষণ করে সে সব ক্ষেত্রেই আমি ভিন্ন মত পোষণ করতে বাধিত বোধ করি। বর্তমান পুস্তকে আমি এ কথাও বলতে চেয়েছি যে, জ্ঞানের গুরুত্ব তার ব্যবহারিক উপযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না; জ্ঞান চিন্তা করার অভ্যাস প্রসারেও সহায়তা করে। এই কারণে আজকাল যে সব জ্ঞানকে অকেজো বলে চিহ্নিত করা হয় সে সব জ্ঞানের মধ্যে অধিকতর উপযোগিতা খুঁজে নিতে পারি। একটা নিবন্ধে স্থাপত্যকর্মের সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক প্রশ্নের সংযোগ বিষয়ে আলোচনা করেছি। বিশেষ জোর দিয়েছি অল্প বয়েসীদের কল্যাণ এবং নারীর মর্যাদা বিষয়ে।

রাজনীতি ক্ষেত্র থেকে সরে এসে, প্রতীচ্য সভ্যতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিষয়ে আলোচনা এবং কীট-পতঙ্গের অত্যাচারে মানব-বংশের বিলুপ্তির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে, সবশেষে আত্মার প্রকৃতি নির্ণয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই পুস্তকের নিবন্ধগুলো একটি সাধারণ সূত্র দ্বারা গ্রথিত, তা হলো: এই জগৎ অসহিষ্ণুতা এবং সংকীর্ণতার কারণে দুর্ভোগপীড়িত। তাছাড়া এই বিশ্বাসের জন্যও দুর্ভোগ পোহাচ্ছে: দিকনিশানাহীন কর্মোদ্যোগও প্রশংসার যোগ্য। অথচ আমাদের জটিল আধুনিক সমাজে সবার আগে দরকার সকল বিষয়ে ধীর-স্থির বিবেচনা, সকল মতবাদ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য সদা প্রস্তুতি। উপরন্তু মন শৃঙ্খলমুক্ত থাকবে, যাতে প্রচলিত নানা দৃষ্টিকোণ ন্যায্য বিচার পেতে পারে।

গ্রন্থের অন্যান্য নিবন্ধ বিষয়ে বলা যায়, কতকগুলো নতুন, কতকগুলো বিভিন্ন সাময়িকীতে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান গ্রন্থে লেখাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হলো উক্ত সাময়িকীগুলোর সম্পাদকদের অনুমতিক্রমে। আলস্যের জয়গান এবং আধুনিক মাইড্যাস প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল হার্পার্স ম্যাগাজিনে; ফ্যাসিবাদের পূর্বসূত্র (ভিন্ন নামে) ছাপা হয়েছিল ইংল্যান্ডের দ্য পলিটিক্যাল কোয়ার্টারলি এবং আমেরিকার দ্য আটলান্টিক মান্থলি সাময়িকীতে; সিলা ও কারিবডিস, অথবা সাম্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদ প্রকাশিত হয় দ্য মডার্ণ মান্থলিতে; আধুনিক সমরূপতা প্রথম স্থান পায় নিউ ইয়র্কের দ্য আউটলুক (বর্তমানে দ্য নিউ আউটলুক) সাময়িকীতে; শিক্ষা ও শৃঙ্খলা প্রকাশিত হয় দ্য নিউ স্টেটসম্যান এবং ন্যাশন সাময়িকীতে। এছাড়া পুস্তকের নানা নিবন্ধের নানা বিষয় নিয়ে পিটার স্পেন্সের সঙ্গে আলোচনা করে অনেক সহায়তা পেয়েছি।

—-বাট্রান্ড রাসেল

.

অধ্যায় ১ — আলস্যের জয়গান

আমার প্রজন্মের অন্য অনেকের মতো আমিও এই নীতিবাক্যের আবহে লালিত হয়েছিঃ শয়তান এখনো দুষ্কর্ম সাধনের জন্য অলস হাত খুঁজে পায়। অত্যন্ত সুবোধ বালক ছিলাম বলে সেকালে যা-কিছু শুনেছি তাই বিশ্বাস করেছি এবং এমনই বিবেকবান ছিলাম যে আজ পর্যন্ত কঠোর শ্রম দিয়ে যাচ্ছি। তবে আমার বিবেক আমার কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করলেও ইতোমধ্যে আমার মতামতের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। আমি মনে করি জগতে খুব বেশি কাজ করা হয়েছে। এবং কর্ম মাত্রেই পুণ্যময় এই বিশ্বাসের দরুন সাধিত হয়েছে ব্যাপক ক্ষতি। বস্তুত আধুনিক শিল্পোন্নত দেশগুলোতে যা প্রচার করা দরকার ছিল তা এতকাল প্রচার করা হয়নি। একটা গল্পের উল্লেখ করছি, গল্পটা আপনারা সকলেই জানেন। জনৈক ভ্রমণকারী নেপলসে বারো জন ভিক্ষুককে রোদে শুয়ে থাকতে দেখেন (মুসোলিনীর শাসনকালের আগের গল্প), এবং যে সবচেয়ে অলস তাকে এক লিরা প্রদানে ইচ্ছুক হন। সেই বারো জন ভিক্ষুকের মধ্যে এগারো জন তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে ওঠে ভিক্ষা গ্রহণের জন্য। অতএব উক্ত ভ্রমণকারী দ্বাদশ ব্যক্তিটিকেই এক লিরা প্রদান করেন। তিনি ঠিক কাজটিই করেছিলেন। কিন্তু যে সব দেশের লোক ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের রোদে আলস্য উপভোগ করে না তাদের ব্যাপারটা বোঝানো একটু কঠিন কাজ বটে, তবে ব্যাপক গণপ্রচার দ্বারা এদের অলসদের কাতারে সামিল করা যায়। আমি আশা করছি এই নিবন্ধের পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো পাঠ করে তরুণদের খ্রিস্টীয় সংঘ প্রচার শুরু করে দেবেন যাতে ভালো ছেলেরা অতঃপর কিছু না করতে বা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে উদ্বুদ্ধ হয়। এবং যদি তাই ঘটে তাহলে আমার জীবন একেবারে বৃথা গেছে বলে মনে করবো না।

অলসতার পক্ষে যুক্তিসমূহ উপস্থাপনের আগে আমি অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য একটি যুক্তি বর্জন করবো। একজন ব্যক্তির কথা ভাবুন যার বাঁচার মতো যথেষ্ট সঙ্গতি আছে, তবু তিনি নিত্যনৈমিত্তিক কিছু কাজ করতে চান, যেমন স্কুলে ছাত্র পড়ানো কিংবা মুদ্রাক্ষরিকের কাজ। তাঁর সম্পর্কে বলা হলো যে তিনি অন্যের মুখের ভাত কেড়ে নিচ্ছেন, অতএব তিনি দুষ্ট প্রকৃতির। এই যুক্তি যদি বৈধ হতো তাহলে আমাদের সবার অলস হওয়ার দরকার ছিল শুধু এ জন্য যে আমাদের কেবল প্রয়োজনীয় খাবার থাকলেই যথেষ্ট। যারা এ ধরনের কথা বলেন তারা ভুলে যান যে, একজন ব্যক্তি যা আয় করেন তিনি তা ব্যয় করেন। এবং এই ব্যয়ের মাধ্যমে অপরকে কাজের সুযোগ দেন। যতক্ষণ একজন মানুষ তার আয় ব্যয় করেন, তিনি তার ব্যয় দ্বারা অপরের জন্য যতটুকু আহার্য যোগান, আয় দ্বারা ততটুকুই অপরের মুখের ভাত কেড়ে নেন। তাহলে, এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃত অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হলেন তিনি যিনি সঞ্চয় করেন। প্রবাদের ফরাসি কৃষকের মতো তিনি যদি শুধু সঞ্চয়ের জন্য সঞ্চয় করেন তাহলে এতে কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ হয় না। তিনি যদি তার সঞ্চয় বিনিয়োগ করেন তাহলে ঘটনা ভিন্ন রূপ ধারণ করে।

অনেকানেক ব্যাপারের মধ্যে অতিসাধারণ একটা ব্যাপার হলো সঞ্চয় থেকে ধার দেওয়া। যেহেতু সভ্য সরকার সমূহের প্রধান খরচ হলো অতীত যুদ্ধের ব্যয় পরিশোধ কিংবা ভবিষ্যতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি; সেহেতু এই দিক থেকে বিচার করলে যিনি সরকারকে ধার দেন তার অবস্থান শেক্সপিয়রের সেই সব দুশ্চরিত্র ব্যক্তির মতো যারা আততায়ী (খুনীও বলা যায়) ভাড়া করেন। তাহলে ঐ ব্যক্তির আচরণে রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি পায়, যে রাষ্ট্রকে তিনি তার সঞ্চয় থেকে ধার দিচ্ছেন। তাহলে এটা পরিষ্কার যে তিনি যদি তার টাকা শুধু শুধু খরচ করে ফেলতেন, কিংবা এমনকি মদ্যপান করে কিংবা জুয়া খেলে ব্যয় করতেন, সেটা অনেক ভালো কাজ হতো।

আমাকে কিন্তু বলা হবে সঞ্চয় শিল্পায়নের উদ্যোগে বিনিয়োগ করা হলে গোটা ব্যাপার ভিন্ন রূপ ধারণ করবে। এই ধরনের উদ্যোগ সফল হলে, প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদন করলে, কথাটা মেনে নেয়া যায়। আজকের দিনে, কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, অধিকাংশ শিল্প উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। এর অর্থ হলো একটা বিরাট শ্রমশক্তি, যা নিয়োজিত করা যেতে পারত উপভোগ্য সামগ্রী উৎপাদনে, তা ব্যয় করা হয় যন্ত্র উৎপাদনে এবং উৎপাদনের পর ঐ যন্ত্র অলস হয়ে পড়ে থাকে এবং আর কারো কোনো কাজে লাগে না। যে ব্যক্তি এমন উদ্যোগে বিনিয়োগ করে যে উদ্যোগ দেউলে হয়ে পড়ে, সে অপরকে এবং নিজেকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। যদি তিনি ভোজনোৎসবে বন্ধুদের আমন্ত্রণ করে খরচ করেন, তবে তারা (আমি আশা করি) সুখ পাবেন, এবং যাদের জন্য তিনি খরচ করবেন তাদের সবাই সুখ পাবে, এদের মধ্যে কসাই, ময়রা, অবৈধ মদ্য প্রস্তুতকারক এবং বিক্রেতাকে ধরা যায়। কিন্তু তিনি যদি রেলপথ বসানোর জন্য ব্যয় করেন (আমি ধরে নিচ্ছি) এবং উক্ত ব্যয়ে এমন এক জায়গায় রেলপথ বসান যেখানে রেলপথের দরকার নেই তাহলে তিনি এমন ক্ষেত্রে বিরাট শ্রমনিয়োগ করলেন যা কারো সুখের কারণ হলো না। তথাপি, তিনি যখন ব্যর্থ বিনিয়োগের জন্য দরিদ্রে পরিণত হবেন তখন তাকে গণ্য করা হবে অযথা দুর্ভাগ্যের শিকার, অথচ একজন অমিতব্যয়ী, যিনি জনগণের কল্যাণে ব্যয় করেছেন, তাকে অবজ্ঞা করা হবে নির্বোধ এবং লঘুচিত্ত ব্যক্তি হিসেবে।

এতক্ষণ যা কিছু বলা হলো তা প্রাথমিক ব্যাপার মাত্র। আমি আসলে গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাই যে, কর্ম পুণ্যময় এই ধারণা থেকে আধুনিক জগতে বিরাট ক্ষতি সাধিত হচ্ছে এবং আমরা কেবল কম কাজ করে সুখ ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারি।

প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে কাজ কী? কাজ দুই প্রকারের: প্রথমত পৃথিবীর উপরিভাগে, অন্তত কাছাকাছি, বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন, অন্যান্য বস্তুর তুলনায় দ্বিতীয়ত, অপরকে অনুরূপ কাজ করতে বলা। প্রথম কাজটি বিরক্তিকর এবং এর জন্য পারিশ্রমিকও কম মেলে; দ্বিতীয় কাজটি অত্যন্ত মজাদার এবং এর জন্য বিরাট পারিশ্রমিক লাভ করা যায়। তাছাড়া দ্বিতীয় কাজটির পরিধি অনির্দিষ্টভাবে বিস্তৃত করা সম্ভব। কারণ যারা আদেশ প্রদান করেন তারাই শুধু নয়, যারা কী আদেশ প্রদান করা উচিত তার পরামর্শ দেন তারাও এর মধ্যে রয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই একযোগে পরস্পরবিরোধী দুটি উপদেশ প্রদান করা হয় দুটি সংগঠিত শ্রেণি কর্তৃক; এর নামই রাজনীতি। এই ধরনের কাজের উপদেশের জন্য যে দক্ষতার দরকার করে তার সঙ্গে উক্ত বিষয়ের জ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই, এখানে শুধু দরকার মানুষকে প্রভাবিত করার উপযোগী বক্তৃতা প্রদানের কায়দার অর্থাৎ বিজ্ঞাপনের জ্ঞান। লেখালেখি করেও বিজ্ঞাপনের কাজ সম্পন্ন করা যায়।

গোটা ইউরোপে, আমেরিকায় যদিও নয়, তৃতীয় এক শ্রেণির লোক রয়েছেন যাদের আলোচিত দুই শ্রেণির চেয়ে অধিক শ্রদ্ধা করা হয়। এক শ্রেণির মানুষ রয়েছেন, যারা ভূমির মালিকানার সুবাদে, অপরকে বেঁচে থাকা এবং কাজ করার সুযোগ দেয়ার জন্য তাদের কিছু প্রদানে বাধ্য করতে পারেন। এই ভূস্বামীরা অলস। অতএব, আমার প্রতি হয়তো আশা করা হবে যে আমি এদের প্রশংসা করবো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাদের পক্ষে অলস হওয়া সম্ভব হয় অপরের শ্রমের জন্য। বাস্তবিকপক্ষে, তাদের আরামদায়ক আলস্যের বাসনা থেকেই ঐতিহাসিকভাবে কাজের প্রশংসার জন্ম নিয়েছে। আবার একটা জিনিস তারা একেবারেই কামনা করে না, তা হলো তাদের উদাহরণ অন্যেরা অনুসরণ করুক।

সভ্যতার শুরু থেকে শিল্পবিপ্লবের সময় পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে নিজের ও পরিবারের প্রয়োজনের কিছুটা অধিক উৎপাদন করতেন, যদিও তার স্ত্রী তার মতোই পরিশ্রম করতেন, এবং তার সন্তানেরা বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের জন্য শ্রম দিতেন। কিন্তু যে সামান্য উদ্বৃত্ত থাকত তা উৎপাদক পেতেন না, যোদ্ধা এবং পুরোহিতরা তা ভোগ করতেন। দুর্ভিক্ষের সময় কোনো উদ্বৃত্ত থাকত না, কিন্তু যোদ্ধা ও পুরোহিতগণ অন্যান্য সময়ের মতোই দুধ-ভাত খেতেন, ফলে অনেক শ্রমিক অনাহারে মারা যেতেন। এই অবস্থা রুশদেশে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিরাজ করেছে, প্রাচ্যে এখনও বিরাজ করছে; বিলেতে শিল্পবিপ্লব সত্ত্বেও নেপোলিয়নের যুদ্ধবৃত্তি চলাকালে এই অবস্থা দাপটের সঙ্গে চালু থাকে এবং একশো বছর আগেও নতুন উৎপাদনকারীদের ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত চালু ছিল। আমেরিকায় বিপ্লবের সঙ্গে-সঙ্গে এই অবস্থার অবসান ঘটে, তবে ব্যতিক্রম ছিল দক্ষিণাঞ্চল, যেখানে গৃহযুদ্ধের সময় পর্যন্ত ব্যাপারটা বজায় ছিল। যে ব্যবস্থা এত দীর্ঘকাল বজায় ছিল এবং অবসান ঘটে অতি-সাম্প্রতিককালে, তা স্বাভাবিকভাবেই মানুষের চিন্তাচেতনায় গভীর ছাপ রাখে। আমরা যে কাজের প্রয়োজনীয়তাকে এতটা অনিবার্য মনে করি তার উৎস কিন্তু এই ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থা শিল্পবিপ্লবের আগের বলে আধুনিক জগতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে নি। আধুনিক প্রযুক্তি সীমাবদ্ধতার ভেতর হলেও অবসর ভোগ সম্ভব করে তুলেছে, তবে ক্ষুদ্র সুবিধাভোগী শ্রেণির বিশেষ অধিকার ভোগের জন্য নয়, সমগ্র গোষ্ঠীতে অবসর ভোগ সমানভাবে অধিকার হিসেবে বণ্টনের জন্য। কর্মের নৈতিকতা ক্রীতদাসের নৈতিকতা আর আধুনিক জগতে ক্রীতদাস প্রথার কোনো প্রয়োজন নেই।

এটা পরিষ্কার বোঝা যায়, আদিম গোত্রসমূহে কৃষকদের নিজের নিয়মে চলতে দিলে, তারা তাদের সামান্য উদ্বৃত্ত হাতছাড়া করত না, যে উদ্বৃত্তের উপর যোদ্ধা ও পুরোহিত শ্রেণি নির্ভর করেছে। বরং তারা হয় কম উৎপাদন করত কিংবা উদ্বৃত্ত উৎপাদন নিজেরাই ভোগ করত। প্রথমে তাদের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে উৎপাদনে এবং উদ্বৃত্ত হস্তান্তরে বাধ্য করা হতো। যাহোক, ক্রমান্বয়ে, বোঝা গেল, তাদের এমন নীতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা যায়, যে নীতিবলে তারা কঠোর পরিশ্রম কর্তব্য মনে করবে, যদিও তাদের শ্রমের একটা অংশ অলসদের পকেটে চলে যাবে। এই উপায়ে প্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগের মাত্রা কমে যায়। এবং সরকারি ব্যয় হয় হ্রাস। আজকের দিনেও নিরানব্বই শতাংশ ব্রিটিশ শ্রমজীবী সত্যি আহত বোধ করবে যদি তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে রাজার আয় সাধারণ কর্মীর বেশি হওয়া উচিত হবে না। ঐতিহাসিকভাবে বলতে গেলে কর্তব্যবোধ দ্বারা ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিরা অপরকে প্রভুদের স্বার্থে বাঁচার জন্য বাধ্য করতেন। তাদের নিজেদের জন্য নয়। অবশ্য ক্ষমতার অধিকর্তৃকগণ এই ব্যাপারটা নিজেদের কাছেই গোপন রাখেন একটা কৃত্রিম বিশ্বাস অর্জন করে যে তাদের স্বার্থ গোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। অনেক সময় ব্যাপারটা সত্যও; এথেন্সের দাস মালিকরা, উদাহরণত, তাদের অবসরের একটা অংশ ব্যয় করতেন সভ্যতায় স্থায়ী অবদান রাখার জন্য, যা ন্যায্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্ভব হতো না। সভ্যতার জন্য অবকাশ অত্যন্ত দরকারি, অতীতকালে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি যে অবসর ভোগ করতে পারতেন তার কারণ জনসংখ্যার সংখ্যাগুরু অংশ শ্রম দিতেন। তাদের শ্রম মূল্যবান ছিল এ জন্য নয় যে কাজ কল্যাণকর, কল্যাণকর হলো অবসর। তবে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সভ্যতার কোনো ক্ষতি না করেও অবসর ন্যায্যভাবে বণ্টন সম্ভবপর হবে।

বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য নিশ্চিত করতে যে শ্রম দরকার আধুনিক প্রযুক্তি তা ব্যাপকহারে হ্রাস সম্ভব করে তুলেছে। যুদ্ধের সময় এটা পরিষ্কার বোঝা গেছে। তখন সামরিক বাহিনীর সকল লোক, যুদ্ধোপকরণ তৈরির কাজে নিয়োজিত সকল নর-নারী, গোয়েন্দাগিরি, যুদ্ধে অপপ্রচার এবং যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলোর সকল নর-নারীকে উৎপাদন-খাত থেকে প্রত্যাহার করা হয়। এতদসত্ত্বেও, মিত্রশক্তির অদক্ষ শ্রমজীবীদের বাস্তব অবস্থার স্তর যুদ্ধের আগের চেয়ে কিংবা পরের চেয়েও উচ্চতর ছিল। এই ঘটনার প্রকৃত তাৎপর্য আর্থিক ব্যবস্থা দ্বারা গোপন রাখা হয়; দেনা করে দেখানো হয় যেন ভবিষ্যৎ বর্তমান সময়কে পুষ্টি যোগাচ্ছে। তবু তা হওয়া সম্ভব ছিল না; কারণ রুটি না-থাকলে একজন লোক কী-করে রুটি খেতে পারে। যুদ্ধ সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে, বৈজ্ঞানিক উপায়ে উৎপাদন দ্বারা, আধুনিক জগতের শ্রম শক্তির একটি ক্ষুদ্র অংশের সাহায্যেই আধুনিক জনসংখ্যাকে বেশ স্বাচ্ছন্দের ভেতর রাখা সম্ভব। যদি যুদ্ধের পর বৈজ্ঞানিক সংগঠন বা উপায়, যা সৃষ্টি করা হয়েছিল জনশক্তিকে মুক্ত করে যুদ্ধে যোগদান এবং যুদ্ধোপকরণ তৈরির জন্য, রক্ষা করা হতো এবং কর্মদিবসের স্থিতিকাল কমিয়ে চার ঘণ্টা করা হতো, তাহলে সকলের অবস্থাই ভালো না হয়ে পারত না। এটা না-করে পুরাতন বিশৃঙ্খলা পুনর্বাসিত করা হয়। যাদের কাজের চাহিদা রয়েছে তাদের কাজের স্থিতিকাল দেয়া হয় বাড়িয়ে। বাকিদের করা হয় বেকার ও নিরন্ন। কারণ? কাজ হচ্ছে কর্তব্য এবং একজন মানুষকে কাজের অনুপাতে পারিশ্রমিক দেয়া হবে না, তাকে পারিশ্রমিক দেয়া হবে কাজ নামক পুণ্যের অনুপাতে।

এই নৈতিকতা দাস রাষ্ট্রের, এবং তা এমন পরিস্থিতিতে আরোপ করা হয়েছে যে পরিস্থিতির একেবারেই উদ্ভব ঘটেনি। অবাক হবার কিছু নেই যে, এতে ফলাফল দাঁড়িয়েছে বিপর্যয়কর। একটা উদাহরণ ধরা যাক। ধরুন, এক বিশেষ মুহূর্তে নির্দিষ্ট সংখ্যক লোক পিন প্রস্তুতে নিয়োজিত রয়েছে। দুনিয়ায় যত পিনের দরকার তত পিন তারা প্রস্তুত করে। ধরুন তারা দিনে আট ঘণ্টা কাজ করে। এখন কোনো ব্যক্তি এমন উপায় উদ্ভাবন করেছে যে উপায়ে উক্ত সংখ্যক লোক আগের চেয়ে দ্বিগুণ পিন উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু দুনিয়ায় দ্বিগুণ সংখ্যক পিনের দরকার নেই; এবং পিনের দাম ইতোমধ্যেই এত সস্তা হয়েছে যে ঐ বস্তুর দাম আরো কমে গেলেও বাড়তি পিন কেউ ক্রয় করবে না। যুক্তিনির্ভর জগতে, পিন প্রস্তুতের সঙ্গে যারা জড়িত তারা সবাই আট ঘণ্টার বদলে চার ঘণ্টা কাজ করবে এবং অন্য সবকিছু আগের মতোই চলবে। কিন্তু বাস্তব জগতে এই ভাবনাকে অনৈতিক গণ্য করা হয়। যদি লোকগুলো আট ঘণ্টাই কাজ করে তাহলে খুব বেশি পিন তৈরি হবে। অনেক নিয়োগকর্তা হবেন দেউলে, পূর্বে পিন তৈরিতে নিয়োজিত কর্মী সংখ্যার অর্ধেক হবে বেকার। এতে কর্মী সংখ্যার অর্ধেক থাকবে সম্পূর্ণ অলস, অপরপক্ষে বাকি অর্ধেক হবে কর্মভারপীড়িত। এই উপায়ে অনিবার্য অবসর সার্বিক দুরবস্থার কারণ হবে। অথচ হওয়া উচিত ছিল সার্বজনীন সুখের উৎস। এই অসুস্থকর অবস্থার কথা ভাবা যায়?

আসল ব্যাপার হলো, দরিদ্র লোকেরা অবসর ভোগ করবেন এই ধারণায় ধনীরা সর্বদাই আহত বোধ করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে একজন কর্মীর সাধারণ কর্মদিবসের পরিধি ছিল পনেরো ঘণ্টা; শিশুদেরও প্রায় সমান সময় কাজ করতে হয়েছে, অন্তত দিনে বারো ঘণ্টা কাজ তাদের করতে হয়েছেই। অপরের ব্যাপারে অযথা নাক গলানো যাদের অভ্যাস তারা যখন ইঙ্গিত প্রদান করেন যে এত ঘণ্টা কাজ খুব বেশি সময় হয়ে যায়, তখন তাদের বলা হয় যে কাজ বয়স্কদের সুরাপান থেকে বিরত রাখে, আর শিশুদের বিরত রাখা যায় অপকর্ম থেকে। আমার ছেলেবেলায় শাহরিক শ্রমজীবীরা ভোট প্রদানের অধিকার লাভের পর আইন দ্বারা নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্য সরকারি ছুটি প্রতিষ্ঠা করা হয়, এতে উচ্চবিত্তের লোকেরা হয় দারুণ ক্ষুব্ধ। মনে পড়ে, জনৈক প্রবীণ ডাচেস-কে বলতে শুনেছি; দরিদ্র লোকেরা ছুটি দিয়ে কী করতে চায়? তারা কাজ করতে বাধ্য। জনগণ আজকাল খোলাখুলি কথা কম বলেন, তবে ঐ মেজাজ রয়েই গেছে, আর এটা পরিণত হয়েছে আমাদের অর্থনৈতিক বিভ্রান্তির উৎস।

এক মুহূর্তের জন্য আমরা কাজের নীতি সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে এবং কুসংস্কার বর্জন করে বিবেচনা করি। প্রত্যেকটি মানুষ প্রয়োজনে, তার জীবৎকালে, মানবশ্রমে উৎপন্ন সামগ্রী নির্দিষ্ট মাত্রায় ভোগ করে। ধরে নিচ্ছি, শ্রমের ব্যাপারটা সর্বোপরি মেনে নেয়া যায় না এবং এটা অন্যায্য যে একটা মানুষ যতটুকু উৎপাদন করবে তার চেয়ে বেশি ভোগ করবে। অবশ্য তিনি সামগ্রী উৎপাদন না করে, উদাহরণত, ডাক্তারদের মতো সেবা দান করতে পারেন; কিন্তু তাকে থাকা ও খাওয়ার বদলে কিছু দিতেই হবে। এ পর্যন্ত কর্তব্যকর্ম অনুমোদন করতেই হবে। তবে এ পর্যন্তই কেবল।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে সকল আধুনিক সমাজে এই সামান্যটুকু কাজও অনেকে করেন না। অন্তত যারা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্থ লাভ করেন কিংবা অর্থ বিয়ে করেন, কিন্তু এ বিষয়ে আমি আলোচনা করতে চাই না। তবে আমি মনে করি না যে, এদের আলস্য অনুমোদন করে যতটা ক্ষতি করা হয় তা শ্রমজীবীদের বেশি কাজ করিয়ে কিংবা অনাহারে রেখে যে ক্ষতি করা হয় তার সমান।

যদি সাধারণ শ্রমজীবীরা দিনে চার ঘণ্টা কাজ করত তাহলে পর্যাপ্ত সামগ্রী সবার জুটত, এবং কেউ বেকার হতেন না-এখানে ধরে নিতে হবে একটা যুক্তিশীল সংগঠন বর্তমান। এই ধারণা ধনবানদের আহত করে, কারণ তারা নিশ্চিত যে এতটা অবসর কীভাবে ভোগ করতে হয় তা শ্রমিকদের জানা নেই। আমেরিকায় স্বচ্ছল ব্যক্তিরাও প্রায়ই দীর্ঘ সময় কাজ করেন; এই ধরনের লোক স্বাভাবিকভাবেই মজুরদের অবকাশের কথা শুনে ক্ষেপে যান; আবার বেকারত্বের কড়া শাস্তির ব্যাপারে তাদের আপত্তি নেই; বস্তুত তারা স্বীয় পুত্রদের অবকাশ যাপনও অপছন্দ করেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তারা চান পুত্ররা কঠোর পরিশ্রম করুক, তাদের সভ্য হবার মতো সময় নাই-ই বা থাকল, অথচ তাদের স্ত্রী ও কন্যারা যদি একেবারেই কাজ না করেন তাহলে তারা কিছু মনে করেন না। প্রয়োজনহীনতার প্রতি উন্নাসিক সমর্থন আভিজাতিক সমাজের নর-নারীর অনুমোদন লাভ করে; কিন্তু ধনিক শ্রেণির শাসন ব্যবস্থায় এটা নারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে; যা হোক এটা কোনো মতেই কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে চলে না।

বিজ্ঞতার সঙ্গে অবকাশের ব্যবহার, মানতেই হবে, সভ্যতা ও শিক্ষার ফসল। যে লোক সারা জীবন প্রতি দিন দীর্ঘ সময় কাজ করে সে যদি হঠাৎ অলস হয়ে যায় তবে সে অস্বস্তি বোধ করবে। কিন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ অবকাশের অভাবে একজন লোক জীবনের অনেক ভালো ব্যাপার থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ এমন কোনো কারণ এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না জনগণ কেন এই বঞ্চনা ভোগ করবে; কেবল নির্বোধ কৃচ্ছতাসাধন, যা একান্তই নানা জাতের, আমাদের বহুল পরিমাণে কর্মে বাধ্য করে, যার কোনো প্রয়োজন নেই।

যে নতুন নীতি রুশ সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে তার মধ্যে অনেক কিছু রয়েছে যা প্রতীচ্যের প্রথাগত শিক্ষার চেয়ে ভিন্ন, আবার এমন জিনিসও রয়ে গেছে যার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। শাসক শ্রেণির মনোভাব এবং বিশেষত যারা শিক্ষাক্ষেত্রে অপপ্রচারের দায়িত্বে নিয়োজিত তারা যা শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে প্রচার করে, তা প্রায় একই ধরনের, যা জগতের সকল শাসক শ্রেণি প্রায় সব সময়ই প্রচার করে আসছে, এবং তাকেই বলা হয় সৎ দরিদ্র। রুশদেশে পরিশ্রম, মিতাচার, সুদূর সুবিধার জন্য দীর্ঘ সময় কাজের ইচ্ছা, এমনকি কর্তৃপক্ষের কাছে আনুগত্য, এসবেরই পুনরাবির্ভাব ঘটেছে; উপরন্তু কর্তৃপক্ষ এখনও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শাসকের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে, যাকে নতুন নামে ডাকা হয় বস্তুতান্ত্রিক দ্বান্দ্বিকতা বলে। অর্থাৎ মহান ঈশ্বরের সিংহাসন এখন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দখলে।

রুশদেশে সর্বহারাদের বিজয় এবং অপরাপর কিছু দেশের নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনকারীদের বিজয়ের সঙ্গে কয়েকটি ব্যাপারে মিল রয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে, পুরুষ মানুষ মেয়ে মানুষের সাধুতাকে উন্নততর বলে মেনে নিয়েছে। এবং মেয়েদের হীনতাকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছে যে, সাধুতা ক্ষমতার চেয়ে অধিক বাঞ্ছনীয়। সব শেষে, নারীর অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাদের উভয়দিক রক্ষা করতে হবে, আর যেহেতু এই আন্দোলনের সম্মুখভাগের নেতৃবৃন্দ পুণ্যের বাঞ্ছনীয়তা সম্পর্কে পুরুষরা যা বলেছে তার সবই বিশ্বাস করেছে, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার মূল্যহীনতা সম্পর্কে যা বলেছে তা মেনে নেয়নি। কায়িক শ্রমের ক্ষেত্রে একই ব্যাপার ঘটেছে রুশদেশে। যুগের পর যুগ, ধনীরা এবং তাদের মোসাহেবদল সৎ পরিশ্রম সম্পর্কে প্রশংসা করে অনেক কিছু লিখেছে, প্রশংসা করেছে সাদাসিধে জীবনের, প্রচার করেছে এমন ধর্মের যে ধর্ম শিক্ষা দেয় যে ধনীদের চেয়ে গরিবদের স্বর্গে যাওয়ার সম্ভাবনা অধিকতর এবং সর্বোপরি কায়িক শ্রমিকদের বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করেছে যে স্থানিক বস্তুর অবস্থা পরিবর্তনের মধ্যে বিশেষ মহত্ত্ব রয়েছে। যেমন পুরুষরা মেয়েদের বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করেছে যে, তারা যৌন-দাসত্ব থেকে বিশেষ মহত্ত্ব লাভ করে। রুশ দেশে কায়িক-শ্রম সম্পর্কিত এতসব শিক্ষা খুব গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়েছে, ফলে গতর-খাটানো শ্রমিকরা অন্যান্যদের চেয়ে অধিক সম্মান পেয়ে থাকে। বস্তুত পুনরুজ্জীবনবাদী আবেদন একই কারণে করা হয়, তবে লক্ষ্য পুরাতন নয়। আবেদনের লক্ষ্য হলো শ্রমিকদের বিশেষ কাজের জন্য তৈরি রাখা। কায়িক শ্রম যুবকদের সামনে আদর্শ হিসেবে খাড়া করা হয়, এবং এটা তাদের সকল নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি।

বর্তমানে, সম্ভবত এসবই করা হয় কল্যাণের জন্য। একটা মস্ত বড় দেশ, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, উন্নতির জন্য অপেক্ষা করে আছে এবং ঋণ খুব কম ব্যবহার করে উন্নতি করতে হবে।-এই পরিস্থিতিতে কঠোর শ্রম দরকার করে। এবং সম্ভবত বিরাট পুরস্কার অর্জন করা যায়। কিন্তু দীর্ঘ সময় কাজ না করে যদি এমন অবস্থায় পৌঁছা যায় যেখানে সবাই আরামদায়ক জীবন যাপন করতে পারবে, তখন কী হবে?

প্রতীচ্যে এই সমস্যার মোকাবেলা আমরা নানাভাবে করতে পারি। অর্থনৈতিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আমাদের মধ্যে নেই, ফলে সামগ্রিক উৎপাদনের বৃহৎ অংশ জনসংখ্যার সংখ্যালঘু অংশের ভোগে চলে যায়। এদের অনেকে মোটই কোনো কাজ করে না। উৎপাদনের উপর কোনো প্রকার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভাবে, আমরা এত বেশি উৎপাদন করি যার কোনো দরকার নেই। আমরা কর্মী-জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশকে অলস রাখি, কারণ তাদের বদলে অন্যদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নিতে পারি। আবার যখন এই সব পদ্ধতিই অপূর্ণ প্রমাণিত হয়, তখন আমরা মুখোমুখি হই যুদ্ধের; বহু লোককে আমরা উচ্চতর বিস্ফোরক পদার্থ প্রস্তুতে লাগাই। আরো অনেককে নিয়োজিত করি বিস্ফোরণে, যেন আমরা এমন শিশু, যে এই মাত্র আবিষ্কার করেছে আতশবাজি। এইসব উপায়ের সম্মিলনে, কঠিন হলেও, আমরা ব্যবস্থা করি এই মনোভাব বজায় রাখতে যে কঠোর কায়িক শ্রম গড়ে মানুষের বিধিলিপি।

রুশদেশে অধিকতর অর্থনৈতিক সুবিচার এবং উৎপাদনের উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের জন্য সমস্যাটা ভিন্ন উপায়ে সমাধান করতে হবে। যৌক্তিক সমাধান এই হবে যে, যত শীঘ্র সম্ভব প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদন এবং সবার জন্য প্রাথমিক আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করার পর, শ্রমের স্থিতিকাল ক্রমান্বয়ে হ্রাস করা, এবং প্রতিটি স্তরে সার্বজনীন ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে অধিক অবসর এবং অধিক সামগ্রীর মধ্যে কোনটার প্রতি পক্ষপাতী হতে হবে। তবে এতকাল কঠোর শ্রম সর্বাধিক পুণ্যবান গণ্য করার শিক্ষা প্রদানের পর, কর্তৃশ্রেণির পক্ষে কঠিন হবে এমন স্বর্গ নির্মাণ করা যেখানে অবসর থাকবে বেশি কাজ হবে কম। সম্ভবত তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করবে, যে পরিকল্পনার বদৌলতে চলতি অবকাশ ভবিষ্যতের উৎপাদনশীলতার জন্য পরিত্যাগ করা হবে। রুশ প্রকৌশলীদের প্রস্তাবিত একটি সরল পরিকল্পনা সম্প্রতি পাঠ করলাম, উক্ত পরিকল্পনায় শ্বেতসাগর এবং সাইবেরিয়ার উত্তর উপকূল উষ্ণ রাখার কথা বলা হয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে কারা সাগর (Kara Sea) বরাবর বাঁধ নির্মাণ করে। এটি একটি খুবই শ্রদ্ধেয় প্রকল্প, তবে এজন্য সর্বহারাদের একটি প্রজন্মের আয়েশ জলাঞ্জলি দিতে হবে, আর আর্কটিক সমুদ্রের বরফ-ক্ষেত্র এবং তুষার ঝড়ের মধ্যে শ্রমের মহত্ত্ব হবে প্রদর্শিত। এই ধরনের ঘটনা যদি ঘটে তাহলে সেটা হবে কঠোর শ্রমের পুণ্যকে উদ্দেশ্য গণ্য করার ফলাফল। তাহলে শ্রম জিনিসটা এমন পর্যায়ে পৌঁছার উপায় আর থাকবে না যখন শ্রমের আর দরকার করবে না।

ব্যাপারটা হলো, বস্তু চারপাশে নড়াচড়া করা আমাদের অস্তিত্বের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে দরকার হলেও, তা মানব জীবনের অন্যতম উপেয় নয়। ঘটনা তাই হলে প্রত্যেক অদক্ষ শ্রমিককে শেক্সপিয়রের চেয়ে উন্নত বিবেচনা করা হতো। দুটি কারণে আমরা এক্ষেত্রে বিপথে চালিত হয়েছি। একটি হলো দরিদ্র সাধারণকে সন্তুষ্ট রাখার প্রয়োজনীয়তা, এজন্যই হাজার হাজার বছর ধরে ধনীরা পরিচালিত হয়েছেন শ্রমের মর্যাদা প্রচারে, অবশ্য এক্ষেত্রে মর্যাদাহীন থাকার জন্য নিজেরা অত্যন্ত যত্ন নিয়েছেন। দ্বিতীয় কারণটি হলো যন্ত্রের প্রতি নতুন আনন্দ। এর দ্বারা আমরা পৃথিবীর উপরিভাগে বিস্ময়কর চাতুর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রফুল্ল বোধ করি। এর কোনো একটি উদ্দেশ্যই প্রকৃত কর্মীর কাছে বড় ধরনের আবেদন রাখে না। আপনি যদি এদের একজনকে জিজ্ঞেস করেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ কোনটি, তিনি সম্ভবত উত্তর দেবেন নাঃ আমি কায়িকশ্রম খুব উপভোগ করি, কারণ এতে অনুভব করতে পারি যে আমি মানুষের মহত্তম কর্ম সিদ্ধি করছি। আরো এই কারণে যে, আমি ভাবতে ভালোবাসি মানুষ এই গ্রহ কতটা রূপান্তরিত করতে পারে। সত্য যে, দেহের জন্য মাঝে মাঝে বিশ্রামের দরকার রয়েছে, আমাকে তা যতটা সম্ভব শ্রেষ্ঠ উপায়ে পূরণ করতে হবে। কিন্তু যখন সকাল আসে এবং আমি কর্মস্থলে ফিরে যাই, যেখানে রয়েছে আমার সন্তুষ্টির উৎস, তখন যে সুখ পাই, তা আর কখনো জোটে না। আমি কখনো কর্মজীবীদের এ ধরনের কথা বলতে শুনিনি। তারা কাজকে কাজের মতোই বিবেচনা করে জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপায় হিসেবে এবং অবসর সময়েই তারা যতটা সম্ভব সুখ উপভোগ করে।

এরপরও বলা হবে, কিছুটা অবসর আনন্দদায়ক হলেও, লোকেরা জানবে না চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কেবল চার ঘণ্টা কাজ করে বাকি সময়টা কী করে কাটানো যায়। আধুনিক জগতে এটা কিছুটা সত্য হলেও আমাদের সভ্যতার জন্য নিন্দাবাদ ছাড়া কিছু নয়; আগের যুগের জন্য এটা সত্য হতো না। আগে হালকা চালচলন এবং খেলাধুলার সুযোগ ছিল যার কিছুটা দক্ষতার মতবাদ দ্বারা নিষেধ করা হয়েছে। আধুনিক মানুষ মনে করেন যে সবকিছু করতে হবে অপর কিছুর স্বার্থে, এবং কখনো উক্ত কাজের স্বার্থে নয়। উদাহরণত গুরু-গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ সব সময়ই সিনেমা দেখতে যাওয়ার অভ্যাসকে নিন্দাবাদ জানাচ্ছেন এবং আমাদের বলছেন যে সিনেমা দেখার অভ্যাস তরুণদের অপরাধকর্মে প্রলুব্ধ করছে। কিন্তু সিনেমা তৈরির জন্য যত শ্রম ব্যয় করা হয় তা শ্রদ্ধেয় বলেই গণ্য। কারণ এটি একটি কাজ এবং এই কাজ আর্থিক মুনাফা আনে। বাঞ্ছনীয় কাজ তাকেই বলতে হবে যা মুনাফা ঘরে আনে, এই মনোভাবটাই সব কিছু উল্টাপাল্টা করে দিয়েছে। যে কসাই আপনাকে মাংস যোগান দেয় এবং যে রুটি প্রস্তুতকারক আপনার রুটি যোগায় তারা প্রশংসার যোগ্য। কারণ তারা অর্থ উপার্জন করছে; কিন্তু আপনি যখন তাদের যোগানো খাদ্য ভোগ করছেন, তখন আপনি নিতান্তই লঘুচেতা, যদি আপনি কাজ করার জন্য শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়োজনে আহার না করে থাকেন। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, মনে করা হয় যে অর্থ উপার্জন ভালো। আর অর্থ ব্যয় মন্দ। একে একই আদান-প্রদানের দুই দিক হিসেবে দেখা, একেবারেই অসংগত তাহলে একজন ধরে নিতে পারেন চাবি ভালো, তালার চাবি ঢুকানোর ছিদ্র মন্দ। পণ্য উৎপাদনে যে ধরনের গুণই থাক না কেন তা অবশ্যই নির্ভর করবে উক্ত পণ্য ভোগ থেকে কতটা সুবিধা লাভ করা গেল তার উপর। আমাদের সমাজে যে-কোনো ব্যক্তি মুনাফার জন্য কাজ করে; কিন্তু তার কাজের সামাজিক উদ্দেশ্য উৎপাদিত পণ্য উপভোগের মধ্যে নিহিত। উক্ত ব্যক্তি এবং উৎপাদনের সামাজিক লক্ষ্যের মধ্যে এই যে বিচ্ছেদ তা বর্তমান দুনিয়ায় মানুষকে স্বচ্ছভাবে চিন্তা করা কঠিন করে দেয়। কারণ এই জগতে মুনাফা অর্জন কর্মের উৎসাহ হিসেবে কাজ করে। আমি উৎপাদনের কথা খুব বেশি ভাবি। ভোগের কথা ভাবি খুবই কম। এতে একটা ফল দাঁড়ায় আমরা উপভোগ ও সরল সুখের প্রতি কম গুরুত্ব প্রদান করি, এবং উৎপাদনের বিচার আমার ভোক্তা কতটা আনন্দ পেল সে অনুসারে করি না।

যখন আমি ইঙ্গিত দেই যে কাজের সময় কমিয়ে চার ঘন্টা করা উচিত, তখন আমি কিন্তু এটা বোঝাই না যে বাকি সময় অবশ্যই লঘুচিত্ততার ভেতর কাটিয়ে দিতে হবে। আমি বোঝাতে চাই যে দিনে চার ঘণ্টা কাজ করলে একজন মানুষ জীবনের প্রয়োজন এবং প্রাথমিক আরামের জন্য ব্যয় করার মতো সুযোগ ও সময় পাবে, এবং বাকি সময় সে যে ভাবে ইচ্ছে করে সে ভাবে ব্যয় করবে। অনুরূপ সমাজ ব্যবস্থার আবশ্যিক অঙ্গ হলো বর্তমানে শিক্ষাদর্শ যে অবস্থায় আছে তার থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং এই শিক্ষাদর্শ, অংশত, মানুষের রুচি গড়ে তুলবে যাতে সে অবসর সময়টা বুদ্ধির সঙ্গে কাজে লাগাতে পারে। আমি যে ধরনের কাজের কথা প্রধানত ভাবছি তাকে বিবেচনা করা হয় নাক উঁচু। দূর পল্লি অঞ্চল ছাড়া সর্বত্র আজ কৃষক-নৃত্য ইন্তেকাল করেছে, কিন্তু যে তাড়নার জন্য ঐ নৃত্য চর্চা করা হতো তা নিশ্চয় মানব প্রকৃতি থেকে উধাও হয়ে যায় নি। শাহরিক জনসংখ্যার আনন্দ প্রধানত নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে; সিনেমা দেখা, ফুটবল খেলা দেখা, রেডিও শোনা ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর কারণ হলো জনগণের সক্রিয় শক্তিকে কাজ পুরোপুরি গ্রাস করে; তাদের যদি অধিকতর অবসর জুটত তবে তারা পুনরায় আনন্দ উপভোগ করত, যে আনন্দে তারা আগে সক্রিয় অংশ নিয়েছে।

অতীতে অবসরভোগী শ্রেণি ছিল ক্ষুদ্র, কর্মী শ্রেণি ছিল বৃহত্তর। অবসরভোগী শ্রেণি যে সুবিধাদি উপভোগ করতেন তাতে সামাজিক ন্যায় বলতে কিছু ছিল না; ফলে উক্ত শ্রেণি অত্যাচারী হয়ে পড়ে, তাদের সহানুভূতি হয়ে যায় সীমাবদ্ধ, এবং এমন কারণ উদ্ভাবন তাদের করতে হয় যাতে ঐ সুবিধাদি ন্যায্যতা পায়। ফলে এর চমৎকারিত্ব হ্রাস পায়, তবে এই ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও, যাকে আমরা সভ্যতা বলি তার প্রায় সবটুকুতেই এটা অবদান রেখেছে। এটা শিল্পকলা চর্চা করেছে। আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞানসমূহ; পুস্তক লিখেছে, দর্শনাদি করেছে উদ্ভাবন, এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোকে করেছে সুন্দর ও সূক্ষ্মতর। এমনকি নির্যাতিতরা যে মুক্তি লাভ করেছে তাও স্বাভাবিকভাবেই উপর থেকে উদ্বোধন করা হয়েছে। অবসরভোগী শ্রেণি না থাকলে মানবতা বর্বরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না।

উত্তরাধিকার সূত্রে উদ্ধৃত কর্মহীন, অবসরভোগী শ্রেণি অবশ্য ছিল একেবারে অপচয়ী। এই শ্রেণির একটি সদস্যকেও পরিশ্রমী হতে শেখানো হয়নি। এবং শ্রেণিটি সামগ্রিকভাবে অসাধারণ কোনো বুদ্ধিমান ছিল না। এই শ্রেণি একজন ডারুইন জন্ম দিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বিপরীতে লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ ভদ্রলোকের নামোল্লেখ করা যায় যারা কোনোদিন খেঁকশিয়াল শিকার এবং অবৈধ শিকারিদের শাস্তি প্রদানের চেয়ে বুদ্ধিমান কোনো কাজের কথা চিন্তা করেনি। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যা যোগান দেয়ার কথা, অধিকতর নিয়মবদ্ধভাবে, তা অবসরভোগী শ্রেণি যোগান দিয়েছে কাকতালীয়ভাবে এবং উপজাত হিসেবে। এটা একটা বিরাট উন্নতি, কিন্তু এর নির্দিষ্ট কিছু ত্রুটিও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন বৃহত্তর জগতের জীবন থেকে এতটা পৃথক যে, যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবহে বাস করেন তারা সাধারণ নর-নারীর মেজাজ ও সমস্যা ঠিক বুঝতে পারেন না; উপরন্তু তারা তাদের যে স্বাভাবিক নিয়মে বক্তব্য প্রকাশ করেন তাতে সাধারণ জনগণের উপর তাদের মতামতের যে প্রভাব থাকা উচিত ছিল তা থাকে না। অপর একটি অসুবিধা এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চা ব্যাপারটা অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠভাবে হয়, এবং যারা একটু আলাদাভাবে গবেষণা করার কথা ভাবেন তাদের করা হয় নিরুৎসাহিত। সুতরাং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যতটাই দরকারে লাগুক, তার চার দেয়ালের বাইরের জগতের সবাই উপযোগবাদী ধান্দায় খুবই ব্যস্ত বলে প্রতিষ্ঠানগুলো সভ্যতার স্বার্থ সংরক্ষণের উপযোগী অভিভাবকে পরিণত হতে পারে না।

যে জগতে কোনো ব্যক্তি চার ঘণ্টার বেশি কাজ করতে বাধ্য নয়, সেখানে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসাসম্পন্ন প্রত্যেকে তার কাজের সুযোগ পাবেন, প্রত্যেক চিত্রকর কেবল চিত্র এঁকে যাবেন এবং তাকে অনাহারে থাকতে হবে না, তার চিত্রকর্ম যতই চমৎকার হোক না কেন। মহৎ সৃষ্টিকর্মের জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে তরুণ লেখকরা রোমাঞ্চকর কেচ্ছা লিখতে বাধ্য হবে না। পেশাগত জীবনে যারা অর্থনীতি কিংবা সরকারের কোনো পর্যায় সম্পর্কে উৎসাহী হয়, তারা প্রাতিষ্ঠানিক নিবিষ্টচিত্ততা ছাড়াও নিজেদের ধারণাকে বিকশিত করতে পারবে। যে নিবিষ্টচিত্ততার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদদের অনেক সময় মনে হয় বাস্তবতাবর্জিত। ডাক্তাররা তাদের শাস্ত্রের সর্বশেষ বিকাশ সম্পর্কে খবর রাখার সময় পাবে; শিক্ষকদের, তারা যৌবনে যা শিখেছে, একঘেয়ে পদ্ধতিতে তা ছাত্রদের শেখানোর বিরক্তিকর সংগ্রাম করতে হবে না। তার যৌবনে অর্জিত জ্ঞান ইতোমধ্যে ভুলও প্রমাণিত হয়ে থাকতে পারে।

সর্বোপরি, ক্ষয়ে-যাওয়া স্নায়ু, ক্লান্তি এবং অজীর্ণতার বদলে থাকবে সুখ এবং জীবনে আনন্দ। যতটুকু কাজ করা হবে তা অবসর আনন্দময় করার জন্য হবে যথেষ্ট। কিন্তু অত্যন্ত ক্লান্তি উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট হবে না। যেহেতু মানুষ তাদের অবসর সময়ে ক্লান্তি বোধ করবে না সুতরাং তারা নিষ্ক্রিয় এবং নিরস আমোদ দাবি করবে না। জনসংখ্যার অন্তত এক শতাংশ যে সময় পেশাগত কাজে ব্যয় করেনি তা জনসাধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করবে এবং যেহেতু তাদের জীবিকার জন্য উক্ত ধান্দার উপর নির্ভর করতে হবে না ফলে তাদের মৌলিকতা ক্ষুণ্ণ হবে না, এমনকি বৃদ্ধ পণ্ডিতদের দ্বারা নির্ধারিত নীতিমালার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলারও দরকার করবে না। এই সব ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেই শুধু অবসরের সুবিধাগুলো লাভ করা যাবে না। সাধারণ নারী-পুরুষ, সুখী জীবনের সুযোগ থাকার দরুন, অধিক দয়াশীল ও কম অত্যাচারী হবে এবং অন্যদের কম সন্দেহের চোখে দেখবে। যুদ্ধের রুচির হবে মৃত্যু, অংশত এই কারণে, অংশত সবাইকে যুদ্ধ শুরু হলে দীর্ঘ ও কঠোর শ্রম দিতে হবে বলে। সকল নৈতিক গুণাবলির মধ্যে এই জগতের সবচেয়ে বেশি দরকার সৎ স্বভাবের, আর সৎ স্বভাব হলো স্বচ্ছন্দ জীবন এবং নিরাপত্তার ফলশ্রুতি, শ্রমসাধ্য সংগ্রামের ফল নয়। উৎপাদনের আধুনিক পদ্ধতি আমাদের সবার জন্য আয়েসি ও নিরাপদ জীবনের সম্ভাবনা সম্ভব করেছে; অথচ আমরা কারো জন্য বেছে নিয়েছি অতিরিক্ত কাজ, আর বাকি লোকদের জন্য বেছে নিয়েছি অনাহার। এতকাল পর্যন্ত আমরা যন্ত্রাদি উদ্ভাবনের আগের সময়ের মতো কঠোর কর্মে লিপ্ত রয়েছি; আর কী নির্বোধের মতোই না আমরা তা করছি; তবে অনন্তকাল বোকা থাকার কোনো যুক্তি নেই।

০২. ‘অকেজো’ জ্ঞান

অধ্যায় ২ – ‘অকেজো’ জ্ঞান

ফ্রান্সিস বেকন, যিনি তাঁর বন্ধুদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে খ্যাতি অর্জন করেন, জোর দিয়ে বলেছেন, জ্ঞানই হলো শক্তি। তবে সকল জ্ঞান সম্বন্ধেই এটা সত্য নয়। স্যার টমাস ব্রাউন ইচ্ছাপোষণ করতেন সাইরেনরা কী গান করে তা জানা। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হতে পারলেও এটা তাঁকে হাকিম থেকে হাই শেরিফ (High Sheriff) হতে সমর্থ করত না। যাকে আমরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বলি সেই ধরনের জ্ঞানের কথা ছিল বেকনের মনে। বিজ্ঞানের উপর তিনি যে গুরুত্ব আরোপ করলেন তাতে কিন্তু আরব্য এবং মধ্যযুগের প্রথম দিকের ঐতিহ্য দেরিতে বহন করা হলো। ঐ ঐতিহ্য অনুসারে জ্ঞান প্রধানত গঠিত জ্যোতিষবিদ্যা, আলকেমি ও ভেষজবিজ্ঞান নিয়ে; এই সবগুলিই বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে গণ্য হতো। বিদ্বান ব্যক্তি তাকেই মনে করা হতো যিনি এইসব বিজ্ঞানে ব্যুৎপন্ন, এবং ফলে জাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী। একাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে দ্বিতীয় সিলভেস্টার পোপকে, অন্য কোনো কারণে নয়, শুধু অনেক বই পড়েছেন বলে সার্বজনীনভাবে বিশ্বাস করা হতো জাদুকর হিসেবে এবং আরো মনে করা হতো যে, তিনি ভূ-প্রেতের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ। প্রসপেরো, যিনি শেক্সপিয়রের সময়ে ছিলেন কাল্পনিক চরিত্র মাত্র, অতঃপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিদ্বানব্যক্তি সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করা হয়েছে তাকে তার প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করা হয়, অন্তত তার জাদুকরী ক্ষমতার জন্য। আমরা এখন যেমন জেনেছি, বেকন সঠিকভাবে বিশ্বাস করতেন যে, বিজ্ঞান মানুষের হাতে তুলে দিতে পারে অধিকতর শক্তিশালী জাদুদণ্ড, যে দণ্ড সম্পর্কে অতীতকালের প্রেসিদ্ধ ব্যক্তিগণ স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারতেন না।

রেনেসাঁস, যা বেকনের সময়ে ইংল্যান্ডে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে, জ্ঞানের উপযোগবাদী ধারণার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। গ্রিকরা হোমারের পরিচিতি অর্জন করে, আমরা যেমন মিউজিক হলের গান সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখি। কারণ হোমারের লেখা উপভোগ তারা করতেন, এবং তাদের মধ্যে কিন্তু এমন বোধ কাজ করত না যে তারা জ্ঞানানুসন্ধান করছেন। কিন্তু ষোড়শ শতকের লোকেরা প্রথমে ব্যাপক ভাষাতাত্ত্বিক বিদ্যা অর্জনের আগে তাঁকে বুঝতে শুরু করতে পারে নি। তাঁরা গ্রিকদের ভক্তি করতেন, এবং আনন্দ উপভোগে বঞ্চিত হতে ইচ্ছুক ছিলেন না; সুতরাং তারা গ্রিকদের অনুসরণ করতেন; ধ্রুপদী রচনাপাঠ এবং অন্যান্য উপায়ে। যে উপায়গুলো খুব সুস্পষ্ট নয়। রেনেসাঁসের সময়ে বিদ্যার্জন ছিল Joie de vivre-এর অংশ, সুরাপান ও যৌনকর্মের মতোই। এবং এটা শুধু সাহিত্য সম্পর্কেই সত্য নয়। অন্যান্য জটিলতার বিষয় সম্পর্কেও সত্য ছিল। ইউক্লিডের পুস্তকের সঙ্গে হবসের প্রথম পরিচয়ের গল্পটা সবাই জানেন; পুস্তকটি খোলর পর আকস্মিকভাবে তার চোখ পড়ে পিথাগোরাসের একটি উপপাদ্যে, তিনি বিস্ময়সূচক চিৎকার করে ওঠেন, হা ঈশ্বর, এ সম্ভব হতে পারে না এবং পেছন দিক থেকে সংশোধনী পাঠ করতে শুরু করেন যতক্ষণ না স্বতঃসিদ্ধে পৌঁছেন, এবং প্রমাণ দেখতে পান ও সত্যতা অনুভব করেন। কেউ সন্দেহ করতে পারবেন না যে এটা ছিল তাঁর জন্য বড় আনন্দদায়ক মুহূর্ত। এই মুহূর্তে তিনি ক্ষেত্র জরিপের কাজে জ্যামিতির উপযোগিতার ভাবনা দ্বারা কলুষিত হন নি।

সত্য যে, রেনেসাঁস ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরাকালীন ভাষাসমূহের ব্যবহারিক প্রয়োজন দেখতে পায়। ধ্রুপদী লাতিন ভাষার প্রতি নতুন প্রীতির প্রাথমিক ফল ছিল পোপের নির্দেশাবলি ও কনস্টান্টাইনের উপহার যে জাল ছিল তা ধরা পড়ল। বাইবেলের প্রাচীন লাতিন তর্জমায় (vulgate) এবং প্রাচীন গ্রিক তর্জমায় (Septuagint) যে ত্রুটিগুলো আবিষ্কৃত হয় তাতে প্রটেস্টান্ট পুরোহিতদের কাছে গ্রিক ও হিব্রু ভাষা বিতর্কমূলক অস্ত্রের দরকারি অঙ্গে পরিণত হয়। প্রজাতান্ত্রিক গ্রিস ও রোমের নীতিমালার সহায়তা নেয়া হয় পিউরিটানদের ক্ষেত্রে স্টুয়ার্টদের প্রতিরোধ এবং জেসুইটদের ক্ষেত্রে রাজতন্ত্রীদের প্রতিরোধ ন্যায়ানুগ করে তোলার জন্য। রাজতন্ত্রীরা পোপের প্রতি আনুগত্য পরিত্যাগ করেছিলেন। তবে এসবই ধ্রুপদীবিদ্যা পুনরুজ্জীবনের প্রতিক্রিয়া, কারণ নয়, এবং লুথারের একশো বছর আগে থেকেই ধ্রুপদী বিদ্যা চর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটে ইতালিতে। রেনেসাঁসের প্রধান অভিপ্রায় ছিল মানসিক স্ফূর্তি এবং শিল্পকলা চর্চা ও কল্পনা প্রতিভা বৃদ্ধি ও বিকাশের স্বাধীনতা সংরক্ষণ, এই স্বাধীনতা হারিয়ে গিয়েছিল, স্থান লাভ করেছিল অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার, যা মনশ্চক্ষুতে ঠুলি পরিয়ে দেয়।

দেখা গেল, গ্রিকরা তাদের মনোযোগর একটি অংশ এমন কিছু বিষয়ে নিবদ্ধ করেছিলেন যা বিশুদ্ধ সাহিত্যিক ও শৈল্পিক নয়; তারা দর্শন, জ্যামিতি এবং জ্যোতির্বিদ্যার মতো বিষয়ও চর্চা করেছেন। এই বিষয়গুলো চর্চা শ্রদ্ধেয় ব্যাপার ছিল। তবে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয়। সত্য যে, হিপ্পোক্রাটিস ও গ্যালেনের নামের জন্য চিকিৎসাশাস্ত্র মর্যাদা লাভ করে; কিন্তু অন্তর্বর্তীকালে আরব দেশের লোক ও ইহুদিরাই শুধু এর চর্চা চালিয়ে যায় এবং জাদুটোনার সঙ্গে কঠিনভাবে জড়িয়ে পড়ে। এ জন্যই প্যারাসেলসাস-এর মতো লোকদের খ্যাতি দ্ব্যর্থক। রসায়নশাস্ত্রের সঙ্গে আরো বাজে গন্ধ যুক্ত হয়। এবং এই শাস্ত্র অষ্টাদশ শতকের আগে মর্যাদা লাভ করেনি।

এইভাবে গ্রিক ও লাতিন ভাষার জ্ঞান, সঙ্গে সঙ্গে জ্যামিতি সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান, হয়তো জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানও, ভদ্রলোকদের বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়। জ্যামিতিক জ্ঞানের বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগকে গ্রিকরা অবজ্ঞা করতেন এবং শুধুমাত্র তাদের অবক্ষয়ের সময় জ্যোতিষশাস্ত্রের ছদ্মাবরণে জ্যোতির্বিদ্যার প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করেন। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দী হেলেনীয় নিরাসক্তি নিয়ে প্রধানত গণিত শাস্ত্রের চর্চা করে, এবং বিজ্ঞানের যে শাখাগুলো ভেলকিবাজির সঙ্গে জড়িত হয়ে মর্যাদা হারিয়েছিল সেগুলোর চর্চা এড়িয়ে চলার ঝোঁক দেখা যায়। জ্ঞানের ব্যাপকতর ব্যবহারিক ধারণার দিকে ক্রমিক পরিবর্তন, গোটা অষ্টাদশ শতকে চলেছে। ঐ সময়ের পর ফরাসি বিপ্লব এবং যন্ত্রপাতি বিকাশের দরুন পরিবর্তনের গতি ত্বরান্বিত হয়। ফরাসি বিপ্লব ভদ্রলোকের সংস্কৃতির প্রতি আঘাত হানে। অপরপক্ষে যন্ত্রপাতি অদ্রলোকসুলভ দক্ষতা ব্যবহারের বিস্ময়কর সুযোগ সৃষ্টি করে। গত দেড়শো বছর জুড়ে মানুষ অকেজো জ্ঞানের মূল্য নিয়ে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর প্রশ্ন তুলেছে। এবং ক্রমান্বয়ে তাদের এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে যে সেই জ্ঞান অর্জনই মূল্যবান যা সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোনো না কোনো অংশবিশেষে প্রয়োগ করা যায়।

ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে, যেখানে প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, জ্ঞান সম্পর্কিত উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কেবল মাত্র আংশিকভাবে স্থান লাভ করে। এখনও বিশ্ববিদ্যালগুলোতে চৈনিক ভাষার অধ্যাপক রয়েছেন যারা চৈনিক ধ্রুপদী রচনা পড়েছেন, কিন্তু সান ইয়াৎ-সেনের রচনাকর্মের সঙ্গে পরিচিত নন, অথচ সান ইয়াৎ সেনের রচনাদি আধুনিক চীন সৃষ্টি করেছে। এখনও এমন অনেক লোক রয়েছেন যারা প্রাচীন ইতিহাস একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত পড়েছেন, যে পর্যায়ের রচয়িতাদের শৈলী বিশুদ্ধ অর্থাৎ তারা গ্রিসের ইতিহাস পড়েছেন আলেকজান্ডার পর্যন্ত, আর রোমের ইতিহাস পড়েছেন নিরো পর্যন্ত, কিন্তু পরবর্তীকালীন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস পাঠ করতে অস্বীকার করেন। কারণ ঐ সময়ের ইতিহাস যারা লিখেছেন তাদের বর্ণনারীতি নিকৃষ্ট। সে যাই হোক এমনকি ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডেও পুরাতন প্রথা এখন মিয়মাণ এবং রুশদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো অধিকতর আধুনিক দেশগুলোতে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। উদাহরণত, আমেরিকায় শিক্ষা পর্ষদ উল্লেখ করেছেন যে ব্যবসায়িক পত্রাদি রচনায় অধিকাংশ লোক মাত্র পনেরো শো শব্দ ব্যবহার করেন। সুতরাং তাদের উপদেশ স্কুলের পাঠ্যবিষয় থেকে বাকি শব্দগুলো বাদ দিতে হবে। ইংরেজদের উদ্ভাবিত মৌলিক ইংরেজি আরো অনেক দূর এগিয়ে গেছে, এখানে আট শত শব্দ যথেষ্ট মনে করা হয়। নন্দনতাত্ত্বিক অর্থে বক্তৃতার মূল্য রয়েছে এই ধারণা মারা যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে এই ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে শব্দাবলির একমাত্র লক্ষ্য হলো ব্যবহারিক তথ্য পরিবেশন। রুশদেশে ব্যবহারিক লক্ষ্য উদ্ধারে আস্থা আমেরিকার চেয়েও আন্তরিক: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যা-কিছু শেখানো হয় তা যেন শিক্ষা ও সরকার সম্পর্কে কোনো কাজে লাগে। একমাত্র কিছুটা মুক্তি পাওয়া গেছে ধর্মতত্ত্বের জন্য অতি পবিত্র বলে গণ্য ধর্মগ্রন্থ চর্চা করতে হবে মূল জার্মান ভাষায় এবং কিছু কিছু অধ্যাপককে দর্শন সম্পর্কে জানতে হবে বুর্জোয়া পরাবিজ্ঞানীদের সমালোচনা থেকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ রক্ষার জন্য। তবে গোঁড়ামি যতই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, এই ক্ষুদ্র ছিদ্রপথও ততই বন্ধ হয়ে যাবে।

সর্বত্রই জ্ঞান ধীরে-ধীরে গণ্য হচ্ছে স্বয়ং শুভ হিসেবে নয়, কিংবা সাধারণভাবে জীবন সম্পর্কে প্রশস্ত ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ার মাধ্যম হিসেবেও নয়, বরং গণ্য হচ্ছে নিতান্তই প্রযুক্তিগত দক্ষতার উপাদান হিসেবে। এটি বৃহত্তর সামাজিক অখণ্ডতার অংশ যা সম্ভব হয়েছে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি এবং সামরিক প্রয়োজনীয়তার জন্য। আজকের দিনে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরস্পরনির্ভরতা অতীতকালের চেয়ে অনেক বেশি, সুতরাং একজন লোকের উপর বিশেষ জীবন যাপনের চাপ অনেক বেশি। বাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে, ধনীদের জন্য স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলো এবং (ইংল্যান্ডে) যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাচীনত্বের দাবিতে অভেদ্য হয়ে গেছে সেগুলি বাদে, তাদের ইচ্ছে মতো অর্থ ব্যয় করতে দেয়া হয় না, বরং তাদের রাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে হবে যে তারা প্রয়োজনীয় অভীষ্ট বাস্তবায়ন করছেন ছাত্রদের দক্ষতা প্রদান এবং আনুগত্য শিখিয়ে। এটি সেই আন্দোলনের অনুরূপ যার পরিণতি দাঁড়িয়েছে বাধ্যতামূলক সামরিক চাকুরি, বয় স্কাউট, রাজনৈতিক দল সংগঠন, এবং পত্রিকাদি কর্তৃক রাজনৈতিক ভাববিলাস প্রচার। আমরা আগের চেয়ে স্বীয় স্বদেশবাসীর প্রতি অনেক বেশি সচেতন, এবং পুণ্যবান হয়ে থাকলে আমরা তাদের উপকার করার জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন থাকি এবং যা কিছুই ঘটুক না কেন তারা আমাদের উপকার করে। আমরা ভাবতেই পারি না যে একজন লোক অলসভাবে জীবন উপভোগ করবে, তার উপভোগের গুণাগুণ যতই সুরুচিপূর্ণ হোক না কেন। আমরা উপলব্ধি করি যে প্রত্যেক ব্যক্তি একটা মহৎ উদ্দেশ্য (সে যাই হোক) বাস্তবায়নের জন্য কিছু কাজ করবে। আরো এজন্য যে কত বাজে লোক এই মহৎ উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে কাজ করছে এবং এটা স্তব্ধ করে দেয়া দরকার। আমাদের মন অবসর পায় না, অতএব আমাদের জ্ঞান অর্জন করে যেতে হবে, তবে এমন জ্ঞান নয় যা দিয়ে আমরা যা-কিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তার জন্য লড়াই করতে সাহায্য পাই।

শিক্ষার সংকীর্ণ উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অনেক কথাই বলার আছে। জীবিকা অর্জনের শুরুর আগে সব কিছু শেখার সময় মেলে না এবং নিঃসন্দেহে কেজো জ্ঞান খুবই দরকারি। কেজো জ্ঞানই আধুনিক জগতের নির্মাতা। এই জ্ঞান না থাকলে আমরা যন্ত্রাদি, মোটর গাড়ি কিংবা রেলগাড়ি বা উড়োজাহাজ পেতাম না; এখানে আরো যোগ করা যায় যে আধুনিক বিজ্ঞাপন ব্যবস্থা কিংবা প্রচারণা পদ্ধতি আমাদের জুটত না। আধুনিক জ্ঞান মানুষের গড় স্বাস্থ্যের প্রভূত উন্নতিসাধন করেছে, আবার একই সময়ে আবিষ্কার করেছে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে কীভাবে বড় বড় শহর পৃথিবী-পৃষ্ঠ থেকে মুছে ফেলা যায়। পূর্বেকার তুলনায় আমাদের জগৎ যে যে ক্ষেত্রে বিশিষ্ট তার উৎস এই কেজো জ্ঞান। কোনো সম্প্রদায়ই এই জ্ঞান এখনও যথেষ্ট পরিমাণে লাভ করেনি এবং নিঃসন্দেহে শিক্ষার দ্বারা এই জ্ঞানের প্রসার অবশ্যই ঘটাতে থাকবে।

এটা স্বীকার করতে হবে যে প্রথাগত সাংস্কৃতিক জ্ঞানের অনেকটাই ছিল বোকামিপূর্ণ। ছেলেরা বছরের পর বছর ব্যয় করে লাতিন ও গ্রিক ব্যাকরণ শেখে। পরিশেষে কিন্তু তারা গ্রিক বা লাতিন লেখকের পুস্তকাদি পাঠে সমর্থও হয় না, তাদের সে ইচ্ছাও থাকে না (নগণ্য ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে)। যে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক ভাষাসমূহ এবং ইতিহাস, লাতিন ও গ্রিকের চেয়ে অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য। এগুলো শুধু অধিকতর প্রয়োজনীয় নয়। এগুলো স্বল্প সময়ে অনেক বেশি সংস্কৃতি যোগায়। পঞ্চদশ শতাব্দীর একজন ইতালিবাসীর যা কিছু পড়ার দরকার ছিল তারা সে সব হাতের কাছে মাতৃভাষায় না পেলেও গ্রিক ও লাতিন ভাষায় অবশ্যই পেয়ে যেতেন, তাই এই ভাষাগুলো তাদের কাছে ছিল সংস্কৃতির অপরিহার্য চাবিকাঠি। কিন্তু সেই সময়ের পর মহৎ সাহিত্য বিভিন্ন আধুনিক ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে এবং সভ্যতার বিকাশ এতটা দ্রুত গতিতে সাধিত হয়েছে যে আমাদের সমস্যা বোঝার জন্য পুরাকাল সম্পর্কিত জ্ঞান হয়ে পড়েছে কম দরকারি অন্তত আধুনিক জাতিসমূহ এবং তাদের সাম্প্রতিক ইতিহাস সম্পর্কিত জ্ঞানের তুলনায়। প্রথাগত স্কুল শিক্ষকের দৃষ্টিকোণ, যা বিদ্যাবত্তার পুনরুজ্জীবনের সময় ছিল খুবই শ্রদ্ধেয়, ক্রমান্বয়ে অযথা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। কারণ তারা পঞ্চদশ শতাব্দীর পর জগৎ কতটা অর্জন করেছে তা পাত্তা দেয়নি। অথচ শুধু ইতিহাস এবং আধুনিক ভাষা নয়, উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে অবদান রাখে। অতএব এটা ধরে নেয়া যায় যে প্রত্যক্ষ উপযোগী না হয়ে শিক্ষার অন্যবিধ লক্ষ্য থাকা দরকার, এবং প্রথাগত পাঠ্যক্রমের প্রতি গুরুত্ব দেয়ারও দরকার নেই। উপযোগ ও সংস্কৃতি, যখন দুটিকেই বৃহত্তর পরিসরে ভাবা হয়, দেখা যায় তাদের মধ্যে অসামঞ্জস্য খুবই কম, যে কোনো একটির গোঁড়া প্রবক্তার কাছে অন্যরকম মনে হলেও।

অনেক ক্ষেত্রে সংস্কৃতি এবং প্রত্যক্ষ উপযোগকে সমন্বিত করা যায়, তবু বিভিন্ন ধরনের কিছু পরোক্ষ উপযোগ রয়েছে এমন জ্ঞানের অধিকারে যা প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে না। আমি মনে করি, আধুনিক জগতের অত্যন্ত বাজে কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের উন্নতি সাধন সম্ভব এই ধরনের জ্ঞানের প্রতি উৎসাহ বাড়িয়ে, এবং সাদামাটা পেশাদারী নৈপুণ্য অর্জনের পিছে একটু কম ছুটে।

যখন সচেতন তৎপরতা কোনো এক বিশেষ লক্ষ্য হাসিলে নিয়োজিত হয়, তখন অধিংকাশ লোকের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ফল দাঁড়ায় ভারসাম্যহীনতা, সঙ্গে যুক্ত হয় এক ধরনের স্নায়বিক বৈকল্য। যারা যুদ্ধকালে জার্মান নীতি পরিচালনা করেছেন তারা অনেক ভুল করেছেন, উদাহরণত, ডুবোজাহাজের ব্যবহার ব্যাপারে। এতে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তির পক্ষ নেয়, অথচ নতুন কোনো লোক এই কাজটিতে (ডুবোজাহাজ ব্যবহার) বিজ্ঞতা দেখতেন না। কিন্তু তারা মাথা ঠিক রেখে ব্যাপারটা বিচার করতে পারেন নি, কারণ তারা মানসিকভাবে ছিলেন ভারাক্রান্ত, অবকাশ বা ছুটি তাদের মোটে জোটেনি। এই একই জিনিস দেখা যাবে যেখানে কতিপয় লোক এমন কাজে নিয়োজিত হয় যা তাদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে। জাপানি সাম্রাজ্যবাদী, রুশ কম্যুনিস্ট এবং জার্মান নাৎসি, এদের সবার রয়েছে কঠিন গোঁড়ামি, যা একান্তভাবেই নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদনের মানসিক জগতে বাস করে। যখন কাজটি গোঁড়াদের অনুমান মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভাব্য হয় তখন ফল দাঁড়ায় চমৎকার; কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য কোনো বিরুদ্ধ শক্তি থাকলে তা ভুলে থাকা হয়, কিংবা উক্ত শক্তিকে শয়তানের কাজ বলে গণ্য করা হয়, যা মোকাবেলা করতে হবে শাস্তি এবং সন্ত্রাস দিয়ে। শিশুদের ক্ষেত্রে যেমন বয়স্ক মানুষদেরও খেলাধুলা করার দরকার রয়েছে, কিংবা এমন একটা সময় তাদের থাকা দরকার যখন কাজের কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকবে না, উপস্থিত আনন্দ উপভোগ ছাড়া। কিন্তু যদি খেলাধুলাকে উদ্দেশ্য সাধন করতে হয় তাহলে এমন ব্যাপারে সুখ ও উৎসাহ খুঁজে পাওয়া সম্ভব করে তুলতে হবে যার সঙ্গে কাজের সম্পর্ক নেই।

দেখা যায় যে আধুনিক শহরের লোকদের আমোদ-প্রমোদের ঝোঁক উত্তরোত্তর নিষ্ক্রিয় ও সমষ্টিগত হচ্ছে। অপরের দক্ষ কার্যকলাপ নিষ্ক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। সন্দেহ নেই, প্রমোদের ব্যবস্থা একেবারে না-থাকার চেয়ে এটা ভালো, কিন্তু সেই জনগোষ্ঠীর চেয়ে উত্তম হবে না শিক্ষার মাধ্যমে যারা বিস্তৃততর পরিসরে চিন্তাশীল উৎসাহে নিমগ্ন, এবং তা কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়। উন্নততর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা যন্ত্রাদির উৎপাদনশীলতা দ্বারা মানুষকে উপকৃত করবে, অবকাশ বৃদ্ধি করবে ব্যাপক হারে। আবার অতিরিক্ত অবসর একঘেয়ে হয়; কিন্তু যারা চিন্তাশীল কাজ ও উৎসাহের সঙ্গে জড়িত তাদের বেলায় একঘেয়ে হবে না। অবসরভোগী জনমানুষকে সুখী হতে হলে তাদের অবশ্যই শিক্ষিত হবে হবে। এবং (তাদের শিক্ষিত হতে হবে। একই সঙ্গে মানসিক উপভোগ এবং কারিগরি জ্ঞান প্রত্যক্ষ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে।

জ্ঞানোপার্জনে সাংস্কৃতিক উপাদান সফলতার সঙ্গে সমন্বিত হলে মানুষের চিন্তার ও বাসনার রূপ গঠন করে। তাদের সংশ্লিষ্ট করে অন্তত বিরাট নৈর্ব্যক্তিক বিষয়াদির সঙ্গে, তার জন্য যা আসন্ন গুরুত্বের শুধু সে সব ব্যাপারের সঙ্গে নয়। তাড়াহুড়ো করে ধারণা করা হয় যে যখন কোনো ব্যক্তি জ্ঞানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কাজের সামর্থ অর্জন করেছে তখন সে তার জ্ঞান শুধু সামাজিক সুফলের জন্য ব্যবহার করবে। শিক্ষার সংকীর্ণ উপযোগী মতবাদ মানুষের লক্ষ্য নির্ণয়ের সঙ্গে-সঙ্গে তার দক্ষতা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে চলে। অপ্রশিক্ষিত মানবিক প্রকৃতিতে বিরাট আকারে নিষ্ঠুরতা থাকে, যা ছোট, বড়, নানা উপায়ে প্রকাশ পায়। ছেলেদের স্কুলে নতুন কোনো ছেলের প্রতি নির্দয় আচরণের ঝোঁক থাকে, কিংবা কারো পোশাক-আশাক যদি প্রচলিত ধাঁচের না হয় তাহলে তার প্রতি নির্দয়তা দেখায়। অনেক মহিলা (পুরুষের সংখ্যাও কম নয়) শুধু খোশগল্প করে দ্বেষ ছড়ায়। স্পেন দেশের লোকেরা ষাঁড়ের লড়াই উপভোগ করে; ব্রিটিশরা উপভোগ করে শিকার ও বন্দুক ব্যবহার। একই নির্দয় আবেগ গুরুতর রূপ নেয় জার্মানিতে ইহুদি এবং রাশিয়ায় কুলাক নির্যাতনে। সকল সাম্রাজ্য এ ধরনের কাজের সুযোগ করে দেয়। আর যুদ্ধের সময় এ ধরনের কাজ সর্বোচ্চ জনহিতকর কর্তব্য হিসেবে গণ্য করা হয়।

এখন, আমাদের স্বীকার করতে হবে যে অত্যন্ত শিক্ষিত ব্যক্তিও অনেক সময় নির্দয় হয়ে থাকে। কিন্তু আমি মনে করি এতে কোনো সন্দেহ নেই যে যাদের মন আকর্ষিত তাদের চেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে নির্দয়তার পরিমাণ কম হয়। স্কুলের একটি গুণ্ডা প্রকৃতির ছেলে শিক্ষার্জনে কম ক্ষেত্রেই গড় দক্ষতা দেখায়। হত্যাকাণ্ড হলে, দেখা যায়, হত্যার মূল নায়কেরা প্রায় ক্ষেত্রেই খুবই অজ্ঞ ব্যক্তি হয়ে থাকে। কারণ এই নয় যে মনন চর্চা সদর্থক মানবিক অনুভূতির জন্ম দেয়। তবে তা দিতেও পারে; কারণ হলো মনন চর্চা প্রতিবেশী নির্যাতনে প্রণোদিত না করে অন্য ক্ষেত্রে উৎসাহী করে, তাছাড়া আধিপত্যের মনোভাব তৈরি না করে, আত্ম-সম্মান অর্জনের ভিন্ন উৎসের দিকে চালিত করে। যে দুটি জিনিস সার্বজনীনভাবে কামনা করা হয় তা হলো ক্ষমতা ও শ্রদ্ধা। অজ্ঞ ব্যক্তি বন্য উপায়ে কেবল যে কোনো একটি অর্জন করতে পারে। এতে পরিবেশের উপর প্রভুত্ব অর্জন অন্তর্ভুক্ত হয়। সংস্কৃতি মানুষকে যে ক্ষমতা দেয় তা কম ক্ষতিকর, এবং এটা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ার সর্বোকৃষ্ট পন্থা। যে কোনো সম্রাটের চেয়ে গ্যালিলিও বেশি কাজ করেছেন পৃথিবী পরিবর্তন করার জন্য এবং তাঁর ক্ষমতা তার নির্যাতনকারীর ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। সুতরাং তার নিজের নির্যাতনকারীতে পরিণত হওয়ার দরকার করেনি।

অকেজো জ্ঞানের সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা এখানে যে এটা মনের চিন্তাশীল অভ্যাসের উন্নয়ন ঘটায়। এই পৃথিবীতে অতি বেশি প্রস্তুতি রয়েছে শুধু কোনো প্রকার পূর্ব চিন্তা ছাড়াই কাজের জন্য, মাঝে মাঝে এমন কাজের জন্যও যে কাজ সম্পর্কে প্রজ্ঞার উপদেশ হবে নিষ্ক্রিয় থাকা। জনগণ এ ব্যাপারে তাদের পক্ষপাত দেখায় নানাভাবে এবং বিশ্রীভাবে। মেফিস্টোফেলিস তার তরুণ ছাত্রদের বলেন যে, তত্ত্ব ধূসর কিন্তু জীবনবৃক্ষ সবুজ এবং সবাই এই উক্তি এমনভাবে উদ্ধৃত করেন যেন এটা গ্যেটের অভিমত, ভেবে দেখা হয় না, গ্যেটের মতে, শয়তান তার প্রাগাতক ছাত্রদের কী বলতে পারে। হ্যামলেটকে দেখানো হয় কাজহীন চিন্তার ভয়ানক সাবধানবাণী হিসেবে, কিন্তু কেউ ওথেলোকে দেখান না চিন্তাহীন কাজের সাবধানবাণী হিসেবে। বার্গসের মতো প্রফেসর, বাস্তববাদী মানুষের প্রতি এক ধরনের স্বপ্নারিবশত দর্শনের নিন্দা করেন এবং বলেন সর্বোৎকৃষ্ট জীবন হবে অগ্রসরমান অশ্বারোহী সৈনিকের অনুরূপ। আমার দিক থেকে বলতে পারি, কাজ সূচিত হবে ব্রহ্মাণ্ড এবং মানবতার অদৃষ্ট সম্পর্কে গভীর বোধ থেকে, বল্গাহীন রোমান্টিক আসক্তি এবং অতিরিক্ত আত্ম-জাহিরের প্রবণতা থেকে নয়। কাজ নয়, চিন্তায় আনন্দ খুঁজে পাওয়ার অভ্যাস প্রজ্ঞাহীনতা ও অতিরিক্ত ক্ষমতা লিপ্সার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ, দুর্ভাগ্যেও নির্মল স্থৈর্য এবং উদ্বেগের মধ্যে মনের প্রশান্তি রক্ষার উপায়। ব্যক্তিত্বে নিমগ্ন জীবন, আগে হোক পরে হোক, অসহনীয় যন্ত্রণাকর হতে পারে; কেবল বৃহত্তর ও কম বিরক্তিকর বিশ্বের জানলা খোলা রেখে জীবনের হতাশজনক দিক সহনীয় করা যায়।

মনের চিন্তাশীলতা অভ্যাসের সুবিধা একই সঙ্গে অতি-তুচ্ছ এবং অত্যন্ত গভীর। ডানা-হীন ক্ষুদ্রকীট, ট্রেন ধরতে না-পারা কিংবা বদমেজাজী ব্যবসাসঙ্গীর মতো ছোটখাটো বিরক্তিকর ব্যাপার দিয়ে শুরু করা যায়। এই ধরনের বিরক্তি দূর করার জন্য বীরত্বের চমৎকারিত্ব কিংবা মানবীয় অসুস্থতা বিষয়ে গভীর ভাবনা মূল্যহীন বলেই মনে হয়, তবু এ ধরনের ব্যাপার যে বিরক্তি উৎপাদন করে তা অনেকের শিষ্ট মেজাজ বিনষ্ট করে দেয়, জীবনে আনন্দও থাকে না। এসব ঘটনায় অপ্রচলিত জ্ঞান সান্ত্বনা বয়ে আনতে পারে, যার সঙ্গে ঐ মুহূর্তের অসুবিধার প্রকৃত কিংবা কল্পিত সম্পর্ক রয়েছে; এবং কোনো সম্পর্ক না থাকলে একজনের চিন্তা থেকে বর্তমানকে মুছে দেয়। ক্রোধে শ্বেতবর্ণধারণকারী লোকদের দ্বারা আক্রান্ত হলে দেকার্তের আসক্তি নামক গ্রন্থের কেন তাদের বেশি ভয় করতে হবে যারা ক্রোধে লাল না হয়ে বিবর্ণ হয়ে যায় অধ্যায়টি স্মরণ করা সুখকর। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অর্জন দুরূহ দেখে যারা অধৈর্য বোধ করেন তাদের অধৈর্য হ্রাস পায় যদি তারা সাধু রাজা ৯ম লুই-র কথা ভাবেন, যিনি ধর্ম যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে পার্বত্য বুড়ো লোকটার সঙ্গে নিজের শক্তির হিসেব কষে নিয়েছিলেন। এই বুড়ো লোকটিকে আরব্য রজনীতে পাই জগতের অর্ধেক শয়তানীর উৎস হিসেবে। পুঁজিবাদীদের দুর্নিবার লোভ যখন নিষ্পেষণের রূপ নেয় তখন একজন আকস্মিকভাবে সান্ত্বনা লাভ করতে পারেন এটা স্মরণ করে যে প্রজাতান্ত্রিক পবিত্রতার প্রতিভূ ব্রুটাস একটি নগরীকে ৪০ শতাংশ সুদের হারে ঋণ দিয়েছিলেন এবং যখন ঐ নগরী সুদ প্রদানে ব্যর্থ হয় তখন তিনি সৈন্য ভাড়া করে নগরীটি অবরোধ করেন।

কৌতূহলী জ্ঞান কেবল অপ্রীতিকর জিনিসকে কম অপ্রীতিকর করে তোলে না। প্রীতিকর জিনিসকে আরো প্রীতিকর করে তোলে। হ্যাঁন রাজত্বের প্রথম দিকে চিনে সর্বপ্রথম পিচ ও অ্যাপ্রিকট ফলের চাষ সূচিত হয়, এই তথ্য জানার পর ঐ দুটি ফলের স্বাদ আমার কাছে আগের চেয়ে বেড়ে গেছে; মহান রাজা কনিষ্ক চীনের কিছু লোককে জিম্মি করে রাখে, তারা ভারতে উক্ত দুটি ফল চাষের প্রচলন করে, অতঃপর ছড়ায় পারস্যে, সেখান থেকে রোমক সাম্রাজ্যে আসে খ্রিষ্টিয় সনের প্রথম শতাব্দীতে; অ্যাপ্রিকট (Apricot) এবং প্রিকশাস (Precocious) শব্দ দুটির উৎস অভিন্ন, লাতিন, কারণ অ্যাপ্রিকট ফল খুব তাড়াতাড়ি পাকে, এবং শব্দটির আগে A অক্ষর যোগ করা হয়েছিল ভুলক্রমে, শব্দতত্ত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার দরুন। এসব তথ্য ঐ ফলটিকে আমার কাছে আরো মিষ্টি করে তুলেছে।

প্রায় একশো বছর আগে সুখ্যাত কয়েকজন মানব প্রেমিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন কেজো জ্ঞান প্রসারের জন্য, ফল দাঁড়িয়েছিল এই যে জনগণ অকেজো জ্ঞান আস্বাদনের কথা ভুলে গেছে। বিষণ্ণতার দ্বারা আক্রান্ত আমি একদিন বার্টনের Anatomy of Melancholy বইটি খুলে বসি এবং জানতে পারি যে বিষণ্ণতা নামক একটা বস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু যেখানে অনেকে মনে করেন যে এটির জন্মদাতা চারটি কৌতুকরস, পক্ষান্তরে গ্যালেন মনে করেন এর জন্মদাতা তিনটি মাত্র, শ্লেষ্ম কিংবা পিটুইটা এর বহির্ভূত। ভ্যালেরিয়াস এবং মেনারডাস আবার এ দুটিকে অন্তর্ভুক্ত করার দারুণ পক্ষপাতী, এবং ফুসসিয়াস, মন্টালটাস, মন্ট্যানাসও অনুরূপ মতের পৃষ্ঠপোষক। তারা বলেন, সাদা কীভাবে কালো হতে পারে? এই লা-জবাব যুক্তি সত্ত্বেও হারকিউলিস দ্য স্যানিয়া এবং কার্ডান, গুইয়ানেরিয়াস এবং লরেনটিয়াস (বার্টন আমাদের এরকমই বলেন) বিপরীত অভিমত পোষণ করতেন। এই ঐতিহাসিক ভাবনা দ্বারা প্রশান্ত হয়ে আমার বিষণ্ণতা বিলীন হয়ে যায়। এখন বিষণ্ণতার কারণ তিনটি কিংবা চারটি করুণ রস হোক না কেন। অতিরিক্ত আগ্রহের নিদান হিসেবে আমি খুব কম বিষয়ই ভাবতে পারি, যা আলোচিত ধরনের প্রাচীন বিতর্কের চেয়ে বেশি কার্যকরী হবে।

কিন্তু সংস্কৃতির অকিঞ্চিত্বর সুখের যেমন স্থান আছে বাস্তব জীবনের অকিঞ্চিৎকর উদ্বেগ লাঘবের জন্য তেমনি ধ্যানের মূল্য রয়েছে মৃত্যু, ব্যথা, নিষ্ঠুরতা, জাতিসমূহের অন্ধভাবে ছুটে বিপাকে পড়ার মতো জীবনের বৃহত্তর অকল্যাণের ক্ষেত্রে। যারা রীতিবদ্ধ ধর্মে আর কোনো স্বস্তি বোধ করেন না, তাদের জন্য, জীবন যাতে ধূসর, কঠোর এবং তুচ্ছ আত্মজাহিরপূর্ণ না হয়, তার জন্য একটা বিকল্পের দরকার। বর্তমান পৃথিবী কুদ্ধ আত্মকেন্দ্রিক গোষ্ঠীতে পূর্ণ, প্রত্যেক গোষ্ঠী মানব জীবনকে সমগ্রভাবে দেখতে অসমর্থ, কোনো-কোনো গোষ্ঠী সভ্যতার ধ্বংস সাধনে রাজি, তবু এক ইঞ্চি ভূমি ছাড়বে না। এ সংকীর্ণতার মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের মহা আয়োজনও ব্যর্থ হতে বাধ্য। ব্যাপারটা ব্যক্তি মনস্তত্ত্বের হলে ইতিহাস, জীববিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতির মধ্যে প্রতিষেধক খুঁজে পাওয়া যাবে। তাছাড়া এমন বিষয়ের সাহায্যও পাওয়া যেতে পারে যেগুলো আত্ম সম্মান খর্ব না-করেও ব্যক্তিকে সমর্থ করে সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে নিজকে দেখায়। যা দরকার তা এই তথ্য বা সেই তথ্য নয়, দরকার এমন জ্ঞানের যা গোটা মানব জীবনের লক্ষ্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। দরকার শিল্পকলা ও ইতিহাস, প্রকৃত বীরপুরুষদের জীবনের পরিচয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষের অদ্ভুত, আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা ধারণা। এর সঙ্গে থাকতে হবে যা-কিছু সুস্পষ্টভাবে মানবিক তার প্রতি গর্বের আবেগ, দেখা ও জানার শক্তি, ঔদার্যের সঙ্গে অনুভব এবং বিবেচনার সঙ্গে চিন্তা। ব্যাপক প্রত্যক্ষণ নৈর্ব্যক্তিক আবেগের সঙ্গে যুক্ত হলেই কেবল প্রজ্ঞা দ্রুত উৎসারিত হয়।

জীবন সকল সময়ই যন্ত্রণাকর ছিল, তবে গত দুশো বছরের চেয়ে এখন আরো বেশি যন্ত্রণাকর হয়েছে। যন্ত্রণা থেকে পলায়নের প্রচেষ্টা মানুষকে অকিঞ্চিৎকরতা, আত্মবঞ্চনা এবং বিরাট সমষ্টিগত উপকথা উদ্ভাবনে পরিচালিত করে। তবে এই সব মৌহর্তিক যন্ত্রণালাঘব আখেরে দুর্ভোগের উৎসের সংখ্যা বাড়ায়। ব্যক্তিগত এবং সামাজিক দুর্ভাগ্যের উপর জয়ী হওয়া সম্ভব কেবল একটি প্রক্রিয়ায়, যাতে ইচ্ছা ও বুদ্ধিবৃত্তি পরস্পরের উপর ক্রিয়া করে। ইচ্ছার কাজ হলো অকল্যাণ পরিহার করতে অস্বীকার করা কিংবা অবাস্তব সমাধান গ্রহণে অসম্মতি, বুদ্ধির কাজ হলো ব্যাপারটা অনুধাবন, চিকিৎস্য হলে চিকিৎসার উপায় অনুসন্ধান, প্রকৃত সম্পর্কে স্থাপন করে সহনশীল করে তোলার চেষ্টা করা কিংবা অবশ্যম্ভাবী বলে গ্রহণ করা; এবং স্মরণ করা। আমাদের পরিমণ্ডলের বাইরে কী রয়েছে, পুরাকালে কী ছিল, আন্তঃনাক্ষত্রিক গহ্বরগুলোতে অনুসন্ধান করলে কী পাওয়া যেতে পারে।

০৩. স্থাপত্যকর্ম ও কিছু সামাজিক প্রশ্ন

সেই আদিকাল থেকে স্থাপত্যকর্মের লক্ষ্য দুটি; একদিকে হলো একেবারে উপযোগবাদী, উষ্ণতা ও আশ্রয় যোগানো। অপরদিকে, রাজনৈতিক, পাথরে চমৎকারিত্ব ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে মানুষের মনে শ্রদ্ধাপূর্ণ বিস্ময় সৃষ্টি করা। দরিদ্রের জন্য মাথা গোঁজার ঠাই করা গেলেই প্রথম উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যায়; কিন্তু দেবতাদের মন্দির এবং রাজা-বাদশার প্রাসাদাদির নকশা তৈরি করা হতো আকাশের শক্তি এবং তাদের মতের প্রিয় পাত্রদের প্রীতি ভীতি জন্মানোর জন্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজা নয়, গোটা সম্প্রদায়কে গৌরবান্বিত করা হতো; এথেন্সের অ্যাপলিস এবং রোমের ক্যাপিটাল ঐসব নগরীর রাজসিকতা প্রদর্শন করত প্রজা এবং মিত্রদের শিক্ষার জন্য। নন্দনতাত্ত্বিক গুণ ঈর্ষণীয় বিবেচনা করা হতো সর্বসাধারণের অট্টালিকায়, এবং পরবর্তীকালে, ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং সম্রাটের প্রাসাদে, কিন্তু কৃষকের পর্ণ কুটীর কিংবা শহুরে লোকদের নড়বড়ে বস্তিতে প্রত্যাশা করা হতো না।

মধ্যযুগের সমাজের জটিলতার কাঠামো সত্ত্বেও স্থাপত্যকর্মে শৈল্পিক দৃষ্টি অনুরূপভাবে সীমাবদ্ধ ছিল, বাস্তবিকপক্ষে আরো এ কারণে যে, বড় মানুষের গৃহ নির্মিত হতে সামরিক শক্তির কথা ভেবে, এবং ঐ গৃহসমূহের কোনো সৌন্দর্য থাকলে সেটা ছিল আকস্মিক ঘটনা। সামন্তপ্রথা নয়, গির্জা ও বাণিজ্যই মধ্যযুগের বৃহৎ অট্টালিকাগুলো নির্মিত হওয়ার কারণ। ক্যাথিড্রালগুলো মেলে ধরেছে সৃষ্টিকর্তা এবং তার বিশপদের মহিমা। ইংল্যান্ড এবং লো কান্ট্রিসের মধ্যে পশমের ব্যবসায়ীদের জানা ছিল যে ইংল্যান্ডের রাজা এবং বারগান্ডির ডিউক বেতনভুক লোক মাত্র এবং তাদের গরিমা প্রকাশ করেছে চমৎকার ক্লথ হল এবং ফ্লারের পৌরসভার অট্টালিকায়, একটু কম জাঁকজমকের সঙ্গে ইংরেজ দোকান বীথিতে। কিন্তু আধুনিক ধনিকতন্ত্রের জন্মস্থান ইতালি বাণিজ্যিক স্থাপত্যশিল্পকে সম্পূর্ণতা প্রদান করে। সাগরকনে ভেনিস, যে নগরী। ধর্মযুদ্ধকে অন্য পথে চালিত করে এবং খ্রিস্টিয় রাজাদের মধ্যে সঞ্চার করে ভীতির, Doges Place ও বণিক রাজকুমারদের প্রাসাদে সৃষ্টি করে নতুন এক ধরনের জাঁকালো সৌন্দর্য। উত্তরের গ্রাম্য ব্যারনদের মতো ভেনিস ও জেনোয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নির্জনতা কিংবা সুরক্ষিত প্রাকারের দরকার ছিল না। বরং তারা পাশাপাশি বাস করেছে এবং এমন নগরী তৈরি করেছে যা ততটা অনুসন্ধিৎসু নয় এমন আগন্তুকের কাছে যা-কিছু দৃশ্যমান তা চমৎকার এবং নান্দনিক বিচারে সন্তোষজনক ছিল। ভেনিসে অপরিচ্ছন্নতা ঢেকে রাখা ছিল সহজ; নোংরা বস্তিগুলো পেছনের গলিতে লুকিয়ে থাকত এবং গন্ডোলা (ভেনিসের হালকা নৌকা-অনু.) ব্যবহারকারীরা তা কখনো দেখতে পেতেন না। ধনিকতন্ত্র এতটা পূর্ণ ও নিখুঁত সাফল্য আর কখনো অর্জন করতে পারে নি।

মধ্যযুগে গির্জাগুলো শুধু ক্যাথিড্রাল নির্মাণ করে নি, আরো এক ধরনের দালান নির্মাণ করেছে যা আধুনিক প্রয়োজনের জন্য সমধিক উপযোগী ছিল; মঠ, সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনীদের জন্য আশ্রম এবং কলেজ। এসবের ভিত্তি ছিল সীমাবদ্ধ প্রকৃতির সাম্যবাদ, লক্ষ্য ছিল শান্তিপ্রিয় সামাজিক জীবন। এই দালানগুলোর যা-কিছু ব্যষ্টিক তা ছিল স্পার্টান এবং সাধাসিধে, গোষ্ঠীগত হলে হতো চমৎকার এবং অতি-পরিসরের। সন্ন্যাসীরা ক্ষুদ্র কুঠুরীতে মাথা গুজতে পেরেই সন্তুষ্ট থাকতেন; সংগঠনের গরিমা প্রকাশ পেত বৃহৎ হল-ঘর, চ্যাপেল এবং ভোজন কক্ষের জাঁকজমকে। বিলেতে সন্ন্যাসীর আশ্রম ও মঠগুলো প্রধানত টিকে আছে ধ্বংসস্তূপ হিসেবে পর্যটকদের আনন্দ দানের জন্য। তবে অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজের কলেজগুলো এখনও জাতীয় জীবনের অঙ্গ, এবং মধ্যযুগীয় গোষ্ঠীতন্ত্রের সৌন্দর্য ধারণ করে আছে।

উত্তরাঞ্চলে রেনেসাঁস ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের অভব্য ব্যারনরা মনোযোগ দেয় ইতালির ধনিক শ্রেণির চাকচিক্য অর্জনের জন্য। মেডিসির কন্যাদের বিয়ে দেয়া হতো রাজা, কবি এবং চিত্রকরদের সঙ্গে, আর আলপসের উত্তরের স্থাপত্যশিল্পীরা অনুকরণ করেছে ফ্লোরেন্সের মডেল, অভিজাতরা সুরক্ষিত প্রাসাদের বদলে পল্লিতে তৈরি করেছে বাড়ি-ঘর, যা, আক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষার অবর্তমানে, চিহ্নিত হয়েছে মার্জিত ও সভ্য লোকদের নতুন ধরনের নিরাপত্তা হিসেবে। তবে এই নিরাপত্তা ফরাসি বিপ্লবের জন্য বিনষ্ট হয়ে যায় এবং তখন থেকে প্রথাগত স্থাপত্যশৈলী তার প্রাণ হারিয়েছে। এসব এখনও কোথাও কোথাও টিকে আছে যেখানে পুরোনো ধরনের ক্ষমতা বিদ্যমান, যেমন লুর্ভে নেপোলিয়নের সংযোজন। তবে এই সব সংযোজনের রয়েছে বাহুল্যপূর্ণ আলংকারিক কদর্যতা, যা থেকে তার নিরাপত্তাহীনতার প্রমাণ মেলে। মনে হয় তিনি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁর মাতার বাজে ফরাসি ভাষায় বার-বার মন্তব্য: Pourvou que cela doure.

ঊনবিংশ শতাব্দীর স্থাপত্যকর্ম ছিল দুধরনের, যন্ত্রে উৎপাদন এবং গণতান্ত্রিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ এর কারণ; একদিকে ধুয়া নিঃসরণের চিমনিযুক্ত কারখানা, অপরদিকে শ্রমজীবী পরিবারসমূহের জন্য ক্ষুদ্রাকৃতি গৃহের সারি। ফ্যাক্টরিগুলো যেখানে প্রতিনিধিত্ব করেছে শিল্পায়নের দরুন সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংগঠন সেখানে ক্ষুদে বাড়িগুলো প্রতিনিধিত্ব করেছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার, যা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী জনগোষ্ঠীর আদর্শ। যেখানে ভূমির উচ্চ ভাড়ার হারের জন্য বহুতলাবিশিষ্ট দালান কাক্ষনীয়, তাদের রয়েছে সামাজিক নয় স্থাপত্যগত ঐক্য: সেখানে সারি সারি অফিস, এক দালানে অনেক বাড়ি, হোটেল, এবং এখানে যারা বাস করেন তারা আশ্রমের সন্ন্যাসীদের মতো গোষ্ঠী গঠন করেন না, বরং যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেন একে অপরের অস্তিত্ব সম্পর্কে অসচেতন থাকার। ইংল্যান্ডের যেখানে ভূমির দাম খুব বেশি নয় সেখানে প্রতিটি পরিবারের জন্য পৃথক বাড়ির নীতি পালিত হয়। রেলপথে লন্ডন কিংবা উত্তরাঞ্চলের কোনো শহরে আসতে একজন দেখতে পাবেন সারি-সারি ছোট-ছোট বাড়িঘর। এর প্রতিটি বাড়ি ব্যক্তিজীবনের কেন্দ্র, গোষ্ঠীজীবনের প্রতিনিধিত্ব করে অফিস, কারখানা কিংবা খনি (কয়লা বা লোহার), জায়গার চরিত্র অনুসারে। পরিবারের বাইরের সামাজিক জীবন হবে একান্তভাবেই অর্থনৈতিক এবং অ-অর্থনৈতিক সকল সামাজিক প্রয়োজন পরিবারের মধ্যেই মেটাতে হবে কিংবা অপূর্ণ থেকে যাবে। কোনো সময়ের সামাজিক আদর্শ যদি তার স্থাপত্য গুণ দ্বারা বিচার করতে হয় তাহলে বলা যায় গত একশো বছরে কিছুই অর্জিত হয়নি।

কারখানা এবং ক্ষুদে বাড়ির সারি থেকে আধুনিক জীবনের কৌতূহলোদ্দীপক অসামঞ্জস্য বোঝা যায়। বৃহৎ গোষ্ঠী সমূহের কাছে উৎপাদনই হয়ে দাঁড়িয়েছে একমাত্র ভাবনার ব্যাপার, যেখানে রাজনীতি এবং অর্থনীতির বাইরের সবকিছু সম্পর্কে আমাদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি রূপ নিয়েছে অধিকতর ব্যক্তি-ইচ্ছা-নির্ভর। এটা কেবল শিল্প এবং সংস্কৃতির ব্যাপারেই সত্য নয়, যেখানে আত্মপ্রকাশের তাড়না ঐতিহ্য এবং প্রথার বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খল বিদ্রোহ পরিচালিত করেছে, এবং-হয়তো জনতার ভিড়ের জন্য-সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ক্ষেত্রেও সত্য, আরো সত্য সাধারণ নারীর ক্ষেত্রে। কারখানায় বাধ্য হয়েই সামাজিক জীবন যাপন করতে হয়, এজন্যই সৃষ্টি হয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন। আমি নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকি, মহিলারা বলেন; এবং তাদের স্বামীরা ভাবেন তারা বাড়িতে গৃহকর্তার ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকবে। এজন্য মহিলাদের সহ্য করতে হয়, এমনকি তারা পছন্দও করে, পৃথক ছোট বাড়ি, পৃথক ছোট রান্নাঘর, গৃহকর্মের জন্য পৃথকভাবে খাটুনি, এবং বাচ্চারা বিদ্যালয়ে না থাকলে তাদের পৃথকভাবে সেবাযত্ন করা। পরিশ্রম কঠোর, জীবন একঘেয়ে, আর মহিলারা নিজের বাড়িতেই কারাবন্দী; তবু, এসব তার স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করলেও, গোষ্ঠীজীবনের চেয়ে এটাই তার পছন্দ। কারণ স্বতন্ত্র থাকলে আত্ম-সম্মানে ঘা লাগে না।

এই ধরনের স্থাপত্যকর্মের প্রতি পক্ষপাতের সঙ্গে মহিলাদের মর্যাদা যুক্ত। নারী আন্দোলন এবং ভোট সত্ত্বেও স্ত্রীদের অবস্থা, অন্তত শ্রমজীবী শ্রেণিতে, আগের থেকে মোটেই পরিবর্তিত হয়নি। স্ত্রী এখনও স্বামীর উপার্জনের উপর নির্ভর করে এবং সে কঠোর পরিশ্রম করলেও মজুরি পায় না। পেশাগতভাবে গৃহকত্রী বলে সে সংসার চায়, সংসারকর্ম পছন্দ করে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ করার সুযোগের ইচ্ছা, যা অধিকাংশ মানুষের থাকে, তাকে বাড়িতেই তৃপ্ত করতে হয়। আর স্বামী এই অনুভূতি উপভোগ করে যে স্ত্রী তার জন্য কাজ করে এবং অর্থনৈতিকভাবে তার উপর নির্ভরশীল। উপরন্তু তার স্ত্রী, তার বাড়ি, তাকে সম্পত্তি থাকার সুখ দেয় যা ভিন্ন ধরনের স্থাপত্যকর্মে সম্ভব হতো না। বৈবাহিক অধিকারচেতনা থেকে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে, সামাজিক জীবনের বাসনা কখনো পোষণ করলেও, এই ভেবে খুশি থাকে যে যাক অপর কোনো সম্ভাব্য বিপজ্জনক বিপরীত লিঙ্গ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ কমই। অতএব তাদের জীবন অচলায়তনে আবদ্ধ হলেও এবং স্ত্রীর খাটুনি অযথা বেশি হলেও কেউ সামাজিক জীবনের জন্য ভিন্ন কোনো সংস্থা বাসনা করে না।

এসবই পরিবর্তিত হতো, যদি ব্যতিক্রম না হয়ে নিয়ম হতো যে বিবাহিত মহিলা বাড়ির বাইরে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করবে। পেশাদার শ্রেণিতে ইতোমধ্যে অনেক স্ত্রী স্বাধীনভাবে কাজ করে অর্থ উপার্জন করছে। মহিলাদের দরকার হলো আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ ফ্লাট-বাড়ি কিংবা গোষ্ঠীভিত্তিক রান্নাঘর, যাতে আহার্য সম্পর্কে তাকে ভাবতে না হয়, তাছাড়া দরকার নার্সারি স্কুল, যাতে অফিসের সময়ে সন্তানের দায়িত্ব নার্সারি স্কুল পালন করতে পারে। বিবাহিত মহিলা প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে কাজ করছে এতে দুঃখিত হবার কথা এবং দিনের শেষে যদি তাকে এমন কাজ করতে হয় যা সাধারণ মহিলারা করে থাকে (চাকুরিজীবী নয়), তাহলে তার উপর কাজের বোঝাটা একটু বেশিই হবে। কিন্তু স্থাপত্যকর্ম সঠিক হলে মহিলারা গৃহস্থালি কর্ম, সন্তানের দেখাশোনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবে। এতে তার স্বামীর, সন্তানাদির সুবিধা হবে এবং সেক্ষেত্রে স্ত্রী ও মাতাদের চিরাচরিত কাজের বিকল্প হিসেবে পেশাদারী কাজ দিলে সুস্পষ্ট লাভ পাওয়া যাবে। সেকেলে ফ্যাশনের স্ত্রীর স্বামীরা এটা মেনেও নেবে যদি তাদের বেশি নয়, কেবল এক সপ্তাহের জন্য স্ত্রীর কাজগুলো করতে হয়।

শ্রমজীবী ব্যক্তির স্ত্রীর কাজ আধুনিক করা হয় নি কারণ কাজের জন্য পারিশ্রমিক মেলে না। অথচ বাস্তবে অধিকাংশ কাজই অদরকারি, বাকি কাজের অধিকাংশ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া যেতে পারে। এবং এটা যদি করতে হয় তাহলে প্রথম যে সংস্কার কর্মটি হাতে নিতে হবে তা হলো স্থাপত্যকর্ম সংস্কার। সমস্যাটা হলো, সেই একই গোষ্ঠীগত সুবিধা অর্জন যা মধ্যযুগের মঠ-আশ্রমে ছিল, কিন্তু ব্রহ্মচর্য পালন ছাড়াই। অর্থাৎ শিশুদের প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে।

আমরা প্রথমে বিবেচনা করে দেখবো কী কী অহেতুক অসুবিধা বর্তমান ব্যবস্থায় রয়েছে। যেখানে প্রত্যেক শ্রমজীবীর সংসার স্বয়ম্ভু, তা সে পৃথক বাড়িতে হোক বা বড় অট্টালিকার ফ্লাটে হোক।

গুরুতর অকল্যাণ হয় সন্তানদের। স্কুলে যাওয়ার বয়স হওয়ার আগে রোদ-বাতাস তারা কমই পায়; মা যে খাবার দেয় তাই তাদের খেতে হয়,-যে মা দরিদ্র, অজ্ঞ, অতিব্যস্ত এবং বয়স্কদের জন্য এক রকম, ছোটদের জন্য অন্যরকম আহার্য সংস্থানে অসমর্থ। মা রান্না বা গৃহের অন্যান্য কাজের সময় তারা নিয়তির উপদ্রব করে, এতে মায়ের মন বিগড়ে যায়, তার স্নায়ুতে চাপ পড়ে, ফলে তাদের শাস্তি পেতে হয়। শাস্তি পাবার পর তারা হয়তো আদরও পায়; এই ছেলেদের কখনো স্বাধীনতা থাকে না। মুক্ত জায়গা এবং উপযুক্ত পরিবেশ পায় না যেখানে তাদের স্বাভাবিক কার্যকলাপ নির্দোষ বলে গণ্য হবে। পরিস্থিতির দরুন তারা দুর্বল হয়ে পড়ে, স্নায়ুরোগে ভোগে এবং তাদের স্বভাব হয় নতজানু প্রকৃতির।

মায়েদের ক্ষতির দিকটাও খুব গুরুতর। তাকে একই সঙ্গে নার্স, রাঁধুনি এবং পরিচারিকার কাজ করতে হয়, এবং এর একটি কাজের জন্যও সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। অনিবার্য কারণেই সে একটি কাজও সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। সে সব সময় ক্লান্ত থাকে এবং সন্তানদের দেখে সুখানুভব করার চেয়ে বরং বিরক্তিই বোধ করে। কাজ শেষে তার স্বামী অবসর ভোগ করে। কিন্তু তার অবসর নেই; পরিশেষে অনিবার্য কারণেই তার মেজাজ হয় খিটখিটে, সংকীর্ণ-মনা এবং ঈর্ষাকাতর।

স্বামীর অসুবিধা একটু কম, কারণ সে বাড়িতেই থাকে কম। কিন্তু সে যখন বাড়িতে থাকে তখন নিশ্চয়ই স্ত্রীর অসন্তুষ্ট স্বভাব কিংবা সন্তানের অসৎ আচরণ উপভোগ করে না। যেখানে তার অভিযুক্ত করা উচিত স্থাপত্যকর্মকে সেখানে সে অভিযুক্ত করে স্ত্রীকে, ফলশ্রুতি দাঁড়ায় দুঃখজনক, এই দুঃখজনক ফলশ্রুতির হেরফের ঘটে তিনি কতটা পাশবিকতা করতে পারেন তার তুলনায়। এ ধরনের ব্যবস্থা ত্রুটিহীন হয়ে যায় না যদি অঘটনের সংখ্যা বিরল হয়ে যায়।

আমি অবশ্যই বলছি না যে এটা সার্বজনীন ব্যাপার, এবং সব ক্ষেত্রেই ঘটে, কিন্তু আমি বলি যে, যখন ঘটে না তখন দরকার অতিরিক্ত মাত্রায় আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, প্রজ্ঞা, এবং মায়ের দৈহিক শক্তি। স্পষ্টতই সে ব্যবস্থা মানুষের ভেতর এতটা গুণাবলি দাবি করে যে তা কেবল ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেই সফল হয়।

এইসব অসুবিধা একযোগে দূর করার জন্য দরকার স্থাপত্যকর্মে সামষ্টিক উপাদান সূচিত করা। পৃথক ক্ষুদ্র বাড়ি, রান্নাঘরসহ বস্তির সারি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তদস্থলে সারি সারি উঁচু দালান কেন্দ্রীয় চতুর্ভুজ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকবে, দক্ষিণ দিকটা নিচু রাখতে হবে সূর্যালোক প্রবেশের জন্য। একটা সাধারণ রান্নাঘর থাকবে, প্রশস্ত ভোজন-কক্ষ, একটা বৃহৎ ঘর থাকবে আমোদ-প্রমোদ, সভা সমিতি এবং সিনেমা দেখার জন্য। কেন্দ্রীয় চতুর্ভুজে থাকবে একটা নার্সারি স্কুল এবং তা এমনভাবে নির্মিত হতে হবে যাতে বাচ্চারা নিজেদের ক্ষতি করতে না পারে, সহজ-ভঙ্গুর সামগ্রীও নষ্ট না। করতে পারে। কোনো সিঁড়ি থাকতে পারবে না, খোলা জায়গায় আগুন থাকে না কিংবা উত্তপ্ত স্টোভ থাকবে শিশুদের নাগালের বাইরে; থালা-বাসন, কাপ, পাতিল তৈরি হতে হবে অভঙ্গুর সামগ্রী দিয়ে। এবং সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে এমন ব্যাপার এড়িয়ে চলার যাতে বাচ্চাদের উঠতে-বসতে এটা করো না, ওটা করো না বলতে না হয়। আবহাওয়া ভালো থাকলে নার্সারি স্কুল বসবে খোলা আকাশের নিচে, আবহাওয়া খারাপ হলে, এমন কক্ষে স্কুল বসবে যার একটি অংশ বায়ু চলাচলের জন্য ভোলা। ওরা আহার-পর্ব সারবে নার্সারি স্কুলে, স্কুল খুব সস্তায় স্বাস্থ্যোপযোগী খাবার সরবরাহ করতে পারবে, যা ওদের মায়েদের পক্ষেও সরবরাহ করা সম্ভব নয়। ছাত্র থাকাকালে তারা প্রাতঃরাশ থেকে রাত্রির শেষ আহার গ্রহণ পর্যন্ত গোটা সময়টা স্কুলেই কাটাবে। এখানে তাদের আমোদ ফুর্তির প্রচুর সুযোগ মিলবে। তাদের নিরাপত্তার জন্য দরকার করবে ন্যূনতম তদারকি।

এতে বাচ্চাদের প্রচুর লাভ হবে, তাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে মুক্ত বাতাস, রোদ, প্রশস্ত পরিসর এবং ভালো খাবারের জন্য। চরিত্র উন্নত হবে স্বাধীনতা এবং বিরামহীন কুঁদুলে বিধিনিষেধের আবহ থেকে মুক্ত থাকার জন্য। অধিকাংশ শ্রমজীবী বাড়ির আবহ ঐ রকমই হয়। চলাফেরার স্বাধীনতা, যা কেবল কিশোর বয়সীদের নিরাপদে অনুমোদন করা যায় বিশেষভাবে গঠিত পরিবেশে, তা নার্সারি স্কুলে হবে নির্বাধ, এতে ফল হবে যে ওরা অভিযান প্রিয় হবে, ওদের পেশির দক্ষতা বিকশিত হবে স্বাভাবিকভাবে, যেমন সমবয়সী প্রাণীকুলের মধ্যে দেখা যায়। কিশোরদের চলাফেরায় সব সময় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তারা অসন্তুষ্ট হয় এবং পরবর্তী জীবনে হয় দুর্বলচিত্ত; তবে তাদের যদি বয়স্কদের মধ্যে থাকতে হয় তাহলে বিধিনিষেধ অনিবার্য হয়ে পড়ে; সুতরাং নার্সারি স্কুল একই সঙ্গে তাদের চরিত্র ও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি হবে।

মহিলাদেরও বিরাট সুবিধা হয়। শিশু মাতৃক্রোড় ত্যাগ করার পর থেকেই তারা পুরোদিনের জন্য এমন মহিলাদের তদারকিতে থাকবে যারা উক্ত কাজের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। মায়েদের খাদ্য ক্রয়ের দায়িত্ব থাকবে না, রান্না করার না, বাসন-কোসন ধোয়ার না। তারা কাজের জন্য সকালে বেরিয়ে পড়বে, ফিরবে সন্ধেয়। তাদের স্বামীদের মতোই। স্বামীদের মতোই তাদের একটা সময় থাকবে কাজের, একটা সময় অবসর ভোগের। তাদের সব সময় ব্যস্ত থাকতে হবে না। তারা সকালে ও সন্ধেয় সন্তানের দেখা পাবে। হেবর্ষণের জন্য পাবে যথেষ্ট সময়, আবার তা স্নায়ুতে চাপ পড়ার জন্য যথেষ্ট হবে না। যে মায়ের সারাদিন কাটে সন্তানের সঙ্গে তার কৃচিৎ অতিরিক্ত বল থাকে তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করার; আসলে মায়ের চেয়ে বাপই বেশি সন্তানের সঙ্গে খেলাধুলা করে। সত্যি বলতে কি, অত্যন্ত স্নেহশীল বয়স্ক ব্যক্তিও বাচ্চাদের প্রতি বিরক্ত হবেন যদি তিনি বিরামহীন মনোযোগের দাবি থেকে মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম না পান। কিন্তু আলাদাভাবে দিন কাটলে সন্ধেবেলা মা-সন্তান উভয়ে অধিক স্নেহ অনুভব করবে। সারাদিন একসঙ্গে থাকলে যা সম্ভব নয়। দৈহিকভাবে ক্লান্ত কিন্তু মনের দিক থেকে প্রশান্ত সন্তান নার্সারি স্কুলের মহিলার নিরপেক্ষ যত্নের পর মায়ের সেবা অধিক উপভোগ করবে। পারিবারিক জীবনের যা-কিছু ভালো তা টিকে থাকবে, স্নেহমমতার উদ্বেগজনক এবং ধ্বংসাত্মক ব্যাপারটা ছাড়াই।

নারী ও পুরুষ সমভাবে ক্ষুদে কামরার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবেন, সময় কাটবে সাধারণের বৃহৎ কক্ষে, যা স্থাপত্যকর্মের দিক থেকে কলেজ হলগুলোর মতোই চমৎকার হতে পারে। সৌন্দর্য ও পরিসরের সুবিধা শুধু ধনীরা ভোগ করবে, এটা কোনো মতেই আবশ্যিক হতে পারে না। অচলায়তনে আবদ্ধ থাকলে যে বিরক্তি জন্ম নেয় তার পরিসমাপ্তি ঘটবে। যা পারিবারিক জীবন অনেক সময় অসম্ভব করে তোলে।

স্থাপত্যকর্মের সংস্কার করলে এই ফলগুলো পাওয়া যাবে।

একশো বছরেরও আগে রবার্ট ওয়েন অনেক পরিহাস কুড়িয়েছিলেন তাঁর সামবায়িক সামন্তরিক ক্ষেত্রর জন্য তাঁর কিন্তু প্রচেষ্টা ছিল শ্রমজীবীদের জন্য কলেজ জীবনের সুবিধা তৈরি করা। ঐ সময়ের ঘোর দরিদ্রতার জন্য উক্ত প্রস্তাব অবশ্য কালোপযোগী বিবেচিত হয়নি। তবু তার প্রস্তাবের অনেক অংশ এখন বাস্তবতার কাছাকাছি এবং কাম্য বলে বিবেচিত। তিনি নিজে নিউ লানার্কে আলোকসম্পাতী নীতির ভিত্তিতে নার্সারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিউ লানার্কের বিশেষ পরিস্থিতির জন্য বিপথগামী হয়ে সামন্তরিক ক্ষেত্রকে উৎপাদনশীল ইউনিট গণ্য করেন, অথচ শুধু আবাসস্থল গণ্য করার কথা ছিল। প্রথম থেকেই শিল্পায়নের ঝোঁক ছিল অতিরিক্ত উৎপাদনের উপর, ভোগ ও সাধারণ জীবনযাপন গুরুত্ব পায়নি। এটা মুনাফার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদানের ফলশ্রুতি। আর মুনাফার সঙ্গে একমাত্র সম্পর্ক উৎপাদনের। ফলে কারখানা হয়ে পড়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক। শ্রমবিভাগ সম্ভব শেষ বিন্দুতে পৌঁছে গেছে, পক্ষান্তরে গৃহ রয়ে গেছে অবৈজ্ঞানিক এবং এখনও অতিরিক্ত কাজের বোঝায় ন্যুজ মায়েদের মাথায় বিচিত্র ধরনের কাজ চাপিয়ে দেয়া হয়। মুনাফা অর্জন-অভিলাষ প্রাধান্য পাওয়ার স্বাভাবিক ফল এই দাঁড়িয়েছে যে, মানবিক কর্মকাণ্ডের সেই সব ক্ষেত্রগুলোই সবচেয়ে বেশি এলোমেলো, অসংগঠিত এবং সর্বতোভাবে অসন্তোষজনক যেখান থেকে কোনো প্রকার আর্থিক মুনাফা লাভের আশা নেই।

অবশ্য স্বীকার করতে হবে স্থাপত্যকর্মের সংস্কারের প্রতি সবচেয়ে শক্তিশালী আপত্তি আসবে স্বয়ং শ্রমজীবীদের মনস্তত্ত্ব থেকে। তারা যতই বিবাদ করুক, গৃহকোণেরর নিভৃত সবার পছন্দ এবং তাদের গরিমা ও অধিকারবোধ এতে সন্তুষ্ট হয়। মঠ-আশ্রমের মতো অবিবাহিত গোষ্ঠীজীবনে অনুরূপ সমস্যা দেখা দেয়নি। বিবাহ ও পারিবারিক জীবনই গোপনীয়তা রক্ষার প্রবৃত্তি সূচিত করেছে। আমি মনে করি না যে এই প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য পরিবারের গৃহকোণে রান্না করার বাস্তবিকপক্ষে কোনো দরকার রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি নিজস্ব আসবাবপত্রসহ নিভৃত-গৃহ তাদের জন্য যথেষ্ট যারা এসবে অভ্যস্ত। কিন্তু আন্তরিক অভ্যাস পরিবর্তন সব সময়ই কঠিন। মহিলাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা অবশ্য ক্রমে ক্রমে তাদের জীবিকা উপার্জনের জন্য গৃহের বাইরে নিয়ে যাবে এবং এতে আমরা যে ধরনের ব্যবস্থার কথা ভাবছি তা তাদের কাছে কাক্ষনীয় হয়ে উঠতে পারে। শ্রমজীবী শ্রেণির মহিলাদের মধ্যে নারী স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যাপারটা এখনও বিকাশের প্রাথমিক স্তরে। তবে এটা বৃদ্ধি পাবে যদি ফ্যাসিবাদী প্রতিক্রিয়া দেখা না দেয়। হয়তো এই অভীষ্ট থেকে মহিলারা গোষ্ঠীভিত্তিক রান্নাবান্না পছন্দ করবেন, নার্সারী স্কুলও তাদের পছন্দ হবে। পরিবর্তনের তাড়না পুরুষদের কাছ থেকে আসবে না। শ্রমজীবী পুরুষ, তারা সমাজতন্ত্রী কিংবা ক্যুনিস্ট হলেও, স্ত্রীদের মর্যাদার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখতে পায় না।

বেকারত্ব যেখানে গুরুতর অমঙ্গল হিসেবে রয়ে গেছে, যেখানে অর্থনৈতিক বিধিবিধান উপলব্ধির ব্যর্থতা প্রায় সার্বজনীন, সেখানে মেয়েদের চাকরিতে নিয়োগ ব্যাপারে স্বভাবতই আপত্তি ওঠে। কারণ এতে পুরুষের বেকারত্ব বাড়ে। তাদের চাকুরি মেয়েরা ছিনিয়ে নেয় বলে। এই কারণে বিবাহিত মহিলার সমস্যার সঙ্গে বেকারত্বের সমস্যা জড়িত এবং এই সমস্যা কিছুটা সমাজতন্ত্র ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়। যে যাই হোক, যে সামন্তরিক ক্ষেত্র নির্মাণের পক্ষে আমি ওকালতি করছি তা বৃহদাকারে বাস্তবায়িত করতে হলে বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে করতে হবে। কারণ শুধুমাত্র মুনাফা লোটার অভিপ্রায় থেকে এটা আশা করা যায় না। শিশুর স্বাস্থ্য ও চরিত্র এবং মায়েদের স্নায়ু দুর্ভোগ পোহাতেই থাকবে যতদিন মুনাফা লাভের বাসনা আমাদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করবে। কিছু জিনিস অভিপ্রায় দ্বারা অর্জন করা যায়। কিছু জিনিস যায় না; অর্জনে ব্যর্থতার তালিকায় পড়ে শ্রমজীবী শ্রেণির স্ত্রী ও সন্তানদের অবস্থার উন্নয়ন,-এবং যা আরো কাল্পনিক মনে হতে পারে-শহরতলী সুন্দর করা। কিন্তু আমরা যদিও শহরতলীর বিকটতা মার্চের বাতাস কিংবা নভেম্বরের কুয়াশার মতো স্বাভাবিক বলে ধরে নিই, তবু এটা বস্তুত অনুরূপ অনিবার্য নয়। শহরতলীর বাড়ি-ঘরগুলো যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে না-হয়ে পৌরসভা দ্বারা নির্মিত হতো, থাকত পরিকল্পিত রাস্তাঘাট, কোর্টস অব কলেজের মতো বাড়ি, তাহলে তো কারণ দেখতে পাই না সেগুলো কেন চোখের জন্য আনন্দদায়ক হতো না। উদ্বেগ ও দারিদ্র্যের মতো বিকটতার জন্যও আমাদের মূল্য দিতে হয়। ব্যক্তি-মুনাফার প্রতি দাসত্বের জন্য আমাদের যে মূল্য দিতে হয় এটা তারই অংশ।

০৪. আধুনিক মাইড্যাস

হথর্নের Tanglewood Tales যাদের পড়া আছে তারা মাইড্যাস-এর গোল্ডেন টাচ (সুবর্ণ স্পর্শ)-এর কাহিনী জানেন। এই সার্থকাম রাজার স্বর্ণের প্রতি অস্বাভাবিক অনুরাগ ছিল। ঈশ্বর একে এই বর দিয়েছিলেন যে, তিনি যা স্পর্শ করবেন তাই স্বর্ণে পরিণত হবে। প্রথমে রাজা তো খুবই খুশি। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন ঈপ্সিত খাদ্যবস্তু গলাধঃকরণ করার আগেই কঠিন ধাতুতে পরিণত হয়ে গেল, তখন উদ্বিগ্ন বোধ করতে শুরু করলেন; স্বীয় কন্যাকে চুম্বন করার সঙ্গে-সঙ্গে যখন সে পাষাণে পরিণত হলো তখন তার চক্ষু উঠল কপালে এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন ঐ বর ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। ঐ মুহূর্ত থেকে তাঁর এ-ও উপলব্ধি হলো যে জগতে স্বর্ণই শুধু একমাত্র মূল্যবান সামগ্রী নয়।

এটি একটি অত্যন্ত সাদামাটা গল্প। তবু জগৎ এই গল্পের মর্মার্থ অনুধাবন করতে হিমসিম খায়। স্পেনবাসীরা ষোড়শ শতকে যখন পেরুতে সোনা পায়, তখন তারা ভাবল এই সোনা নিজেদের কাছেই রাখতে হবে এবং সোনা যাতে বাইরে রপ্তানি না হয়ে যায় তার জন্য সমস্ত রকম প্রতিবন্ধক খাড়া করল। ফলে স্পেন অধিকৃত দেশগুলোতে পণ্যসামগ্রীর দাম চড়ে গেল। এতে স্পেন প্রকৃত সম্পদের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে সমৃদ্ধতর হলো না। একজন মানুষ এই ভেবে গর্ব ও সন্তোষ বোধ করতে পারেন যে, এখন তার টাকার পরিমাণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ, কিন্তু সে ডাবলুন যদি শুধু আগের চেয়ে অর্ধেক পণ্য ক্রয়ে সমর্থ হয়, তাহলে ঐ লাভটা আর বাস্তবিক থাকল না। এতে তার পক্ষে অধিকতর পরিমাণ খাদ্য ও পানীয় ক্রয় সম্ভব হবে না, কিংবা উন্নততর বাড়ি ক্রয় করতে পারবে না বা চোখে দেখার মতো কোনো সুবিধা হবে না। ইংরেজ ও ওলন্দাজরা অপেক্ষাকৃত কম শক্তিধর ছিলেন বলে আজকের ইস্টার্ন ইউনাইটেড স্টেটস নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেছে, এই অঞ্চল সোনা না থাকায় অবজ্ঞা কুড়িয়েছে। কিন্তু সম্পদের উৎস হিসেবে এই অঞ্চল নিউ ওয়ার্ল্ডের স্বর্ণ-উৎপাদনকারী অংশের চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদনশীল বলে প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এলিজাবেথের যুগে নিউ ওয়ার্ল্ডের সোনা উৎপাদনকারী অংশের প্রতি সকল জাতির লোলুপ দৃষ্টি ছিল।

ইতিহাসের বিষয় হিসেবে যদিও এই ঘটনা সবার জানা তবু আজকের সমস্যায় এর প্রয়োগ সরকার সমূহের মানসিক ক্ষমতার বহির্ভূত বলেই মনে হয়। বিষয় হিসেবে অর্থ শাস্ত্রকে সকল যুগেই উল্টাপাল্টাভাবে দেখা হয়েছে, তবে ব্যাপারটা বর্তমান সময়ের জন্য যতটা সত্য আগের যে কোনো সময়ে ততটা ছিল না। যুদ্ধের পর এ ক্ষেত্রে যা ঘটে তা এতটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ যে এটা বিশ্বাস করাই কঠিন সরকার যারা চালাচ্ছে, তারা সাবালক এবং তারা পাগলাগারদে বড় হয়ে ওঠেন নি। তারা জার্মানিকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল, আর বহুকাল চর্চিত শাস্তি প্রদানের পন্থা হলো ক্ষতিপূরণের দাবি আরোপ। অতএব তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করল। এতদূর ব্যাপারটা ভালোই ছিল। বিপত্তি বাঁধল এখানে যে, ক্ষতিপূরণ দাবির পরিমাণ এতটা বেশি ধরা হলো যে, জার্মানিতে যে পরিমাণ সোনা আছে দাবিকৃত পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি, হয়তো সমগ্র জগতেও এত সোনা নেই। সুতরাং গাণিতিকভাবেই জার্মানদের পক্ষে অসম্ভব পণ্য-সামগ্রী ভিন্ন অন্য কোনো উপায়ে ক্ষতিপূরণ করা; জার্মানি পণ্য-সামগ্রী আকারে ক্ষতিপূরণ করতে পারবে কিংবা এ ব্যাপারে তারা কিছুই করতে পারবে না।

ইত্যবসরে সরকারসমূহের বোধধাদয় হলো যে, তারা একটি দেশের সমৃদ্ধির পরিমাপ করে আমদানির চেয়ে কতটা বেশি রপ্তানি করতে পারে তা দিয়ে। যখন একটি দেশ আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি করে তখন বলা হয় যে দেশটির বাণিজ্যিক ভারসাম্য অনুকূলে। ব্যাপারটা বিপরীত হলে ভারসাম্য প্রতিকূলে গণ্য করা হয়। জার্মানির পক্ষে অসম্ভব পরিমাণ সোনা দিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করে প্রকারান্তরে তারা ডিক্রি জারি করে বসে যে, মিত্রশক্তির সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারসাম্য জার্মানির অনুকূলে থাকবে, আর ভারসাম্য প্রতিকূলে থাকবে মিত্রশক্তির। অতঃপর তারা আতংকের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন জার্মানির রপ্তানি বাণিজ্য চাঙ্গা করে অনিচ্ছুকভাবে বরং দেশটির উপকার করা হচ্ছে। এই সাধারণ যুক্তির সঙ্গে আরো নির্দিষ্ট কিছু যুক্তি যোগ হলো। জার্মানি এমন কিছু উৎপাদন করে না যা মিত্রশক্তি উৎপাদন করতে পারে না। জার্মান প্রতিযোগিতার হুমকি সর্বত্রই অভিযোগের আকার ধারণ করল। ইংরেজদের জার্মানির কয়লার দরকার নেই। তাদের নিজেদের কয়লাখনি শিল্পেই তখন মন্দা দেখা দিয়েছে। ফরাসিদের জার্মানির লৌহ ও লৌহজাত সামগ্রীর দরকার নেই। কারণ তারা নব-অধিকৃত লোরেন প্রদেশের আকরিকের দ্বারা নিজস্ব লৌহ ও ইস্পাত সামগ্রীর উৎপাদন বাড়াচ্ছে। এমন আরো অনেক ব্যাপার। সুতরাং মিত্রশক্তি যদিও জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রইল, অপরদিকে তারা এ ব্যাপারেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলো যে কোনো বিশেষ আকারে তাকে পরিশোধ করতে দেয়া যাবে না।

এই উন্মাদ পরিস্থিতির উন্মাদসুলভ সমাধানও খুঁজে পাওয়া গেল। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো জার্মানি যা পরিশোধ করতে পারবে তাই তাকে ধার দেয়া হবে। বস্তুত মিত্রশক্তি বলতে লাগল; ক্ষতিপূরণ করা থেকে তোমাকে অব্যাহতি দেয়া যাবে না, কারণ এটা তোমার শয়তানির ন্যায়ানুগ শাস্তি। অপরদিকে, তোমাকে পরিশোধেরও সুযোগ দেয়া যাবে না, কারণ এতে আমাদের শিল্প-কারখানা ধ্বংস হয়ে যাবে; অতএব আমরা তোমাকে ধার দেব এবং তুমি সে ধার পরিশোধ করবে। এইভাবে নিজেদের ক্ষতি না-করেও নীতিটা টিকিয়ে রাখা যাবে। তোমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ব্যাপারে কথা হলো, আমরা আশা করছি ঐ ব্যাপারটা কেবল কিছুকালের জন্য মুলতবি রইল।

বলাবাহুল্য, এই সমাধান সাময়িক কালের জন্যই শুধু হতে পারে। জার্মানিকে যারা ঋণ প্রদান করল তারা ঋণের সুদ চায়। সুতরাং একই সংকট দেখা দিল যেটা ক্ষতিপূরণ ব্যাপারে দেখা দিয়েছিল। জার্মানির পক্ষে স্বর্ণ মাধ্যমে পরিশোধ সম্ভব নয়। আর মিত্রশক্তি পণ্যসামগ্রীর মাধ্যমে পরিশোধে গররাজি। অতএব সুদ পরিশোধের জন্যও ঋণ প্রদান দরকারি হয়ে পড়ল। স্পষ্টত জনগণ আগে হোক পরে হোক এই খেলায় এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়বে। জনগণ যদি ধার দিয়ে কিছু না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন বলতে হবে দেশটির ক্রেডিট বা জমা ভালো অবস্থায় নেই। আর এটা যখন ঘটে তখন জনগণ পাওনা টাকার প্রকৃত পরিশোধ দাবি করে কিন্তু আমরা যেমন দেখেছি, জার্মানির পক্ষে তা সম্ভব নয়। ফলে স্থানে-স্থানে দেউলিয়া অবস্থা দেখা দিল বা লালবাতি জ্বলতে শুরু করল। প্রথমে লালবাতি জ্বলল জার্মানিতে, তারপর জ্বলল। জার্মানিকে ধারদাতা পক্ষগুলোর। তারপর তাদের মধ্যে যারা উক্ত পক্ষগুলোকে টাকা ধার দিয়ে বসে আছে; আরো ইত্যাদি। ফল দাঁড়াল সার্বিক মন্দা, দুর্বিপাক, অনাহার, ধ্বংস, সামগ্রিক বিপর্যয় এবং লাগাতর সামগ্রিক বিপর্যয়। যার দরুন সারা বিশ্ব ভুগছে।

আমি বলছি না যে, জার্মানির কাছে ক্ষতিপূরণ দাবিই আমাদের সকল অসুবিধার একমাত্র কারণ। এতে আমেরিকার কাছে মিত্রশক্তির দেনারও অবদান রয়েছে। অনুরূপভাবে, পরিমাণে কম হলেও ব্যক্তিগত ও সরকারি দেনাও অবদান রেখেছে, যেখানে ঋণদাতা ও গ্রহীতাকে শুল্কের উঁচু দেয়াল বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ফলে পণ্যসামগ্রীর মাধ্যমে পরিশোধ হয়ে পড়েছে দুষ্কর। জার্মানির ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যাপারটা কোনো অর্থেই সমগ্ৰ অসুবিধার উৎস না হলেও, বিভ্রান্ত চিন্তার অন্যতম স্বচ্ছ উদাহরণ, যা অসুবিধা মোকাবিলা কঠিন করে তুলেছে।

যে বিভ্রান্ত চিন্তা থেকে আমাদের দুর্ভাগ্য উৎসারিত হয়েছে, তা খাতক ও উৎপাদকের দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রান্তি কিংবা আরো সঠিকভাবে বলা যায়, প্রতিযোগিতামূলক নিয়মের অধীন উৎপাদনের বিভ্রান্তি। ক্ষতিপূরণের দাবি যখন আরোপ করা হয় তখন মিত্রশক্তি নিজেদের ভোক্তা মনে করেছে; তারা মনে করেছে কী সুখের ব্যাপারই না হবে জার্মানি তাদের হয়ে কাজ করবে অস্থায়ী ক্রীতদাস হিসেবে এবং জার্মানি যা উৎপাদন করবে তা বিনাশ্রমে তারা ভোগ করতে সমর্থ হবে। অতঃপর ভার্সাই সন্ধি সমাধা হবার পর তাদের হঠাৎ ঠাহর হলো যে তারাও উৎপাদক। এবং তাদের দাবিকৃত জার্মান পণ্যসামগ্রীর বন্যা দেশীয় শিল্প-কারখানা ধ্বংস করবে। এতে তারা এতটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল যে নিজেদের মাথার চুল ছিঁড়তে শুরু করল এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডেকে বসল, তখনও কিছু হলো না। মোদ্দা কথাটা এই যে, জগতের শাসক শ্রেণি এতটাই অজ্ঞ ও নির্বোধ যে সমস্যাটা নিয়ে ঠিক মতো ভাবতে তারা অসমর্থ। এবং তারা এতটাই দাম্ভিক যে যাদের সাহায্য কাজে লাগতে পারে তাদের উপদেশ গ্রহণেও অরাজি।

সমস্যাটা আরো একটু সরল করে দেখার জন্য অনুমান করা যাক, মিত্রশক্তির একটি দেশ একটি ব্যক্তি নিয়ে গঠিত। ব্যক্তিটি রবিনসন ক্রুসো এবং সে একটি মরুময় দ্বীপে বাস করে। ভার্সাই চুক্তির শর্তানুসারে তাকে জার্মানরা বিনামূল্যে জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করতে বাধ্য। কিন্তু যদি সে মিত্রশক্তিসমূহের মতো আচরণ করে তাহলে সে বলবে, না, আমার জন্য কয়লা আনার দরকার নেই। কারণ এতে আমার কাষ্ঠসংগ্রহশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে; আমার জন্য রুটি আনবে না। এতে আমার কৃষিশিল্প এবং কারখানার যন্ত্রপাতি ধ্বংস হয়ে যাবে; আমার জন্য পোশাক আনতে হবে না, কারণ এতে আমি যে পশুর চামড়া দিয়ে পরিচ্ছদ তৈরির কারখানা গড়ে তুলছি (যা এখন শিশু অবস্থায় আছে) তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। তুমি সোনা সরবরাহ করলে আমি কিছু মনে করবো না। কারণ এতে আমার কোনো ক্ষতি হবে না; ঐ সোনা আমি গুহায় লুকিয়ে রাখব এবং কোনোদিন ব্যবহার করব না; কিন্তু আমার পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব হবে এমন কোনো পণ্য সরবরাহ করলে আমি তা গ্রহণ করব না। আমাদের কল্পিত রবিনসন ক্রুসো সত্যিই যদি এ ধরনের কিছু বলেন, তাহলে আমরা ধরে নেব যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করে তার বুদ্ধিবৃত্তি লোপ পেয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, প্রত্যেকটি জাতি জার্মানিকে তাই বলেছে। কোনো ব্যক্তি নয়, একটি জাতি যখন উন্মাদরোগগ্রস্ত হয় তখন ভাবা হয় যে জাতিটি প্রজ্ঞার পরিচয় দিচ্ছে এবং উক্ত প্রজ্ঞা শিল্পকারখানা গড়ার জন্য দরকারি।

আমাদের ক্রুসো সাহেবের সঙ্গে একটি জাতির প্রাসঙ্গিক পার্থক্য এখানে যে, ক্রুসো সাহেবের সময়জ্ঞান প্রচণ্ড। পক্ষান্তরে একটি জাতির সময়জ্ঞান বলতে কিছু নেই। কোনো ব্যক্তি যদি কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই পোশাক পায়, তাহলে সে পোশাক তৈরি করার জন্য সময় নষ্ট করে না। কিন্তু একটি জাতি কিংবা যে কোনো জাতি মনে করে তাদের প্রয়োজনীয় সব কিছু তৈরি করা উচিত। (আবহাওয়ার মতো) কিছু প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক থাকলে অবশ্য ব্যতিক্রম হয়। জাতিগুলোর যদি কোনো জ্ঞানগম্যি থাকত তবে আন্তর্জাতিক সম্মতির মাধ্যমে তারা ঠিক করে নিত কোন জাতি কী উৎপাদন করবে। এবং সবকিছু উৎপাদন করার চেষ্টা করত না; কোনো ব্যক্তি যেমন সবকিছু উৎপাদনের চেষ্টা করে না। কোনো ব্যক্তিই নিজেই তার পোশাক, জুতো, মোজা, খাদ্য, বাড়ি ইত্যাদি তৈরি করার চেষ্টা করে না। তার এটা ভালোই জানা আছে। যে, সে যদি প্রয়োজনীয় সবকিছু তৈরির চেষ্টা করে তবে তার আরাম-আয়েস নিচু স্তরের হবে। কিন্তু জাতিসমূহ এখনও শ্রম বিভাগের নীতি বুঝে উঠতে পারে নি। যদি তাই বুঝত তবে তারা জার্মানিকে নির্দিষ্ট শ্রেণির পণ্য দিয়ে পরিশোধ করতে দিত। এবং ঐ পণ্য নিজেরা আর তৈরি করত না। যাদের বেকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তারা অন্য ধরনের কাজ জনগণের খরচে শিখে নিত। কিন্তু এর জন্য দরকার উৎপাদন সংগঠনের। যা ব্যবসায়িক গোঁড়ামির বিপরীত।

স্বর্ণ-সম্পর্কিত কুসংস্কারের কারণ কৌতুককরভাবে দৃঢ়মূল, এই কুসংস্কার শুধু যারা এর দ্বারা লাভবান হয় তাদেরই নয় যাদের জন্য এটা দুর্ভাগ্য বয়ে আনে তাদেরও এই কুসংস্কার রয়েছে। ১৯৩১ সালের শরৎকালে ফরাসিরা যখন ইংরেজদের স্বর্ণমান বর্জনে বাধ্য করে, তখন তারা ভেবেছিল এতে ইংরেজদের ক্ষতি হবে। ইংরেজরাও তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত হয়। এক ধরনের লজ্জা, জাতীয় গ্লানিতে ইংল্যান্ড প্লাবিত হয়ে যায়। অথচ সেরা অর্থনীতিবিদগণ স্বর্ণমান পরিত্যাগের পক্ষে বলে আসছিলেন। পরবর্তীকালের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয় যে তারা ঠিকই বলেছিলেন। দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের রক্ষকগণও এতটা অজ্ঞ ছিলেন যে ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করা হয় ব্রিটিশ জনগণের স্বার্থে সর্বোৎকৃষ্ট কাজটি করার জন্য, আর ফ্রান্স তার অবন্ধুসুলভ নীতির জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও ইংল্যান্ডের উপকার করে বসে।

সকল প্রয়োজনীয় পেশার মধ্যে সবচেয়ে হাস্যকর বা বিকট পেশা হলো সোনার খনিশিল্প। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সোনা উত্তোলন করা হয় ও চৌর্যবৃত্তি এবং দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অপরিসীম সাবধানতা অবলম্বন করে উক্ত সোনা লন্ডন, প্যারিস এবং নিউইয়র্কে আনা হয়। এবং এই শহরগুলোর ব্যাংকের ভূ-গর্ভস্থ ভল্টে রাখা হয়। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকার ভূ-গর্ভেই এই সম্পদ সংরক্ষণ করা যেত। ব্যাংকে ভবিষ্য প্রয়োজনে আমানত হিসেবে রাখলে তার কিছুটা উপযোগিতা থাকে, কিন্তু যদি বলা হয় এই আমানত নির্দিষ্ট পরিমাণের নিচে কোনোদিন নামতে দেয়া যাবে না তাহলে ঐ আমানত না থকার সামিল হয়ে দাঁড়ায়। যদি আমি বলি বৃষ্টির দিনে কাজে লাগানোর জন্য ব্যাংকে এক শো পাউন্ড জমা রাখবো, সে কাজটা বিজ্ঞজনোচিত কাজই হবে। কিন্তু যদি আমি বলি যে, যত দরিদ্রই আমি হই ঐ এক শো পাউন্ডে আমি কোনদিন হাত দেব না তাহলে উক্ত টাকা আমার সম্পদের কার্যকরী অংশ হিসেবে আর থাকল না। এমন বলা যায় যে, ঐ টাকা আমি কাউকে দিয়ে দিয়েছি। ব্যাপারটা অভিন্ন হয়ে দাঁড়ায় ব্যাংকে গচ্ছিত আমানত যদি কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা না হয়। জাতীয় ক্রেডিটের একটা অংশ যদি এখন প্রকৃত স্বর্ণে রাখা হয় তবে তা নিতান্তই বর্বরতার নিদর্শন হয়ে দাঁড়ায়। কোনো দেশের অভ্যন্তরে ব্যক্তিগত বিনিময়ের ক্ষেত্রে স্বর্ণের ব্যবহার উঠে গেছে। যুদ্ধের আগে কিছু পরিমাণে এর ব্যবহার ছিল, কিন্তু যারা যুদ্ধের পর বড় হয়ে উঠেছেন তারা স্বর্ণমুদ্রার চেহারাই দেখেন নি। তথাপি ভেলকিবাজি দেখিয়ে বলা হয় যে জনগণের আর্থিক নিরাপত্তা বা স্থায়িত্ব নির্ভর করে কথিত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সোনা মজুদের উপর। যুদ্ধ চলাকালে সাবমেরিনের জন্য সোনা পরিবহন যখন বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায় তখন এই কাল্পনিক ব্যাপারটা আরো অনেক দূর গড়ায়। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে উত্তোলিত স্বর্ণ কেউ ধরে নেয় যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে, কেউ ধরে নেই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স কিংবা অন্য কোনো জায়গায়। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে ঐ সোনা দক্ষিণ আফ্রিকাতেই ছিল। কল্পনাটা আরো একটু বাড়িয়ে কেন ধরা হলো না যে খনি থেকে উত্তোলন করে সেখানেই রেখে দেয়া হয়।

তত্ত্বগতভাবে স্বর্ণ মজুদে সুবিধা এই যে, তা অসাধু সরকারের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে, কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। কারণ সংকটকালে সরকারকে স্বর্ণমান মেনে চলতে বাধ্য করার কোনো উপায় নেই। বস্তুত সরকার সুযোগ বুঝে বা বিপদে পড়লে স্বর্ণমান বর্জন করে। বিলম্বে যুদ্ধে যোগ দেয়া ইউরোপের দেশগুলো তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে ঋণের একটা অংশ পরিশোধের দায় এড়িয়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি ঘটিয়ে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া তাদের অভ্যন্তরীণ সমগ্র ঋণ পরিশোধের দায় এড়ায়। ফ্রান্স তার মুদ্রার মান এক-পঞ্চমাংশ কমিয়ে দিয়ে ফ্রা-তে হিসেবকৃত ঋণের পাঁচ ভাগের চারভাগ দায় অস্বীকার করে। স্বর্ণে পাউন্ড স্টার্লিং-এর মান আগের মূল্যের তুলনায় এখন চারভাগের তিন ভাগ মাত্র। রুশদেশ খোলাখুলিভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা ঋণ পরিশোধ করবে না। তবে এটা দুষ্ট আচরণ, রুশদের এই আচরণ কোনো দেশ গ্রহণযোগ্য মনে করেনি; সম্মানজনকভাবে ঋণদায় এড়ানোর জন্য দ্রভাবে তা করতে হয়।

ব্যাপারটা হলো, যে কোনো সরকার, জনগণের মতোই স্বার্থের অনুকূলে হলেই শুধু ঋণ পরিশোধ করে, অন্যথায় নয়। বিশুদ্ধ আইনগত নিশ্চয়তা, যেমন স্বর্ণমান, প্রতিকূল সময়ে কোনো কাজে লাগে না। অন্য সময় এর দরকার করে না। কোনো ব্যক্তি সাধু হওয়াটা ততক্ষণ লাভজনক মনে করে যতক্ষণ সে ধার নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে এবং ধার পরিশোধের ক্ষমতা রাখে। ধার পরিশোধের সামর্থ হারালে তখন গা ঢাকা দেয়াটাই সুবিধাজনক মনে করে। একটি সরকার দেশের জনগণের সঙ্গে যে আচরণ করে অপর দেশের সঙ্গে আচরণের তুলনায় তা আলাদা জাতের। দেশের জনগণ সরকারের করুণার উপর নির্ভরশীল, অতএব, তাদের প্রতি সদাচরণের কোনো ইচ্ছাই সরকারের নেই, যদি না পুনরায় ধার নেয়ার অভিলাষ থাকে। যুদ্ধের পর জার্মানিতে যেমন ঘটেছিল, যখন দেখা যায় দেশের ভেতর থেকে ধার পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই তখন চালু মুদ্রা মূল্যহীন করলে কাজ হয়। ফলে অভ্যন্তরীণ সমস্ত দেনা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু অন্য দেশ থেকে নেয়া ঋণের ব্যাপারটা আলাদা। রুশদেশ যখন অপরদেশ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধে অস্বীকৃতি জানাল তখন তাকে সমগ্র সভ্য জগতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হলো। সঙ্গে সঙ্গে চলল মারমুখী প্রচারণা। অধিকাংশ দেশ এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় অসমর্থ, ফলে অন্য দেশ থেকে গৃহীত ঋণ সম্পর্কে সতর্ক থাকে। স্বর্ণ-মান নয়, যুদ্ধভীতিই অপর দেশকে দেয়া ঋণের নিরাপত্তা বিধান করে থাকে। এই নিরাপত্তা ঠুনকো এবং আন্তর্জাতিক সরকার গঠন ভিন্ন অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়।

আর্থিক লেন-দেন কতটা সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে তা অনেক সময় অনুধাবন করা সম্ভব হয় না। অনেকটা ব্যবসায়িক বুদ্ধি দ্বারা সম্পদের মালিকানা অর্জন করা হয়, কিন্তু উক্ত ব্যবসায়িক বুদ্ধি কেবল সম্ভব সেনা ও নৌশক্তির কাঠামোর ভেতর। সামরিক শক্তির জোরেই ওলন্দাজরা ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে নিউইয়র্ক কেড়ে নেয়, আবার ওলন্দাজদের কাছ থেকে ইংরেজরা ছিনিয়ে নেয়, সামরিক শক্তির বলেই মার্কিনীরা দখল কায়েম করে ইংরেজদের কাছ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে যখন তেল আবিষ্কৃত হলো তার মালিক হলো মার্কিন নাগরিকগণ। কিন্তু কম শক্তিধর দেশে তেল আবিষ্কৃত হলে ছলে-বলে-কৌশলে অন্য কোনো বৃহৎ শক্তি-র নাগরিক তার মালিকানা লাভ করে বসে। যে পদ্ধতিতে এটা করা হয় তা গোপন থাকে। কিন্তু পেছনে ওৎ পেতে থাকে যুদ্ধের প্রস্তুতি। সুপ্ত হুমকিই চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় সাহায্য করে।

তেল ব্যাপারে যা প্রযোজ্য, ঋণ ব্যাপারেও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। মুদ্রার মান। কমানো কিংবা ঋণ পরিশোধ অস্বীকার যখন সরকারের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করে, সরকার তখন তা করে থাকে। সত্য যে, কোনো-কোনো দেশ ঋণ পরিশোধের নৈতিক গুরুত্ব বিষয়ে লম্বা-চওড়া কথা বলে থাকে। আসল ব্যাপার হলো ঐ দেশগুলো ঋণ দিয়ে বসে আছে। যতদিন ঋণগ্রস্ত দেশ তাদের কথা শোনে, সে শুধু তাদের শক্তি আছে বলে, নীতিগত দিক বুঝে করে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে মুদ্রার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার একটা উপায়ই রয়েছে, আর তা হলো, বিশ্ব-সরকার গঠন। এই সরকারের অধীনে থাকবে সমগ্র সামরিক শক্তি। স্থায়ী মুদ্রা ব্যাপারে এই সরকারের স্বার্থ থাকতে হবে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে সমর্থ স্থায়ী ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন মুদ্রা চালু করবে। এটাই একমাত্র সত্য স্থায়িত্ব এবং স্বর্ণের এই স্থায়িত্ব প্রদানের ক্ষমতা নেই। সার্বভৌম দেশগুলো দুঃসময়ে স্বর্ণে নির্ভরতা বজায় রাখে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, স্বর্ণ মুদ্রা স্থায়িত্ব বিধান করে এই যুক্তি যে কোনো দিক বিচারে ভ্রমাত্মক।

যারা নিজেদের বড় বেশি বাস্তববাদী বলে বিবেচনা করে তারা আমাকে পুনঃপুন জানান যে, ব্যবসায়ীরা সাধারণত ধনী হওয়ার অভিলাষ পোষণ করে। পর্যবেক্ষণ করে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, আমাকে যারা এই নিশ্চয়তা দিয়েছেন তারা বাস্তববাদী হওয়া তো দূরের কথা, তারা হলেন আবেগতাড়িত আদর্শবাদী মাত্র, যে জগতে তারা বাস করেন সেই জগতের মৌলিক বাস্তবতা তারা দেখতে পান না। ব্যবসায়ীরা যদি অপরকে দরিদ্র রাখার চেয়ে নিজেরা ধনী হওয়ার জন্য বাস্তবিক ইচ্ছা পোষণ করতেন, তাহলে জগত্তা দ্রুত স্বর্গে পরিণত হয়ে যেত। ব্যাংকিং এবং মুদ্রা থেকে একটা সুন্দর উদাহরণ আহরণ করা যায়। ব্যবসায়িক শ্রেণির সাধারণ স্বার্থই হলো এটা দেখা যে মুদ্রা স্থায়ী এবং ঋণ নিরাপদ। এই দুটি হাসিলের জন্য স্পষ্টতই সারা জগতে একটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকা দরকার। এই মুদ্রা অবশ্যই কাগজী হবে, যা পণ্য-সামগ্রীর গড়-মূল্য যতটা সম্ভব স্থির রাখবে। এই মুদ্রার ভিত্তি গোল্ড রিজার্ভ হওয়ার দরকার করে না। বরং বিশ্ব-সরকারের সুনাম বা ঋণ পরিশোধের সামর্থের উপর নির্ভর করবে। এবং বিশ্ব-সরকারের আর্থিক লেন-দেনের সংগঠন একটি থাকবে, তা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাপারগুলো এত স্বচ্ছ যে একটি শিশুর পক্ষেও তা বোঝ সম্ভব। কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রস্তাবই ব্যবসায়ীদের দিক থেকে আসে না। কেন? জাতীয়তাবাদই এর কারণ। নিজেরা ধনবান হওয়ার চেয়ে অপর দেশকে দরিদ্র রাখতে তাদের আগ্রহ বেশি।

অপর একটি কারণ হলো, উৎপাদকের মনস্তত্ত্ব। এটা স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলেই মনে হয় যে, টাকা ব্যবহার্য বস্তু শুধু এ কারণে যে টাকা দিয়ে পণ্য-সামগ্রী বিনিময় চলে। তবু খুব কম লোকই আবেগগত এবং যৌক্তিকভাবে তা সত্য মনে করেন। প্রায় প্রত্যেক লেন-দেনের ব্যাপারে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি খুশি হয়। আপনি এক জোড়া জুতো কেনেন তখন বিক্রেতা বিপণনের যাবতীয় কায়দা আপনার উপর আরোপ করে এবং বিক্রেতা ধরে নেন তিনি একটা ছোটোখাটো বিজয় অর্জন করেছেন। অপরপক্ষে আপনি মনে-মনে বলবেন না যে কি সুন্দর! ঐ নোংরা কাগজের টুকরোগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া গেল, যে টুকরাগুলো আহার্য হিসেবে গ্রহণও করতে পারতাম না, পোশাক হিসেবে ব্যবহারও চলত না। মাঝখান থেকে এক জোড়া চমৎকার জুতো পেয়ে গেলাম। আমার ক্রয়ের ব্যাপারটা বিক্রয়ের তুলনায় কম গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কিছু কিছু ব্যতিক্রম ঘটে যখন সরবরাহ হয় সীমিত। যে ব্যক্তি ওল্ড মাস্টারের চিত্রকর্ম ক্রয় করে সে বিক্রেতার চেয়ে বেশি খুশি হয়। কিন্তু ঐ ওল্ড মাস্টার যখন জীবিত ছিলেন তখন তিনি নিশ্চয় তার পৃষ্ঠপোষকের (ক্রেতার) চেয়ে বেশি খুশি হতেন। ক্রয়ের চেয়ে বিক্রি করে আমরা যে বেশি আনন্দিত হই তার মূল মনস্তাত্ত্বিক উৎস হলো সুখের চেয়ে ক্ষমতা আমরা বেশি পছন্দ করি। এটা সার্বিক চরিত্র নয়; এমন কিছু অমিতব্যয়ী ব্যক্তিও রয়েছেন যারা অনতিদীর্ঘ এবং আনন্দময় জীবন পছন্দ করেন। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্য শক্তিমান ও সফল ব্যক্তিদের, যারা প্রতিযোগিতামূলক যুগে সামঞ্জস্য আনেন। যে কালে সকল সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা হতো তখন উৎপাদনের মনস্তত্ত্ব কম আধিপত্য করেছে। উৎপাদকের মনস্তত্ত্বই মানুষকে ক্রয়ের চেয়ে বিক্রয়ের প্রতি বেশি আগ্রহী করে তোলে। এবং এ জন্যই সরকারসমূহ এমন জগৎ সৃষ্টির হাস্যকর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় যেখানে প্রত্যেক জাতি শুধু বিক্রি করে, কোনো জাতি ক্রয় করে না।

একটা অবস্থার জন্য উৎপাদকের মনস্তত্ত্ব জটিল হয়ে যায়। এই অবস্থাটা অর্থনৈতিক সম্পর্ককে বিশিষ্টতা দান করে। যদি কিছু আপনি উৎপাদন এবং বিক্রয় করেন তা হলে দুই ধরনের মানুষ আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আপনার ব্যবসার প্রতিযোগী এবং খদ্দেরগণ। প্রতিযোগী আপনার ক্ষতি করে। খদ্দের দ্বারা আপনি লাভবান হোন। প্রতিযোগীদের আপনার চেনা আছে, তুলনামূলকভাবে তাদের সংখ্যাও কম, পক্ষান্তরে খদ্দেররা ছড়ানো-ছিটানো এবং অনেকাংশে অচেনা। ফলে আপনি খদ্দেরের চেয়ে প্রতিযোগীর প্রতি বেশি সচেতন হবার চেষ্টা করেন। এটা স্বীয় গোষ্ঠীর ভেতর না ঘটতে পারে, কিন্তু গোষ্ঠী যদি বাইরের হয় তাহলে এটা ঘটবেই। এবং ঐ গোষ্ঠীকে আপনার স্বার্থের প্রতিকূলে বলে ধরা হবে। এই বিশ্বাসই সংরক্ষণমূলক শুল্কের উৎস। বিদেশকে সম্ভাব্য খদ্দের হিসেবে না দেখে উৎপাদনে প্রতিযোগী হিসেবে দেখা হয়। ফলে মানুষ বিদেশি প্রতিযোগীতা এড়ানোর জন্য বিদেশি বাজার হারাতে রাজি থাকে। এক ছোট্ট শহরে এক কসাই ছিল, সে অন্যান্য কসাইয়ের উপর চটে গেল, কারণ তারা তার খদ্দের কেড়ে নিয়েছে। উক্ত কসাই প্রতিজ্ঞা করে বসল সে সবার জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। প্রতিজ্ঞা অনুসারে সে শহরটি নিরামীষ ভোজীতে পরিণত করল। অতঃপর বিস্ময়ের সঙ্গে তাকে লক্ষ্য করতে হলো যে সে নিজেরও ধ্বংস ডেকে এনেছে। উক্ত কসাইয়ের বোকামি অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়। তবু তার বোকামি বৃহৎ শক্তিগুলোর বোকামির চেয়ে বেশি নয়। সবাই লক্ষ্য করেছেন বৈদেশিক বাণিজ্য অপরাপর জাতিকে ধনী করে এবং সবাই শুল্কের দেয়াল খাড়া করেছেন বৈদেশিক বাণিজ্য ধ্বংস করার জন্য। আর সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন যে, তাদের প্রতিযোগীদের সমানই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কেউ ভেবে দেখেন নি যে, বাণিজ্য পারস্পরিক ব্যাপার এবং কোনো বৈদেশিক রাষ্ট্র যখন পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে, একই সঙ্গে ক্রয়ও করে, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে। ব্যাপারটা ভেবে দেখা হয় নি এজন্য যে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভিন্ জাতির প্রতি ঘৃণা তাদের বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কে স্বচ্ছভাবে ভাবতে অসমর্থ করে তুলেছে।

গ্রেট ব্রিটেনে, ধনী-দরিদ্রের দ্বন্দ্ব, যা যুদ্ধের পর থেকে দলগত বিভাগের ভিত্তি হয়ে রয়েছে, অধিকাংশ শিল্পপতিকে মুদ্রা সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাগুলো বুঝতে অসমর্থ করে তুলেছে। যেহেতু আর্থিক যোগান সম্পদের প্রতিনিধিত্ব করে তাই ধনীদের ভেতর একটা ঝোঁক পড়েছে যে, ব্যাংকার এবং অর্থের যোগানদারদের পদক্ষেপ অনুসরণ করে চলতে হবে। অথচ বাস্তব এই যে, ব্যাংকারদের স্বার্থ শিল্পপতিদের বিপরীত। মুদ্রা-সংকোচ ব্যাংকারদের অনুকূলে ছিল। পক্ষান্তরে এটা ব্রিটিশ শিল্পপতিদের পঙ্গু করেছে। এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, মজুরদের যদি কোনো প্রকার ভোট না থাকত তাহলে যুদ্ধের সময় থেকে ব্রিটিশ রাজনীতি অর্থের যোগানদার এবং শিল্পপতিদের দ্বন্দ্বের ভেতর গঠিত হতো। যাহোক, অর্থের যোগানদার এবং শিল্পপতিরা এক জোট হয়ে যায় মজুরদের বিরুদ্ধে; শিল্পপতিরা অর্থের যোগানদারদের সমর্থন করে এবং দেশটা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায় এজন্য যে, ফরাসিরা অর্থের যোগানদারদের পরাস্ত করে।

শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নয়, গোটা বিশ্বেই সাম্প্রতিককালে অর্থের যোগানদারদের স্বার্থ সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। এই অবস্থাটা নিজের থেকে পরিবর্তিত হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কোনো আধুনিক গোষ্ঠীর ধনী হবার সম্ভাবনা নেই যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে আর্থিক ব্যাপার অর্থের যোগানদারদের স্বার্থে কাজ করে। অবস্থাটা এরকম দাঁড়ালে অর্থের যোগানদারদের অবাধে ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের সুযোগ দেয়া বিজ্ঞজনোচিত কাজ হবে না। কোনো কোনো ব্যক্তি কিউরেটরের লাভের জন্য জাদুঘর চালাতে পারেন। তাকে এই স্বাধীনতাও দিতে পারেন উচ্চ মূল্য প্রদানের প্রস্তাব এলে তিনি জাদুঘরে রক্ষিত সামগ্রী বেচে দিতে পারবেন। কিছু কিছু কাজ আছে যাতে ব্যক্তিগত মুনাফার অভিপ্রায় সর্বসাধারণের অনুকূলে কাজ করে। আবার কিছু কিছু কাজের ফলাফল উল্টা দাঁড়ায়। আর্থিক ব্যাপারটা, আগের দিনে যাই ঘটে থাকুক না কেন, বর্তমানে অবশ্যই শেষোক্ত শ্রেণিতে পড়ে। ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, আর্থিক ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন বেড়েই চলেছে। এখন দরকার হবে আর্থিক এবং শিল্পের ব্যাপারটা একক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা, আর লক্ষ্য থাকবে এই একক সত্তা থেকে সর্বাধিক মুনাফা লাভ। আর্থিক ব্যাপারটা আলাদাভাবে দেখলে চলবে না। উভয়ে যখন স্বাধীনভাবে কাজ করে তখন অর্থ শিল্পের চেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু শিল্পের স্বার্থের সঙ্গে গোষ্ঠীর স্বার্থ অধিকতর মেলে। অর্থের স্বার্থের সঙ্গে যেমন ততটা নয়। অর্থের অতিরিক্ত ক্ষমতার জোরেই বর্তমান বিশ্বের এই হাল হয়েছে।

যেক্ষেত্রে কতিপয় ব্যক্তি অধিক ব্যক্তির উপর ক্ষমতা খাটাতে সমর্থ হয়েছে তারা সব সময়ই ঐ অধিক ব্যক্তির কিছু কিছু কুসংস্কারের দরুন সহায়তা পেয়েছে। প্রাচীন মিশরের পুরোহিতরা চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণের সম্পর্কে ভবিষ্য-কথনের উপায় আবিষ্কার করেছিলেন, যা তখনও জনগণ আতঙ্কজনক ব্যাপার বলে গণ্য করতেন; এর সুযোগ নিয়ে পুরোহিতরা মূল্যবান উপহার আদায় এবং ক্ষমতা খাটাতে সমর্থ হন। অন্য কোনো উপায়ে এটা সম্ভব হতো না। রাজা-বাদশাদের এক সময় স্বর্গীয় সত্তা মনে করা হতো। ফলে ক্রোমওয়েল প্রথম চার্লসের মুণ্ডু দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করলে তাঁকে এই দোষে দুষ্টু জ্ঞান করা শুরু হয় যে তিনি পবিত্র দেহ অপবিত্র করেছেন। আজকের দিনে অর্থের যোগানদারগণ জনগণের স্বর্ণের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ কুসংস্কারের উপর নির্ভর করেন। সাধারণ নাগরিক ভয়ে হতভম্ব হয়ে যায় যখন সে মজুদ স্বর্ণ, ইস্যুকৃত নোট, মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রাসংকোচ, পুনঃমুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদি এবং আরো অনেক অজানা পরিভাষার ভেলকিবাজি সম্পর্কে শুনতে পায়। তখন তার মধ্যে এই বোধ কাজ করে যে, যে ব্যক্তি এই সব ব্যাপার নিয়ে অনর্গল কথা বলতে পারেন তিনি নিশ্চয় অত্যন্ত বিজ্ঞ ব্যক্তি হবেন। এবং এ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন জাগলেও জিজ্ঞেস করতে সাহস করেন না। তিনি বুঝতে পারেন না যে আধুনিক লেন-দেন ব্যাপারে বাস্তবিক পক্ষে স্বর্ণের ভূমিকা কত ক্ষুদ্র, অথচ স্বর্ণের ভূমিকা সম্পর্কে তাকে ব্যাখ্যা করতে বললে তিনি বিপাকে পড়বেন। তিনি অস্পষ্টভাবে অনুভব করেন যদি বেশ কিছু পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ থাকে তবে দেশ অধিকতর নিরাপত্তার মধ্যে থাকবে। কাজেই দেখা যাবে, স্বর্ণের মজুদ বাড়লে তিনি খুশি হন, কমলে বড়ই বিষণ্ণ।

সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধরনের বুদ্ধিহীন শ্রদ্ধার অবস্থাই গণতন্ত্রের দ্বারা শৃঙ্খলামুক্ত থাকার জন্য অর্থের যোগানদারদের দরকার। অর্থের যোগানদারগণ অবশ্য গণমতের সঙ্গে মোকাবেলা করতে গিয়ে আরো কিছু সুবিধা পান। অত্যন্ত ধনবান বলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অকাতরে অর্থ দান করতে পারেন, এতে বিদ্যায়তনিক মতের প্রভাবশালী অংশ তার অনুগত থাকে। ধনিকতন্ত্রের মাথায় বসে আছেন বলে যাদের রাজনৈতিক চিন্তা কম্যুনিজমের ভয়-তাড়িত তাদের স্বাভাবিক নেতায় পরিণত হন। অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী বলে সমগ্র জাতির ভেতর খেয়াল খুশি মতো সমৃদ্ধি কিংবা সর্বনাশ বিতরণ করতে পারেন। আমার সংশয় হয়, কুসংস্কার না থাকলে এই উপায়গুলোর কোনোটা সম্পূর্ণ উপযোগী হতো কি-না। একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই যে, অর্থ শাস্ত্র প্রত্যেক পুরুষ, নারী ও শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই বিষয়টা কোনো বিদ্যালয়ে একেবারে পড়ানো হয় না, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেও একটা সংখ্যালঘু শ্রেণিই শুধু এই বিষয়ে শিক্ষা পেয়ে থাকে। উপরন্তু রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকার দরুন এ বিষয়ে যে ধরনের শিক্ষা তাদের পাওয়া উচিত ছিল তা তারা পায় না। গুটিকয় প্রতিষ্ঠান মাত্র ধনিক শ্রেণির প্রতি পক্ষপাত না দেখিয়ে অর্থশাস্ত্রে শিক্ষা দিয়ে থাকে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। কার্যত অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা গৌরবান্বিত করার জন্য শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। অনুমান করি, আর্থিক ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিদের জন্য কুসংস্কার ও রহস্যময়তা যে অত্যন্ত জরুরি এসবের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে।

যুদ্ধের মতো, আর্থিক ব্যবস্থাও বিপাকে পড়ে। কারণ এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদের পক্ষপাত গোষ্ঠীস্বার্থের প্রতিকূলে যায়। যখন নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, নৌ এবং পদাতিক বাহিনীর বিশেষজ্ঞরা মূল উদ্দেশ্যের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপারটা এমন নয় যে ঐ লোকগুলো অসাধু। তাদের পেশাগত অভ্যাসই অস্ত্রশস্ত্রের প্রশ্নটা প্রকৃত পরিপ্রেক্ষিতের আলোকে দেখা বাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই একই ঘটনা ঘটে আর্থিক ব্যাপারে। বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান কম লোকেরই আছে। ব্যতিক্রম শুধু তারা যাত্রা প্রচলিত ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে অর্থ লাভে লিপ্ত। এদের পক্ষে স্বাভাবিক কারণে পুরোপুরি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনও সম্ভব হয় না। এই অবস্থার প্রতিকার করতে হলে পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে পৃথিবীর আর্থিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। সঙ্গে-সঙ্গে আর্থিক নীতিমালা সহজতর করা জরুরি যাতে সবাই তা বুঝতে পারে। স্বীকার করতে হবে কাজটা সহজ নয়। কিন্তু আমি মনে করি না যে এটি একটি অসম্ভব কাজ। চলতিকালে গণতন্ত্র সফল করে তোলার জন্য অন্যতম বাধা এই যে, আধুনিক জগত্তাই জটিল, এ জন্য সাধারণ নর-নারীর পক্ষে রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো সম্পর্কে বুদ্ধিদীপ্ত মতামত গঠন ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে। কাদের বিশেষজ্ঞ মতামত সর্বাধিক শ্রদ্ধা করা উচিত যে সম্পর্কে মনস্থির করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এই সমস্যার প্রতিকার সম্ভব শিক্ষাদর্শের উন্নতিসাধন করে। তাছাড়া সমাজের কাঠামো ব্যাখ্যা করার জন্য বর্তমানে যে উপায় প্রচলিত রয়েছে তার চেয়ে সহজ উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। যারা প্রকৃতই কার্যকর গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তারা এ ধরনের সংস্কার সমর্থন করবেন। কিন্তু হয়তো শ্যামদেশ এবং মঙ্গোলিয়ার দূরাঞ্চল ছাড়া আজ আর কোথাও কোনো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ব্যক্তি অবশিষ্ট নেই।

০৫. ফ্যাসিবাদের পূর্বসূত্র

আমরা যখন আমাদের যুগের সঙ্গে (ধরুন) ১ম জর্জের যুগের তুলনা করি, আমরা লক্ষ্য করি বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার মেজাজে একটা গভীর পরিবর্তন ঘটেছে এবং এই পরিবর্তনের অনুসরণে তাল মিলিয়ে রাজনৈতিক সুরও বদলে গেছে। এক হিসেবে গত দুশো বছর আগের ধ্যান-ধারণাকে যুক্তিশীল বলা যেতে পারে এবং আমাদের যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্যকে বলা যেতে পারে যুক্তিবিরোধী। কিন্তু আমি এই শব্দগুলোকে ব্যবহার করছি কোনো একটি মেজাজ সম্পূর্ণ গ্রহণ কিংবা সম্পূর্ণ বর্জন অর্থে নয়। উপরন্তু এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, রাজনৈতিক ঘটনা বারে বারে নতুন রঙে রঞ্জিত হয় পূর্বতন কালের ভাবনা দ্বারা একটি তত্ত্ব ঘোষণা এবং তার ব্যবহারিক কার্যকারিতার ভেতর বিরাট বিরতি থাকে। ১৮৬০ সালে ইংরেজ জাতির রাজনীতি প্রভাবিত হয়েছিল ১৭৭৬ সালের অ্যাডাম স্মিথের ভাবনা-ধারণা দ্বারা। আজকের জার্মান রাজনীতিকে ১৮০৭ সালের ফিশতের তত্ত্বের বাস্তবায়ন গণ্য করা চলে। রুশ রাজনীতি ১৯১৭ সালের পর কম্যুনিস্ট ইশতেহারের মতবাদ বাস্তবায়িত করেছে, ঐ ইশতেহার প্রথম ঘোষিত হয় ১৮৪৮ সালে। সুতরাং বর্তমান যুগকে বুঝতে হলে অনেক আগের সময়ের দিকে ফিরে তাকাতে হবে।

কোনো রাজনৈতিক মতবাদ ব্যাপক প্রচারণা পেলে ধরে নিতে হবে এর পেছনে দুটো কারণ ক্রিয়াশীল ছিল। একদিকে থাকে পূর্বতন কালের জ্ঞানচর্চা। অর্থাৎ থাকেন কিছু লোক যারা কিছু তত্ত্ব এগিয়ে নিয়ে যান, যে তত্ত্বগুলো গজিয়ে উঠেছে পূর্বতন তত্ত্বের বিকাশ কিংবা প্রতিক্রিয়া হিসেবে। অপরপক্ষে, কিছু-কিছু অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি জনগণকে এমন দৃষ্টিকোণ গ্রহণে আগেই অনুপ্রাণিত করে রাখে যা সুনির্দিষ্ট মেজাজ অবলম্বনে মন্ত্রণা যোগায়। তবু শুধু এগুলো থেকেই সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা মেলে না, যেহেতু প্রায়ই দেখা যায়, পূর্বতন জ্ঞানচর্চা অবজ্ঞা করা হয়। যে ব্যাপার নিয়ে আমরা এখানে ভাবতে বসেছি তাতে দেখা যায় যে, যুদ্ধোত্তর কালের দুনিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠীর অসন্তোষের সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল, ফলে তা আগের কালে উদ্ভাবিত নির্দিষ্ট একটি দর্শনের প্রতি তাদের সহানুভূতিশীল করেছে। এই দর্শন বিষয়ে প্রথমে কিছু কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করি। অতঃপর এই দর্শনের বর্তমান জনপ্রিয়তার বিষয়ে ভাবা যাবে।

যুক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয় যুক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে নিউটন যখন মানুষের মন শাসন করছিলেন, তখন একটা বিশ্বাস ব্যাপক প্রসার লাভ করে যে প্রাঞ্জল সাধারণ সূত্র আবিষ্কারের মধ্যেই জ্ঞানের পথ মেলে। এবং এই সাধারণ সূত্র থেকে অবরোহী যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব। অনেকেই ভুলে গেছিলেন যে নিউটনের মধ্যাকর্ষণ সূত্রের ভিত্তি এক শতাব্দীর সতর্ক পর্যবেক্ষণ, এবং তিনি কল্পনা করতেন যে সাধারণ সূত্র প্রকৃতির আলোকে আবিষ্কার সম্ভব। সে সময় ছিল প্রাকৃতিক ধর্ম, প্রাকৃতিক আইন, প্রাকৃতিক নৈতিকতা, এবং প্রাকৃতিক আরো অনেক কিছু। ধরা হতো এই বিষয়গুলো গঠিত স্বতঃপ্রমাণিত স্বতঃসিদ্ধান্ত থেকে গৃহীত প্রতিপাদক অনুমান, অনেকটা ইউক্লিডের নিয়মে। এই দৃষ্টিভঙ্গির রাজনৈতিক ফল ছিল মানুষের অধিকার, যা আমেরিকান এবং ফরাসি বিপ্লবের সময় প্রচার পায়।

কিন্তু যে মুহূর্তে যুক্তির মন্দির নির্মাণ প্রায় শেষ হবার পথে, সেই সময় একটা মাইন পোতা হয় এবং পরিশেষে গোটা অট্টালিকা বিস্ফোরিত হয়ে দূর আকাশে বেড়াতে থাকে। যে ব্যক্তি এই মাইন পুতেছিলেন তার নাম ডেভিড হিউম। তাঁর মানবের প্রকৃতি (Treatise of Human Nature) প্রকাশিত হয় ১৭৩৯ সালে, বইটির উপনাম ছিল নৈতিক বিষয়ে যুক্তির পরীক্ষামূলক পদ্ধতির সূচনার প্রচেষ্টা। বইটি তাঁর সমগ্র অভিপ্রায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে তা তাঁর কর্মতৎপরতার অর্ধেক মাত্র। তাঁর অভিপ্রায় ছিল পর্যবেক্ষণ ও আরোহী যুক্তি বিকল্প হিসেবে ব্যবহার, নামমাত্র স্বতঃপ্রমাণিত স্বতঃসিদ্ধান্তের পরিবর্তে। মেজাজের দিক থেকে তিনি ছিলেন পুরোপুরি বুদ্ধিবাদী, তবে তাঁর বুদ্ধিবাদের চরিত্র এরিস্টটলীয় নয়, বেকনপন্থী। কিন্তু তাঁর সূক্ষ্মদর্শিতার সঙ্গে বুদ্ধিগত সতোর প্রায় অভূতপূর্ব সম্মিলন তাঁকে কয়েকটি বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিচালিত করে; যে, আরোহী যুক্তির অভ্যাসের যৌক্তিক ন্যায্যতা নেই, এবং কারণবাদে বিশ্বাস কুসংস্কারে বিশ্বাস থেকে সামান্যই উন্নত। ফল দাঁড়াল ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে বিজ্ঞানও ভ্রমাত্মক প্রত্যাশা এবং যুক্তিহীন বিশ্বাসের অবাঞ্ছিত পর্যায়ে ঠেকল।

হিউমের মধ্যে বুদ্ধিবাদ ও সংশয়বাদ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেছে। তবে সংশয়বাদ চর্চার ক্ষেত্রেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকবে এবং নিত্যদিনের ব্যবহারিক জীবনে এটি ভুলে থাকতে হবে। উপরন্তু ব্যবহারিক জীবন শাসিত হবে, যতদূর সম্ভব, সেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দ্বারা, যে পদ্ধতি সম্পর্কে সংশয়বাদ প্রশ্ন তুলেছে। এ ধরনের আপস সম্ভবপর এমন একজন ব্যক্তির পক্ষেই, যিনি সমানভাবে দার্শনিক এবং ইহজাগতিক; অনুপ্রাণিত ব্যক্তির ভেতর এই দুয়ে অবিশ্বাস সংরক্ষণে আভিজাতিক রক্ষণশীলতার (Toryism) আস্বাদও এতে ছিল। বৃহত্তর জগৎ কিন্তু হিউমের মতবাদ সম্পূর্ণ গ্রহণে অস্বীকার করে। তাঁর অনুসারীগণ তাঁর সংশয়বাদ বাতিল করে দেন, পক্ষান্তরে তাঁর প্রতিপক্ষরা বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবাদী দৃষ্টিকোণের ফল হিসেবে এই তত্ত্বের উপর জোর দেন। হিউমের দর্শনের ফলে ব্রিটিশ দর্শন হয়ে পড়ে অগভীর, জার্মান দর্শন হয়ে পড়ে বুদ্ধিবাদবিরোধী এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অসহনীয় অজ্ঞেয়তাবাদের ভীতি কাজ করে। ইউরোপীয় চিন্তা তার অতীতের ঐকান্তিকতা আর পুনরুদ্ধার করতে পারে নি; হিউমের প্রতিটি অনুসারীর কাছে মানসিক ভারসাম্যের অর্থ দাঁড়ায় অগভীরতা, গভীরতার অর্থ দাঁড়ায় নির্দিষ্ট মাত্রার উন্মাদগ্রস্ততা। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উপযোগী দর্শনের উপর অতি সাম্প্রতিককালীন আলোচনায় হিউম-উত্থাপিত পুরাতন বিতর্ক পুনরায় শুরু হয়েছে।

বিশেষভাবে জার্মান ছাপ-যুক্ত দর্শন সূচিত কান্টের সঙ্গে, এবং হিউমের দর্শনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে। কান্ট কারণবাদ, ঈশ্বর, নৈতিকতা, নৈতিক আইন এবং অনুরূপ আরো অন্যান্য ব্যাপারে বিশ্বাস করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু তিনি উপলব্ধি করলেন হিউমের দর্শন এসবে বিশ্বাস কঠিন করে তুলেছে। ফলে তিনি উদ্ভাবন করলেন বিশুদ্ধ যুক্তি এবং ব্যবহারিক যুক্তির মধ্যে পার্থক্য। বিশুদ্ধ যুক্তির কাজ হলো যা-কিছু প্রমাণ করা সম্ভব তাই নিয়ে, যা অধিক পরিমাণে ছিল না; ব্যবহারিক যুক্তি হলো পুণ্য অর্জনের জন্য যা-কিছু প্রয়োজন, এটা খুবই বেশি পরিমাণে ছিল। এটা সুস্পষ্ট যে বিশুদ্ধ যুক্তি যুক্তি মাত্র, পক্ষান্তরে ব্যবহারিক যুক্তি পক্ষপাতদোষদুষ্ট। অনুরূপভাবে দর্শনে এমন জিনিসের প্রতি আবেদন ফিরিয়ে আনলেন যা তাত্ত্বিক যুক্তিশীলতার বহির্ভূত ব্যাপার বলে স্বীকৃত, স্কলাসটিমিজমের অভ্যুদয়ের পর যা স্কুলগুলো থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল।

আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে কান্টের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলেন তাঁর অব্যবহিত উত্তরসূরি ফিশতে, যিনি দর্শন থেকে রাজনীতিতে এসে এমন আন্দোলনের উদ্বোধন করেন যা জাতীয় সমাজতন্ত্র নামে বিকাশ লাভ করেছে। তবে ফিশতে সম্পর্কে বলার আগে যুক্তির ধারণা সম্পর্কে আরো কিছু বলবার রয়েছে।

হিউমের মতবাদের উত্তর খুঁজে পাওয়ার ব্যর্থতা থেকে, যুক্তি-কে আর কিছুতেই পরম গণ্য করা চলে না। যে অবস্থা থেকে যে কোনো ধরনের প্রস্থান তাত্ত্বিক কারণে নিন্দিত হতে পারে। তথাপি একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য থেকে যায় এবং পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, দার্শনিক র‍্যাডিকেলদের মনের গঠন এবং প্রথম যুগের মুসলমান ধর্মোন্মত্তদের পার্থক্যের কথা এখানে বলা হচ্ছে। যদি আমরা প্রথম দলের সদস্যদের যুক্তিশীল এবং দ্বিতীয় দলভুক্তদের যুক্তিবিবর্জিত গণ্য করি, তাহলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সাম্প্রতিককালে অ-যুক্তি গজিয়ে উঠেছে।

আমি মনে করি আমরা যাকে বাস্তবে যুক্তি মনে করি তা তিনটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। প্রথমত, এটা বলপ্রয়োগ নয়, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাজের পক্ষপাতী; দ্বিতীয়ত, এর কাজ হলো যুক্তিতর্ক দ্বারা বোঝানো, এবং যারা এ কাজটি করেন তারা তাদের যুক্তিকে সম্পূর্ণ বৈধ জ্ঞান করেন; তৃতীয়ত, মতামত গঠন করতে গিয়ে, যত বেশি সম্ভব পর্যবেক্ষণ এবং আরোহী পদ্ধতি ব্যবহার করেন, এবং সজ্ঞার উপর নির্ভর করে কম। প্রথম যুক্তিটি ইনকুইজিশন বাতিল করে দেয়; দ্বিতীয়টি বাতিল করে ব্রিটিশ যুদ্ধ-প্রচার পদ্ধতির মতো ঘটনা, যা হিটলার এই যুক্তিতে প্রশংসা করেন যে প্রচার অবশ্যই এর মানসিক উন্নতি ডুবিয়ে দেবে গভীরে কি সংখ্যক লোককে এর নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে তার সমানুপাতে। দ্বিতীয়টি এই ধরনের রাশভারি প্রস্তাব প্রয়োগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, যেমন মিসিসিপি সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন বলেছিলেন, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রভু চান যে এই বিরাট উপত্যকা একটি জাতির শরিক হবে, এটি তাঁর কাছে ছিল স্বতঃসিদ্ধ, তাঁর শ্রোতাদের কাছেও, কিন্তু যিনি এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন তার কাছে এটা সহজে প্রমাণ করা যায় নি।

যুক্তির উপর নির্ভরতা যেভাবে সংজ্ঞায়িত হলো, তা ব্যক্তি ও তার শ্ৰোতৃমণ্ডলীর মধ্যে স্বার্থ ও দৃষ্টিকোণের নির্দিষ্ট একতা বিরাজ করছে ধরে নেয়। সত্য যে, মিসেস বন্ড এই যুক্তি তাঁর পাঁতিহাসগুলোর উপর প্রয়োগ করেন, যখন তিনি চিৎকার করে বলেন, এসো এবং নিহত হও, কারণ তোমাকে দিয়ে আমার ক্রেতাদের উদর পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু সাধারণভাবে তাদের কাছে যুক্তি খাটানো অকার্যকর ভাবা হয় যাদের আমরা প্রকৃতপক্ষে গ্রাস করতে ইচ্ছুক। যে ব্যক্তি মাংস ভক্ষণে বিশ্বাস করে সে এমন যুক্তিজাল বিস্তারের চেষ্টা করে না যা ভেড়ার জন্য বৈধ মনে হবে এবং নিৎশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেন না যাদের তিনি এই বলে গাল দেন যে এরা অপদার্থ এবং কদর্য। মার্কসও পুঁজিবাদীদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন না। এই উদাহরণগুলো থেকে আমরা দেখতে পাই, যুক্তির প্রতি আবেদন সহজতর হয় যখন ক্ষমতা প্রশ্নাতীতভাবে কতিপয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অষ্টাদশ শতকের বিলেতে কেবলমাত্র অভিজাত শ্রেণির লোক এবং তাদের বন্ধুদের মতামতের গুরুত্ব ছিল। এবং এই মতামত সব সময়ই অপরাপর অভিজাতদের কাছে যৌক্তিক আকারে উপস্থাপন করা যেত। রাজনৈতিক নির্বাচকমণ্ডলীর আকার বৃদ্ধি এবং মতামতের ভিন্নতা তীব্রতর হলে, যুক্তির প্রতি আবেদন কঠিনতর হয়ে পড়ে, কারণ সার্বজনীনভাবে স্বীকৃতি যাত্রাবিন্দুর সংখ্যা কমে যায়, যা থেকে সম্মতি সূচিত হতে পারে। যখন অনুরূপ যাত্রাবিন্দু খুঁজে পাওয়া যায় না, লোকেরা তখন স্ব-স্ব স্বজ্ঞার উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়; এবং যেহেতু বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বজ্ঞা বিভিন্ন, অতএব এগুলোর উপর নির্ভরতা পরিচালিত করে বিবাদ ও ক্ষমতার রাজনীতিতে।

এদিক থেকে যুক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ইতিহাসের পুনরাবর্তক ঘটনা। প্রথম যুগের বৌদ্ধধর্ম ছিল যুক্তিশীল; এর পরবর্তী আকৃতি, এবং ভারতে যে হিন্দুধর্ম এর স্থান দখল করে, উভয়ই ছিল যুক্তিবর্জিত। প্রাচীন গ্রিসে অর্ফিয়ুসপন্থীরা হোমারের যুক্তিশীলতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সক্রেটিস থেকে মারকাস অরেলিয়াস পর্যন্ত প্রাচীন কালের সকল প্রসিদ্ধ ব্যক্তি প্রধানত যুক্তিশীল ছিলেন। মারকাস অরেলিয়াসের পর এমনকি রক্ষণশীল নব্য-প্লেটোবাদীরা কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়। ইসলামি জগৎ বাদ দিয়ে ধরলে যুক্তির দাবি একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত শিকেয় তোলা থাকে। অতঃপর স্কলাস্টিসিজম, রেনেসাঁস এবং বিজ্ঞানের মাধ্যমে যুক্তি ক্রমান্বয়ে প্রবল হয়ে ওঠে। রুশো এবং ওয়েসলের জন্য একটা প্রতিক্রিয়া মাথাচাড়া দিয়েছিল, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও যন্ত্রাদির বিজয়ের দরুন বেশিদূর এগোতে পারেনি। ষাটের দশকে যুক্তিতে বিশ্বাস সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিল; কিন্তু তারপর থেকে এর প্রাধান্য ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায় এবং এখনও হ্রাস পাচ্ছে। গ্রিক সভ্যতার সূচনা থেকে বুদ্ধিবাদ এবং বুদ্ধিবাদ বিরোধিতা পাশাপাশি বাস করেছে, এবং যখন মনে হয়েছে কোনো একটি সম্পূর্ণ প্রাধান্য লাভ করতে পারে, তখন প্রতিক্রিয়া দ্বারা, সর্বদাই বিরুদ্ধপক্ষ নতুনভাবে আসরে ফেটে পড়েছে।

যুক্তির বিরুদ্ধে আধুনিক বিদ্রোহ একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে পূর্বেকার বিদ্রোহসমূহ থেকে বিভিন্ন। অর্ফিয়ুসবাদ থেকে শুরু করে, অতীতে সাধারণ লক্ষ্য ছিল মুক্তি,-এই ধারণাটা জটিল, এতে মিশে রয়েছে কল্যাণচিন্তা ও সুখ, এবং নিয়মানুসারে এটা অর্জন করা হতো কঠিন আত্মত্যাগের মাধ্যমে। আমাদের সময়ের যুক্তিবিরোধীদের লক্ষ্য মুক্তি নয়, ক্ষমতা। এই লক্ষ্যে তারা এমন নৈতিক কর্তব্য দাঁড় করিয়েছে যা একই সঙ্গে খ্রিষ্টধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম বিরোধী। এবং আধিপত্য করার বাসনা থেকে প্রয়োজনে জড়িত হয়ে পড়েছে রাজনীতির সঙ্গে। এদের লেখক তালিকায় রয়েছেন; ফিশতে, কার্লাইল, ম্যাসিনি, নিৎশে-আর এদের সমর্থনদাতারা হলেন ট্রেইটশকে, রাডিয়ার্ড কিপলিং, হিউস্টন চেম্বারলেইন এবং বার্গসে। এই আন্দোলনের বিরোধীদের মধ্যে বেন্থামপন্থীদের এবং সমাজতন্ত্রীদের একই দলের দুই শাখা গণ্য করা চলে। উভয় শাখা বিশ্বজনীন, জাতীয় সংস্কারমুক্ত, উভয় দল গণতান্ত্রিক। উভয় দলের আবেদন অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতি। এদের মধ্যে তফাতটা উপায়ের ব্যাপারে, উপেয় নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। পক্ষান্তরে এই নতুন আন্দোলন, যার পরাকাষ্ঠা (এখন পর্যন্ত) ঘটেছে হিটলারে, উপেয় ব্যাপারেও ভিন্ন, গোটা খ্রিস্টীয় সভ্যতার ঐতিহ্য থেকেও পৃথক।

রাষ্ট্রনীতিজ্ঞদের যে লক্ষ্য অন্বেষণ করা উচিত, প্রায় সকল যুক্তিবিরোধী যেমন মনে করেন, যা থেকে জন্ম নিয়েছে ফ্যাসিবাদ, তা সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে বিবৃত করেছেন নিৎশে। সচেতনভাবে, খ্রিস্টধর্ম এবং উপযোগবাদ-এর বিরোধিতা করে তিনি বেন্থামের মতবাদ বাতিল করে দিয়েছেন। ঐ মতবাদের সুখ ও সর্ববৃহৎসংখ্যা কথা দুটির জন্য। মানবতা, তিনি বলেন, উপেয়-র চেয়ে অধিক উপায়-মানবতা কেবলমাত্র পরীক্ষামূলক বস্তু। তার প্রস্তাবে উপেয় হলো অসাধারণ ব্যক্তির মহত্ত্ব: লক্ষ্য হলো পর্যাপ্ত মহৎ শক্তি অর্জন যা মানুষের ভবিষ্যতের রূপ দেবে, শৃঙ্খলা আরোপ এবং কোটি কোটি আনাড়ি ও কদর্য লোক সম্পূর্ণ নির্মূল করার মাধ্যমে, তবু এই আনাড়ির উক্ত উপায়ে সৃষ্ট দুর্ভাগ্যের দৃশ্য দেখে ধ্বংসপ্রাপ্তি এড়াতে পারে, যে ধ্বংসযজ্ঞের তুলনা ইতঃপূর্বে ছিল না। উপেয় সম্পর্কিত এই ধারণা, লক্ষ্য করা উচিত, স্বতঃই যুক্তিবিরোধী নয়, কারণ উপেয়-র প্রশ্ন যুক্তি দ্বারা নির্ধারণ সম্ভব নয়। এটা আমরা অপছন্দ করতে পারি, আমি নিজে পছন্দ করি না-কিন্তু আমরা এটা ভ্রমাত্মক প্রমাণ করতে পারি না, নিৎশে যেমন নির্ভুল প্রমাণ করতে পারেন না। তথাচ এর সঙ্গে যুক্তিহীনতার স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে, যেহেতু যুক্তি দাবি করে পক্ষপাতহীনতা, পক্ষান্তরে মহৎ মানুষের তন্ত্র সবসময় প্রতিজ্ঞার উপর জোর দেয়; আমি মহৎ ব্যক্তি।

যে চিন্তাসংঘ থেকে ফ্যাসিবাদ জন্ম নিয়েছে তার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। তারা কল্যাণ অন্বেষণ করেছেন ইচ্ছার মধ্যে, অনুভূতি কিংবা প্রত্যক্ষ জ্ঞানে নয়, তারা সুখের চেয়ে ক্ষমতাকে বেশি মূল্যবান মনে করেন। তাদের পক্ষপাত বলপ্রয়োগের প্রতি, যুক্তিশীলতার প্রতি নয়। তাদের কাম্য শান্তি নয়, যুদ্ধ, গণতন্ত্র নয়, অভিজাততন্ত্র, বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতা নয়, অপপ্রচার। তারা প্রাচীনকালের স্পার্টায় প্রচলিত কৃচ্ছুতাসাধনকে অন্যের উপর প্রভুত্ব বিস্তারের উপায় মনে করেন, আত্ম-শৃঙ্খলার উপায় মনে করেন না, যা পুণ্য অর্জনের অনুকূল এবং কেবল অপর জগতে সুখ নিশ্চিত করে। এদের মধ্যে শেষোক্তরা জনপ্রিয় ডারুইনবাদে আপুত এবং অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামকে তারা উন্নততর প্রজাতির উৎস গণ্য করেন; তবে এই সংগ্রাম হবে বিভিন্ন জাতির মধ্যে, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নয়, মুক্ত প্রতিযোগিতার পক্ষপাতীরা যেমন এর পক্ষে ওকালতি করে থাকেন। সুখ ও জ্ঞানকে লক্ষ্য মনে করা তাদের কাছে নিষ্ক্রিয় ব্যাপার। তাদের কাছে সুখের বিকল্প হলো গৌরব, এবং জ্ঞানের বিকল্প হিসেবে ধরেন এই ব্যবহারিক দাবি যে তারা যা ইচ্ছে করেন তাই সত্য। ফিশতে, কার্লাইল এবং ম্যাসিনির কাছে এই মতবাদগুলো এখনও প্রথাগত নৈতিক ভাষার পোশাকে আবৃত; নিৎশের কাছে এগুলো প্রথমে নগ্ন ও নির্লজ্জভাবে এগিয়ে যায়।

এই বিরাট বিপ্লব উদ্বোধনের জন্য ফিশতের যতটুকু কৃতিত্ব পাওয়া উচিত ছিল তিনি তা পান নি। তিনি শুরু করেন বিমূর্ত পরাবিজ্ঞানী হিসেবে, তবু পরবর্তীকালে স্বেচ্ছাচারী এবং আত্মকেন্দ্রিক মেজাজের পরিচয় দেন। তাঁর গোটা দর্শন আমি আমিই, এই অবস্থা থেকে বিকশিত হয়েছে। এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য:

অহম (Ego) নিজেকে স্থাপন করে এবং এই স্থাপনের ফলেই সে অহম; এটা একই সঙ্গে প্রতিনিধি ও কাজের ফলাফল, এটি সক্রিয় এবং সক্রিয়তা দ্বারা সৃষ্ট; আমি আছি বলতে কর্ম বোঝায় (Thathandlung), অহম আছে, কারণ এটি নিজেকে স্থাপন করেছে।

এই তত্ত্বানুসারে অহম অস্তিত্বশীল, কারণ অহম অস্তিত্বশীল থাকতে চায়। উপস্থিত মনে হয় যে নন-ইগোও অস্তিত্বশীল, কারণ ইগো একে অস্তিত্বশীল দেখতে চায়। তবে এভাবে সৃষ্ট নন-ইগো কখনো ইগো বহির্ভূত কিছু হতে চায় না, কারণ ইগো একে স্থাপন করা সাব্যস্ত করেছে। চতুর্দশ লুই বলতেন, Letat cest moi,১২ ফিশতে বলতেন, আমি নিজেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। কান্ট এবং রোবেসপিয়য়ের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে হাইনে মন্তব্য করেছেন, আমরা জার্মানদের তুলনায় তোমরা ফরাসিরা নিস্তেজ ও নমনীয়।

এটা সত্য যে ফিশতে কিছু পরই ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে এই আমি বলতে তিনি ঈশ্বরকে বুঝিয়েছেন; কিন্তু পাঠক কী-করে এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত হতে পারেন।

জেনার যুদ্ধের পর-পর ফিশতেকে যখন বার্লিন থেকে পালিয়ে যেতে হলো, ভাবলেন নিজেও নন-ইগোকে খুব বেশি জোর দিয়ে নেপোলিয়নের আকারে স্থাপন করছেন। ১৮০৭ সালে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বিখ্যাত জার্মান জাতির প্রতি বক্তৃতা প্রদান করেন। উক্ত বক্তৃতায় প্রথমবারের মতো তিনি জাতীয়তাবাদের সমগ্র নীতিমালা উপস্থাপন করেন। এই বক্তৃতাগুলো শুরু করা হয় এই ব্যাখ্যা দিয়ে যে জার্মানরা আধুনিক জাতিসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কারণ এই জাতির শুধু বিশুদ্ধ ভাষা রয়েছে। (রুশ, তুর্কী, চিনা, এস্কিমোদের এবং হটেনটটদের নাম না হয় নাই উল্লেখ করি, যদিও তাদের বিশুদ্ধ ভাষা রয়েছে)। ফিশতে কিন্তু তাঁর ইতিহাসের বইগুলোতে তা উল্লেখ করেন নি। জার্মান ভাষায় বিশুদ্ধতা কেবল জার্মানদেরই গভীরতার সমর্থতা দিয়েছে; তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, চরিত্র থাকা এবং জার্মান হওয়া নিঃসন্দেহে একই জিনিস বোঝায়। কিন্তু যদি জার্মান চরিত্রকে বৈদেশিক কলুষতার সংক্রামক প্রভাব থেকে রক্ষা করতে হয়, এবং জার্মান জাতিকে যদি এককভাবে কাজে সমর্থ হতে হয়, তাহলে অবশ্যই নতুন ধরনের শিক্ষার দরকার করবে, যে শিক্ষা জার্মান জাতিকে সম্মিলিত একদেহে রূপান্তরিত করবে। তিনি বলেন, নতুন শিক্ষা অবশ্যই এমন হবে যে তা ইচ্ছার স্বাতন্ত্র ধ্বংস করবে। তিনি আরো যোগ করেন, ইচ্ছা হলো মানুষের প্রকৃত ভিত্তি।

বহির্বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে, কিছুটা একেবারে অনিবার্য হড়ে পড়লে সেটুকু মেনে নিতে হয় তার অতিরিক্ত নয়। সামরিক বাহিনীতে চাকুরি সার্বজনীন করতে হবে। সবাইকে যুদ্ধে অশগ্রহণে বাধ্য করতে হবে, বাস্তব অবস্থার উন্নয়নের জন্য নয়, স্বাধীনতার জন্য নয়, শাসনতন্ত্র সংরক্ষণের জন্যও নয়, বরং এই তাড়নার অধীনে করতে হবে যে-উচ্চতর দেশপ্রেমের সর্বগ্রাসী শিখা। এই দেশপ্রেম জাতিকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে মহাকালের পোশাক হিসেবে, যার জন্য মহৎ লোকেরা আনন্দের সঙ্গে আত্মোৎসর্গ করে, এবং অবজ্ঞেয় লোকেরা, যারা কেবল অপরের জন্য বেঁচে আছে, তাদেরও অনুরূপভাবে আত্মোৎসর্গ করতে হবে।

মহৎ মানুষ মানবতার লক্ষ্য, এবং অবেজ্ঞয় মানুষের নিজেদের কোনো দাবি নেই, এই মতবাদ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আধুনিক আক্রমণের প্রধান দিক। খ্রিস্টধর্ম শেখায় প্রতিটি মানুষের মধ্যে অবিনশ্বর আত্মা রয়েছে এবং এই হিসেবে সকল মানুষই সমান। মানুষের অধিকার তত্ত্ব খ্রিস্টধর্মীয় মতবাদের বিকাশ মাত্র। উপযোগবাদ ব্যক্তির জন্য সর্বাত্মক অধিকার স্বীকার না করলেও, একজন মানুষের সুখের প্রতি যতটুকু গুরুত্ব দেয়, সকল মানুষের প্রতি ততটুকুই গুরুত্ব দিয়ে থাকে; ফলে এই মতবাদের পরিণতি গণতন্ত্র, প্রাকৃতিক অধিকার-এর মতবাদ যেমন। কিন্তু ফিশতে, এক ধরনের রাজনৈতিক ক্যালভিনদের মতো, নির্দিষ্ট কিছু লোককে বেছে নেন, অন্যদের বাতিল করে দেন অবান্তর গণ্য করে।

অবশ্য কঠিন কাজ হলো কারা পছন্দকৃত বা নির্বাচিত তা জানা। যে জগতে ফিশতের মতবাদ সার্বজনীনভাবে গ্রহণ করা হবে সেই জগতের প্রত্যেকেই মনে করবেন তিনি মহৎ ব্যক্তি, এবং তিনি এমন দলে যোগ দেবেন যে দলকে তার মতামতের যথেষ্ট অনুরূপ মনে হবে এবং আরো মনে হবে যে উক্ত দল তার মতোই মহৎ। উক্ত দলীয় লোকগুলো তার জাতি হতে পারে, ফিশতের বেলায় যেমন হয়েছিল, তার শ্রেণিভুক্তও হতে পারে, সর্বহারা ক্যুনিস্টদের বেলায় যেমন; কিংবা তার পরিবার, নেপোলিয়নের বেলায় যেমন। মহত্ত্বের কোনো বস্তুগত বৈশিষ্ট্য নেই, যুদ্ধে সফল হওয়া ছাড়া; সুতরাং এই নীতির অনিবার্য ফল হলো যুদ্ধ।

জীবন সম্পর্কে কার্লাইলের দৃষ্টিভঙ্গি প্রধানত ফিশতে থেকে গৃহীত। একমাত্র ফিশতেই তাঁর মতামতকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেন। কিন্তু কার্লাইল এর সঙ্গে আরো কিছু যোগ করেন যা তখন থেকে উক্ত গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে; এ যুক্ত হয় এক ধরনের সমাজতন্ত্র এবং সর্বহারাদের জন্য উল্কণ্ঠা, যা প্রকৃত শিল্পবাদ ও নব্য ধনীদের অপছন্দ করে। কার্লাইল এ কাজটি এত সুন্দরভাবে করেন যে এঙ্গেলসও এতে প্রতারিত হন। ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত ইংরেজ শ্রমজীবীদের উপর লিখিত পুস্তকে তিনি কালাইলের উচ্চ প্রশংসা করেন। সুতরাং আমরা অবাক হই না যে জনগণ জাতীয় সমাজতন্ত্রের মধ্যে সমাজতন্ত্রের বহিরাবরণ দেখে মুগ্ধ হন।

বস্তুত, কার্লাইলের এখনও প্রতারণা করার শক্তি আছে। তার বীর পূজা খুবই মর্যাদাকর শোনায়; তিনি বলেন, আমাদের নির্বাচিত সংসদের দরকারই নেই, বরং দরকার বীর-রাজা, এবং অ-বীরোচিত নয় এমন একটা জগৎ। এটা বোঝার জন্য তা কীভাবে বাস্তবে রূপান্তরিত হয় সেটা বিচার করে দেখতে হবে। কার্লাইল অতীত ও বর্তমান গ্রন্থে দ্বাদশ শতাব্দীর অ্যাবট স্যামসনকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেছেন। একজন যদি তাকে পাত্তা না দিয়ে বরং Chronicle of Jocelin of Brakelonde পড়েন তিনি দেখতে পাবেন যে উক্ত অ্যাবট ছিলেন বিবেকহীন দাঙ্গাবাজ, যার মধ্যে মিশেছিল অত্যাচারী ভূ-স্বামী এবং বটতলার উকিলের সকল দোষ। কার্লাইলের অপরাপর বীরগণও অন্তত সমান আপত্তিকর। ক্রোমওয়েল আয়ারল্যান্ডে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালানোর পর তিনি মন্তব্য করেন, আমি বলবো অলিভারের সময়েও ঈশ্বরের সুবিচারে বিশ্বাস করা হতো; কিন্তু অলিভারের সময়ে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের পক্ষে কথার উন্মত্ত ফুলঝুরি ছিল না, এই পাপপূর্ণ জগতে জাঁ-জ্যাক ফিলানথ্রপি এবং সর্বজনীন গোলাপজল নিয়ে বাড়তি কথা হতো না, কেবলমাত্র পরবর্তী অবক্ষয়ী প্রজন্মে-ভালো ও মন্দ এমন নির্বিচারে মিশে সার্বিক ঝোলা-গুড়ে পরিণত হয়-বাস্তবায়িত হয় এই জগতে। তার অপরাপর বীরদের অধিকাংশ সম্পর্কে, যেমন ফ্রেডারিক দ্য গ্রেট, ড. ফ্রানসিয়া, এবং গবর্নর আয়ার, একটি কথাই বলা প্রয়োজন যে, এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল একটিই, এবং তা হলো, রক্তের জন্য দুর্নিবার তৃষ্ণা।

যারা এখনও মনে করেন যে কার্লাইল কম-বেশি উদারপন্থী ছিলেন তাদের অতীত ও বর্তমান-এ গণতন্ত্রের উপর লিখিত অধ্যায়টি পড়া উচিত। এই অধ্যায়ের প্রায় গোটা অংশে উইলিয়াম দ্য কনকারের প্রশংসা করা হয়েছে এবং তাঁর সময়ে ভূমিদাসরা কি সুখী জীবনযাপন করেছেন, দিয়েছেন তার বর্ণনা। অতঃপর দিয়েছেন স্বাধীনতার সংজ্ঞা, মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা, আপনি বলবেন, সঠিক পথ বেছে নেয়া কিংবা বেছে নিতে বাধ্য করা এবং উক্ত পথে হাঁটা (পৃ. ২৬৩)। এরপর তিনি বলেন, গণতন্ত্র হলো শাসিত হওয়ার জন্য বীর খুঁজে হতাশ হওয়া এবং বীরের অভাব মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। অধ্যায়টি শেষ করা হয়েছে গয়গম্বরসুলভ গম্ভীর ভাষায় বিবৃতি দিয়ে: গণতন্ত্রের দৌড় পূর্ণ হবার পর যে সমস্যা থেকে যাবে তা হলো আপনার চেয়ে প্রকৃত শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি দ্বারা শাসিত সরকার অনুসন্ধান। এই কথাগুলোতে এমন একটি শব্দ কি রয়েছে। যা হিটলার সমর্থন করতেন না?

ম্যাৎসিনির মেজাজ কার্লাইলের চেয়ে নমনীয় ছিল, বীরতন্ত্র ব্যাপারে তিনি ভিন্নমত পোষণ করতেন। তাঁর আদরের ধন ছিল জাতি, মহান ব্যক্তি নয়। এবং যদিও তিনি ইতালিকে সর্বোচ্চ স্থান দিতেন, তবু আইরিশদের বাদ দিয়ে ইউরোপীয় সকল জাতির ভূমিকা স্বীকার করতেন। অবশ্য তিনি কার্লাইলের মতো কর্তব্যের স্থান সুখের উপর বলে বিশ্বাস করতেন। এমনকি এর স্থান সর্বজনীন সুখের উপর। তিনি ভাবতেন ঈশ্বর প্রত্যেক ব্যক্তিকে সঠিক বিবেক দিয়েছেন, সর্বোপরি দরকার হলো, সবাই তাঁর আন্তরিকভাবে অনুভূত নৈতিক বিধি মান্য করে চলবে। তিনি কখনো বুঝতে পারেননি যে বিভিন্ন ব্যক্তি আন্তরিকভাবেই নৈতিক বিধি সম্পর্কে বিভিন্ন মত পোষণ করতে পারেন, অথবা তিনি প্রকৃত প্রস্তাবে চাইতেন যে অন্যেরা তিনি যাকে উচিত কর্তব্য মনে করবেন তাই কবুল করবেন। তিনি নৈতিকতাকে গণতন্ত্রের উপর স্থান দিয়ে বলেছেন; সংখ্যাগুরুর সাধারণ ভোটে সার্বভৌমত্ব গঠিত হয় না, যদি তা সর্বোচ্চ নৈতিকতার সুস্পষ্টভাবে বিরোধিতা করে,….. জনগণের ইচ্ছা পবিত্র, যখন জনগণ নৈতিক বিধি ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করে; আইন থেকে বিচ্যুত হলে বাতিল ও অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং এতে খামখেয়ালী প্রকাশ পায়। মুসোলিনিরও একই অভিমত ছিল।

এই গোষ্ঠীর মতবাদে সেই সময়ের পর শুধুমাত্র একটা নতুন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যুক্ত হয়েছে, উপাদানটি হলো জাতি নামক ছদ্ম-ডারউইনবাদী বিশ্বাস। (ফিশতে জার্মান শ্রেষ্ঠতা বুঝতেন ভাষাগত দিক থেকে, জৈবিক উত্তরাধিকার নয়) নিৎশে, যিনি তাঁর অনুসারীদের মতো জাতীয়তাবাদী এবং সেমাইট বিরোধী ছিলেন না, তাঁর মতবাদ কেবলমাত্র বিভিন্ন ব্যক্তির ভেতর প্রয়োগ করেন; ইচ্ছে করেছেন অযোগ্যদের সন্তান প্রজননে বাধা দিতে হবে এবং আশা করেছেন, কুকুর বিশেষজ্ঞদের পদ্ধতিতে, শ্রেষ্ঠতর। জাতির উৎপাদন, যাদের ক্ষমতা থাকবে, এবং এদের হিতসাধনের জন্যই শুধু মানবতার বাকি অংশ বেঁচে থাকবে। তবে পরবর্তী সকল লেখকই অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে সর্বপ্রকার চমৎকারিত্ব তার জাতির মধ্যে মিশে আছে। আইরিশ লেখকরা হোমর যে আইরিশ ছিলেন তা প্রমাণ করার জন্য অনেক পুস্তক লিখেছেন; ফরাসি নৃতত্ত্ববিদগণ পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য উপস্থাপন করেছেন কেল্ট নয়, টিউটনরাই উত্তর ইউরোপের সভ্যতার উৎস; হিউস্টন চেম্বারলেন বিস্তৃত যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যে দান্তে ছিলেন জার্মান এবং খ্রিস্ট ইহুদি ছিলেন না। ঈঙ্গ ভারতীয়দের মধ্যে জাতিতত্ত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ সর্বজনীন ব্যাপার। এদের কাছ থেকেই সাম্রাজ্যবাদী ইংল্যান্ড রাডিয়ার্ড কিপলিং-এর মাধ্যমে এই সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবে ইংল্যান্ডে সেমেটিক বিরোধিতা কখনো শক্তিশালী ছিল না; যদিও একজন ইংরেজ, হিউস্টন চেম্বারলেন, জার্মানিতে সেমেটিক বিরোধিতার মিথ্যা ঐতিহাসিক ভিত্তি প্রদানে মূল ভূমিকা পালন করেন। তবে জার্মানিতে এটা দাপটের সঙ্গে মধ্যযুগ থেকে বজায় ছিল।

রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হলে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, জাতি সম্পর্কে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই জানা যায় না। এটা সম্ভব বলে ধরে নেয়া যায় যে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে জেনেটিক মানসিক ব্যবধান থাকতে পারে; তবে এটা সুনিশ্চিত যে ব্যবধানটা কী তা আমরা এখনও জানতে পারি নি। বয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে পরিবেশের প্রতিক্রিয়া বংশগতির ছাপ আড়াল করে। উপরন্তু বিভিন্ন ইউরোপীয়দের জাতিগত পার্থক্য, সাদা, হলুদ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে পার্থক্যের চেয়ে কম সুনির্দিষ্ট ইউরোপীয়দের মধ্যে এমন কোনো সুচিহ্নিত শারীরিক বৈশিষ্ট্য নেই যে যার সাহায্যে বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতিসমূহের সদস্যদের আলাদা করে চেনা যেতে পারে, কারণ বিভিন্ন উৎসের সংমিশ্রণের ফলাফল হলো ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। মানসিক শ্রেষ্ঠতার বেলায় প্রত্যেকটি সভ্য জাতি গ্রহণযোগ্য দাবি উত্থাপন করতে পারেন, এতে প্রমাণিত হয় যে সবার দাবি সমানভাবে অসিদ্ধ। এটা সম্ভব হতে পারে যে ইহুদিরা জার্মানদের চেয়ে হীন, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সম্ভব হতে পারে জার্মানরা ইহুদিদের চেয়ে হীন। এই প্রশ্নে ছদ্ম-ডারউইনবাদী অর্থহীন কথা সূচনা করার গোটা ব্যাপারটাই বিজ্ঞানবিরোধী। ভবিষ্যতে মানুষ যাই জানতে সমর্থ হোন না কেন, বর্তমানে আমাদের হাতে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে একটি জাতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে অপর একটি জাতিকে উৎসাহিত করার ইচ্ছে বোধ করতে পারি।

ফিশতে থেকে শুরু করে গোটা আন্দোলনের পদ্ধতিটাই হলো আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির প্রয়াস এবং ক্ষমতাভিলাষ। উপায় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে কতকগুলো বিশ্বাস। যে বিশ্বাসগুলোতে এমন কিছুই নেই তাদের পক্ষে যায়, কেবল বিশ্বাসগুলো একটু আত্মতৃপ্তিকর বটে। ফিশতের একটা মতবাদের দরকার ছিল যা তাকে নেপোলিয়নের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর অনুভব করতে সাহায্য করবে; কার্লাইল এবং নিৎশে কয়েকটি ক্ষেত্রে দুর্বল ছিলেন, ফলে উক্ত দুর্বলতাগুলোর ক্ষতিপূরণ খোঁজেন কল্পনার জগতে; রাডিয়ার্ড কিপলিং-এর যুগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদিতার কারণ শিল্পায়নে প্রাধান্য হারানোর লজ্জা এবং আমাদের কালের হিটলারীয় পাগলামী হলো মিথ্যার মুকুট, যার সাহায্যে জার্মান অহমকে ভার্সাইর ঠাণ্ডা ঝাঁপটার বিরুদ্ধে উষ্ণ রাখা হয়। মারাত্মক আঘাতে আত্ম মর্যাদা বিক্ষত হলে কোনো মানুষই সুস্থভাবে চিন্তা করতে পারেন না, এবং যারা ইচ্ছাকৃতভাবে একটি জাতিকে অপমানিত করে তারা শুধু নিজেদেরকেই ধন্যবাদ জানাতে পারেন যদি নিজেরা উন্মাদের জাতিতে পরিণত হন।

এখানেই আমি কারণগুলো খুঁজে পাই যা অযৌক্তিক এমনকি যুক্তিবিরোধী (আমাদের বিবেচ্য) মতবাদটি ব্যাপকভাবে গ্রহণ সম্ভব করে তুলেছে। প্রায় সব সময়ই সব ধরনের মতবাদ সব ধরনের প্রত্যাদিষ্ট ব্যক্তিগণ প্রচার করতেন, তবে যে মতবাদগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে তা অবশ্যই ঐ সময়ের পরিস্থিতির দ্বারা সৃষ্ট মেজাজের প্রতি বিশেষ আবেদন রাখে। আধুনিক যুক্তিবিযুক্তবাদীদের মতবাদগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, আমরা যেমন দেখেছি, চিন্তা ও অনুভূতি বাদ দিয়ে, ইচ্ছা-র উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ। ক্ষমতাকে গৌরবান্বিত করে তোলে। পর্যবেক্ষণমূলক এবং আরোহী পরীক্ষার পরিবর্তে পদান্বয়ী অব্যয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থাপনে বিশ্বাস। মনের এই অবস্থা, উড়োজাহাজের মতো যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ যাদের অভ্যাস এবং আরো, যারা বর্তমানে আগের চেয়ে কম ক্ষমতাবান এবং পূর্বেকার প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুক্তিশীল পথ খোঁজায় অসমর্থ, তাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। শিল্পায়ন ও যুদ্ধ, যান্ত্রিক ক্ষমতার অভ্যাস সূচিত করলেও, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অবস্থানের পরিবর্তন করেছে, ফলে বড় বড় গোষ্ঠীর মেজাজ হয়েছে বাস্তবিক আত্ম-জাহিরের। এবং এর পরিণামই হলো ফ্যাসিবাদ।

১৯২০ সালের জগতের সঙ্গে ১৮২০ সালের জগতের তুলনা করলে আমরা দেখতে পাই যে কয়েকটি গোষ্ঠীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে; বড়-বড় শিল্পপতি, শ্রমজীবী, নারী, ধর্মদ্বেষী এবং ইহুদিদের। (এখানে ধর্মদ্বেষী বলতে আমি তাদের বুঝিয়েছি যাদের ধর্ম তাদের দেশের সরকারি ধর্ম নয়) পারস্পরিকভাবে, এই শ্রেণিগুলো ক্ষমতা হারিয়েছেন: রাজা, অভিজাত ব্যক্তি, পাদরি, নিম্নমধ্যবিত্তশ্রেণি এবং নারীর তুলনায় পুরুষরা। বড়-বড় শিল্পপতিরা, যদিও আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অধিকতর শক্তিশালী, সমাজতন্ত্রের হুমকিতে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করেছেন, বিশেষ করে এদের মধ্যে মস্কোর ভীতি কাজ করছে। যাদের স্বার্থ যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত, যেমন সমরনায়ক, নৌসেনাপতি, পাইলট, অস্ত্রনির্মাতা প্রতিষ্ঠান, তাদের অবস্থা এই রকম: বর্তমানে তারা খুব শক্তিশালী কিন্তু বলশেভিক এবং শান্তিবাদী নামক বিনাশক দলের ভয়ে ভীত। এরা ইতোমধ্যেই রাজা, অভিজাত ব্যক্তি, ক্ষুদ্র দোকানদার, যারা মেজাজের কারণে ধর্মীয় সহিষ্ণুতাবিরোধী, যারা আক্ষেপ করেন নারীর উপর পুরুষের প্রাধান্যের দিনগুলোর জন্য, ইত্যাদি শ্রেণিকে পরাজিত করেছে; এরা সুনিশ্চিতভাবে জীবন সংগ্রামে পরাজিত হয়েছেন বলেই মনে হয়; অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ, ভাবা হয়, আধুনিক জগতে তাদের জন্য কোনো স্থান রাখেনি। স্বাভাবিকভাবেই তারা অসন্তুষ্ট হন, সামগ্রিকভাবে এদের সংখ্যাও অগণন। তাদের মানসিক প্রয়োজনের জন্য নিৎশের দর্শন মনস্তাত্ত্বিকভাবে উপযোগী করে তোলা হয়, এবং অত্যন্ত চতুরভাবে শিল্পপতি ও সমরবিদগণ এই অসন্তোষ কাজে লাগিয়ে পরাজিত গোষ্ঠীগুলোকে একটা দলে রূপান্তরিত করে, যারা শিল্প ও যুদ্ধ বাদে সবকিছুর প্রতি মধ্যযুগীয় প্রতিক্রিয়া সমর্থন করবে। শিল্প ও যুদ্ধের ক্ষেত্রে গোটা প্রযুক্তি হবে আধুনিক, ক্ষমতার অংশীদারিত্বের বেলায় নয়, এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা যাবে না, কারণ শান্তিই বর্তমান শিল্পপতিদের কাছে সমাজতন্ত্রীদের বিপজ্জনক করে তুলেছে।

কার্যত নাৎসি দর্শনে অযৌক্তিক উপাদানগুলো ঢুকেছে, রাজনৈতিকভাবে বলতে গেলে, সেই গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন আদায়ের প্রয়োজনে যাদের জন্য আর কোনো লক্ষ্য নেই, সুস্থ উপাদানগুলো স্থান পেয়েছে শিল্পপতি ও সমরবিদদের জন্য। পূর্বোক্ত উপাদান অযৌক্তিক, কারণ ক্ষুদ্র দোকানদারগণ প্রত্যাশা বাস্তবায়িত করতে পারবেন বলে মনে হয় না, এবং হতাশা থেকে আত্মরক্ষার জন্য তাদের আজগুবি বিশ্বাসে আশ্রয় গ্রহণ ছাড়া গত্যন্তর নেই; অপরদিকে, ফ্যাসিবাদের সাহায্যে শিল্পপতি এবং সমরবিদগণ তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন, অন্য কোনো উপায়ে ইচ্ছাপূরণের সম্ভাবনা নেই বললে চলে। সভ্যতার ধ্বংসসাধন করেই কেবল তারা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন, এই ঘটনা থেকে তারা অযৌক্তিক হন না, খাড়া শয়তানে পরিণত হন। এরা আন্দোলনের শ্রেষ্ঠতম বুদ্ধিগত উপাদান; নৈতিক দিক দিয়ে হীনতম; বাকিরা গৌরব, বীরত্ব এবং আত্মত্যাগের স্বপ্নে চমকিত হয়ে তাদের গুরুতর স্বার্থের প্রতি হয়ে পড়েছে অন্ধ, এবং আবেগে প্রজ্জ্বলিত হয়ে নিজেদের এমন লক্ষ্য অর্জনে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে যা তাদের লক্ষ্য হতে পারে না। এটাই হচ্ছে নাৎসিরাজ্যের মনস্তাত্ত্বিক রোগনিরূপণ বিজ্ঞান।

শিল্পপতি এবং সমরবিদ, যারা ফ্যাসিবাদের সমর্থক, তারা সুস্থ মনের অধিকারী বলেছি, কিন্তু তারা কেবলমাত্র তুলনামূলকভাবে সুস্থ। দাইজেন (Thyssen) বিশ্বাস করেন যে, তিনি একই সঙ্গে সমাজতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা এবং তার বাজার বিরাট আকারে সম্প্রসারিত করতে সক্ষম। ১৯১৪ সালের তাঁর পূর্বসূরিদের চেয়ে তিনি এ ব্যাপারে সঠিক মনে করার অধিক কোনো কারণ দেখি না। জার্মান আত্মবিশ্বাস এবং জাতীয়তাবাদী অনুভূতি বিপজ্জনক মাত্রায় উন্নীত করা তার জন্য খুবই দরকারি, এবং এর ফলাফল যে অসফল যুদ্ধ তা এক রকম অনিবার্য। এমনকি বড় ধরনের প্রাথমিক কিছু সাফল্যও চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারবে না; বিশ বছর আগের মতো, এখন জার্মান সরকার আবার আমেরিকাকে ভুলে গেছে।

একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা, সামগ্রিকভাবে নাৎসিবিরোধী, যদিও প্রতিক্রিয়াশীলতার সমর্থক হতে পারত-আমি সংঘবদ্ধ ধর্মের কথা বলছি। যে আন্দোলনের দর্শন নাৎসিবাদে পৌঁছেছে তা এক হিসেবে প্রটেস্টান্টবাদের যৌক্তিক বিকাশ। ফিশতে ও কার্লাইলের নৈতিকতা ক্যালভিনপন্থী, এবং ম্যাৎসনি, যিনি আজীবন রোমের বিরোধিতা করেছেন, লুথারপন্থীদের মতো ব্যক্তি-বিবেকে আগাগোড়া বিশ্বাসী ছিলেন। নিৎশের ব্যক্তির মূল্যের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল, এবং তাঁর বিবেচনায় বীর কর্তৃপক্ষের কাছে নতি স্বীকার করবেন, এটা অনুচিত। এক্ষেত্রে তিনি প্রাটেস্টান্টদের বিদ্রোহী শক্তিকে বিকশিত করেছিলেন। হয়তো প্রত্যাশা করা যেত যে প্রটেস্টান্ট গির্জাগুলো নাৎসি আন্দোলনকে অভিনন্দন জানাবে, একটা পর্যায় তারা তা করেছেও। কিন্তু যে সব ব্যাপারে প্রটেস্টান্টবাদ ক্যাথলিকবাদের শরিক ছিল, দেখতে পেল নতুন দর্শন তার বিরোধী। নিৎশে ছিলেন জোরালোভাবে খ্রিস্টান ধর্মবিরোধী, এবং হিউস্টন চেম্বারলেন বুঝিয়ে গেছেন যে খ্রিস্টধর্ম হলো নীচু শ্রেণির কুসংস্কার যা গড়ে উঠছে ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলীয় (Levant) সংকর জাতীয় বিশ্বনাগরিকদের মধ্যে। বিনয়-নম্রতা, প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা, বশংবদ ব্যক্তিদের অধিকার, এসব বাতিল করে দেয়া গসপেলের শিক্ষার বিরোধী; এবং এন্টিসেমিটিজম, যখন এটা একই সঙ্গে তাত্ত্বিক ও বাস্তবিক, ইহুদিদের ভেতর থেকে জন্ম নেয়া ধর্মের সঙ্গে সহজে আপোস করতে পারে না। এইসব কারণে নাৎসিরাজ্য এবং খ্রিস্টধর্মের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন কঠিন, এবং এটা অসম্ভব নয় এদের মধ্যেকার পারস্পরিক বিরুদ্ধাচারণ নাৎসিদের পতন ঘটাবে। কি জার্মানি কিংবা অন্য কোথাও আধুনিক অযৌক্তিকতার সঙ্গে প্রথাগত খ্রিস্টধর্মের আরো একটা কারণে সহাবস্থান সম্ভব নয়। ইহুদি ধর্ম-দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম, সত্যের ধারণার সঙ্গে পরস্পরসূত্রে বিশ্বাসের পুণ্য গ্রহণ করে। ঐ ধারণা ও পুণ্য সৎ সংশয়ের মধ্যে বেঁচে থাকে, যেমন ভিক্টোরীয় যুগের সকল মুক্তচিন্তাবিদদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মের সকল পুণ্য স্থান লাভ করেছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে সংশয়বাদ এবং বিজ্ঞাপনের প্রভাবে দেখা গেল সত্য আবিষ্কার নৈরাশ্যজনক। কিন্তু মিথ্যাচারের উপর জোর দেয়া লাভজনক। হিটলার নাৎসী দলের কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে বলেছেন:

জাতীয় রাষ্ট্র বিজ্ঞানকে দেখবে জাতীয় গর্ব বৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে। শুধু পৃথিবীর ইতিহাস নয়, সভ্যতার ইতিহাসও এই দৃষ্টিকোণ থেকে শেখাতে হবে। উদ্ভাবক শুধুমাত্র উদ্ভাবক হিসেবে আবির্ভূত হবেন না, তার উপস্থাপন হবে স্বদেশবাসী হিসেবে। কোনো বৃহৎ কীর্তির প্রতি সম্ভ্রমের সঙ্গে গৌরব যুক্ত করতে হবে, কারণ ঐ ভাগ্যবান কৃতিপুরুষ আমাদের জাতির সদস্য। আমরা অবশ্যই জার্মান ইতিহাসের মহৎ নামের ভিড়ের ভেতর থেকে মহত্তমদের বের করে আনবো এবং তাদের স্থাপন করবো যুবকদের সামনে, এবং এটা করতে হবে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক উপায়ে যাতে তারা জাতীয় অনুভূতির অটল স্তম্ভ হতে পারে।

সত্যানুসন্ধান হিসেবে বিজ্ঞানের ধারণা হিটলারের কাছ থেকে এতটা দূরীভূত হয়েছে যে, তিনি বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার যুক্তি বিস্তার করেন না। আমরা যেমন জানি, আপেক্ষিকতা-সূত্র মন্দ বিবেচিত হয়েছে, কারণ উক্ত সূত্রের আবিষ্কর্তা একজন ইহুদি। ইনকুইজিশন গ্যালিলিও-র মতবাদ বাতিল করে দেয় এই বিবেচনায় যে, উক্ত মতবাদ অসত্য; হিটলার কিন্তু কোনো মতবাদ গ্রহণ কিংবা বর্জন করেন রাজনৈতিক কারণে, তাঁর কাছে সত্য বা মিথ্যা কোনো ব্যাপার নয়। হতভাগা উইলিয়াম জেমস, যিনি এই দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভাবক, অবশ্যই আতংকগ্রস্ত হতেন দেখে যে তার দৃষ্টিভঙ্গির কী অপব্যবহার শুরু হয়েছে; কিন্তু যখন একবার বস্তুগত সত্যের ধারণা বর্জিত হলো, এটা পরিষ্কার যে আমি কি বিশ্বাস করবো? এই প্রশ্নের মীমাংসা তখন করতে হবে- আমি যেমন ১৯০৭ সালে লিখেছিলাম, বল প্রয়োগ এবং বৃহৎ সৈন্যদলের মধ্যস্থতা দ্বারা, ধর্মতত্ত্ব কিংবা বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে নয়। যে রাষ্ট্রের নীতির ভিত্তি যুক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সে রাষ্ট্র অবশ্যই দেখতে পাবে যে তাদের সঙ্গে শুধু জ্ঞান বিজ্ঞানের বিরোধ বাধেনি। গির্জাগুলোর সঙ্গেও বিরোধ দেখা দিয়েছে; অবশ্য যেখানে খ্রিষ্টধম খাঁটি অবস্থায় টিকে আছে।

যুক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অনেক সমর্থ এবং উদ্যোগী পুরুষ ক্ষমতাপ্রীতি চরিতার্থ করার পথ খুঁজে পায় না, ফলে হয়ে পড়ে নাশকতামূলক চরিত্রের। অতীতে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো অধিক মানুষকে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করতে দিয়েছে, এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা অধিক সংখ্যক লোককে দিয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা। ভেবে দেখুন এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কথা, যারা ঘুমায় শহরতলিতে, কাজ করে বড়-বড় নগরে। এদের ট্রেনে লন্ডন শহরে আসতে হয়, পথের দুপাশে দেখতে পায় বিরাট এলাকা জুড়ে ছোট-ছোট বাগান বাড়ি। এই বাড়িগুলোর পরিবারসমূহ শ্রমজীবীদের সঙ্গে কোনো প্রকার সংহতি বোধ করে না; পরিবারগুলোর লোকেরা স্থানীয় ব্যাপারেও অংশগ্রহণ করে না। কারণ নিয়োগকর্তার আদেশ পালন করতেই এদের দিন ফুরিয়ে যায়। তাদের উদ্যোগশীলতা চরিতার্থ করার একমাত্র উপায় হলো সপ্তাহান্তে বাড়ির পেছনে বাগান পরিচর্যা। রাজনৈতিকভাবে শ্রমজীবী শ্রেণির জন্য কিছু করা হলে তারা ঈর্ষা বোধ করে এবং যদিও নিজেরা যে দরিদ্র সেটা অনুভব করে, কিন্তু নাক উঁচু ভাবটা বজায় রাখার জন্য সমাজতন্ত্র এবং ট্রেড ইউনিয়নের পদ্ধতি গ্রহণ করে না। তাদের শহরতলী হয়তো প্রাচীন কালের বিখ্যাত নগরগুলোর মতো জনবহুল, কিন্তু তাদের সামাজিক জীবন ক্লান্তিকর, এবং সামাজিক জীবনে উৎসাহী হওয়ার মতো সময়ও নেই। এ ধরনের লোকের কাছে যদি অসন্তোষ প্রকাশের মতো যথেষ্ট শক্তি থাকে তাহলে ফ্যাসিবাদী আন্দোলন তাদের কাছে মুক্তিদাতা বলে প্রতিভাত হয়।

রাজনীতিতে যুক্তির অবক্ষয় দুটি উপাদানের সৃষ্টি; একদিকে যেমন বিভিন্ন শ্রেণি ও চরিত্রের ব্যক্তি রয়েছে যাদের চলতি দুনিয়া কোনো সুযোগ দেয় না, এরা সমাজতন্ত্রেও কোনো ভরসা দেখে না, কারণ তারা শ্রমজীবী নয়; অপরদিকে, অনেক সমর্থ এবং শক্তিশালী লোক রয়েছেন যাদের স্বার্থ বৃহত্তর সমাজের বিরোধী, ফলে তারা কেবলমাত্র নানা ধরনের ভুল ভাবাবেগের পক্ষে কাজ করে। ক্যুনিজম-বিরোধিতা, বৈদেশিক অস্ত্রভাণ্ডারের ভীতি এবং বৈদেশিক প্রতিযোগিতার প্রতি ঘৃণা, ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জুজু। এতে আমি বোঝাচ্ছি যে, তারা বাস্তব সমস্যার বুদ্ধিমান বিবেচনা বাদ দিয়ে চলতেই অভ্যস্ত। এই পৃথিবীর যে দুটি জিনিসের সবচেয়ে বেশি দরকার তা হলো সমাজতন্ত্র ও শান্তি, কিন্তু এই দুটি জিনিসই আমাদের সময়ের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের স্বার্থের বিরোধী। এমন পদক্ষেপ নেয়া খুব কঠিন নয়, যাতে এটা জনসংখ্যার বৃহৎ অংশের কাছে স্বার্থবিরোধী মনে হবে এবং কাজটি করার সহজ উপায় হলো গণভাবাবেগ সৃষ্টি করা। সমাজতন্ত্র ও শান্তির জন্য বিপদ যত বড় হবে সরকারসমূহ ততই প্রজাদের প্রলোভন দেখিয়ে বিপথগামী করবে; জনগণের চলিত আর্থিক কষ্ট যত বড় হবে, দুর্ভোগপীড়িত জনগণের বুদ্ধিগত মিতাচার হবে ততই বিনষ্ট, ক্রমাত্মক আলেয়ার পেছনে ছোটায় হবে অতিরিক্ত অভ্যস্ত।

জাতীয়তাবাদের জ্বর, যা ১৮৪৮ সাল থেকে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, যুক্তিহীনতাতত্ত্বের একটা রূপ মাত্র। এক ও অদ্বিতীয় সর্বজনীন সত্যের ধারণা বর্জন করা হয়েছে; এখন সত্যের নানা ভেদ, ইংরেজ সত্য, ফরাসি সত্য, জার্মান সত্য, মন্টেনেগ্রান সত্য, রাজশাসিত মোনোকো রাষ্ট্রের জন্যও একটা সত্য রয়েছে। অনুরূপভাবে শ্রমজীবীর জন্য রয়েছে একটা সত্য, পুঁজিবাদীদের জন্য ভিন্ন সত্য। এইসব বিভিন্ন সত্যের মধ্যে, যৌক্তিক প্রক্রিয়া যদি হতাশ হয়, তাহলে একমাত্র সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় যুদ্ধ, এবং অপপ্রচারকারী উন্মাদগ্রস্ততার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বিভিন্ন জাতি ও শ্রেণির মধ্যে বিরাজিত গভীর বিরোধ, যা আমাদের জগৎকে সংক্রমিত করেছে, সমাধা না করা পর্যন্ত মানুষ যুক্তিশীলভাবে চিন্তার অভ্যাসে প্রত্যাবর্তন করবে, এমন প্রত্যাশা করা যায় না। অসুবিধাটা এখানে যে, যত দীর্ঘকাল যুক্তিহীনতা বিরাজ করবে, আমাদের অসুবিধাগুলোর সমাধানে পৌঁছানো ততই দৈবাধীন হয়ে পড়বে। কারণ যুক্তি নৈর্ব্যক্তিক বলে সর্বজনীন সহযোগিতা সম্ভব করে তোলে। যুক্তিহীনতা যেহেতু গোপন আসক্তির প্রতিনিধিত্বকারী, ফলে বিবাদ হয়ে পড়ে অনিবার্য। এই কারণেই যুক্তিশীলতা, সত্যের সর্বজনীন ও নৈর্ব্যক্তিক মানের কাছে আবেদনের অর্থে, মানব-বংশের উন্নতির জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ, শুধু সেই সময়ের জন্যই নয় যখন সহজে এর প্রাদুর্ভাব ঘটে, বরং আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই সব মন্দ-ভাগ্যের সময়ের জন্য যখন একে এক শ্রেণির পুরুষের অসার স্বপ্ন হিসেবে ঘৃণা ও বাতিল করা হয়।

 ০৬. সিলা ও ক্যারিবডিস অথবা সাম্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ

আজকের দিনে অনেকেই বলে থাকেন সাম্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদই হলো রাজনীতি ক্ষেত্রে একমাত্র বিকল্প, এবং যিনি একটাকে সমর্থন করেন না তিনি প্রকারান্তরে অপরটিকে সমর্থন করেন। আমি এই উভয় তন্ত্রের বিরোধী, বিকল্প হিসেবে এই দুটির কোনো একটিকেই আমি সমর্থন করতে অপারগ। আর আমি যদি ষোড়শ শতকের লোক হতাম তবে প্রটেস্টান্ট কিংবা ক্যাথলিক হতাম। প্রথমে আমি সাম্যবাদ সম্পর্কে আমার আপত্তিগুলো লিপিবদ্ধ করব। অতঃপর ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে। তারপর দেখবো এই দুটি তন্ত্রের মধ্যে কোথায় মেলে।

যখন আমি একজন সাম্যবাদী (Communist) সম্পর্কে বলি, আমি এমন একজন ব্যক্তিকে বোঝাই যিনি তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মতবাদগুলো কবুল করেছেন। এক হিসেবে প্রথম যুগের খ্রিস্টানরা কম্যুনিস্ট ছিলেন, মধ্যযুগের অনেকানেক গোষ্ঠীই অনুরূপ ছিলেন। কিন্তু ঐ হিসেবটা আজ আর চলে না। আমি কেন কম্যুনিস্ট নই তার কারণগুলো পর্যায়ক্রমে উপস্থাপন করছিঃ

১. আমি মার্কস-এর দর্শন সমর্থন করতে অপারগ। Materialism and Emperio-Criticism আরো কম সমর্থন করি। আমি বস্তুবাদী নই। যদিও ভাববাদ থেকে আমার অবস্থান ততধিক দূরে। আমি বিশ্বাস করি না যে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের জন্য কোন প্রকার দ্বান্দ্বিকতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দ্বান্দ্বিকতায় বিশ্বাস মার্কস গ্রহণ করেছিলেন হেগেল থেকে, বাদ দিয়েছিলেন এর যৌক্তিক ভিত্তি অর্থাৎ ভাবের প্রাথমিকতা। মার্কস বিশ্বাস করতেন যে মানবিক বিকাশ পরবর্তী স্তরে এক হিসেবে হবে প্রগতি; এই বিশ্বাসের পক্ষে আমি কোনো যুক্তি দেখতে পাই না।

২. মার্কস-এর মূল্যতত্ত্ব আমি গ্রহণ করতে পারি না, আরো পারি না উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্বের তিনি যে আকৃতি দিয়েছেন তা। কোনো পণ্যের বিনিময় মূল্য ঐ পণ্য উৎপাদনে যে শ্রম লেগেছে তার সমানুপাতিক, এই তত্ত্ব, যা মার্কস রিকার্ডো থেকে গ্রহণ করেছিলেন, তা রিকার্ডোর খাজনা-তত্ত্ব দ্বারাই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। আর অনেক আগেই ঐ তত্ত্ব অ-মার্কসীয় অর্থনীতিকরা বর্জন করেছেন। উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে, যা অন্যত্র মার্কস নিজেই বাতিল করে দিয়েছেন। মার্কসের অর্থশাস্ত্রে যৌক্তিক সমগ্রতা নেই, বরং তা গঠিত হয়েছে পুরাতন মতবাদ গ্রহণ ও বর্জনের উপর। এই গ্রহণ ও বর্জনের কাজটা চলেছে পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে যুক্তি খাড়া করার অনুকূলে।

৩. কোনো একজন মানুষকে অভ্রান্ত গণ্য করা বিপজ্জনক ব্যাপার। এর ফল দাঁড়ায় অবশ্যম্ভাবীরূপে অতি-সরলীকরণ। বাইবেলের আক্ষরিক অনুপ্রেরণার ঐতিহ্য মানুষকে পবিত্র গ্রন্থ খোঁজার জন্য প্রস্তুত করে তুলেছে। কিন্তু কর্তৃপূজা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী।

৪. সাম্যবাদ গণতান্ত্রিক নয়। সর্বহারার একনায়কতন্ত্র আসলে সংখ্যালঘুর একনায়কতন্ত্র। এই সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণিতে পরিণত হয়। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, শাসনকার্য শাসকশ্রেণির স্বার্থেই পরিচালিত হয়ে থাকে। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে প্রভাবিত হলেই শুধু ব্যতিক্রম দেখা যায়। এই শিক্ষা শুধু ইতিহাসের নয়, মার্কসেরও। সাম্যবাদী রাষ্ট্রে শাসকশ্রেণির ক্ষমতা এমনকি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী শ্রেণির চেয়ে বেশি। এই শ্রেণি যতদিন সামরিক বাহিনীর আনুগত্য ধরে রাখতে পারবে ততদিন ক্ষমতা খাঁটিয়ে এমন সুবিধা আদায় করতে পারে যা পুঁজিবাদীদের ক্ষমতার সমান ক্ষতিকর। ক্যুনিজম সর্বদাই সাধারণের কল্যাণের জন্য কাজ করবে মনে করা বোকামিপূর্ণ ভাববাদ ছাড়া কিছু নয়, এবং এটা মার্কসীয় রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের বিরোধী।

৫. ফ্যাসিবাদ ছাড়া অন্য যে কোনো তন্ত্রের চেয়ে কম্যুনিজম মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করে অনেক বেশি। বিশেষত বুদ্ধিজীবীর স্বাধীনতা। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পূর্ণ একীকরণ অত্যাচারের এমন ভয়ানক যন্ত্র তৈরি করে যাতে কোনো প্রকার ব্যতিক্রম ঘটার ছিদ্রপথ থাকে না। এমন ব্যবস্থায় প্রগতি অনতিবিলম্বে অসম্ভব হয়ে পড়বে, কারণ আমলাদের চরিত্রই এই যে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়া অন্য যে কোনো প্রকার পরিবর্তনে তারা বাধা প্রদান করে থাকে। যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনা সম্ভব হয় এ জন্য যে আপতিকভাবে অজনপ্রিয় ব্যক্তি বেঁচে থাকতে সমর্থ হন। কেপলার জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করে জীবন ধারণ করেছেন, ডারউইন টিকে ছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ লাভ করে। মার্কস পেয়েছেন, এঙ্গেলস কর্তৃক মানচেস্টারের সর্বহারাদের শোষণের অংশ। অজনপ্রিয়তা সত্ত্বেও বেঁচে না থাকার অনুরূপ সুযোগ সাম্যবাদী শাসনের অধীনে সম্ভব নয়।

৬. সমকালীন মার্ক্সীয় সাম্যবাদী চিন্তায় মেধার চেয়ে কায়িক শ্রমকে বেশি গৌরবময় করে তোলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এতে মেধাকর্মীদের শত্রুতে পরিণত করা হচ্ছে, অথচ এরা হয়তো সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখতে পেতেন এবং এই মেধাকর্মীদের সহায়তা ব্যতিরেকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংগঠন কমই সম্ভব।

৭. শ্রেণি-যুদ্ধের পক্ষে প্রচারের দরুন ঐ যুদ্ধ এমন সময়ে বেঁধে যেতে পারে যখন পরস্পরবিরোধী পক্ষের শক্তি কম বেশি সমান, কিংবা এমন সময়েও সংগঠিত হতে পারে যখন পাল্লাটা পুঁজিবাদীদের পক্ষেই ভারী। যদি পুঁজিবাদী পক্ষের শক্তি অধিকতর ভারী হয় তাহলে ফল দাঁড়াবে প্রতিক্রিয়ার যুগ। যদি উভয় পক্ষের শক্তি মোটামুটি সমান হয় তাহলে যুদ্ধের আধুনিক পদ্ধতির জন্য, সভ্যতার ধ্বংসসাধন সম্ভব, সঙ্গে-সঙ্গে পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী উভয় পক্ষের বিলুপ্তি ঘটবে। আমি মনে করি, যেখানে গণতন্ত্র চালু আছে, সেখানে সমাজতন্ত্রীদের উচিত জনগণকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাজ করা, শুধু বিরোধী পক্ষের অবৈধ বলপ্রয়োগ রোধের জন্যই শক্তি প্রয়োগ করা উচিত। এই পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রীদের শক্তির পাল্লা এতটা ভারী হবে যে পরিণামী যুদ্ধ হবে খুব সংক্ষিপ্ত, যুদ্ধের তীব্রতাও এতটা হবে না যে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।

৮. মাকর্স এবং ক্যুনিজমে এতটা ঘৃণা রয়েছে যে, কম্যুনিস্টদের দিয়ে আশা করা যায় না যে, বিজয়ী হবার পর তারা ঈর্ষাপরায়ণতার স্থান রাখবেন না। তাহলে দেখা যাচ্ছে নিষ্পেষণের পক্ষে যুক্তি বিজয়ী পক্ষের বেলায় দৃঢ়তর, বিশেষত বিজয় যদি অর্জিত হয়ে থাকে হিংস্র ও সন্দিগ্ধ যুদ্ধের ফলে। এই ধরনের যুদ্ধের পর বিজয়ী দলের সুস্থ পুনর্গঠনের মেজাজ থাকবে বলে মনে হয় না। মাকর্সবাদীরা ভুলে যান যে যুদ্ধের নিজস্ব মনস্তত্ত্ব রয়েছে, যা ভয় থেকে উৎসারিত হয়ে থাকে এবং মূল বিবাদের কারণ থেকে তা স্বতন্ত্র।

কম্যুনিজম ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই বলে যে মনে করা হয় তা সুনিশ্চিতভাবে আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ক্ষেত্রে খাটে না। সম্ভবত ইতালি এবং জার্মানির ক্ষেত্রেও নয়। ইংল্যান্ডে এক সময় ক্রোমওয়েলের অধীনে ফ্যাসিবাদ ছিল। ফ্রান্সে ছিল নেপোলিয়নের অধীনে, এর কোনোটিই পরবর্তীকালে গণতন্ত্র আসতে প্রতিবন্ধক হতে পারে নি। রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্নে রাজনীতির ক্ষেত্রে অপরিপক্ক জাতি সর্বশ্রেষ্ঠ দিক নির্দেশক হতে পারে না।

ফ্যাসিবাদের প্রতি আপত্তি ক্যুনিজমের প্রতি আপত্তির চেয়ে সরল এবং এক হিসেবে আপত্তিগুলো আরো মৌলিক। সামগ্রিকভাবে কম্যুনিস্টদের লক্ষ্যের সঙ্গে আমি এক মত; আমি অমত পোষণ করি তারা যে উপায় অবলম্বন করতে চান সে ব্যাপারে। ফের বলি, তাদের লক্ষ্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। কিন্তু ফ্যাসিবাদীদের ক্ষেত্রে, তাদের উপায় ও উপেয়, উভয় ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে।

ফ্যাসিবাদ একটি জটিল আন্দোলন; এর জার্মান ও ইতালীয় আকৃতির মধ্যে ফারাক বিস্তর। অন্য কোনো দেশে যদি এর প্রসার ঘটে তবে সেখানে আরো ভিন্ন আকার নিতে পারে। তবে এর কিছু আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যা না থাকলে তা আর ফ্যাসিবাদ থাকবে না। ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রবিরোধী, জাতীয়বাদী, পুঁজিবাদী, এবং এই তন্ত্রের আবেদন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সেই অংশের প্রতি যারা আধুনিক উন্নয়নে ভোগান্তির শিকারে পরিণত হয়েছে এবং আশঙ্কা করে যে সমাজতন্ত্র কিংবা ক্যুনিজম প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের ভোগান্তি আরো বাড়বে। ক্যুনিজম ও গণতন্ত্রবিরোধী, তবে তা একটা সময়ের জন্য, অন্তত যতক্ষণ তাদের তাত্ত্বিক ঘোষণা প্রকৃত নীতি হিসেবে গ্রহণ করা চলবে, উপরন্তু ক্যুনিজমের লক্ষ্য হলো মজুরের সেবা করা, আর এই মজুররাই উন্নত দেশগুলোর সংখ্যাগুরু অংশ। কম্যুনিস্টরা চান সমগ্র জনগোষ্ঠী মজুর দ্বারা গঠিত হোক। ফ্যাসিবাদ আরো মৌলিক অর্থে গণতন্ত্রবিরোধী। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসেবে এরা বৃহত্তম সংখ্যার মহত্তম মঙ্গল নীতি গ্রহণ করে না। এরা কতিপয় ব্যক্তি, জাতি এবং শ্রেণিকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে নির্বাচন করে এবং এই নির্বাচিতদেরকেই শুধু বিবেচনায় আনে। অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীকে ঐ পছন্দ করা ব্যক্তিদের সেবার কাজে নিয়োজিত হতে বাধ্য করা হয়।

ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতা লাভের জন্য সংগ্রামকালে জনসংখ্যার একটা অংশের কাছে আবেদন রাখতে হয়। জার্মানি ও ইতালিতে ফ্যাসিবাদ মূল কর্মসূচির যা কিছু জাতীয়তাবাদ বিরোধী তা বর্জন করে সমাজতন্ত্রের ভেতর থেকে গজিয়ে উঠেছে। সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধির ধারণা ফ্যাসিবাদ গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই পরিকল্পনা সমগ্র জগতের উপকারের জন্য না হয়ে, একটি দেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থে কাজ করবে এবং এই স্বার্থ উদ্ধার করা হয় যত না দক্ষতা বাড়িয়ে তার চেয়ে বেশি মজুর ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অ-জনপ্রিয় অংশের উপর নিষ্পেষণের মাত্রা চড়িয়ে। যে শ্রেণিগুলো ফ্যাসিবাদের বদান্যতার পরিধির বাইরে অবস্থান করে তারা খুব বেশি হলে স্বপরিচালিত জেলখানায় বসবাসের সুযোগ পায়; ফ্যাসিবাদ এর চেয়ে বেশি কিছু করার ইচ্ছেও পোষণ করে না।

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তিই এখানে যে এই তন্ত্রে সমগ্র মানবতার একটি নির্বাচিত অংশকেই শুধু গুরুত্ব প্রদান করা হয়ে থাকে। সন্দেহ নেই, সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার শুরু থেকেই ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিরা বাস্তব ক্ষেত্রে অনুরূপ নির্বাচন করে আসছেন; কিন্তু খ্রিষ্টধর্ম তত্ত্বগতভাবে সবসময়ই মানবাত্মাকে স্বনির্ভর সত্ত্বা হিসেবে স্বীকার করেছে; এই সত্তা অপরকে গৌরবান্বিত করার হাতিয়ার নয়। আধুনিক গণতন্ত্র খ্রিষ্টধর্মের নৈতিক আদর্শ থেকে শক্তি লাভ করেছে এবং রাষ্ট্রের কর্ণধারদের ধনী ও শক্তিমানদের স্বার্থে একান্তভাবে মনোযোগ দেয়া থেকে ভিন্নমুখী করার ব্যাপারে অবদান রাখে। এক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ প্রাচীন প্যাগানবাদের জঘন্যতম আদর্শে প্রত্যাবর্তন।

ফ্যাসিবাদ সফল হলে পুঁজিবাদের অকল্যাণকর দিক প্রতিকারের জন্য কিছুই করবে; বরং পুঁজিবাদকে জঘন্য পর্যায়ে উন্নীত করবে। শ্রমিকদের বলপূর্বক কায়িকশ্রমে নিয়োগ করা হবে। তাদের জুটবে শুধু খোরাকি। এই শ্রমিকদের কোনো প্রকার রাজনৈতিক অধিকার থাকবে না, পছন্দ করা স্থানে থাকা ও কাজের স্বাধীনতা থাকবে না এবং সম্ভবত তাদের স্থায়ী পারিবারিক জীবনও থাকবে না; বস্তুতপক্ষে তারা ক্রীতদাসে পরিণত হবে। জার্মানি যেভাবে বেকার সমস্যার মোকাবিলা করে তাতে এই ব্যাপারগুলোর সূচনা হয়তো লক্ষ্য করা যেতে পারে। বাস্তবিকপক্ষে এটা গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত পুঁজিবাদের অনিবার্য ফল এবং রুশদেশে শ্রমিকের অনুরূপ দাসত্ব অবস্থা যে-কোনো প্রকার একনায়কতন্ত্রের অনিবার্য ফসল। অতীতে দেখা গেছে, স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে এসেছে ক্রীতদাসপ্রথা কিংবা ভূমিদাসত্ব।

ফ্যাসিবাদ সফল হলে এসবই ঘটবে। তবে এই তন্ত্র স্থায়ীভাবে সফল হবে না। কারণ ফ্যাসিবাদের পক্ষে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। নাৎসিদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো ভারিশিল্প, বিশেষ করে ইস্পাত এবং রসায়নশিল্প। ভারিশিল্প জাতিগতভাবে সংগঠিত হলে আজকের দিনে যুদ্ধ সূচনায় সর্বাধিক প্রভাব খাটায়। প্রত্যেক সভ্য দেশের সরকার যদি ভারি শিল্পের সেবাদাস হিসেবে কাজ করে, বর্তমানে তা ভালো মতোই হতে দেখা যাচ্ছে-তাহলে অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধ এড়ানো যাবে না। ফ্যাসিবাদের প্রত্যেক বিজয়ে যুদ্ধ নিকটে চলে আসে; আর যুদ্ধ যখন আসবে তখন ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বলে মনে হয়।

অবাধ বাণিজ্যনীতি, সমাজতন্ত্র কিংবা কম্যুনিজমের মতো ফ্যাসিবাদের কোনো সুশৃঙ্খল নীতিমালা নেই। মূলত এটি একটি আবেগতাড়িত প্রতিবাদ, অংশত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সেই সদস্যদের (যেমন ক্ষুদ্র দোকানদার) যারা আধুনিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত, এই ক্ষতির কারণ বিশৃঙ্খল শিল্পপতিগণ, যাদের ক্ষমতার লোভ নিজেদের শক্তিশালী মনে করাকে বাতিকে পরিণত করেছে। ফ্যাসিবাদ যুক্তিবিবর্জিত, এই কারণে যে এই তন্ত্র সমর্থকদের অভিলাষ পূরণ করতে পারে না। তাছাড়া ফ্যাসিবাদের কোনো দর্শন নেই। শুধু একটা মনঃসমীক্ষণ রয়েছে। এই তন্ত্র সফল হলে ফল দাঁড়াত সর্বগ্রাসী দুর্ভোগ। কিন্তু এই তন্ত্র যুদ্ধ সমস্যার সমাধান দিতে পারে না বলে দীর্ঘ সময়ের জন্য সফল হবে না।

আমি মনে করি না, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার ফ্যাসিবাদ গ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ এই দেশ দুটিতে প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের ঐতিহ্য এতটা প্রবল যে তা এটা অনুমোদন করবে না। সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এই বোধ কাজ করে যে জনগণের ব্যাপারের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে এবং রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের অধিকার হারাতেও সে ইচ্ছে করবে না। সাধারণ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন তাদের কাছে খেলাধুলার (যেমন ডার্বি) মতো ঘটনা, অতএব এসব না থাকলে জীবন নিরানন্দ হয়ে পড়বে। ফ্রান্স সম্পর্কে এত সুনিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ফ্রান্স যদি ফ্যাসিবাদ গ্রহণ করে তাহলে আমি অবাক মানবো। যুদ্ধের সময়ে সাময়িকভাবে ফ্যাসিবাদ গ্রহণ করতে পারে, তবে সেটা ব্যতিক্রমী ঘটনা হবে।

কিছু কিছু আপত্তি আছে-আমার কাছে এই আপত্তিগুলো তর্কাতীত, এবং কম্যুনিজম এবং ফ্যাসিজম উভয় তন্ত্রের ক্ষেত্রে তা সমানভাবে খাটে। উভয় তন্ত্রে একটা সংখ্যালঘু শ্রেণি পূর্বকল্পিত নক্সা অনুসারে জনগণকে বলপূর্বক ছাঁচে ঢেলে তৈরি করতে চায়। মানুষ মেশিন তৈরির জন্য বিভিন্ন উপাদানকে যে মূল্য দেয় ফ্যাসিবাদে জনগণের মূল্যও তদনুরূপ। প্রক্রিয়ার ভেতর উপাদানে অনেক পরিবর্তন আসে। কিন্তু যে পরিবর্তন ঘটে লক্ষ্য অনুসারে, অন্তর্নিহিত কোনো উন্নয়নের সূত্রে নয়। যেখানে প্রাণীকুল নিয়ে কথা, বিশেষত মানুষের ব্যাপারে, স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃদ্ধি নির্ধারিত ফল দেয়, ভিন্ন ফল হতে পারে শুধু বাধ্য করলে কিংবা জোর জবরদস্তির দরুন। জ্বণতত্ত্ববিদগণ দুই মাথা-ওয়ালা প্রাণী জন্ম দিতে পারে কিংবা এমন প্রাণী যার নাক এমন জায়গায় গজিয়েছে যেখানে পায়ের আঙুল থাকার কথা। কিন্তু এই দানবিকতা জীবনের জন্য খুব সুখকর নয়। অনুরূপভাবে ফ্যাসিস্ট এবং কমুনিস্টদের মনে সমাজের একটা সমগ্র চিত্র থাকার ফলে ব্যক্তিসত্তাকে দুমড়ে মুচড়ে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে চায়। যাদের ছাঁচের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত করে তোলা সম্ভব হয় না তাদের হত্যা করা হয় কিংবা পাঠিয়ে দেয়া হয় বন্দীশালায়। আমি মনে করি না যে, এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি, যা ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে অস্বীকার করে, নৈতিক বিচারে সমর্থনযোগ্য, এবং এটা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে সুফল হবে। গুল্ম কেটে-ছেটে ময়ূরের আকার দেয়া যেতে পারে, এবং অনুরূপ উৎপীড়ন দ্বারা একইভাবে মানুষকে বিকৃত রূপ দেয়া যায় কিন্তু গুল্ম মোচড়ানোর সময় নিষ্ক্রিয় থাকে, অপরদিকে মানুষ, একনায়কের অভিলাষ যাই হোক না কেন, সব সময় সক্রিয় থাকে, এক ক্ষেত্রে না হলেও অপর ক্ষেত্রে। মালির কাছ থেকে শেখা কাটা-ছাঁটার জন্য কাঁচি চালানোর বিদ্যা গুল্ম বিতরণ করতে পারে না, কিন্তু বিকৃত মানব সন্তান সব সময়ই অপেক্ষাকৃত বিনয়ী ব্যক্তিকে কাঁচি চালানো শেখাতে সমর্থ। কৃত্রিমভাবে ব্যক্তিচরিত্র তৈরির প্রতিক্রিয়া হয় জন্ম দেয় নিষ্ঠুরতা কিংবা ঔদাসীন্য, সম্ভবত উভয়ই পর্যায়ক্রমে জন্মে। এবং এই ধরনের চরিত্রগুণসম্পন্ন জনগণের কাছ থেকে কোনো ভালো কাজ আশা করা যায় না।

আরেক ব্যাপার হলো, একনায়কের উপর নৈতিক ফলশ্রুতি, যে সম্পর্কে ক্যুনিস্ট ও ফ্যাসিস্ট উভয় পক্ষই যথেষ্ট বিবেচনা করেন না। ধরা যাক, মানুষ হিসেবে একনায়ক যদি অত্যল্প মানবিক সহানুভূতিসম্পন্ন হন তাহলে তিনি প্রথমে খুবই নির্দয় হবেন এবং ব্যক্তিগত লক্ষ্য হাসিলের জন্য যে কোনো প্রকার নিষ্ঠুরতা করতে পিছপা হবেন না। তাত্ত্বিক কারণে মানুষকে ভুগিয়েছেন বলে তিনি শুরুতে যদি সহানুভূতি পোষণ করেন। তাহলে তাকে কঠোর চরিত্রের অধিকারী উত্তরসূরির কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে কিংবা নিজের মানবিক গুণাবলি কমিয়ে ফেলতে হবে। আর যদি তাই করেন তাহলে তিনি, যে ব্যক্তি সংগ্রাম করেন নি, তার চেয়ে বেশি ধর্ষকামী হয়ে উঠবেন। উভয় ক্ষেত্রে সরকার নির্দয় ব্যক্তিদের হাতে চলে যাবে, তাদের ক্ষমতাপ্রেম নির্দিষ্ট ধরনের সমাজ গড়ার অভিলাষের ছদ্মবেশ ধারণ করবে। স্বেচ্ছাতন্ত্রের অনিবার্য নিয়মে একনায়কতন্ত্রের প্রাথমিক লক্ষ্যের মধ্যে যা কিছু ভালো ছিল (থেকে থাকলে) তা ক্রমে ক্রমে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে এবং একনায়কের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা হয়ে দাঁড়াবে রাষ্ট্রযন্ত্রের নগ্ন লক্ষ্য।

যন্ত্রের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা জন্ম দিয়েছে, যাকে আমরা বলতে পারি, ম্যানিপুলেটরদের ফ্যালাসি। এতে ব্যক্তি ও সমাজকে নিষ্প্রাণ বস্তু গণ্য করা হয়, আর ম্যানিপুলেটরদের গণ্য করা হয় স্বর্গীয় সত্তা হিসেবে। মানুষ চিকিৎসায় পরিবর্তিত হয় এবং চিকিৎসক চিকিৎসার ক্রিয়াফল হিসেবে নিজেও বদলে যান। কাজেই সামাজিক গতিবিদ্যা অত্যন্ত দুরূহ বিজ্ঞান, একনায়ককে বোঝার জন্য এই বিজ্ঞান যতটা জানা প্রয়োজন আমরা তার চেয়ে কম জানি। সাধারণ মানিপুলেটরের কাছে, রুগীর স্বাভাবিক বৃদ্ধির অনুভূতি কৃশ হয়ে পড়ে; ফল কিন্তু তার আশানুরূপ হয় না, অর্থাৎ রুগী পূর্ব পরিকল্পিত প্যাটার্নে নিষ্ক্রিয়ভাবে মিশে যায় না বরং বৃদ্ধি হয় রুগ্নতা ও বিকৃতি এবং যে প্যাটার্ন জন্ম নেয় তা হাস্যকর ও বিকট। গণতন্ত্র এবং ধৈর্যের পক্ষে চূড়ান্ত মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি হলো, স্বাধীন বৃদ্ধি, চলাফেরার স্বাধীনতা এবং অ-প্রশিক্ষিত স্বাভাবিক জীবনযাপন আবশ্যিক, মানুষকে যদি বিকট দৈত্যে পরিণত হতে না হয়। সে যাই হোক, আমি যেমন বিশ্বাস করি, কম্যুনিস্ট এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র সমানভাবে অগ্রহণযোগ্য, তেমনি এই বোধটাও দুঃখজনক যে, ঐ দুটিকে একমাত্র বিকল্প মনে করা হয়, এবং গণতন্ত্রকে মনে করা হয় সেকেলে। যদি লোকেরা সে রকমই মনে করে তাহলে তারাও তাই হবে; অন্যরকম ভাবলে হবে না।

০৭. সমাজতন্ত্র কেন দরকার

বর্তমান কালে সমাজতন্ত্রীদের বিরাট সংখ্যাগুরু অংশ কার্ল মার্কসের শিষ্য, যার কাছ থেকে তারা এই বিশ্বাসটা গ্রহণ করেছেন যে, সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য একমাত্র সম্ভাব্য রাজনৈতিক শক্তি হলো উৎপাদনের উপায়ের অধিকারীদের প্রতি অধিকারচ্যুত সর্বহারার অনুভূত ক্রোধ। অনিবার্য প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যারা সর্বহারা নন, গুটিকয় ব্যতিক্রম বাদে, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, সমাজতন্ত্রকে ঠেকাতেই হবে এবং যখন তারা শুনতে পায় যে তাদের ঘোষিত শত্রুরা শ্রেণিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতায় থাকাকালেই নিজেরা যুদ্ধ সূচনার প্রবর্তনা অনুভব করেন। ফ্যাসিজম কম্যুনিজমের প্রত্যুত্তর মাত্র এবং কড়া প্রত্যুত্তরই বলতে হবে। যতদিন মার্কসীয় পরিভাষায় সমাজতন্ত্রের প্রচার করা হবে ততদিন এর বিরুদ্ধাচারণও হবে শক্তিশালী এবং উন্নত পশ্চিম বিশ্বে দিন দিন এর সাফল্য আরো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। অবশ্য ধনীরা সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করতই, কিন্তু সে বিরোধিতা হতো কম তীব্র ও কম ব্যাপক।

নিজের সম্পর্কে বলতে পারি, অত্যন্ত আগ্রহী মার্কসবাদীর মতোই আমি যদিও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী কিন্তু আমি সমাজতন্ত্রকে সর্বহারার প্রতিহিংসার বাণী গণ্য করি না। এমনকি, প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপায়ও মনে করি না। প্রাথমিকভাবে আমি সমাজতন্ত্রকে সাধারণ বুদ্ধিবিবেচনার তাগিদে যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সন্ধি করে চলার উপায় মনে করি। এই সমাজতন্ত্র মানুষের সুখ বাড়াবে তবে শুধু সর্বহারার নয়, মানববংশের একটা ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু অংশীবাদে, সবার। হিংসোন্মত্ত বিপ্লব ভিন্ন এর বাস্তবায়ন যদি বর্তমানে সম্ভব না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে প্রধানত এর হিংসাব্রত প্রবক্তাদের জন্যই তা হচ্ছে না। তবে আমি এখনও বিশ্বাস করি সুস্থ সমর্থন দ্বারা এর প্রতি বিরোধিতা নমনীয় করা যাবে, এবং আসন্ন পরিবর্তন কম বিপর্যয়কর করে তোলা সম্ভবপর হবে।

সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়ে আমরা শুরু করতে পারি। এই সংজ্ঞায় অবশ্যই দুটি অংশ থাকতে হবে, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক। অর্থনৈতিক অংশ থাকবে প্রকৃত অর্থনৈতিক ক্ষমতা রাষ্ট্রের মালিকানাধীন। অন্তর্ভুক্ত হবে ন্যূনপক্ষে ভূমি ও খনিজসামগ্রী, পুঁজি, ব্যাংকিং ক্রেডিট এবং বৈদেশিক বাণিজ্য। রাজনৈতিক অংশ হবে প্রকৃত রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক। স্বয়ং মার্ক্স এবং ১৯১৮ সালের আগের সকল সমাজতন্ত্রী কোনো প্রশ্ন না তুলে সমাজতন্ত্রের এই সংজ্ঞার সঙ্গে সম্মত হতেন, কিন্তু বলশেভিক দল কর্তৃক রুশ গণপরিষদ বিলুপ্তির পর থেকে একটা ভিন্ন মতবাদ জন্মলাভ করেছে। এই মতবাদ অনুসারে, বিপ্লবের মাধ্যমে যখন কোনো সমাজতন্ত্রী সরকার সাফল্য অর্জন করেছে তখন এর অনড় সমর্থকদেরই শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকবে। অবশ্য স্বীকার করতে হবে গৃহযুদ্ধের অব্যবহিত পরই পরাজিতদের সব সময় ভোটাধিকার প্রদান সম্ভব হয় না, কিন্তু অনুরূপ অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয়। যে সমাজতন্ত্রী সরকার সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক কর্মসূচি কার্যকরি করেছে, গণতান্ত্রিক সরকার সম্ভব করে তোলার জন্য যথেষ্ট জনপ্রিয় সমর্থন নিশ্চিত করার আগে তার কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয় যদি আমরা একটা চরম উদাহরণ স্মরণ করি। প্রাচ্যদেশীয় একজন স্বৈরশাসক ডিক্রি জারি করতে পারেন যে, তার রাজ্যের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের তিনি একক মালিক হবেন, কিন্তু এতে সমাজতান্ত্রিক শাসন কায়েম করা হবে না। কঙ্গোয় দ্বিতীয় লিওপোন্ড-এর শাসন অনুকরণযোগ্য মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। জনপ্রিয় নিয়ন্ত্রণ না থাকলে আশা করার কী যুক্তি থাকে যে রাষ্ট্র স্বীয় সমৃদ্ধি ভিন্ন অন্য কোনো কাজে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাবে। ফলে শোষণ শুধু নবরূপ লাভ করবে। অতএব সমাজতান্ত্রিক শাসনের সংজ্ঞার অংশ হিসেবে গণতন্ত্রকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।

উক্ত সংজ্ঞার অর্থনৈতিক অংশ ব্যাপারে আরো কিছু বলা দরকার; ব্যক্তিগত উদ্যোগের কোনো কোনো রূপ কারো কারো আছে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হবে, কেউ কেউ বিপরীত মত পোষণ করবেন। কোনো উদ্যোগী ব্যক্তিকে কি রাষ্ট্রের কাছ থেকে ভাড়া নেয়া একখণ্ড জমির উপর কাঠের গুদাম নির্মাণ করতে দেয়া উচিত হবে? হা, হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ব্যক্তি বিশেষকে নিউইয়র্ক শহরে স্কাইস্ক্রাপার নির্মাণ করতে দেয়া উচিত হবে। অনুরূপভাবে এক ব্যক্তি তার বন্ধুকে একটি শিলিং ধার দিতে পারেন। কিন্তু একজন অর্থের যোগানদার কোনো কোম্পানি কিংবা বিদেশি সরকারকে দশ মিলিয়ন পাউন্ড ধার দিতে পারেন না। ব্যাপারটা পরিমাণের এবং সহজেই তা মিটিয়ে ফেলা যায়, যেহেতু বড় ধরনের লেন-দেনের ব্যাপারে বিভিন্ন আইনগত নিয়ম-কানুন মেনে চলার দরকার আছে, কিন্তু ছোটোখাটো ব্যাপারে নয়। যেখানে নিয়ম-কানুন মেনে চলা অপরিহার্য, সেখানে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ দেয়। আর একটা উদাহরণ নেয়া যাক, অর্থনৈতিক অর্থে অলংকার পুঁজি নয়, কারণ অলংকার উৎপাদনের মাধ্যম নয়। কিন্তু কোনো ব্যক্তির যদি হিরক থেকে থাকে তবে সে তা বিক্রি করে কোম্পানির শেয়ার বা অংশীদারিত্ব ক্রয় করতে পারে। সমাজতন্ত্রের অধীনেও সে হিরকের অধিকারী হতে পারে, কিন্তু সে তা বিক্রি করে শেয়ার ক্রয় করতে পারবে না। কারণ বাজারে শেয়ার নামে কোনো বস্তু থাকবে না। ব্যক্তিগত সম্পত্তি আইন করে নিষিদ্ধ করার দরকার নেই। দরকার শুধু ব্যক্তিগত বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা। এতে যেহেতু কেউ মুনাফা লাভ করতে পারবে না, তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তি ক্রমান্বয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাবে, থাকবে শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজনে লাগে এমন কিছু সামগ্রী। অন্যের উপর প্রয়োগযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষমতা ব্যক্তির হাতে থাকা চলবে না। অর্থনৈতিক ক্ষমতাহীন ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকতে পারে।

সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফলে যে সুবিধাগুলো আশা করা যাবে (অবশ্য ধরে নিতে হবে ধ্বংসকারী বৈপ্লবিক যুদ্ধ ছাড়াই প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে) তা হবে বিভিন্ন ধরনের এবং তা কোনো ক্রমেই শুধু মজুর শ্রেণির জন্য হবে না। আমি একেবারেই নিশ্চিত নই এই সব সুবিধা বা এর যে কোনোটি দীর্ঘ জটিল শ্রেণিদ্বন্দ্বের ভেতর সমাজতান্ত্রিক দলের বিজয় দ্বারা লাভ করা যাবে। শ্রেণিদ্বন্দ্ব মেজাজ রুক্ষ করবে, নির্দয় সামরিক রূপ সম্মুখে নিয়ে আসবে, অনেক বিশেষ প্রতিভার অপচয় হবে মৃত্যুতে, কারাবাসে এবং নির্বাসনে; আর বিজয়ী সরকারের মানসিকতা হবে সেনানিবাসের। সমাজতন্ত্রের যে গুণাগুণ থাকবে বলে আমি দাবি করি তা থাকার জন্যই লোকজনকে আনতে হবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এবং প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে ক্ষুদ্র অসন্তুষ্ট শ্রেণিকে পরাস্ত করার জন্য। আমি নিশ্চিত যে, সমাজতান্ত্রিক প্রচারণা যদি কম ঘৃণা ও তিক্ততার সঙ্গে পলিচালনা করা যায়, আবেদনটা হিংসার দরবারে করা না হয়, করা হয় আর্থিক সংগঠনের সুস্পষ্ট প্রয়োজনের কাছে, তাহলে মানুষকে বোঝনোর কাজটা অনেক সহজ হবে। একই সঙ্গে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তাও হ্রাস পাবে। প্রবর্তনার ভেতর আইনগত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এমন বিষয়ের রক্ষা ব্যতিরেকে অন্য কোনো ব্যাপারে শক্তি প্রয়োগ আমি অনুমোদন করি না, কারণ (ক) এটা ব্যর্থ হওয়া সম্ভব (খ) এই সংগ্রাম হবে বিপর্যয়কর এবং ধ্বংসাত্মক এবং (গ) দুর্দম্য বিবাদের পর বিজয়ীরা তাদের সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য ভুলে যেতে পারেন এবং প্রতিষ্ঠা করতে পারেন একেবারে আলাদা জাতের শাসন, সম্ভবত সামরিক উৎপীড়নমূলক স্বেচ্ছাচারতন্ত্র। সুতরাং সফল সমাজতন্ত্রের শর্ত, আমার মতে, সংখ্যাগুরুকে উক্ত মতবাদ সম্পর্কে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বুঝিয়ে প্রতিষ্ঠা করা।

সমাজতন্ত্রের পক্ষে আমি নয়টি যুক্তি উপস্থাপন করব। যুক্তিগুলোর একটিও নতুন নয় এবং সবগুলোর গুরুত্বও সমান মনে করা যাবে না। তালিকা অনির্দিষ্টভাবে দীর্ঘ করা যায়, কিন্তু আমি মনে করি এই নয়টি যুক্তি প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, সমাজতন্ত্র শুধু একটি শ্রেণির স্বার্থে সৃষ্ট মতবাদ নয়।

১. মুনাফার অভিপ্রায়ের মূলোৎপাটন

পৃথক আর্থিক শ্রেণি হিসেবে মুনাফা শিল্প বিকাশের একটি নির্দিষ্ট স্তরে কেবল স্পষ্ট হয়। এর বীজাণু দৃশ্যমান হয় রবিনসন ক্রুসো এবং তার ম্যান ফ্রাইডের সম্পর্কের মধ্যে। ধরা যাক শরৎকালে রবিনসন ক্রুসো বন্দুকের সাহায্যে তার দ্বীপের সমগ্র খাদ্য সরবরাহের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছে। তাহলে সে এমন অবস্থায় আছে যে, সে এখন ফ্রাইডেকে দিয়ে পরবর্তী বছরের ফসল সংগ্রহের প্রস্তুতির জন্য কাজে লাগাতে পারবে। তবে কথা থাকবে যে ফ্রাইডের জীবন বাঁচিয়ে রাখা হবে এবং উদ্বৃত্ত শস্য নিয়োগকর্তার গোলায় উঠবে। এই চুক্তিবলে রবিনসন ক্রুসো যা পাবে তা তার বিনিয়োগকৃত পুঁজি ও সুদ হিসেবে গণ্য করা চলে। তার পুঁজি হলো কতকগুলো যন্ত্রপাতি এবং তার অধিকারে সংরক্ষিত খাদ্য। কিন্তু মুনাফা, সভ্য দেশগুলোতে, এর চেয়েও অধিক বিনিময়ের মাধ্যমে ঘটে। উদাহরণত একজন সুতা প্রস্তুতকারক তার নিজের এবং পরিবারের জন্য শুধু সুতা উৎপাদন করে না। আর সুতাই তার একমাত্র দরকারি সামগ্রী নয়, তৈরি সুতার একটা বড় অংশ অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য তাকে বিক্রি করতে হয়। আবার সুতা তৈরির আগে তাকে অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করতে হয়। তুলা, যন্ত্রপাতি, শ্রম, বিদ্যুৎ। এই সব সামগ্রী ক্রয়ের জন্য তিনি যা ব্যয় করেন এবং তৈরি সামগ্রী বিক্রি করে যা লাভ করেন সেই ব্যবধানটা তার মুনাফা হিসেবে থাকে। কিন্তু তিনি যদি কারখানা নিজেই পরিচালনা করেন তাহলে একজন ব্যবস্থাপক রাখলে তাকে যে মাইনে দিতে হতো সেই পরিমাণটা বাদ দিয়ে ধরতে হবে; অর্থাৎ কল্পিত ব্যবস্থাপকের মজুরি বাদ দিয়ে পুরো আয়টা প্রস্তুতকারকের মুনাফা হবে। বড় বড় ব্যবসায়, যেখানে অংশীদারগণ ব্যবস্থাপনায় শ্রম দেন না, তারা যা লাভ করেন, সেটা হলো উদ্যোগের ফলে আহরিত মুনাফা। যাদের বিনিয়োগ করার মতো টাকা রয়েছে তারা মুনাফার আশায় প্রলুব্ধ হন। এই মুনাফা প্রত্যাশাই নতুন কি উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এবং কোন উদ্যোগ সম্প্রসারণ করা হবে তার নির্ধারক অভীপ্সা হিসেবে কাজ করে। বর্তমান ব্যবস্থার সমর্থকগণ মনে করেন মুনাফার প্রত্যাশাই সাময়িকভাবে সঠিক সামগ্রী সঠিক পরিমাণে উৎপাদন সম্ভব করে তুলবে। পূর্বে একটা সীমা পর্যন্ত এই ধারণার সত্যতা ছিল, কিন্তু এখন ব্যাপারটা অন্যরকম।

বস্তুত এটা আধুনিক উৎপাদনের জটিল বৈশিষ্ট্যের ফল। আমি যদি সেকেলে গ্রাম্য মুচি হই এবং প্রতিবেশীরা আমার কাছে তাদের জুতো নিয়ে আসে সংস্কার বা মেরামতের জন্য, তাহলে আমি জানবো যে আমার শ্রমের চাহিদা আছে; কিন্তু আমি যদি বড় ধরনের জুতো প্রস্তুতকারক হই, দামি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি, তাহলে আমাকে অনুমান করতে হবে কত জোড়া জুতো আমি বিক্রি করতে পারবো। এবং আমি সহজেই ভুল অনুমান করে বসতে পারি। আর অপর একজনের উন্নততর যন্ত্রপাতি থাকতে পারে এবং সে সস্তায় অধিক সংখ্যক জুতো বিক্রি করতে পারে; কিংবা আগের ক্রেতারা দরিদ্র হয়ে যেতে পারেন এবং তারা শিখে নিতে পারেন জুতো কত বেশি দিন ব্যবহার করা যায়, কিংবা ফ্যাশনও বদলে যেতে পারে এবং জনগণের চাহিদা এমন ধরনের জুতোর জন্য হতে পারে যে ধরনের জুতো আমার যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি করা সম্ভব নয়। এর কোনো একটি ঘটলে শুধু আমার মুনাফা লাভ বন্ধ হবে না। আমার যন্ত্রপাতি নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকবে এবং আমার কারখানায় নিয়োজিত কর্মীরা হয়ে পড়বে বেকার। আমার যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য যে শ্রম নিয়োগ করা হয়েছিল তা প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং ঐ শ্রম এতটা অপচয়িত হয়েছে যে, এর সঙ্গে সাগরে বালু নিক্ষেপের তুলনা চলতে পারে। যে লোকদের বেকারে পরিণত করা হলো তারা মানুষের প্রয়োজনে লাগার মতো আর কিছু সৃষ্টি করতে পারছে না এবং ঐ সম্প্রদায় এতটা দীন-দরিদ্র হয়ে পড়ে যে অতঃপর এদের পিছনে ব্যয় করা হয় শুধু তাদের অনাহার থেকে রক্ষার জন্য। লোকগুলো মজুরির পরিবর্তে বেকার ভাতার উপর নির্ভরশীল বলে আগের চেয়ে অনেক কম খরচ করে, এতে উৎপাদক শ্রেণিতে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কারণ এখন আর লোকগুলো তাদের উৎপাদিত পণ্য ক্রয়ে সমর্থ নয়। সুতরাং আমি যে এত জোড়া জুতো বিক্রি করে মুনাফা লাভ করতে পারবো মনে করে গোড়াতেই যে ভুল হিসেব করেছিলাম তা ক্রমান্বয়ে বেকারের সংখ্যা বাড়াতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে ঘটে চাহিদার হ্রাস। নিজের সম্পর্কে বলা যায়, দামি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ব্যাপারে আমি শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি, আমার সমস্ত পুঁজি ও আর্থিক সামর্থ নিঃশেষ করেছি। ফলে হঠাৎ করে জুতো তৈরির ব্যবসা ছেড়ে সমৃদ্ধতর শিল্পে নিয়োজিত হওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।

কিংবা আরো ঝুঁকিপূর্ণ একটা ব্যবসার কথা ধরা যাক : জাহাজ নির্মাণ। যুদ্ধ চলাকালে, কিছুকালের জন্য যুদ্ধান্তেও, জাহাজের প্রচুর চাহিদা ছিল। যেহেতু কেউ জানতেন না যে যুদ্ধ কতদিন চলবে কিংবা ইউ-বোট কতটা কার্যকরভাবে সফল হবে, তাই অভূতপূর্ব সংখ্যক জাহাজ নির্মাণের জন্য খুবই ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। ১৯২০ সালের মধ্যে জাহাজের ঘাটতি পূরণ করা হয় এবং জাহাজের প্রয়োজনীয়তা সামুদ্রিক বাণিজ্য হ্রাসের ফলে হঠাৎ করে কমে যায়। প্রায় সকল জাহাজ নির্মাণ কারখানা অব্যবহার্য হয়ে পড়ে এবং কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বৃহত্তর অংশ বেকারে পরিণত হয়। এটা বলা যায় না যে তাদের এই দুর্ভাগ্যে পতিত হওয়া উচিত ছিল, যেহেতু সরকারই চেয়েছে তারা যত দ্রুত সম্ভব জাহাজ তৈরি করুক। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগপ্রথার অধীনে যারা নিঃস্ব হলো তাদের প্রতি সরকার স্বীকৃত কোনো দায়িত্ব নেই। এতে দরিদ্র সম্প্রসারিত হওয়া অনিবার্য। ঐ সময় ইস্পাতের চাহিদা কম ছিল। সুতরাং লৌহ এবং ইস্পাত শিল্প মার খায়। অস্ট্রেলীয় এবং আর্জেন্টাইন মাংসের চাহিদাও কম ছিল, কারণ বেকারত্বের জন্য ডাল-ভাত খেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। ফলে মাংসের বদলে অস্ট্রেলিয়া এবং আর্জেন্টিনা যেসব সামগ্রী নিয়েছে তার চাহিদা হ্রাস পায়। এবং এই ব্যাপারটা অনির্দিষ্টভাবে চলতে থাকে।

বর্তমান কালে মুনাফা লাভেচ্ছার ব্যর্থতার আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে, আর সেটা হলো অপ্রাচুর্যের ব্যর্থতা। অনেক সময় দেখা যায় কোনো কোনো পণ্য প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা চলে, দামও কম থাকে। কিন্তু মাঝারি পরিমাণে উৎপাদন করলে দাম কম রাখা যায় না। তাহলে সেক্ষেত্রে উৎপাদনের মিতব্যয়ী উপায় হবে সারা জগতে প্রত্যেক পণ্যের জন্য একটি কারখানা থাকা। কিন্তু অবস্থাটা যেহেতু একবার নয় ক্রমে-ক্রমে সৃষ্টি হয়েছে, অতএব বাস্তবে রয়ে গেছে প্রত্যেক পণ্যের জন্য অনেকগুলো কারখানা। প্রত্যেকেই জানেন তার কারখানাটিই যদি জগতের একমাত্র কারখানা হতো তবে সেখান থেকে সবার জন্য সরবরাহ সম্ভব হতো, মুনাফাও হতো বড় রকমের। কিন্তু এখন অবস্থা যা, একাধিক প্রতিযোগী, কেউ পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করতে পারছে না, ফলে কারো মুনাফার নিরাপত্তা নেই। এই অবস্থাটাই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। যেহেতু মুনাফা লাভের একমাত্র সম্ভাবনা থেকে যায় একটা বিরাট বাজার একান্ত নিয়ন্ত্রণে রাখার উপর। ইতোমধ্যে দুর্বলতার প্রতিযোগীরা হয়ে পড়ে দেউলিয়া, এদের কারখানা যত বড় হয় বন্ধ হয়ে যাবার পর স্থানচ্যুতি ঘটে তত বিরাট আকারে। প্রতিযোগিতার দরুন এত অধিক পরিমাণে উৎপাদন করা হয় যে বিক্রি থেকে কোনো মুনাফা থাকে না। কিন্তু সরবরাহ হয় হ্রাস অথবা মন্থর, কারণ যেখানে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানে নির্দিষ্ট কয়েক বছরের জন্য ক্ষতি দিয়ে উৎপাদন চালু রাখা উৎপাদন একেবারে বন্ধ করার চেয়ে কম বিপর্যয়কর।

আধুনিক বৃহদায়তন কারখানা ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের ঈপ্সা দ্বারা পরিচালিত হতে দেয়ার ফলশ্রুতি এই সব বিশৃঙ্খলা ও স্থানচ্যুতির ঘটনা।

পুঁজিবাদী শাসনে, কোন নির্দিষ্ট সামগ্রী কোন নির্দিষ্ট কারখানা উৎপাদন করবে তা নির্ণয়ের খরচ কারখানার মালিককে বহন করতে হয়, সম্প্রদায় করে না। একটা উদাহরণ সহযোগে পার্থক্যটা বোঝানো যেতে পারে। ধরা যাক জনৈক ভদ্রলোককে, ধরুন তার নাম মিঃ হেনরি ফোর্ড-এমন কম খরচে গাড়ি তৈরির উপায় উদ্ভাবন করেছেন যে অপর কারো পক্ষে প্রতিযোগিতায় নামা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে ফল দাঁড়ায় এই যে গাড়ি তৈরির কাজে নিয়োজিত বাকি সকল কারখানা দেউলে হয়ে পড়ে। নতুন সস্তা গাড়ি তৈরির সম্প্রদায়ের খরচে পৌঁছার জন্য আপনাকে মিঃ ফোর্ডকে যে পরিমাণ খরচ করতে হয় তার সঙ্গে সমানুপাতে যোগ করতে হবে বর্তমানে অকেজো অপরের মালিকানাধীন সকল কারখানা, তৎসঙ্গে যোগ করতে হবে পূর্বে অপরের কারখানায় কাজ করেছেন কিন্তু বর্তমানে বেকার কর্মী এবং ব্যবস্থাপকদের লালন পালন ও শিক্ষার খরচ। (কেউ কেউ ফোর্ডের কারখানায় কাজ নেবে। কিন্তু সম্ভবত সবাই নেবে না। কারণ নতুন পদ্ধতিতে খরচ আরো কম পড়ে সুতরাং অতিরিক্ত শ্রমিকদের দরকার করে না)। সম্প্রদায়ের আরো কিছু ক্ষেত্রে খরচের দরকার করবে-যেমন শ্রমবিরোধ, ধর্মঘট, দাঙ্গা, বাড়তি পুলিশ, বিচার ও কারাবাস। এইসব যখন হিসেবে ধরা হবে তখন হয়তো দেখা যাবে পুরাতন গাড়ি তৈরির চেয়ে নতুন গাড়ি তৈরি করতে গিয়ে প্রথম দিকে সম্প্রদায়ের খরচ অনেক বেশি পড়ছে। এখন ঘটনা হলো সম্প্রদায়ের খরচই নির্ধারণ করে সামাজিকভাবে কোনটা সুবিধাজনক। অপরপক্ষে ব্যক্তিমালিকানায় প্রস্তুতকারকের খরচ নির্ধারণ করে, আমাদের ব্যবস্থায়, যা ঘটে থাকে।

সমাজতন্ত্র এইসব সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করে তা পরবর্তী পর্যায়ে আমি ব্যাখ্যা করবো।

২. অবসরের সম্ভাবনা

যন্ত্রাদির উৎপাদনশীলতার দরুন মানববংশের আরাম-আয়েশের মান মোটামুটি পর্যায়ে বজায় রাখার জন্য আগের চেয়ে অনেক কম কাজ করার দরকার হয়। কিছু সতর্ক লেখক মনে করেন প্রতিদিন ঘণ্টা খানেকের কাজই যথেষ্ট, কিন্তু এই হিসেবটা এশিয়া মহাদেশের জন্য হয়তো যথেষ্ট নয়। আমি একটু বেশিই সতর্কতা অবলম্বন করে অনুমান করছি, যদি সকল বয়স্ক লোক দিনে চার ঘণ্টা কাজ করেন তবে বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন জনগণ বাস্তব সুখের জন্য যা কিছু কামনা করেন তা উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট হবে।

বর্তমানে, যাহোক, মুনাফা লাভেচ্ছার জন্য অবসর সমানভাবে বিতরণ সম্ভব হচ্ছে না; অনেকের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়, অনেকে একেবারে কর্মহীন, বেকার। এর ফলাফল দাঁড়ায় এই রকম; নিয়োগকর্তার কাছে মজুরের মূল্য সে কতটা কাজ করেছে। তার উপর নির্ভরশীল, যা যতক্ষণ সাত কি, আট ঘণ্টা অতিক্রম না করছে, নিয়োগকর্তা কর্তৃক ধরে নেয়া হয় যে তা কর্মদিবসের দৈর্ঘ্যের সমানুপাতিক হতে হবে। অপরপক্ষে, মজুরও মনে করে কম সময় কাজ করে কম মজুরি পাওয়ার চেয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করে ভালো মজুরি পাওয়া অধিকতর লাভজনক। ফলে দীর্ঘ কর্মদিবস উভয় পক্ষের কাছে উপযোগী মনে হয়, ফলে যারা বেকার তারা থাকে অনাহারে অথবা তাদের জনগণের খরচে ভরণপোষণ করতে হয়।

যেহেতু বর্তমানে মানববংশের সংখ্যাগুরু অংশ ন্যায়সঙ্গত স্বাচ্ছন্দের স্তরে পৌঁছতে পারে না তাই এখন প্রয়োজনে এবং সাধারণ স্বাচ্ছন্দের জন্য যতটা উৎপাদন করা হয় সেই পরিমাণ সামগ্রী উৎপাদনের জন্য বিজ্ঞতার সঙ্গে দিনে গড়ে চার ঘণ্টার কম সময় কাজ করলেই যথেষ্ট হবে। এর অর্থ হলো, কর্মরত ব্যক্তির গড় কর্মদিবস যদি আট ঘণ্টা হয় তাহলে অর্ধেক সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে, অযোগ্যতা এবং অপ্রয়োজনীয় উৎপাদনের জন্য না হলেও। প্রথমে অযোগ্যতার ব্যাপারটা ধরা যাক; আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি প্রতিযোগিতার দরুন কী রকম অপচয় হয়। কিন্তু এর সঙ্গে যোগ করতে হবে বিজ্ঞাপনের জন্য যাবতীয় ব্যয় এবং বিপণনের জন্য নিয়োজিত যত দক্ষ শ্রম। জাতীয়তাবাদ আরো এক ধরনের অপচয়ের জন্য দায়ী। উদাহরণত, মার্কিনী গাড়ি নির্মাতারা শুল্কের কারণে ইউরোপের প্রধান শহরগুলোতে কারখানা স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে, অথচ যুক্তরাষ্ট্রেই যদি তারা সুবৃহৎ কারখানায় সব কটা গাড়ি নির্মাণ করত তাহলে স্পষ্টতই প্রচুর শ্রম বেঁচে যেত। তাছাড়া সমরাস্ত্র নির্মাণে অপচয় হয়, সামরিক প্রশিক্ষণে অপচয় হয়। যেখানে সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক সেখানে তো গোটা পুরুষ জনসংখ্যা জড়িত হয়ে পড়ে। তবে এইসব অপচয় এবং আরো নানা ধরনের অপচয় এবং ধনবানের বিলাসিতার ফলে জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি আজ কর্মে নিয়োজিত। তবে যতদিন চলতি ব্যবস্থা চালু থাকবে অপচয় নিবারণের প্রতিটি পদক্ষেপ শুধু মজুর শ্রেণির দুরবস্থা এখনকার চেয়েও খারাপ করবে।

. অর্থনৈতিক নিরাপত্তা

দুনিয়ার বর্তমানে যা অবস্থা তাতে শুধু বহুসংখ্যক লোকই নিঃস্ব নয়, সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর মধ্যে যারা নিঃস্ব নয় তারাও সম্পূর্ণ ন্যায়সংগতভাবে এই ভয়তাড়িত যে তারা যে কোনো মুহূর্তে নিঃস্ব হতে পারেন। মজুরশ্রেণি সব সময় বেকার হওয়ার বিপদ দেখে; বেতনভোগীরা জানেন যে তাদের কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে, কিংবা কোম্পানি কর্মীর সংখ্যা কমিয়ে ফেলতে পারে ব্যবসায়ী শ্রেণি, যারা ধনী হিসেবে খ্যাত, জানেন যে তাদের সমস্ত টাকা বিনষ্ট হওয়া অসম্ভব নয়। পেশাজীবীরা কঠিন সংগ্রামের ভেতর আছেন। পুত্র-কন্যাদের শিক্ষার জন্য বিরাট আত্মত্যাগ স্বীকার করার পর তারা দেখতে পাচ্ছেন তারা যে দক্ষতা অর্জন করেছেন সে দক্ষতার জন্য আগে যে চাকুরি ছিল এখন তা নেই। তারা যদি আইনজীবী হন, তবে তারা দেখতে পান জনগণের আদালতে যাওয়ার আর্থিক ক্ষমতা নেই, যদিও গুরুতর অন্যায় প্রতিকারহীন থেকে যাচ্ছে তারা ডাক্তার হলে দেখতে পান তাদের পূর্বেকার বেশ লাভজনক বিষাদাক্রান্ত রোগীরা আর অসুস্থ হওয়ার সাহস করছেন না; যদিও প্রকৃত রোগভোগীদের অতি-প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ছাড়াই চলতে হচ্ছে। দেখতে পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত নারী-পুরুষ দোকানের গোমস্তার কাজ করছেন, এতে হয়তো তারা নিঃসম্বল হওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছেন, কিন্তু পরিণামে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আগে উক্ত কাজগুলো যারা করতেন। নি পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায়ের সকল শ্রেণির অর্থনৈতিক ভীতি পুরুষ মানুষের দিনের ভাবনা ও রাতের স্বপ্ন শাসন করে। ফলে তার কাজ স্নায়ু খুঁড়ে খায়, তার কাছে অবসর প্রফুল্লকর লাগে না। আমি মনে করি সদাপ্রস্তুত এই সন্ত্রাসই পাগলাটে মেজাজের প্রধান কারণ, যা সভ্য দুনিয়ায় বিরাট অংশে বিস্তার লাভ করেছে।

প্রায় ক্ষেত্রেই সম্পদের ঈপ্সা জাগে নিরাপত্তার ঈপ্সা থেকে। মানুষ টাকা সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করে এই আশায় যে বৃদ্ধ বয়সে এবং হীনবল হলে তারা চলতে পারবে এবং তাদের সন্তানদেরও সামাজিক স্তরের নিচে নামতে হবে না। আগের দিনে এই প্রত্যাশা ছিল যুক্তিপূর্ণ, যেহেতু তখন নিরাপদ বিনিয়োগ নামক একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু বর্তমানে নিরাপত্তা বিধানের কোনো ব্যবস্থা নেই; বড়-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পথে বসে; রাষ্ট্র হয় দেউলে, এবং যা কিছু এখনও অস্তিত্বশীল পরবর্তী যুদ্ধে তা ভেসে যাবে। ফলশ্রুতি, অসুখী উদাসীন মেজাজ, যা সম্ভাব্য প্রতিকার সম্পর্কে সুস্থ বিবেচনা কঠিন করে তোলে।

সম্ভাব্য যে কোন প্রকার পরিবর্তনের চেয়ে, যুদ্ধ প্রতিরোধ বাদ দিয়ে, আর্থিক নিরাপত্তা সভ্য সমাজের সুখ বৃদ্ধিতে অধিক সাহায্য করবে। সামাজিক প্রয়োজনের জন্য যতটুকু কাজ করা দরকার তা সকল স্বাস্থ্যবান বয়স্ক ব্যক্তির জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে, কিন্তু তাদের আয় নির্ভর করবে শুধুমাত্র তাদের কাজ করার ইচ্ছার উপর এবং যখন সাময়িকভাবে কোনো কারণে তাদের কাজের দরকার হবে না তখনও তার আয় বন্ধ করা যাবে না। উদাহরণত, একজন চিকিৎসক নির্দিষ্ট মাইনে পাবে, তার মৃত্যুর পরই শুধু ঐ মাইনে বন্ধ হয়ে যাবে। এবং প্রত্যাশা করা হবে না নির্দিষ্ট বয়সের পরও সে কাজ করবে। আর তাকে নিশ্চিত হতে হবে যে তার সন্তানাদি উপযুক্ত শিক্ষা পাবে।

সমাজের স্বাস্থ্য যদি এতটা উন্নত হয়ে যায় যে, সব কজন যোগ্য ডাক্তারের চিকিৎসা সেবার দরকার আর করে না তাহলে কতিপয় ডাক্তারকে চিকিৎসা গবেষণা কিংবা স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থার উন্নতিসাধনের জন্য অনুসন্ধান অথবা আরো প্রয়োজন অনুসারে খাদ্যের উন্নতির কাজে নিয়োগ করতে হবে। আমি মনে করি না যে এতে কোনো সন্দেহ আছে ডাক্তারদের বিরাট সংখ্যাগুরু অংশ আগের ব্যবস্থার চেয়ে বর্তমান ব্যবস্থায় আরো সুখী হবেন। অতি সফল কতিপয় ডাক্তারের আয় যদি কিছুটা কমেও যায় তবু এর ব্যত্যয় হবে না।

অতিমাত্রায় সম্পদের লিঙ্গ কোনো মতেই কাজের উদ্দীপনা হতে পারে না। বর্তমানে অধিকাংশ লোক ধনী হওয়ার জন্য নয়, অনাহার এড়ানোর জন্য কাজ করে। একজন ডাক পিয়ন অপর ডাক-পিওনের চেয়ে বেশি ধনী হওয়ার প্রত্যাশা করে না, একজন সৈনিক কিংবা নৌসেনা দেশের সেবা করে বিরাট টাকা পয়সার মালিক হতে চায় না। সত্য যে, সমাজে কিছু লোক থাকেন যারা অত্যন্ত উদ্যোগী এবং তারা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হতে চান, এদের কাছে প্রধান লক্ষ্যই হলো আর্থিক ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য। কেউ সমাজের মঙ্গল করেন, কেউ অমঙ্গল, কেউ কেউ করেন তৈরি কিংবা গ্রহণ করেন ব্যবহার্য উদ্ভাবন, কেউ কেউ শেয়ার বাজার স্বীয় সুবিধার জন্য কাজে লাগান কিংবা রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলেন। কিন্তু প্রধানত তাদের অভিপ্রায় হলো সাফল্য অর্জন। আর সাফল্যের প্রতীক হলো টাকা। যদি অন্য কোনো আকারে সাফল্য লাভ সম্ভব হতো যেমন সম্মান কিংবা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ লাভ করে, তবু তাদের মধ্যে পর্যাপ্ত উৎসাহ কাজ করত এবং বর্তমানে যা করছে তা না করে সমাজের সুবিধার জন্য কাজ করতেন। সাফল্যের বাসনা নয়, শুধু সম্পদের জন্যই সম্পদের লিপ্সা, সমাজের জন্য কোনো কাজে লাগে না, এটা অতিরিক্ত আহার কিংবা পানীয় গ্রহণের চেয়েও বেশি কিছু নয়। অতএব যে সমাজ ব্যবস্থায় এই বাসনা প্রকাশের পথ নেই সেই সমাজব্যবস্থা ততটা খারাপ নয়। অপরপক্ষে যে সমাজব্যবস্থা নিরাপত্তাহীনতা দূর করেছে যে সমাজ আধুনিক জীবনধারার বাজে ভাবাগেব অনেকটাই দূর করবে।

৪. বেকার ধনী

মজুরশ্রেণির মধ্যে বেকারত্ব দেখা দিলে যে অকল্যাণ হয় তা সাধারণভাবে স্বীকৃত। নিজেদের ভোগান্তি হয়, সমাজের জন্য তার শ্রম কাজে লাগানো গেল না এটা একটা ক্ষতির দিক, এবং অনেককাল কর্মহীন থাকার ফলে তার মনোবল নষ্ট হয়ে যায়, এগুলো এতই পরিচিত বিষয় যে এ নিয়ে বেশি কিছু বলার দরকার করে না।

কিন্তু বেকার ধনীরা ভিন্ন ধরনের অকল্যাণ। জগৎ অলস ব্যক্তি দ্বারা পরিপূর্ণ। বিশেষ করে নারীশ্রেণি, যারা সামান্যই শিক্ষা লাভ করেছে, এদের টাকাপয়সার প্রাচুর্য, ফলে এরা বিরাট আত্মবিশ্বাসের অধিকারী। যদিও এদের প্রকৃত কৃষ্টি থাকার ঘটনা বিরল, অথচ এরাই শিল্পকলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এই শিল্পকলা বাজে ধরনের না হলে তাদের আনন্দ লাভের সম্ভাবনা কমই থাকে। তাদের অব্যবহার্যতা তাদের অবাস্তব ভাবাবেগের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে তারা সতেজ আন্তরিকতা অপছন্দ করে এবং কৃষ্টির উপর অবাঞ্ছনীয় প্রভাব খাটায়। বিশেষত আমেরিকায় যে তোক টাকা উপার্জন করে সে নিজেই উক্ত টাকা ব্যয়ের জন্য ব্যস্ত থাকে; কৃষ্টি প্রধানত পরিচালিত হয়। মহিলাদের দ্বারা, যাদের মর্যাদার প্রতি একমাত্র দাবি এই যে, তাদের স্বামীদের আয়ত্তে রয়েছে ধনী হওয়ার কৌশল। অনেকে মনে করেন সমাজতন্ত্রের চেয়ে পুঁজিবাদ শিল্পকলার অনেক বেশি অনুকূলে, তবে আমি মনে করি এরা শুধু স্মরণ করেন অতীত জামানার অভিজাততন্ত্র এবং চলতিকালের ধনীকতন্ত্র ভুলে থাকেন।

অলস ধনীর অস্তিত্ব আরো কিছু দুর্ভাগ্যজনক ফলাফলের জন্ম দেয়। যদিও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ শিল্প কারখানাগুলোতে আধুনিক ঝোঁক হলো ছোট ছোট অনেক নয়, গুটিকয় বৃহৎ উদ্যোগের দিকে, তবে কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, লন্ডনের অপ্রয়োজনীয় ক্ষুদ্র দোকানগুলো। যে সব এলাকায় ধনী মহিলারা কেনাকাটা করেন সেখানে অসংখ্য টুপির দোকান রয়েছে, সাধারণত এই দোকানগুলোর মালিক। রাশিয়ান কাউন্টেসরা। প্রত্যেকেই দাবি করেন তাদের টুপিগুলো অন্যান্য দোকনের টুপির চেয়ে সুন্দর। এদের খদ্দেররা এক দোকান থেকে অপর দোকনে ছোটাছুটি করে, কয়েক মিনিটের কেনাকাটার কাজে ব্যয়িত হয় কয়েক ঘণ্টা। দোকানগুলোর শ্রমিকের সময় যেমন অপচয়িত হয় তেমনি খরিদ্দারের। আরো একটা অকল্যাণ এই হয় যে, কিছু সংখ্যক লোকের জীবিকা কোনো কাজে লাগে না। অত্যন্ত ধনী ব্যক্তিদের খরচ করার ক্ষমতা থাকার দরুন তারা বিরাট সংখ্যায় পরান্নভোজী পোষে। এরা নিজেরা সম্পদ থেকে যত দূরেই অবস্থান করুন না কেন, তবু ভয় পায় অলস ধনী না থাকলে তাদের পণ্য বিক্রি হতো না এবং তারা সর্বস্বান্ত হয়ে যেত।

নির্বোধ শ্রেণির লোকের ভঙ্গুর ক্ষমতার উপর নির্ভরতার জন্য এইসব ভোগান্তি হয় নৈতিক, বুদ্ধিগত এবং শৈল্পিকভাবে।

৫. শিক্ষা

বর্তমানে উচ্চতর শিক্ষা, সর্বাংশে না হলেও, প্রধানত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সন্তানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সত্য যে, কখনো কখনো ছাত্রবৃত্তির বদৌলতে শ্রমিক শ্রেণির সন্তানরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারে, কিন্তু এর জন্য তাদের এত কঠোর পরিশ্রম করতে হয় যে তারা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং প্রথম জীবনের প্রতিশ্রুতি কার্যে পরিণত করতে পারে না। আমরা যে অবস্থা গড়ে তুলেছি তাতে সমর্থতার বিরাট অপচয় হয়; মজুর শ্রেণির অভিভাবকের কোনো ছেলে বা মেয়ের অংকে, সংগীতে কিংবা বিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণির সমর্থতা থাকতে পারে, কিন্তু সে তার প্রতিভা কাজে লাগানোর সুযোগ কমই পেয়ে থাকে। উপরন্তু শিক্ষাদর্শ, অন্তত ইংল্যান্ডে, এখন আগাগোড়া চালবাজি সংক্রামিত: ব্যক্তি-পরিচালিত এবং প্রাথমিক স্কুলগুলোতে ছাত্ররা স্কুল জীবনের প্রতি মুহূর্তে শ্রেণি চেতনা মনে গেঁথে নেয়। আর যেহেতু শিক্ষা ব্যাপারটা প্রধানত রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে, তাই রাষ্ট্র স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে, ফলে যতদূর সম্ভব যুবক শ্রেণির বিচার ক্ষমতা ভোঁতা করে দেয় এবং তাদেরকে দুঃসাহসিক ভাবুকতা থেকে রক্ষা করে। অনুমোদন করতে হবে যে, যে কোনো নিরাপত্তাহীন শাসনে এসব হতে বাধ্য এবং এই ব্যাপারটা ইংল্যান্ড ও আমেরিকার চেয়ে রুশদেশে আরো খারাপ। যদিও সমাজতান্ত্রিক শাসন এক সময় যথেষ্ট নিরাপদ হয়ে যেতে পারে, তখন সমালোচনার ভয় আর করবে না। কিন্তু পুঁজিবাদী শাসনের বর্তমান অবস্থায় এটা হওয়া প্রায় অসম্ভব, ক্রীতদাস রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তো ভিন্ন ব্যাপার, সেখানে মজুর শ্রেণি কোনো শিক্ষাই পাবে না। সুতরাং এটা আশা করা যায় না যে, শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান ত্রুটিগুলোর প্রতিকার করা যাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়াই।

৬. নারীমুক্তি এবং শিশু-কিশোরদের কল্যাণ

সাম্প্রতিক কালে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য অনেক কিছু করা হয়েছে, তা সত্ত্বেও স্ত্রীদের সংখ্যাগুরু অংশ এখনও আর্থিকভাবে তাদের স্বামীদের উপর নির্ভরশীল। নারীদের এই নির্ভরতা নানাদিক থেকে মজুরশ্রেণি যে নিয়োগকর্তার উপর নির্ভরশীল তার চেয়ে আরো খারাপ। একজন চাকুরে তার চাকরি ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু স্ত্রীর জন্য এটি একটি কঠিন কাজ। উপরন্তু গৃহস্থালির কাজে তিনি যতই কঠোর পরিশ্রম করুন না কেন, তিনি কোনো প্রকার মজুরি দাবি করতে পারেন না। এই অবস্থাটা যতদিন চলবে, ততদিন বলা যাবে না যে তারা অর্থনৈতিক সাম্য অর্জনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। তবে এটা বোঝা কঠিন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া কীভাবে এই অবস্থার প্রতিকার করা সম্ভব। দরকার হলো সন্তানের খরচ বহন করবে রাষ্ট্র, স্বামী নয়, আর বিবাহিত মহিলারা শিশুকে স্তন্যদান এবং গর্ভধারণের শেষ অবস্থায় ছাড়া ঘরের বাইরে কাজ করে জীবিকা অর্জন করবে। এর জন্য দরকার স্থাপত্যকর্মের সংস্কার (এই গ্রন্থের অপর একটি নিবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে), এবং শিশু-কিশোরদের জন্য নার্সারি স্কুল স্থাপন। শিশুদের জন্য, তাদের মায়েদের জন্যও এটা হবে বিরাট আশীর্বাদ। যেহেতু শিশু সন্তানদের জন্য চাই খোলামেলা জায়গা, আলো এবং সুষম খাদ্য, অথচ তা মজুরের বাড়িতে সম্ভব নয়, কিন্তু নার্সারি স্কুলে সস্তায় এগুলোর সরবরাহ সম্ভবপর।

স্ত্রীদের মর্যাদা এবং শিশু-সন্তানের লালন পালনের জন্য এই ধরনের সংস্কার সমাজতন্ত্র ছাড়াও সম্ভব হতে পারে, এখানে-সেখানে অসম্পূর্ণভাবে কাজটা করাও যায়। কিন্তু প্রয়োজন অনুসারে এবং সম্পূর্ণভাবে কিছুতেই করা যাবে না, সমাজের সাধারণ অর্থনৈতিক রূপান্তরের অংশ হিসেবে যদি না করা হয়।

. শিল্পকলা

সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর স্থাপত্যশিল্পের কতটা উন্নতি হবে সে সম্পর্কে ইতোমধ্যেই আমার বক্তব্য রেখেছি। আগের কালে পেইন্টিং (চিত্রশিল্প) বিরাট স্থাপত্যকর্মের সঙ্গে জড়িত থেকেছে এবং অলংকৃত করেছে। অবস্থাটা আবার ফিরে আসতে পারে যদি আমাদের প্রতিবেশীদের প্রতি প্রতিযোগিতামূলক ভয়ের দরুন দীন আবাসস্থল সম্প্রদায়গত সৌন্দর্যের বাসনার কাছে হার মানে। সিনেমার মতো আধুনিক শিল্প খুবই সম্ভাবনাপূর্ণ। কিন্তু প্রযোজকরা যদি বাণিজ্যিক অভিপ্রায় দ্বারা পরিচালিত হন তাহলে এর সুস্থ বিকাশ সম্ভব হবে না; বস্তুত, অনেকেই এই অভিমত পোষণ করেন যে ইউ এস, এস, আর এই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়নের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। প্রত্যেক লেখক জানেন বাণিজ্যিক অভিলাষের জন্য সাহিত্য কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; প্রায় সব প্রাণবান লেখা কোনো না কোনো গোষ্ঠীকে আহত করে, ফলে কাটতি হয় কম। লেখকদের পক্ষে নিজেদের যোগ্যতা গ্রন্থস্বত্বের জন্য প্রাপ্য অর্থ দ্বারা পরিমাপ না করা কঠিন কাজ, এবং যখন বাজে লেখা বিরাট আর্থিক উপহার বয়ে আনে তখন ভালো লেখা সৃষ্টির জন্য লেখকের দরকার করে অস্বাভাবিক চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং গরিব থাকা।

স্বীকার করতে হবে সমাজতন্ত্র অবস্থাটা আরো খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যেহেতু প্রকাশনাশিল্প রাষ্ট্রের একচেটিয়া কারবারে পরিণত হবে, সুতরাং অনুদারভাবে সেন্সরপ্রথা ব্যবহার রাষ্ট্রের পক্ষে সহজ হবে। যতদিন পর্যন্ত নতুন শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিরোধিতা থাকবে ততদিন এটা এড়ানো যাবে না। কিন্তু সন্ধিক্ষণ বা অবস্থান্তরকাল যখন শেষ হবে তখন আশা করা যায়, যে বইগুলো যোগ্যতা বিচার করে রাষ্ট্র প্রকাশে ইচ্ছুক হবে না, সে বইগুলোও প্রকাশিত হতে পারবে যদি লেখকগণ ব্যয় নির্বাহের জন্য অতিরিক্ত সময় কাজ করে হলেও প্রকাশ করা উচিত মনে করেন। যেহেতু সময়ের সাশ্রয় খুব বেশি হবে না সেহেতু অতিরিক্ত কঠোর শ্রমের দরকার করবে না। কিন্তু এতে সেই লেখকদের বই প্রকাশে বিরত করা যাবে যারা নিজেরা খুব একটা নিশ্চিত নন যে তাদের বইয়ে মূল্যবান কিছু রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো বই প্রকাশ করা যেন সম্ভবপর হয়, কিন্তু কাজটা যেন অতি সহজ হয়ে না দাঁড়ায়। বর্তমানে বই খুব বেশি প্রকাশিত হয়। বইগুলোর মানও সেই পরিমাণে কম থাকে।

৮. অলাভজনক জনসেবা

সভ্য সরকার সূচিত হওয়ার পর থেকে এটা মেনে নেয়া হয়েছে যে, কিছু কিছু কাজ করতেই হবে, কিন্তু কাজগুলো মুনাফা লাভের ইচ্ছা থেকে এলোমেলো পরিচালনাধীনে ন্যস্ত করা যাবে না। এই সবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যুদ্ধ; এমনকি যারা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অযোগ্যতা সম্পর্কে একেবারে সুনিশ্চিত তারাও এমন ইঙ্গিত করেন না যে জাতীয় প্রতিরক্ষার ব্যাপারটা ব্যক্তিমালিকানাধীন ঠিকাদার গোষ্ঠীর উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। কিন্তু আরো অনেক কাজ রয়েছে, যেগুলো জনকর্তৃপক্ষ সমাধা করার প্রয়োজন মনে করে, যেমন পথ-ঘাট, পোতাশ্রয়, বাতিঘর, নগর-উদ্যান, আরো অনুরূপ কিছু কাজ। গত এক শ বছরে বিশেষ ধরনের কাজের জন্য একটা বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তা হলো জনস্বাস্থ্য। প্রথম দিকে অবাধ বাণিজ্যের গোঁড়া অনুসারীরা এর বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু বাস্তব যুক্তির কাছে ঐ বিরোধিতা একেবারে টেকেনি। কিন্তু যদি ব্যক্তি উদ্যোগের তত্ত্ব মেনে চলা হতো তাহলে বিরাট অর্থ লাভের সকল নতুন উপায় সম্ভব হতো। প্লেগ রোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি প্রচার এজেন্টের নিকট যেতে পারতেন। উক্ত এজেন্ট রেলওয়ে, থিয়েটার কোম্পানি প্রভৃতির কাছে এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি পাঠাতেন যে ঐ রোগী তাদের আস্তানায় দেহরক্ষার কথা ভাবছেন যদি না তার বিধবা পত্নীকে একটা বিরাট অঙ্কের টাকা প্রদান করা হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে রোগীকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা স্বেচ্ছামূলক কাজের অন্তর্ভুক্ত হবে না। কারণ, সুবিধাটা সর্বসাধারণের, ক্ষতিটা ব্যক্তির।

বিগত শতাব্দীর অন্যতম বৈশিষ্ট্যই এই ছিল যে জনসেবার সংখ্যাবৃদ্ধি এবং ব্যাপারটা জটিল করা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো শিক্ষাব্যবস্থা। রাষ্ট্র কর্তৃক এটা সার্বজনীনভাবে কার্যকরী করার আগে তখনকার স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালগুলোর অভিপ্রায় ছিল আলাদা-আলাদা। মধ্যযুগ থেকে ধার্মিক অভিপ্রায়ে গঠিত কিছু প্রতিষ্ঠান ছিল, কিছু ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানও ছিল, যেমন কলেজ দ্য ফ্রান্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কৃতবিদ্য (আলোকপ্রাপ্ত) রেনেসাঁস সম্রাটগণ; পক্ষপাতপুষ্ট দরিদ্ৰশ্রেণির জন্য কিছু দাঁতব্য স্কুলও ছিল। এগুলোর একটিও মুনাফা লোটার জন্য পরিচালিত হয়নি। অবশ্য মুনাফা লাভেল জন্যও কিছু স্কুল পরিচালিত হয়েছে। নমুনা স্বরূপ Dotheboys Hall এবং সালেম হাউসের নাম করা যায়। মুনাফা লাভের জন্য আরো কিছু স্কুল রয়েছে। যদিও শিক্ষা কর্তৃপক্ষ তাদের Dotheboys Hall–এর অনুকরণ করতে বাধা দেয়। এই স্কুলগুলো পাণ্ডিত্যের ক্ষেত্রে উচ্চমান অর্জন নয়, সৎশিক্ষার উপর নির্ভর করতে অভ্যস্ত। সর্বোপরি শিক্ষার উপর মুনাফা লাভের অভিলাষের প্রভাব নগণ্য।

এমনকি জনকর্তৃপক্ষ যখন প্রকৃতপক্ষে কাজ করে না, তখনও কাজ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার বোধ করে। একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি রাস্তা আলোকিত করার কাজ সম্পন্ন করতে পারে। কিন্তু এ কাজটি করতেই হবে, এতে লাভ হোক বা না হোক। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করা যেতে পারে, কিন্তু নির্মাণকার্য স্থানীয় আইন কিংবা উপবিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বর্তমানে সাধারণভাবে স্বীকার করা হয় যে আরো কঠোর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। একক নগর-পরিকল্পনা, গ্রেট ফায়ারের পর লন্ডন নগরীর জন্য স্যার ক্রিস্টোফার রেন যেমন প্রকল্প তৈরি করেছিলেন, হয়তো বস্তি ও উপকণ্ঠের বিকটতা ও অপরিচ্ছন্নতা দূর করতে পারে, আধুনিক শহরগুলোকেও সুন্দর, স্বাস্থ্যকর এবং সুখকর করা যায়। এই উদাহরণ থেকে আমাদের এই অত্যন্ত গতিশীল বিশ্বে ব্যক্তি-উদ্যোগের বিরুদ্ধে আরো কিছু যুক্তির ব্যাখ্যা মেলে। যে এলাকাগুলো বিবেচনায় আসবে তার পরিধি এতই বিরাট যে বৃহত্তম বণিক শ্রেণির পক্ষেও এ ব্যাপারে কিছু করা সম্ভব নয়। উদাহরণত, লন্ডন শহরকে অবশ্যই সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে, কারণ এর অধিবাসীদের একটা বিরাট অংশ শহরের এক প্রান্তে ঘুমায় আর কাজ করে অপর প্রান্তে। সেন্ট লরেন্স ওয়াটারওয়ের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বিশাল স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। কারণ দুটি দেশের বিভিন্ন অংশে এটি বিস্তার লাভ করেছে; এরকম ক্ষেত্রে কোনো একক সরকার পর্যাপ্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আগের দিনের চেয়ে এখন যাত্রী, সামগ্রী ইত্যাদি অত্যন্ত সহজে পরিবহন করা যায়, ফলে ক্ষুদ্র অঞ্চলগুলো, ঘোড়া যখন দ্রুততম পরিবহন মাধ্যম ছিল, সে সময়ের চেয়ে কম স্বয়ম্ভর হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপনাগুলো এতটা গুরুত্ব লাভ করেছে যে, যদি সেগুলো ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে নতুন ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকবে, যার সঙ্গে তুলনা চলতে পারে দুর্গবাসী মধ্যযুগের ব্যারনদের। স্পষ্টতই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল সম্প্রদায় চলনসই আর্থিক নিরাপত্তা অর্জন করতে পারে না যদি বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পূর্ণ একচেটিয়া সুবিধাদি অপব্যবহারের স্বাধীনতা পায়। পণ্যসামগ্রীর পরিবহন এখন রেলপথের উপর নির্ভরশীল। জনগণের চলাফেরার জন্য পথ-ঘাটের উপর নির্ভরশীলতা আংশিকভাবে ফিরে এসেছে। রেলওয়ে এবং মোটরগাড়ি নগরগুলোর সৃষ্ট করেছে। এইভাবে বৃহত্তর থেকে বৃহত্তর এলাকায় অধিকতর মাত্রায় জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠ করছে এবং উদ্ভাবনের অগ্রযাত্রার জন্য এর প্রয়োজন বেড়েই চলেছে।

৯. যুদ্ধ

আমি এবার সমাজতন্ত্রের পক্ষে সর্বশেষ ও সর্বাধিক শক্তিশালী যুক্তি প্রসঙ্গে আসছি; যুদ্ধ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা। যুদ্ধের সম্ভাবনা কিংবা এর ক্ষতিকারক দিক নিয়ে আলোচনা করে আমি সময় নষ্ট করবো না, কারণ এগুলো নিশ্চিত বলে ধরে নেয়া যায়। আমার আলোচনা দুটি প্রশ্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবো:

১. বর্তমানে যুদ্ধের বিপদ কতটা পুঁজিবাদের সঙ্গে সম্পর্কাণ্বিত?

২. সমাজতন্ত্র যুদ্ধের বিপদ কতটা দূর করবে?

যুদ্ধ সুপ্রাচীন ব্যাপার, পুঁজিবাদ এর সূচনা করেনি। তবে যুদ্ধের কারণ সব সময়ই প্রধানত ছিল অর্থনৈতিক। অতীতকালে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত দুটি, রাজা রাজড়াদের উচ্চাভিলাষ এবং সমর্থ জাতি কিংবা উপজাতির সম্প্রসারণবাদী দুঃসাহসিক অভিযানপ্রিয়তা। সাত বছরের যুদ্ধের মতো ঘটনায় এই উভয় ধরনের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। ইউরোপে এই যুদ্ধ ছিল রাজবংশীয় (dynastic), অপরদিকে আমেরিকা এবং ভারতে জাতিসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব। রোমকরা যে রাজ্য জয় করতে পেরেছে তা শুধু তাদের সমরনায়ক ও সেনাদলের (Legionaries) অর্থ লাভের আকাঙ্ক্ষার জন্য। আরব, হুন ও মঙ্গোলিয়দের মতো পশুপালক গোষ্ঠীগুলো পুনঃপুন রাজ্য জয়ে বেরিয়েছে। পূর্বেকার চারণভূমির অপর্যাপ্ততার জন্য। এবং সব সময়ই, যুদ্ধ করা সহজ হয়েছে এজন্য যে সমর্থ পুরুষরা বিজয় নিশ্চিত মনে করেছে। তারা যুদ্ধ করে আনন্দও পেতেন, অপরদিকে রমণীরা পৌরুষকে শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রশংসা করেছেন। ব্যতিক্রমও ছিল, সম্রাট যখন বলপূর্বক তাদের ইচ্ছা আরোপ করতে পারতেন চৈনিক এবং পরবর্তী রোমক সাম্রাজ্যে যেমন ঘটেছে)। যদিও যুদ্ধ আদিমকালের সূচনা থেকে বহুপথ পরিভ্রমণ করেছে, তবু সেই প্রাচীন অভিলাষ এখনও আছে, যারা যুদ্ধের অবসান চান। তাদের অবশ্যই তা স্মরণে থাকতে হবে। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র যুদ্ধের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ রক্ষাকবচ হতে পারে। কিন্তু সকল প্রধান সভ্য রাষ্ট্রে জাতীয় সমাজতন্ত্র কায়েম হলে যুদ্ধের সম্ভাবনা কেন অনেকটা হ্রাস করতে পারবে তা এখন আমি দেখাতে চেষ্টা করবো।

যদিও যুদ্ধের প্রতি দুঃসাহসিক অভিযানের তাড়না সভ্য দেশগুলোর এক শ্রেণির লোকের ভেতর এখনও কাজ করে, তবু শান্তির ইচ্ছা সৃষ্টিকারী অভিপ্রায় গত কয়েক শতাব্দীর তুলনায় এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জনগণ বুঝতে পেরেছে গত যুদ্ধ এমনকি বিজয়ী পক্ষের জন্যও সমৃদ্ধি বয়ে আনে নি। তারা বুঝতে পারে যে, পরবর্তী যুদ্ধে বেসামরিক জীবননাশের যে সম্ভাবনা রয়েছে তার বিশালতার তুলনা কোনো যুগের সঙ্গে চলবে না। তিরিশ বছরের যুদ্ধের পর থেকে তীব্রতায়ও তার তুল্য হবে না, তাছড়া সম্ভবত এই ক্ষতি শুধু এক পক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তারা ভীত যে প্রধান শহরগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সমগ্র একটা মহাদেশের সভ্যতা হবে বিনষ্ট। বিশেষত, ব্রিটিশ জনগণ সচেতন যে তারা যুগ-যুগান্ত ধরে বহিঃআক্রমণ থেকে মুক্তি লাভের যে সুবিধা ভোগ করেছে তা হারিয়েছে। এইসব বিবেচনা থেকে গ্রেট ব্রিটেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রগাঢ় আসক্তি জন্মেছে, অন্যান্য দেশগুলোতেও অনুরূপ অনুধাবন কাজ করছে, তবে হয়তো তীব্রতা কিছুটা কম। তাহলে, এতসব সত্ত্বেও, যুদ্ধের বিপদ কেন আসন্ন? প্রত্যক্ষ কারণ অবশ্যই ভার্সাই সন্ধির কঠোরতা, যার জন্য জার্মানিতে সামরিক জাতীয়তাবাদ জন্ম দিয়েছে। কিন্তু একটা নতুন যুদ্ধ সম্ভবত ১৯১৯ সালের চেয়ে কঠোর সন্ধির জন্ম দেবে, ফলশ্রুতিতে পরাস্ত পক্ষে আরো উগ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। এই বিরামহীন ওঠা-নামার ভেতর স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কেবলমাত্র জাতিসমূহের শত্রুতার হেতুগুলো দূরীভূত করার মাধ্যমেই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। একালে এ হেতুগুলো প্রধানত খুঁজে পাওয়া যাবে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক স্বার্থের মধ্যে। সুতরাং এর বিলুপ্তি মৌলিক অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের মধ্যে নিহিত।

অর্থনৈতিক শক্তি কীভাবে যুদ্ধে ইন্ধন জোগায়, লৌহ ও ইস্পাত শিল্পকে আমরা তার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি। মূল ঘটনা হলো, আধুনিক কৌশল অবলম্বন করে প্রচুর পরিমাণ উৎপাদন করলে প্রতি টন উৎপাদনে যে খরচ পড়ে তা স্বল্প পরিমাণ উৎপাদনের চেয়ে অনেক কম। ফলে বাজার যদি বিরাট হয় তাহলে মুনাফা আসে, অন্যথায় নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ইস্পাত শিল্পের দেশীয় বাজার অন্যান্য দেশের চেয়ে আকারে অনেক বড় বলে এ যাবৎকাল রাজনীতি নিয়ে কোনো প্রকার অসুবিধায় পড়েনি, কেবল প্রয়োজনে নৌশক্তি নিরস্ত্রীকরণের জন্য গৃহীত পরিকল্পনা বন্ধে হস্তক্ষেপ করেছে, তার বাইরে কিছু করেনি। কিন্তু জার্মান, ফরাসি এবং ব্রিটিশ ইস্পাত শিল্পগুলোর বাজার তাদের কারিগরি প্রয়োজনে যে চাহিদার সৃষ্টি হয়েছে তার চেয়ে ক্ষুদ্রতর। অবশ্য তারা পরস্পরের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে কিছুটা সুবিধা আদায় করে নিতে পারত, কিন্তু এতে কিছু অর্থনৈতিক আপত্তি রয়েছে। ইস্পাতের চাহিদার একটা বিরাট অংশ যুদ্ধের প্রস্তুতির সঙ্গে জড়িত। সুতরাং জাতীয়তাবাদের দরুন ইস্পাত শিল্প লাভবান হয়, জাতীয় অস্ত্রভাণ্ডার বৃদ্ধিতেও তাদের লাভ। উপরন্তু Comite des Fores এবং জার্মান ইস্পাত সংস্থা আশা করে, মুনাফা ভাগাভাগি না করে, যুদ্ধ দ্বারা প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্মূল করতে; এবং যেহেতু যুদ্ধের ব্যয় মূলত অন্যের ঘাড়ে চাপবে, অতএব তারা মনে করে যুদ্ধের ফলাফল তাদের জন্য আর্থিক দিক দিয়ে সুবিধাজনক হতে পারে। হয়তো তাদের এই হিসেবে ভুল আছে। কিন্তু এই ভুল ক্ষমতামদমত্ত সুঃসাহসী এবং আত্মপ্রত্যয়ী লোকের জন্য স্বাভাবিক। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লোরেন। অঞ্চলের আকরিক এক সময় জার্মানির অধিকারে ছিল, বর্তমানে ফ্রান্সের দখলে, ফলে দুদেশের মধ্যে শক্রতা বেড়েই চলেছে। এই ঘটনা সব সময় মনে করিয়ে দেয় পরবর্তী যুদ্ধে কী অর্জিত হবে। আর স্বাভাবিকভাবেই জার্মানরা একটু বেশি আক্রমণাত্মক, যেহেতু ফরাসিরা ইতোমধ্যেই গত যুদ্ধের লুষ্ঠিত ধন উপভোগ শুরু করেছে।

ইস্পাত শিল্প এবং অনুরূপ স্বার্থঘটিত অন্যান্য শিল্পকারখানা, কিছুতেই তাদের উদ্দেশ্যের অনুকূলে বৃহৎ জাতিসমূহের সেবা পাবে না যদি তারা জনগণের সঠিক আবেগের কাছে আবেদন রাখতে না পারে। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে তারা ভীতির কাছে আবেদন রাখতে পারে; জার্মানিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের কাছে; এবং এই অভীষ্টগুলো উভয়পক্ষের জন্য সম্পূর্ণ বৈধ। কিন্তু ব্যাপারটি সম্পর্কে যদি শান্ত মাথায় বিবেচনা করা যায় তাহলে উভয় পক্ষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, ন্যায়সঙ্গত চুক্তি প্রত্যেককে সুখী করবে। এমন কোনো কল্যাণকর যুক্তি নেই যে জার্মানদের অন্যায় সয়ে যেতে হবে। কিংবা অন্যায় যদি দূর করা হয় তবে তাদের যুক্তিসঙ্গত কোনো অজুহাত থাকবে না এমন আচরণ করার, যাতে প্রতিবেশীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারিত হবে। কিন্তু শান্ত এবং যুক্তিযুক্ত হওয়ার জন্য যখনই কোনো প্রচেষ্টা নেয়া হয় তখনই দেশপ্রেম ও জাতীয় মর্যাদার প্রতি আবেদনের রূপ ধরে অপপ্রচার হস্তক্ষেপ করে। অর্থাৎ স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। দুনিয়াটা সুরাপানে মত্ত অবস্থায় আছে, সে মাতাল সংস্কারের জন্য উসুক, কিন্তু সে এমন দয়ালু বন্ধুদের দ্বারা পরিবৃত যারা তাকে সব সময় সুরা যোগাচ্ছে, ফলে সে স্থায়ীভাবে মত্ত অবস্থায় থাকছে। এক্ষেত্রে দয়ালু বন্ধুরা টাকার পাহাড় গড়ছে তার দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা কাজে লাগিয়ে। এখন তার প্রথম কাজ হবে এদেরকে অপসারণ করা। এই অর্থেই কেবল বলা যায় যে আধুনিক পুঁজিবাদ যুদ্ধের জন্য দায়ী বা কারণ, কিন্তু এটাই সমগ্র কারণ নয়। তবে এটা কারণগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্দীপনা যোগায়। এই অবস্থাটা যদি আর না থাকত তাহলে উদ্দীপনার অনুপস্থিতির জন্য মানুষ খুব তাড়াতাড়ি যুদ্ধের অসঙ্গতি বুঝে যেত এবং এমন ন্যায়সঙ্গত চুক্তিতে পৌঁছাত যে, ভবিষ্যতে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি সম্ভব হতো না।

ইস্পাতশিল্প এবং অনুরূপ স্বার্থের সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠীগুলো যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে তার সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রে, অর্থাৎ এমন কর্তৃপক্ষের পরিচালনায় যে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সকল সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছে। কিন্তু প্রধান শিল্পোন্নত দেশগুলোতে জাতীয়করণ সম্ভবত যুদ্ধের আসন্ন বিপদ দূর করার জন্য যথেষ্ট হবে। কারণ ইস্পাতশিল্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যদি সরকারের হাতে থাকে এবং সরকার যদি গণতান্ত্রিক হন, তাহলে এর পরিচালনা শিল্পের স্বার্থে না হয়ে জাতির স্বার্থে হবে। পাবলিক ফাইন্যান্সের লেন-দেনের হিসাবপত্রে, ইস্পাতশিল্প গোষ্ঠী সমাজের অন্যান্য অংশের ক্ষতি করে যে মুনাফা অর্জন করবে তা অন্যত্র ক্ষতি দ্বারা শোধরানো হবে, এবং যেহেতু একটি পৃথক কারখানার লাভ বা ক্ষতির জন্য কোনো ব্যক্তির আয় ওঠানামা করবে না, তাই কারো অভিলাষ হবে না জনগণের খরচে ইস্পাতশিল্পের স্বার্থ সম্প্রসারণ। বোঝা যাবে যে, যুদ্ধাস্ত্র বৃদ্ধির জন্য ইস্পাতের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ক্ষতি হচ্ছে, কারণ এতে জনগণের মধ্যে বিতরণের জন্য ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ হ্রাস পাবে। এইভাবে সর্বসাধারণ এবং ব্যক্তি স্বার্থের মধ্যে মিলন ঘটবে, এবং ভ্রমাত্মক অপপ্রচারের অভিলাষ আর থাকবে না।

এবার আমাদের বিবেচনাধীন অন্যান্য অকল্যাণের প্রতিকার কীভাবে সমাজতন্ত্র করবে সে সম্পর্কে কিছু বলা যায়।

শিল্পে মুনাফার পিছনে ছোটার পথনির্দেশক অভিলাষের স্থান নেবে সরকারি পরিকল্পনা। সরকার হিসেবে ভুল করতে পারেন, কিন্তু ব্যক্তির চেয়ে ভুলটা কম করার সম্ভাবনা বেশি। কারণ সরকারের এ ব্যাপারে পূর্ণতর জানাশোনা এবং বিচারবুদ্ধি থাকবে। রাবারের উচ্চমূল্যের সময় যার পক্ষে সম্ভব সেই রাবার বৃক্ষ রোপণ করেছে, ফলে কয়েক বছর পর রাবারের মূল্য ভীষণ পড়ে যায়, তখন দেখা গেল বিশেষ প্রয়োজনে রাবার উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে চুক্তিতে পৌঁছা দরকার। একটা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ, যার হাতে রয়েছে সকল পরিসংখ্যান, এই ধরনের ভুল হিসাব বন্ধ করতে পারে। তথাপি, নতুন উদ্ভাবনের মতো অদৃশ্য কারণসমূহ সর্বাধিক সযত্নে তৈরি হিসাবও ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে সমগ্র গোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে নতুন প্রক্রিয়া গ্রহণ করে লাভবান হতে পারবে। সমাজতন্ত্রের অধীনে যে-কোনো সময় বেকারদের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় বেকারত্বের ভীতি এবং নিয়োগকর্তা ও কর্মীর ভেতর পারস্পারিক সন্দেহের জন্য তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যখন একটি কারখানায় অবক্ষয় শুরু হয় এবং অপর একটি কারখানা প্রসারিত হতে থাকে তখন কনিষ্ঠতর কর্মীদের অবনতিশীল কারখানা থেকে সরিয়ে এনে প্ৰসাৰ্যমাণ কারখানায় প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। বেকারত্বের অনেকটা দূর করা যায় শ্রমের সময় কমিয়ে। যখন কোনো ব্যক্তির জন্য কাজই খুঁজে পাওয়া যাবে না, তখনও সে পূর্ণ মজুরি পাবে, তাকে মজুরি প্রদান করতে হবে তার কাজ করার ইচ্ছার জন্য। যতদূর কাজ করতে বাধ্য করার দরকার হবে, তা করতে হবে অপরাধ আইনের প্রয়োগ দ্বারা, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সাহায্য নেয়।

যারা পরিকল্পনার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের উপর কাজটা ছেড়ে দিতে হবে। সবশেষে ব্যাপারটা নির্ভর করবে জনপ্রিয় মতামতের উপর, স্বাচ্ছন্দ্য এবং অবসরের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য এটা দরকার। যদি প্রত্যেক দিনে চার ঘণ্টা কাজ করে তবে দিনে পাঁচ ঘণ্টা কাজ করলে যতটা স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করা যেত ততটা করা যাবে না। তবে আশা করা যায় প্রযুক্তিগত উন্নতি অংশত অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য এবং অংশত অধিকতর অবসরের ব্যবস্থা করার জন্য ব্যবহার করা যাবে।

নেহাৎ অপরাধী না হলে যেহেতু সবাই মাইনে পাবে, এবং শিশুদের খরচ বহন করবে রাষ্ট্র, কাজেই অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা থাকবে না (যুদ্ধের বিপদ যতদিন থাকবে সেটা ব্যতিক্রম ধরে)। স্ত্রীরা স্বামীদের উপর নির্ভরশীল হবে না, সন্তানদেরকে তাদের অভিভাবকদের ত্রুটির জন্য ভুগতে দেয়া হবে না। কোনো ব্যক্তি আর্থিক কারণে অপর কোনো ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল হবে না, সবাই হবে রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল।

যদি সমাজতন্ত্র কতকগুলো সভ্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়, কিন্তু অধিকাংশ দেশগুলোতে নয়, তাহলে যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে যাবে এবং ব্যবস্থাটার পূর্ণ সুবিধা বাস্তবায়ন করা যাবে না। তবে আমি একটা কথা সুনিশ্চিত বলেই মনে করি যে দেশগুলো সমাজতন্ত্র গ্রহণ করবে সে দেশগুলো আক্রমণাত্মক সমরতন্ত্রী আর থাকবে না এবং অন্য দেশের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য আন্তরিকভাবে যোগ দেবে। গোটা সভ্য জগতে সমাজতন্ত্র সার্বজনীন হয়ে ওঠার পর শান্তি প্রতিষ্ঠার যুক্তি অতিক্রম করে যুদ্ধের অভিলাষের সম্ভবত যথেষ্ট বল থাকবে না।

আমি পুনরায় বলি: সমাজতন্ত্র শুধু সর্বহারার জন্য মতবাদ নয়। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা ঠেকিয়ে এই তন্ত্র কিছু অতি ধনী বাদ দিয়ে সবার সুখ বর্ধন করবে; এবং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এটা যেমন প্রথম শ্রেণির যুদ্ধ ঠেকাতে সক্ষম, তেমনি সমগ্র জগতে অপরিমেয় সমৃদ্ধি আনয়ন করবে। শিল্পপতিরা যে বিশ্বাস করে আর একটা মহাযুদ্ধ হলে তারা লাভবান হবে, সে সম্পর্কে বলা যায় যে, এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনৈতিক যুক্তি দ্বারা সত্য বলে মনে হলেও তা বাতিকগ্রস্ত লোকের অব্যবস্থচিত্ত বিভ্রম মাত্র।

বাস্তব ব্যাপারটা তাহলে কি এই যে (কম্যুনিস্টরা যেমন মনে করেন) সমাজতন্ত্র সার্বজনীনভাবে হিতকর এবং সর্বসাধারণের কাছে সহজবোধ্য; তাছাড়া প্রচলিত অর্থব্যবস্থা যেহেতু ভেঙে পড়েছে এবং আর একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ হলে বিপদ আরো ঘনিয়ে আসবে, ফলে সমাজতন্ত্র জরুরি হয়ে পড়বে? ব্যাপারটা কি আমরা এই যে, সমাজতন্ত্রের গুরুত্ব সর্বহারা এবং বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশই শুধু উপলব্ধি করতে সক্ষম? এবং এই তন্ত্র একটি রক্তক্ষয়ী, অনিশ্চিত, ধ্বংসাত্মক শ্রেণি-যুদ্ধ ছাড়া প্রতিষ্ঠা করা যাবে না? আমি নিজের পক্ষ থেকে বলতে পারি, এটা বিশ্বাস করা অসম্ভব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র পুরাকালীন অভ্যাসের বিরুদ্ধে কাজ করে, সুতরাং আবেগগত বিরোধিতা দেখা দেয়, যা কেবল ক্রমান্বয়ে উত্তরণ সম্ভব। শুধু কি তাই, বিরুদ্ধপক্ষের মনে সমাজতন্ত্র নাস্তিক্যবাদ এবং সন্ত্রাসের রাজত্বের সঙ্গে জড়িত। অথচ সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মের কোনোই সম্পর্ক নেই। এটি একটি অর্থনৈতিক মতবাদ এবং একজন সমাজতন্ত্রী খ্রিস্টান, মুসলমান, বুদ্ধধর্মাবলম্বী কিংবা ব্রহ্মের উপসনাকারী হতে পারেন। সন্ত্রাসের রাজত্ব সম্পর্কে বলা যায়, সম্প্রতিকালে বহু সন্ত্রাসের রাজত্ব দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে, এবং যেখানে সমাজতন্ত্র এসবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ রূপে আসে। ভয় করা হয় সমাজতন্ত্র পূর্ববর্তী শাসনের হিংস্রতা উত্তরাধিকার সূত্রে কিছুটা লাভ করবে। কিন্তু যে দেশগুলো এখনও কতকটা মুক্ত চিন্তা এবং বাক স্বাধীনতার অনুমতি দেয়, সেখানে উদ্দীপনা ও সহনশীলতার সম্মিলন ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রও অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যার কাছে বুঝেসুঝে গ্রহণের জন্য উপস্থাপন করা যায়। সে সময় এলে যদি সংখ্যালঘু অবৈধভাবে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করে তাহলে সংখ্যাগুরুকে অবশ্যই বিদ্রোহ দমনের জন্য বল প্রয়োগ করতে হবে। যেক্ষেত্রে প্ররোচনা সম্ভব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মন এখনও তৈরি হয়নি সেখানে বলপ্রয়োগের প্রশ্ন ওঠে না; সংখ্যাগুরুর মন তৈরি থাকলে ব্যাপারটা গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া যায়, যদি না যথেচ্ছাচারী লোকেরা বিদ্রোহ করে বসে। এ ধরনের বিদ্রোহ দমনের জন্য যে কোনো সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং গণতান্ত্রিক দেশে অন্যান্য নিয়মতান্ত্রিক দলের মতো সমাজতন্ত্রীদেরও বলপ্রয়োগের অধিক সুযোগ থাকবে না এবং যদি সমাজতন্ত্রীদের অধিকারে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা থাকেও, পূর্ববর্তী প্ররোচনার জন্যই কেবল তা অর্জন করতে পারে। কোনো কোনো মহলে যুক্তি দেখানো নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে যে, যদিও সমাজতন্ত্র হয়তো এক সময় সাধারণ প্রচারণার মাধ্যমে কায়েম করা সম্ভব হতো, ফ্যাসিজমের উদ্ভব এটা অসম্ভব করে তুলেছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের দেশগুলোর বেলায় এটা অবশ্যই সত্য, কারণ শাসনতান্ত্রিকভাবে বিরোধিতা উক্ত দেশগুলোতে সম্ভব নয়। কিন্তু ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেনে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক দল রয়েছে; গ্রেট ব্রিটেনে ও যুক্তরাষ্ট্রের কম্যুনিস্টদের সংখ্যা একেবারে নগণ্য। এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না যে তারা পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পাচ্ছে। এই কিছুদিন আগেই তারা প্রতিক্রিয়াশীলদের দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু শ্রমিক দলের পুনরুজ্জীবন ঠেকানোর জন্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে চরমপন্থা বিস্তার রোধের জন্য যথেষ্ট সন্ত্রাসমূলক ছিল না। সমাজতন্ত্রীদের অতি সত্তর গ্রেট ব্রিটেনে সংখ্যাগুরু হওয়া অসম্ভব নয়। সন্দেহ নেই, অতএব তারা তাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে অসুবিধার সম্মুখীন হবে; এবং অতি ভীরুর দল এই অসুবিধাগুলো স্বীয় দলের কার্যক্রম পরিত্যাগের জন্য অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। কারণ, সৎ প্রচারণা অনিবার্য কারণে মন্থর ব্যাপার হলেও সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা অবশ্যই দ্রুত ও হঠাৎ করে সম্পন্ন হবে। কিন্তু এখনই এমন কোনো জোরালো কারণ ঘটেনি যে ধরে নিতে হবে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থ হবে, অন্য কোনো পদ্ধতি সফল হবে এমন মনে করার যুক্তি আরো কম। অপরপক্ষে, অনিয়মতান্ত্রিক উৎপীড়নমূলক যে কোনো উপায় শুধু ফ্যাসিবাদ প্রসারেই সহায়তা করবে। গণতন্ত্রের দুর্বলতা যাই হোক না কেন, এর মাধ্যমেই এবং সমাজতন্ত্রে জনপ্রিয় আস্থার জোরেই কেবল আশা করা যায় যে গ্রেট ব্রিটেন কিংবা আমেরিকায় সমাজতন্ত্র সফল হবে। যে কেউ গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা দুর্বল করার চেষ্টা করেন, তিনি ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায়, সমাজতন্ত্র কিংবা কম্যুনিজম নয়, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবেন।

০৮. প্রতীচ্য সভ্যতা

সত্যিকার পরিপ্রেক্ষিতে একজনের পক্ষে নিজের সভ্যতাকে দেখা কোনো মতেই সহজ কাজ নয়। এই লক্ষ্যে পৌঁছার কেবল তিনটি উপায় রয়েছে; ভ্রমণ, ইতিহাস এবং নৃবিজ্ঞান; আমি এ বিষয়ে যা প্রস্তাব করবো তাতে এই তিনটি উপাদানের সংমিশ্রণ থাকবে; তবে এই তিনটির কোনো একটি বস্তুগত তদন্তের ক্ষেত্রে বিরাট কোনো সাহায্য হবে না। কারণ পর্যটকরা তাদের কৌতূহলের বস্তুকেই কেবল দেখতে পান; উদাহরণত, মার্কো পলো একবারও দেখতে পাননি যে চীনা মহিলাদের পদযুগল ক্ষুদ্রাকৃতি। ইতিহাসকারগণ ঘটনাবলি সজ্জিত করেন নিজেদের অর্জিত অভ্যাস অনুসরণে; রোমকে সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের জন্য নানা কারণ দেখানো হয়েছে, যেমন সাম্রাজ্যবাদ, খ্রিষ্টধর্ম, ম্যালেরিয়া, বিবাহবিচ্ছেদ এবং দেশান্তরগমন। শেষ দুটি কারণ যথাক্রমে আমেরিকার পাদরি ও রাজনীতিবিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। নৃবিজ্ঞানী ঘটনা নির্বাচন এবং ব্যাখ্যা করেন তার সময়ে প্রচলিত সংস্কার অনুসরণে। আমরা যারা ঘরকুনো তারা বন্য লোকদের সম্পর্কে কী জানি? রুশোপন্থীরা বলেন তারা মহৎ, আবার সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে তারা নির্দয়, ধর্মপুষ্ট মনের নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, তারা পুণ্যবান পারিবারিক মানুষ, আবার বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইন সংস্কারের প্রবক্তরা বলেন, তাদের জীবনাচরণে মুক্ত যৌনতার প্রাধান্য রয়েছে; স্যার জেমস ফ্রেজার বলেন, তারা সবসময় তাদের ঈশ্বরকে হত্যা করে। এদিকে অন্যেরা বলেন, তারা সর্বদাই দীক্ষা-কর্মানুষ্ঠানে নিয়োজিত। সংক্ষেপে, আদিম বা বন্য লোক নৃবিজ্ঞানীদের বাধিত করেন, অর্থাৎ নৃবিজ্ঞানীদের তত্ত্বের জন্য যা যা দরকার তারা তাই করেন। এই সব ক্রটি সত্ত্বেও ভ্রমণ, ইতিহাস এবং নৃবিজ্ঞান সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা, এবং আমাদের এসবই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে হবে।

তবে প্রথমেই একটা প্রশ্ন: সভ্যতা কী? আমি বলবো এর প্রথম আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য হলো পূর্বচিন্তন। বাস্তবিকপক্ষে পূর্বচিন্তনই মানুষকে বন্যপশু থেকে আলাদা চিহ্নিত করে, বয়স্কদের পৃথক করে শিশুদের থেকে। তবে পূর্বচিন্তন যেহেতু মাত্রার ব্যাপার, অতএব আমরা বেশি কিংবা কম সভ্য জাতি এবং সময়কালকে পূর্বচিন্তনের প্রাপ্ত পরিমাণ অনুসারে পৃথক করে চিনতে পারি। এবং পূর্বচিন্তন সূক্ষ্ম পরিমাপে প্রায় সমর্থ। আমি বলবো না যে একটা গোষ্ঠীর গড় পূর্বচিন্তন কৌতূহলের পরিমাণের ব্যস্তানুপাতিক, অবশ্য এই মতটিও গ্রহণ করা যায়। কিন্তু আমরা বলতে পারি যে, যে কোনো কাজে পূর্বচিন্তনের মাত্রা তিনটি উপাদান দ্বারা পরিমাপ করা যায়; বর্তমানে যন্ত্রণা, ভবিষ্যৎ সুখ এবং এই দুটির মধ্যে বিরতির সময় পরিধি। অর্থাৎ পূর্বচিন্তন পাওয়া যায় ভবিষ্যৎ সুখ দিয়ে বর্তমান যন্ত্রণা প্রথমে ভাগ করে, অতঃপর মধ্যেকার বিরতিকাল দিয়ে গুণ করতে হবে। আবার ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক পূর্বচিন্তনের মধ্যে তফাত রয়েছে। একটি অভিজাত কিংবা ধনিক সম্প্রদায়ে এক ব্যক্তি বর্তমান যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে, অপরজন ভোগ করে ভবিষ্যৎ সুখ। এতে সামষ্টিক পূর্বচিন্তন সহজতর হয়ে পড়ে। এই অর্থে শিল্পায়নের সকল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কর্মকাণ্ড প্রদর্শন করে সামষ্টিক পূর্বচিন্তনের উচ্চমাত্রা; যারা তৈরি করেন রেলপথ, পোতাশ্রয় কিংবা জাহাজ তাদের কাজের সুবিধা কয়েক বছর পর লাভ করা যায়।

এটা সত্য যে আধুনিক জগতের কোনো ব্যক্তি এতটা পূর্বচিন্তন দেখান নি যতটা দেখিয়েছেন প্রাচীন মিসরবাসীরা মৃতদেহ মমি করে, কারণ এই কাজটি তারা করেন যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা হলো ঐ মমি দশ হাজার বছর পর পুনরুজ্জীবিত হবে। এখণ আমি আর একটি উপাদানের সন্ধান পেলাম যা সভ্যতার জন্য আবশ্যিক : জ্ঞান। কুসংস্কারভিত্তিক পূর্বচিন্তনকে পুরোপুরি সভা বলে গণ্য করা যায় না; অবশ্য এটা মনের এমন অভ্যাস জন্ম দিতে পারে যা সত্যকার সভ্যতা বিকাশের জন্য আবশ্যিক। উদাহরণ, এই যে শুদ্ধাচারীদের (পিউরিটান) অভ্যাস ছিল পরবর্তী জীবনের জন্য সুখ বিসর্জন, তা নিঃসন্দেহে পুঁজি সঞ্চয়ে সাহায্য করেছে। যে পুঁজি শিল্পায়নের জন্য ছিল খুবই দরকারি। তাহলে আমরা সভ্যতার সংজ্ঞা এইভাবে নিরূপণ করতে পারি: জীবনের একটা রীতি, যা জ্ঞান ও পূর্বচিন্তনের সমন্বয়ে গঠিত।

এই অর্থে সভ্যতা শুরু হয়েছে কৃষিকার্য এবং রোমন্থক জন্তু পোষ মানানোর সঙ্গে। এই কিছুকাল আগেও কৃষিজীবী এবং পশুপালক জনগোষ্ঠীর লোকেরা পরিষ্কারভাবে পৃথক ছিল। আমরা বাইবেলের আদিপুস্তকে পড়ি কীভাবে ইস্রায়িলীদের গোশেন প্রদেশে উপনিবেশ স্থাপন করতে হয়, মূল মিশরে তাদের জায়গা হয়নি, কারণ মিশরবাসীরা পেশা হিসেবে পশুপালনকে একেবারে পছন্দ করেনি, এ বিষয়ে তাদের ছিল ঘোর আপত্তি: পরে যোসেফ আপন ভ্রাতাদের ও পিতার স্বজনকে বললেন, আমি গিয়ে ফেরাউনকে জানাবো, তাকে বলবো, আমার ভাইয়েরা এবং পিতার স্বজনেরা কেনান দেশ থেকে আমার কাছে এসেছে; তারা মেষপালক, পশু রক্ষণাবেক্ষণ তাদের কাজ; এবং তাদের গোমেমাদি ও সর্বস্ব সঙ্গে এনেছে। এতে ফেরাউন যখন তোমাদের ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমাদের পেশা কী? তখন তোমরা বলবে, আপনার এই দাসগণ পুরুষানুক্রমে এবং অদ্যাবধি পশুপালন করে আসছে; ফলে তোমরা গোশেন প্রদেশে বাস করতে পারবে; কারণ মিশরবাসীরা পশুপালকদের একদম ঘৃণা করে। মি. হুকের ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, পশুপালক মঙ্গলদের প্রতি চিনাদেরও অনুরূপ মনোভাব কাজ করেছে। মোটের উপর, কৃষিকাজ সব যুগের উচ্চতর সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করেছে। ধর্মের সঙ্গেও ছিল এর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। কিন্তু গোষ্ঠীপতিদের গো-মহিষাদির প্রভাবও ব্যাপক ছিল ইহুদি ধর্মের উপর, অতঃপর উক্ত প্রভাব খ্রিষ্টধর্মের উপর বর্তায়। কেইন ও আবেলের গল্প এক খণ্ড প্রচারণা মাত্র, এতে দেখানো হলো যে মেষপালকরা কৃষিজীবীদের চেয়ে পুণ্যবান। তথাপি এই সম্প্রতিকাল পর্যন্তও সভ্যতা প্রধানত কৃষিকার্যের উপর নির্ভরশীল ছিল।

আমরা এতক্ষণ এমন বিষয় বিবেচনার মধ্যে আনিনি যা প্রতীচ্যের সভ্যতাকে অন্যান্য অঞ্চলের সভ্যতা থেকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। যেমন ভারত, চীন, জাপান এবং মেক্সিকোর সভ্যতা থেকে। বস্তুত বিজ্ঞানের উদ্ভবের আগে এই পার্থক্য খুবই কম ছিল। বিজ্ঞান ও শিল্পায়ন আজকের প্রতীচ্য সভ্যতার বিশিষ্টতার চিহ্ন; কিন্তু আমি প্রথমে বিবেচনা করব শিল্প বিপ্লবের আগে আমাদের সভ্যতা কেমন ছিল।

আমরা যদি পশ্চিমী সভ্যতার উৎপত্তির কারণগুলোতে ফিরে যাই তাহলে দেখতে পাবো মিশর ও ব্যাবিলন থেকে এটা যা গ্রহণ করেছে তা প্রধানত সকল সভ্যতারই বৈশিষ্ট্য এবং তা কেবল পশ্চিমের বিশেষ বৈশিষ্ট্য নয়। পশ্চিমী সভ্যতার বিশিষ্টতা শুরু হয় গ্রিকদের সঙ্গে, এই গ্রিকরা অবরোহী চিন্তার অভ্যাস এবং জ্যামিতি উদ্ভাবন করে। তাদের অন্যান্য গুণ হয় ছিল না কিংবা থাকলে তা অন্ধকার যুগে হারিয়ে যায়। সাহিত্য এবং শিল্পকলায় হয়তো তাদের শ্রেষ্ঠতা ছিল, কিন্তু বিভিন্ন প্রাচীন জাতিসমূহ থেকে তাদের বিভিন্নতা খুব গভীর ছিল না। পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা গুটিকয় ব্যক্তির জন্ম দেয়, এখানে আমরা আর্কিমিডিস-এর নামোল্লেখ করতে পারি, যিনি আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে অনুমান করতে পেরেছিলেন, কিন্তু তারা কোনো মতবাদী গোষ্ঠী কিংবা ঐতিহ্য নির্মাণ করে যেতে পারেন নি। গ্রিকদের সভ্যতার একটা অতি সুস্পষ্ট অবদান হলো অবরোহী যুক্তি এবং বিশুদ্ধ গণিত।

যাহোক, গ্রিকরা কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে ছিলেন অযোগ্য এবং সভ্যতায় তাদের অবদান হয়তো সত্যিই হারিয়ে যেত শুধু রোমানদের প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য টিকে থাকে। রোমানরা আবিষ্কার করেন সিভিল সার্ভিস এবং আইন দ্বারা একটা বিরাট সাম্রাজ্যের প্রশাসন কীভাবে চালাতে হয় তার কৌশল। পূর্ববর্তী সাম্রাজ্যগুলোতে সবকিছু নির্ভর করেছে সম্রাটের শক্তিমত্তার উপর, কিন্তু রোমক সাম্রাজ্যে সম্রাট খুন হতে পারতেন প্রেটরীয়ান রক্ষীদের হাতে এবং সেনাবাহিনী প্রশাসন যন্ত্রের বিন্দব্রিাত্র ক্ষতি না করে সাম্রাজ্যের জন্য নিলাম ডাকতে পারতেন। আর প্রশাসন-যন্ত্রকে যতটা ঝুট ঝামলো পোহাতে হতো তার সঙ্গে তুলনা চলতে পারে আজকের দিনে নির্বাচন পরিচালনায় যতটা ঝুটঝামেলা পোহাতে হয় তার সঙ্গে। মনে হয় রোমানরা ব্যক্তি প্রশাসকের প্রতি আনুগত্যের স্থানে নৈর্ব্যক্তিক রাষ্ট্রের প্রতি নিবেদিত চিত্ততার গুণ উদ্ভাবন করেন। সত্য যে, গ্রিকরা দেশপ্রেমের কথা বলতেন, কিন্তু তাদের রাজনীতিবিদরা ছিলেন দুর্নীতিপরায়ণ এবং এদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো সময়ে পারস্য সম্রাটের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রের প্রতি ভক্তির রোমক ধারণা পশ্চিমে স্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা আবশ্যিক উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।

প্রাক-আধুনিককালে প্রতীচ্য সভ্যতার জন্য আরো একটা উপাদানের আবশ্যকতা ছিল, আর তা হলো রাষ্ট্র এবং ধর্মের মধ্যে অদ্ভুত সম্পর্ক যা খ্রিষ্টধর্মের মাধ্যমে আসে। খ্রিষ্টধর্ম মূলত ছিল সম্পূর্ণ অ-রাজনৈতিক। কারণ রোমক সাম্রাজ্যে এই ধর্মের বিকাশ ঘটে তাদের প্রতি সান্ত্বনা স্বরূপ যারা জাতীয় এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হারিয়েছিল; এবং এটা ইহুদি ধর্ম থেকে জগতের শাসককুলের প্রতি নৈতিক দোষারোপের মনোভাবটা গ্রহণ করে। কনস্ট্যাটাইনের আগে খ্রিস্টধর্ম এমন সংঘ গড়ে তোলে যার প্রতি খ্রিস্টানদের আনুগত্য রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের চেয়ে ছিল বেশি। রোমের পতনের পর ইহুদি, গ্রিক ও রোমক সভ্যতার সারাৎসার গির্জা অসাধারণ সংশ্লেষণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে। ইহুদি নীতিপরায়ণতা থেকে আসে খ্রিস্টধর্মের নীতিসূত্র; অবরোহী যুক্তির প্রতি গ্রিক অনুরাগ থেকে আসে ধর্মতত্ত্ব; রোমক সাম্রাজ্যবাদ এবং আইনবিজ্ঞানের উদাহরণ থেকে আসে গির্জার কেন্দ্রীভূত প্রশাসন এবং ক্যানন ল।

যদিও উচ্চ সভ্যতার এই উপাদানগুলো, এক অর্থে, গোটা মধ্যযুগে সংরক্ষণ করা হয়, তবু এসব দীর্ঘকাল কম-বেশি সুপ্তাবস্থায় থাকে। বস্তুত ঐ সময় পশ্চিমী সভ্যতা সর্বোকৃষ্ট ছিল না; মুসলমান এবং চৈনিক সভ্যতা ছিল উচ্চতর। কেন পশ্চিম দ্রুত উপরের দিকে উঠতে শুরু করল তা, আমি মনে করি, অনেকাংশে বিরাট রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে। আজকের দিনের ঝোঁক হলো সবকিছুর অর্থনৈতিক কারণ অনুসন্ধান, কিন্তু এই অভ্যাসভিত্তিক ব্যাখ্যা ঘটনার অতিসরলীকরণ মাত্র। কেবল অর্থনৈতিক কারণ দিয়ে, উদাহরণত, স্পেনের অবক্ষয় ব্যাখ্যা করা যায় না, বরং এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে অসহিষ্ণুতা এবং নির্বুদ্ধিতার ভেতর। বিজ্ঞানের অভ্যুদয়ও অর্থনৈতিক কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা ভুল হবে। সাধারণ নিয়মে সভ্যতার অবক্ষয় ঘটে কেবল বৈদেশিক উন্নততর সভ্যতার সম্পর্কে এলে। মানব ইতিহাসের গুটিকয় বিরল যুগেই, এবং বিক্ষিপ্ত অঞ্চলে, স্বতঃস্ফূর্ত প্রগতি ঘটে; এবং পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁর সময় থেকে স্বতঃস্ফূর্ত প্রগতি লক্ষ্য করি। আমি মনে করি না যে কথিত যুগের এবং স্থানের সাধারণ সামাজিক অবস্থায় এমন কিছু ছিল যা, যে যুগে এবং স্থানে প্রগতি সংঘটিত হয়নি, তার থেকে বিশিষ্ট ছিল। তাহলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতেই হয় যে বিরাট প্রগতির যুগগুলো নির্ভর করেছে অসাধারণ দক্ষতা সম্পন্ন গুটিকয় ব্যক্তির উপর। অবশ্য এসবের কার্যকারিতার জন্য বিচিত্র সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার দরকার ছিল, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কারণ দেখা গেছে অবস্থা অনুকূলে কিন্তু অসাধারণ ব্যক্তি নেই, অনুরূপ ক্ষেত্রে কোনো প্রগতির দেখা মেলেনি। যদি কেপলার, গ্যালিলিও এবং নিউটন শৈশবেই দেহরক্ষা করতেন তাহলে আমরা এখন যে জগতে বাস করছি তার সঙ্গে ঘোড়শ শতাব্দীর যে বিরাট প্রভেদ, তা অনেক কম হতো। তাহলে এটা আমরা নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে পারি যে প্রগতি কোনো নিশ্চিত ব্যাপার নয়; যদি বিখ্যাত ব্যক্তি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা বাইজান্টাইন ধরনের স্থবিরতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবো।

মধ্যযুগের কাছে আমরা একটা বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ঋণী, আর তা হলো প্রতিনিধিত্বশীল সরকার। এটা গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে এই পদ্ধতি প্রথম বারের মতো সম্ভব করে তুলেছে যে বৃহৎ সাম্রাজ্যের সরকারকে শাসিতের কাছে মনে হতে হবে ঐ সরকার তারাই নির্বাচন করেছে। এই পদ্ধতি যেখানে সফল হয় সেখানে রাজনৈতিক স্থায়িত্ব হয় উচ্চমাত্রায়। তবে সম্প্রতিকালে এটা সুস্পষ্ট হয়েছে যে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ধুলার ধরণীর সব অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য ঔষধি নয়। বাস্তবিকপক্ষে, মনে হয়, এর সাফল্য ইংরেজিভাষী দেশসমূহ এবং ফরাসিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

যে কোনো উপায়ে রাজনৈতিক সংহতি সৃষ্টি পশ্চিমী সভ্যতার বিশিষ্টতাসূচক চিহ্নে পরিণত হয়েছে। অন্যান্য অঞ্চলের সভ্যতায় যা দেখা যায় না। এর প্রধান কারণ দেশপ্রেম, যা, যদিও এর মূল নিহিত ইহুদি সবিশেষত্ব এবং রোমানদের রাষ্ট্রের প্রতি ভক্তিতে, জন্ম নিয়েছে আধুনিককালে, প্রথম সূচিত হয় ইংরেজদের আর্মাডা৫ প্রতিরোধের ভেতর এবং এর প্রথম সাহিত্যিক প্রকাশ ঘটে শেক্সপিয়ারে। ধর্মযুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে প্রধানত দেশপ্রেমভিত্তিক রাজনৈতিক সংহতি পশ্চিমে দ্রুত বাড়ছে। এ ব্যাপারে জাপান অসাধারণ যোগ্য ছাত্র হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। প্রাচীন জাপানে ছিল দাঙ্গাবাজ সামন্ত ব্যারনের দল, যাদের তুলনা গোলাপের যুদ্ধাকালীন ইংল্যান্ডের অসংখ্য ব্যারন। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র এবং বারুদের সাহায্যে শোগুন অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত করে; (জাহাজে আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলাবারুদের সঙ্গে জাপানে ধর্ম প্রচারকরাও এসেছিল); এবং ১৮৬৮ সাল থেকে শিক্ষা ও শিন্টো ধর্মের সাহায্যে সরকার পশ্চিমের মতোই একটা সমসত্ত্ব, দৃঢ়সংকল্প এবং একতাবদ্ধ জাতি গঠনে সফল হয়।

আধুনিক জগতে সামাজিক সংহতির উচ্চ মাত্রার জন্য প্রধানত দায়ী যুদ্ধকৌশলের পরিবর্তন; এবং গোলাবারুদ থেকে শুরু করে সবকিছুর উদ্ভাবন সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। সম্ভবত এই প্রক্রিয়া কোনো মতেই শেষ হয়ে যায়নি, কিন্তু এটা একটা নতুন উপাদানকে জটিল করে তুলেছে: যেহেতু সেনাবাহিনী অস্ত্রাদির জন্য শিল্প শ্রমিকদের উপর ক্রমান্বয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তাই সরকারের খুব বেশি দরকার হয়ে পড়েছে জনসংখ্যার বৃহৎ অংশের সমর্থনের। এই ব্যাপারটা প্রচারণা কৌশলের কাজ এবং এক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে সরকারগুলো দ্রুত উন্নতি সাধন করবে বলেই মনে হয়। গত চার শ বছরের ইউরোপের ইতিহাস ছিল একই সঙ্গে উন্নতি ও অবক্ষয়ের, পুরাতন সংশ্লেষণের অবক্ষয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছে ক্যাথলিক গির্জা, এবং এখনও সম্পূর্ণ না হলেও, নতুন সংশ্লেষণের উন্নতি অদ্যাবধি দেশপ্রেম এবং বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল থেকেছে। এটা মনে করা যায় না যে আমাদের বৈজ্ঞানিক সভ্যতা অন্যত্র প্রতিস্থাপন করলে একই ফল পাওয়া যাবে বা উক্ত স্থানের বৈজ্ঞানিক সভ্যতা আমাদের অনুরূপ হবে। খ্রিষ্টধর্ম এবং গণতন্ত্রে আরোপিত বিজ্ঞান এমন ফলাফল জন্ম দিতে পারে যা কুলপূজা এবং একচ্ছত্র রাজতন্ত্রে আরোপিত বিজ্ঞানের ফলাফল থেকে একেবারে আলাদা। ব্যক্তির প্রতি সুনির্ধারিত শ্রদ্ধার জন্য আমরা খ্রিষ্টধর্মের কাছে ঋণী, কিন্তু এই অনুভূতির প্রতি বিজ্ঞান সম্পূর্ণত নিরপেক্ষ। বিজ্ঞান নিজের থেকে কোনো নৈতিক আদর্শের প্রস্তাব করে না, এবং এ ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে, কোন নৈতিক আদর্শ আমাদের ঐতিহ্য থেকে পাওয়া নৈতিক আদর্শের স্থান দখল করবে। ঐতিহ্য খুব ধীর গতিতে পরিবর্তিত হয়। আর আমাদের নৈতিক আদর্শ যে পর্যায়ে এখনও রয়ে গেছে তা কেবল প্রাক-শিল্পযুগের উপযোগী; তাই বলে এই ধারা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকবে বলে আশা করা যায় না। মানুষ ক্রমান্বয়ে এমন ভাবনা অধিকার করবে যা তার বাস্তব অভ্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এমন আদর্শ গ্রহণ করবে যা তার শিল্পপ্রযুক্তির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। জীবনোপায়ের পরিবর্তনের হার আগের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন দ্রুততর; গত দেড় শ বছরে জগৎ যতটা পরিবর্তিত হয়েছে পূর্ববর্তী চার হাজার বছরে ততটা হয়নি। পিটার দ্য গ্রেট হামুরাবির সঙ্গে বাক্য বিনিময় করতে না-পারলেও একে অপরের কথা খুব ভালোভাবে বুঝতেন; কিন্তু এদের কেউ আধুনিক মহাজন কিংবা শিল্পপতির কথা বুঝতে পারতেন না। একটা কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার এই যে, আধুনিক সময়ের সকল নতুন ধারণা কারিগরি কিংবা বৈজ্ঞানিক। বিজ্ঞান অতি সম্প্রতি নতুন নৈতিক আদর্শ লালন শুরু করেছে, আর এটা শুরু করেছে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন নৈতিক বিশ্বাসের আগল থেকে হিতৈষণা মুক্তির মাধ্যমে। যেখানে প্রথাগত নীতি দুর্ভোগের দণ্ডের বিধান দেয় (উদাহরণত জন্মনিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধকরণে), সেখানে একটু সদয় নীতিকে নৈতিকতাবিবর্জিত মনে করা হয়; ফলে যারা তাদের নীতিকে জ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত হতে দেয়, তাদের অজ্ঞানতার অবতাররা দুষ্ট চরিত্রের গণ্য করে। যাহোক, অবশ্য এটা নিতান্তই সন্দেহজনক যে, আমাদের সভ্যতার মতো একটি সভ্যতা যখন এতটা বিজ্ঞাননির্ভর, তা দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে, সফলতার সঙ্গে এমন জ্ঞান নিষিদ্ধ করতে পারবে যা মানুষের সুখ বিরাটাকারে বৃদ্ধি করতে সমর্থ।

প্রকৃত ব্যাপার এই যে আমাদের প্রথাগত নৈতিক আদর্শ হয় ব্যক্তিগত পবিত্রতার ধারণার মতো একেবারে ব্যক্তি-কেন্দ্রিক কিংবা আধুনিক জগতের গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীর চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর উপযোগী। সামাজিক জীবনের উপর আধুনিক প্রযুক্তির অন্যতম প্রতিক্রিয়া হলো মানুষের কর্মকাণ্ড বিরাট মাত্রায় সংগঠিত হয়েছে বৃহত্তর গোষ্ঠী গঠনে, ফলে একজন মানুষের কার্যকলাপের প্রতিক্রিয়া অনেক সময় এমন জনগোষ্ঠীর উপর পড়ে যে গোষ্ঠীর সঙ্গে তার নিজ গোষ্ঠীর সম্পর্ক সহযোগিতার কিংবা দ্বন্দ্বের। পরিবারের মতো ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোর গুরুত্ব ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এবং এখন কেবলমাত্র একটাই বৃহৎ গোষ্ঠী টিকে আছে, জাতি কিংবা রাষ্ট্র, যে সম্পর্কে প্রথাগত নৈতিকতা কিছুটা পাত্তা দেয়। ফলে এই যে আমাদের কালের কার্যকরী ধর্ম, যদি শুধু প্রথাগত না হয়, দেশপ্রেম নিয়ে গঠিত। গড় মানুষ দেশপ্রেমের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে ইচ্ছুক, এবং সে এই নৈতিক দায়িত্বকে এতটা বাধ্যতামূলক মনে করে যে তার কাছে কোনো বিদ্রোহ সম্ভবপর মনে হয় না।

এটা অসম্ভব মনে হয় না যে ব্যক্তি স্বাধীনতা আদায়ের আন্দোলন যা ছিল রেনেসাঁসের যুগ থেকে উনিশ শতকী উদারতন্ত্রের যুগ পর্যন্ত সময়ের বৈশিষ্ট্য, তা শিল্পায়নের জন্য যে সংগঠনপ্রিয়তা বাড়ে তাতে বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যক্তির উপর সমাজের চাপ, নতুন আকারে এতটা বড় হতে পারে যার তুলনা মিলবে কেবল বর্বর গোষ্ঠীগুলোতে, জাতিসমূহও হয়তো ক্রমান্বয়ে ব্যক্তির কৃতিত্বের চেয়ে সমষ্টির কৃতিত্ব নিয়ে নিজেরা বেশি গর্ব করবে। এই ব্যাপারটা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে লোকেরা গর্ববোধ করে গগণচুম্বী অট্টালিকা, রেলস্টেশন, সেতু ইত্যাদি নিয়ে; কবি, শিল্পী এবং বিজ্ঞানী নিয়ে তাদের কোনো গর্ব নেই। এই একই মনোভাব সোভিয়েত সরকারের দর্শনে অনুপ্রবেশ করেছে। সত্য যে, উভয় দেশে ব্যক্তিবীরের জন্য আকাক্ষা কাজ করে; রুশ দেশে ব্যক্তিগত বিশিষ্টতা কেবল লেনিনের; আমেরিকায় ক্রীড়াবিদ, মুষ্টিযোদ্ধা এবং চলচ্চিত্র তারকাদের। তবে উভয় ক্ষেত্রে কথিত বীরেরা হয় মৃত কিংবা তুচ্ছ এবং বর্তমানের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ সেই কারণে প্রসিদ্ধ কোনো ব্যক্তির নামের সঙ্গে যুক্ত করা হয় না।

একটা কৌতূহলজাগর ব্যাপারে কল্পনা খাটানো যায়; তাহলো, ব্যক্তি নয়, সমষ্টির প্রচেষ্টায় উন্নতমানের কিছু সৃষ্টি করা যায় কি-না এবং তেমন ধরনের সভ্যতা সর্বোৎকৃষ্ট মানের হতে পারে কি-না। আমি তো মনে করি এই প্রশ্নের উত্তর হঠাৎ করে দেয়া সম্ভব নয়। এটা সম্ভব যে শিল্পকলা এবং বুদ্ধিবৃত্তি উভয় ব্যাপারে অতীতে ব্যক্তির প্রচেষ্টায় যা অর্জন করা যেত এখন সহযোগিতার মাধ্যমে তার চেয়ে উন্নততর কিছু অর্জন করা যায়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই একটা ঝোঁক তৈরি হয়েছে, কোনো কাজের ব্যাপারে ব্যক্তি নয়, গবেষণাগার-সংশ্লিষ্টতা অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে, এটা আরো সুস্পষ্টভাবে হলে তা বিজ্ঞানের জন্য হয়তো ভালোই হবে, কারণ এতে সহযোগিতা বাড়বে। কিন্তু যে কোনো ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ যদি সামষ্টিকভাবে করতে হয় তাহলে প্রয়োজনেই ব্যক্তিকে খাটো করতে হবে: সে-ক্ষেত্রে তারা এতকাল যে প্রতিভাবান ব্যক্তি হিসেবে বড়াই করে এসেছেন সেটা আর সম্ভব হবে না। এই সমস্যায় প্রবেশ করে খ্রিস্টীয় নৈতিকতা, তবে স্বাভাবিকভাবে যা মনে করা হয় তার বিপরীত অর্থে। সাধারণভাবে ভাবা হয় যে, যেহেতু খ্রিস্টধর্ম পরার্থবাদী এবং প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করতে বলে, অতএব এই ধর্ম ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ বিরোধী। যাহোক এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রমাদ। খ্রিস্টধর্মের আবেদন ব্যক্তির আত্মার প্রতি এবং এই ধর্ম ব্যক্তির মোক্ষের উপর জোর দেয়। একজন মানুষ তার প্রতিবেশীর জন্য যা করে, সে তা করে কাজটি তার জন্য সঠিক বলে, কারণ এই নয় যে সে, স্বাভাবিকভাবে কোনো বৃহত্তর গোষ্ঠীর অংশ বলে তা করে। সূচনা থেকেই খ্রিস্টধর্ম, এবং এখনও আবশ্যিকভাবে, রাজনৈতিক নয়, এমনকি পারিবারিকও নয়। ফলে এর ঝোঁক হলো প্রকৃতি ব্যক্তিকে যতটা বানিয়েছে তার চেয়ে বেশি স্বয়ম্ভর করে তোলা। অতীতে পরিবার ব্যক্তি-সংশোধনের শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু এখন পরিবারের অবক্ষয় ঘটছে এবং মানুষের প্রবণতার উপর যে অধিকার ছিল তা হারিয়ে ফেলেছে। পরিবার যা হারিয়েছে, জাতির তাই লাভ হয়েছে। কারণ জাতি আবেদন রাখে মানুষের নৈতিক প্রবৃত্তির উপর, যে প্রবৃত্তিগুলো শিল্পায়িত জগতে কোনো সুযোগ পায় না। একজনের ইচ্ছে হয় মানুষ যদি তার জৈবিক সহজাত আবেগসমূহকে মানববংশের কল্যাণে প্রয়োগ করত; কিন্তু এটা মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে অসম্ভব বলেই মনে হয়। বাহ্যিক কোনো বিপদ, যেমন নতুন কোন রোগ কিংবা সার্বিক দুর্ভিক্ষ, হুমকি হয়ে দাঁড়ালে অবশ্য ভিন্ন কথা। এগুলো যেহেতু সম্ভব নয় তাই আমি দেখতে পাই না এমন কোনো মনস্তাত্ত্বিক উপায়ের সম্ভাবনা যা দিয়ে বিশ্ব-সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। একটা উপায় তবু থেকে যায় কোনো জাতি বা কয়েকটা জাতি মিলে যদি গোটা বিশ্ব জয় করে। মনে হয় বিকাশের এটাই স্বাভাবিক ধারা, হয়তো আগামী এক শো কি দুশো বছরের মধ্যে এটা সম্ভবও হবে। পশ্চিমের সভ্যতার বর্তমান অবস্থায় প্রথাগত সকল উপাদানের চেয়ে বিজ্ঞান ও শিল্পপ্রযুক্তির গুরুত্ব অনেক বেশি। এ থেকে মনে করা ঠিক হবে না যে মানবজীবনের উপর এইসব নতুনত্বের ফলাফল সম্পূর্ণ বিকশিত হয়েছে: অতীত যুগের চেয়ে এখন সব কিছু দ্রুততর গতিতে চলে, তাই বলে খুব বেশি দ্রুত গতিতে চলে না। মানবিকতা বিকাশে গুরুত্বের দিক থেকে শিল্পযুগের সঙ্গে তুলনা চলতে পারে এমন সর্বশেষ ঘটনা হলো কৃষিবিজ্ঞান উদ্ভাবন এবং পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে যেতে এর সময় লেগেছে হাজার হাজার বছর। সঙ্গে-সঙ্গে প্রসারিত হয়েছে ভাবনা-ধারণার একটি রীতি ও জীবন যাপনের পদ্ধতি। এমনকি কৃষিজীবন পদ্ধতি এখনও পৃথিবীর সকল অভিজাততন্ত্রকে জয় করতে পারেনি এবং অদ্ভুত রক্ষণশীলতার সঙ্গে এখনও শিকার যুগের স্তরে রয়ে গেছে, শিকারের জন্তু-জানোয়ার সংরক্ষণের নিয়মাবলি থেকে আমরা তা বুঝতে পারি। অনুরূপভাবে আমরা আশা করতে পারি যে কৃষিকার্যের দৃষ্টিভঙ্গি অনুন্নত দেশসমূহ এবং জনগোষ্ঠীর অনুন্নত অংশে বহুকাল টিকে থাকবে।

তবে এই দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমা সভ্যতার বিশিষ্টতা নয়, কিংবা এর থেকে প্রাচ্যে যা জন্ম নিচ্ছে তাও নয়। আমেরিকায় দেখতে পাওয়া যায়, এখানকার কৃষিকার্যও আধা-শৈল্পিক মানসিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কারণ আমেরিকায় কোনো দেশীয় কৃষককুল নেই। রাশিয়া এবং চিনে সরকারের শিল্পায়নের দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, কিন্তু বিরাট অজ্ঞ কৃষি জনসংখ্যার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করতে হয়। যাহোক, এই সঙ্গে এটা স্মরণ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, যে জনগোষ্ঠী লিখতে পড়তে জানে না তাদের সরকারি প্রচেষ্টায় দ্রুত পরিবর্তন করা যায়; পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকায় ব্যাপারটা ভিন্ন বলে কাজটা কঠিন। অক্ষরজ্ঞান বাড়িয়ে এবং সঠিক প্রচার প্রয়োগ করে রাষ্ট্র উদীয়মান প্রজন্মকে প্রবীণদের এতটা ঘৃণা করতে শেখাতে পারে যে, এতে সর্বোন্নত বিষয়াসক্ত আমেরিকাবাসীও অবাক মানবে, এবং এভাবে এক প্রজন্মের মধ্যে মানসিকতার সম্পূর্ণ পরিবর্তন সাধন সম্ভব। রুশদেশে এই প্রক্রিয়া পুরোদমে চলছে; চিনে শুরু হয়েছে। সুতরাং আশা করা যায় যে এই দুটি দেশ শিল্পের অনুকূলে নির্ভেজাল মানসিকতা গড়ে তুলবে। এই মানসিকতা হবে সেই সব প্রথাগত উপাদান থেকে মুক্ত, যা অতি ধীরে বিকাশমান পশ্চিমে এখনও টিকে আছে।

প্রতীচ্য সভ্যতার পরিবর্তন হয়েছে এবং এতটা দ্রুতগতিতে বদলে যাচ্ছে যে যারা এই সভ্যতার অতীতের প্রতি অনুরাগ বোধ করেন তারা দেখতে পান নিজেরা যেন ভিন্ন জগতে বাস করছেন। তবে চলতি কালটা এমন উপাদান আরো সুস্পষ্টভাবে বের করে আনছে যা রোমকদের সময় থেকে কিছু পরিমাণে সব সময় বিরাজিত ছিল, এবং এটাই সব সময়ই ভারত ও চীন থেকে ইউরোপকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। বীর্য, সহিষ্ণুতা এবং বিমূর্ত বুদ্ধিবৃত্তি ইউরোপের স্বর্ণযুগকে প্রাচ্যের স্বর্ণ যুগ থেকে বিশিষ্টতা দেয়। সাহিত্য ও শিল্পে গ্রিকদের হয়তো শ্ৰেষ্ঠতা ছিল, তবে চিনের তুলনায় তাদের শ্রেষ্ঠতা মাত্রার ব্যাপারে শুধু। শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে ইতোমধ্যেই আমি অনেক কিছু বলছি; কিন্তু অসহিষ্ণুতা সম্পর্কে কিছু বলা দরকার, কারণ ইউরোপের এই বৈশিষ্ট্য জনগণ যতটা উপলব্ধি করেন তার চেয়েও প্রকট।

গ্রিকদের এই অসদগুণের প্রতি আসক্তি তার উত্তরসূরিদের চেয়ে অনেক কম ছিল। তবু তারা সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে; এবং প্লেতো, সক্রেটিসের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা সত্ত্বেও, মনে করতেন রাষ্ট্র একটা ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দেবে, এবং ঐ ধর্ম সম্পর্কে যদি কেউ সন্দেহ পোষণ করে তবে তাকে নির্যাতন করতে হবে। অবশ্য তিনি নিজে ঐ ধর্মকে মিথ্যা জ্ঞান করতেন। কনফুশিয়াস, তাও এবং বুদ্ধপন্থীরা এধরনের হিটলারসুলভ মতবাদ মেনে নিতেন না। প্লেতোর ভদ্রলোকোচিত শালীনতা ঠিক ইউরোপীয় ছিল না; ইউরোপ শাহুরিক ও মার্জিত নয়, বরং সমরপ্রিয় ও চতুর ছিল। প্রতীচ্য সভ্যতার বিশিষ্টতা বরং খুঁজে পাওয়া যাবে পুটার্কের সিরাকুস প্রতিরক্ষার বিবরণে। উক্ত যুদ্ধে সিরাকুস আর্কিমিডিস উদ্ভাবিত যান্ত্রিক কৌশলাদি কাজে লাগায়।

নির্যাতনের একটি উৎস, যেমন গণতান্ত্রিক ঈর্ষা, গ্রিকদের মধ্যে খুবই বিকাশ লাভ করে। আরিস্টিডেসকে নির্বাসিত করা হয় কারণ তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রসিদ্ধি উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল; ইফিসাসের হিরাক্লিটাস উল্লসিত হয়ে বলেছেন: ইফিসাসবাসীদের উচিত নিজেদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো, অন্তত এর প্রতিটি বয়স্ক ব্যক্তির তাই করা উচিত এবং নগরটা দাড়িহীন বালকদের হাতে ছেড়ে দেয়া হোক; কারণ তারা তাদের মধ্যেকার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হারমোডোরাসকে বহিষ্কার করেছে এই বলে আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কাউকে থাকতে দেয়া হবে না; যদি কেউ থাকে সে অন্যত্র চলে যাবে, অন্যদের মাঝে বাস করবে। আমাদের কালের অপ্রিয় অনেক বৈশিষ্ট্যই গ্রিকদের ছিল। তাদের মধ্যে ছিল ফ্যাসিবাদ, জাতীয়তাবাদ, সমরবাদ, ক্যুনিজম, অফিসের প্রভু এবং দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ; তাদের মধ্যে কলহপ্রিয় কদর্যতা এবং ধর্মীয় নির্যাতনও দেখা গেছে। তাদের মধ্যে মহৎ ব্যক্তি ছিল, তা আমাদের মধ্যেও তো রয়েছে; এখনকার মতো তখনও উৎকৃষ্ট ব্যক্তিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নির্বাসন, কারাবাস এবং মৃত্যুবরণ করেছে। গ্রিক সভ্যতার অবশ্য একটা ব্যাপারে আমাদের থেকে শ্রেষ্ঠতা ছিল, সেটা হলো পুলিশের অদক্ষতার ক্ষেত্রে। ফলে তখন মার্জিত লোকদের বিরাট একটা অংশ পালিয়ে রক্ষা পেয়েছে।

কন্সটানটাইন কর্তৃক খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার পরই শুধু নিপীড়নকারী আবেগ সম্পূর্ণ প্রকাশের প্রথম সুযোগ পায়, এই নিপীড়নকারী আবেগের জন্যই ইউরোপ এশিয়া থেকে বিশিষ্ট। সত্য যে, গত দেড়শো বছরের বিরতিকালে উদারতন্ত্র ছিল, কিন্তু এখন আবার শ্বেত জাতিসমূহ ধর্মতাত্ত্বিক গোঁড়ামিতে ফিরে যাচ্ছে। এই গোঁড়ামি খ্রিষ্টানরা পেয়েছিল ইহুদিদের কাছ থেকে। ইহুদিরাই প্রথম এই ধারণা উদ্ভাবন করে যে কেবল একটা ধর্মই সত্য হতে পারে। কিন্তু তারা চায়নি যে সারা জগৎ এই ধর্ম গ্রহণ করুক। সুতরাং তারা কেবল অন্যান্য ইহুদিদের অত্যাচার করেছে। খ্রিষ্টানরা ইহুদিদের ঈশ্বরের বিশেষ প্রত্যাদেশে বিশ্বাস সংরক্ষণ করেও এতে যোগ করেছেন রোমকদের জগব্যাপী আধিপত্যের বাসনা এবং গ্রিকদের আধিবিদ্যক সূক্ষ্মতা। এই সমন্বয় সৃষ্টি করেছে অত্যন্ত হিংস্রভাবে নির্যাতনকারী একটি ধর্ম এবং ধর্মের ক্ষেত্রে এতটা হিংস্রতা ইতোপূর্বে ছিল না। জাপান ও চিনে বৌদ্ধধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে গ্রহণ করা হয় এবং শিন্টো ও কনফুশীয় ধর্মের পাশাপাশি অবস্থানের অনুমোদন দেয়: মোহামেডান জগতে খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের অত্যাচার করা হয়নি যতদিন তারা নজরানা প্রদান করেছে; কিন্তু খ্রিষ্টীয় জগতে ধর্মীয় অনুশাসন থেকে ক্ষীণ বিচ্যুতিরও স্বাভাবিক শান্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।

যারা ফ্যাসিবাদ ও ক্যুনিজমের অসহিষ্ণুতা পছন্দ করেন না তাদের সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই, অবশ্য যদি না তারা মনে করেন এটা ইউরোপীয় ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি। নিপীড়নমূলক সরকারি গোঁড়ামির আবহে আমাদের মধ্যে যারা মনে করেন তাদের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে তারা আধুনিক রাশিয়া কিংবা জার্মানির চেয়ে ইউরোপের অতীতের যুগগুলোতে খুব ভালো বোধ করতেন না। জাদুর সাহায্যে আমরা যদি অতীতে ফিরে যেতে পারি, আমরা কি দেখবো আধুনিক রাষ্ট্রসমূহের চেয়ে স্পার্টা উন্নততর? আমরা কি সেই সমাজগুলোতে বাস করতে পছন্দ করতাম যোড়শ শতাব্দীর ইউরোপের মতো সে সমাজ ডাইনিতে অবিশ্বাস করলে মৃত্যদণ্ড প্রদান করেছে? আমাদের কি সহ্য হতো গোড়ার দিকের নিউ ইংল্যাণ্ড, কিংবা ইনকাদের প্রতি পিযারোর (Pizarro) আচরণ? রেনেসাঁস জার্মানি কি উপভোগ্য লাগত, যেখানে ১,০০,০০০ ডাইনিকে পুড়িয়ে মারা হয়? আমাদের কি ভালো লাগত অষ্টাদশ শতকের আমেরিকা, যেখানে বোস্টনের প্রধান। যাজকগণ ম্যাসাচুসেটসের অগ্নিগিরির জন্য দায়ী করেন বিদ্যুত্বহী তারের অধার্মিকতাকে? উনিশ শতকে আমরা কি নবম পোপ পাইয়াসকে সমর্থন করতাম যিনি জন্তু-জানোয়ারের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ সমাজকে নাকচ করে দেন এই যুক্তিতে যে নিম্ন শ্রেণির জীবের প্রতি মানুষের কোনো কর্তব্য আছে এই বিশ্বাস ধর্মবিরোধী? আমি আশংকিত যে ইউরোপ যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন, এই মহাদেশ সর্বকালেই বীভৎস। ছিল, কেবল ১৮৪৮ থেকে ১৯১৪, এই সংক্ষিপ্ত সময়টা বাদ দিয়ে। দুর্ভাগ্যবশত এখন। আবার আদিরূপে প্রত্যাবর্তন করছে।

০৯. তারুণ্যপূর্ণ সিনিসিজম

পশ্চিম দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটু ঘোরাফেরা করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, আজকের বুদ্ধিমান তরুণেরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সিনিক। রাশিয়া, ভারত, চিন কিংবা জাপানের ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়। আমি বিশ্বাস করি চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া এবং পোল্যান্ডেও এমনটা দেখা যাবে না, এবং কোনোক্রমেই জার্মানিতে এটা সার্বজনীন ব্যাপার হতে পারে না। কিন্তু এটা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিমান তরুণদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। পশ্চিমের তরুণেরা কেন সিনিক তা বোঝার জন্য আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে প্রাচ্যের তরুণরা কেন সিনিক নয়।

রুশদেশের তরুণরা সিনিক নয়, কারণ তারা সামগ্রিকভাবে কম্যুনিস্ট দর্শন গ্রহণ করে, এবং দেশটি বিরাট ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, বুদ্ধি দ্বারা ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়ে আছে। সুতরাং তরুণরা অনুভব করে তাদের জন্য অর্থপূর্ণ ভবিষ্যৎ অপেক্ষমাণ। ইউটোপিয়া সৃষ্টি করতে গিয়ে আপনি যখন পাইপলাইন বসাচ্ছেন, গড়ছেন রেলপথ কিংবা কৃষককে শিক্ষা দিচ্ছেন একযোগে চার মাইল ক্ষেত্রে ফোর্ডের ট্রাক্টর চালনা তখন আপনাকে জীবনের লক্ষ্যে নিয়ে ভাববার দরকার করবে না। ফলে রুশ যুবকরা সতেজ এবং আন্তরিক বিশ্বাসে আপ্লুত।

ভারতের অকপট যুবকদের মৌলিক বিশ্বাস এই যে, ইংরেজরা দুষ্ট প্রকৃতির এই উদাহরণ থেকে, যেমন দেকার্তরে অস্তিত্ব বিষয়ক দর্শন থেকে, একটা সমগ্র দর্শন দাঁড় করা যায়। ইংরেজরা যেহেতু খ্রিষ্টান, এই তথ্য থেকে ধরে নেয়া হয় যে হিন্দুধর্ম কিংবা ইসলামধর্ম (যখন যেমন) একমাত্র সত্য ধর্ম। ইংল্যান্ড যেহেতু পুঁজিবাদী এবং শিল্পপ্রধান, অতএব সংশ্লিষ্ট তার্কিকের মেজাজ অনুসারে প্রত্যেকে চকরা ঘুরাবে কিংবা দেশীয় শিল্প ও পুঁজিবাদ বিকাশের জন্য সংরক্ষণমূলক কর আরোপ করতে হবে এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিবাদে এসবই হবে প্রধান হাতিয়ার। আর যেহেতু ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখলে রেখেছে সামরিক শক্তির জোরে, অতএব নৈতিক বল একমাত্র শ্রদ্ধেয় ব্যাপার। তাছাড়া ভারতের জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ড নিগ্রহ তাদেরকে বীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তাদের অসার বা তুচ্ছ মনে করার জন্য যথেষ্ট নয়। এইভাবে ঈঙ্গ-ভারতীয়রা তাদের বুদ্ধিদীপ্ত যুবকদের সিনিসিজমের অনিষ্টকর প্রভাব থেকে রক্ষা করেন।

চিন দেশে ইংরেজদের প্রতি ঘৃণাও একটা ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু এই ঘৃণার পরিমাণ ভারতের চেয়ে কম, কারণ ইংরেজরা ঐ দেশ কোনো দিন জয় করেনি। চৈনিক যুবকরা দেশপ্রেমের সঙ্গে প্রতীচ্যবাদের প্রতি আন্তরিক আগ্রহ যুক্ত করেন। পঞ্চাশ বছর আগে জাপান এই কাজটিই করেছিল। চৈনিক যুবকরা চান চিনের জনগণ আলোকপ্রাপ্ত হোন, স্বাধীন ও সমৃদ্ধশালী হোন এবং এর ফল লাভের জন্য তাদের কাজকে নির্দিষ্ট রূপ দিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে তাদের এই আদর্শ উনিশ শতকের, কিন্তু চিনের জন্য এটা বিগত (প্রাচীন) কালের হয়ে যায়নি। চিনে সিনিসিজম জড়িত ছিল রাজকীয় শাসনযন্ত্রের কর্মচারীদের সঙ্গে, যুদ্ধবাজ সমরনায়কদের মধ্যে এ মনোভাবটা ছিল, যারা ১৯১১ সাল থেকে দেশটিকে বিপথগামী করে। কিন্তু আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের মানসিকতায় সিনিসিজমের স্থান নেই। জাপানের তরুণ বুদ্ধিজীবীদের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা ১৮১৫ সাল থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত ইউরোপীয় কন্টিনেন্টের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন্ন নয়। উদারতন্ত্রের নীতিবাক্য এখনও প্রবল: সংসদীয় সরকার, প্রজার স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও বাক-স্বাধীনতা এই সব নিয়ে তোলপাড় চলে। ঐতিহাসিক সামন্তপ্রথা এবং স্বেচ্ছাচারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তরুণদের ব্যস্ত ও উদ্দীপনার ভেতর রাখার জন্য যথেষ্ট।

পশ্চিমের স্বাভাবিক সারল্যচ্যুত যুবকদের কাছে উষ্ণ আবেগ জিনিসটা গ্রাম্য ব্যাপার বলে অনুভূত হয়। তাদের নিশ্চিত বিশ্বাস এই যে সবকিছু নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করে তারা সব কিছু দেখতে পেরেছে এবং লক্ষ্য করেছে যে ভ্রাম্যমাণ চাঁদের নিচে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। অবশ্য পুরাকালীন শিক্ষায় এর পক্ষে বিপুল যুক্তি রয়েছে। আমি মনে করি না যে, এই যুক্তিগুলো সমস্যার গোড়ায় পৌঁছতে পারে। কারণ অন্যান্য পরিস্থিতিতে যুবকরা পুরাকালীন শিক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং নিজেরাই আলাদা সুসমাচার (Gospel) তৈরি করে নেয়। আজকের প্রতীচীর তরুণরা যদি শুধু সিনিসিজম দ্বারা প্রতিক্রিয়া জানায়, তবে সেই পরিস্থিতির জন্য অবশ্যই বিশেষ কারণ থাকবে। তরুণরা শুধু তাদেরকে যা বলা হয় তাই বিশ্বাস করতে অসমর্থ নয়। তারা সব কিছু বিশ্বাস করতে অসমর্থ। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, এর কারণ খোঁজার জন্য তদন্ত হওয়া উচিত। আমরা প্রথমে কতকগুলো পুরাতন আদর্শ একটা একটা করে আলোচনা করে দেখি তারা কেন পুরাতন আনুগত্যসমূহে প্রেরণা পায় না। ধর্ম, দেশ, প্রগতি, সৌন্দর্য, সত্য, আদর্শ হিসেবে এইগুলোর নাম আমরা করতে পারি। তরুণদের চোখে এগুলোর মধ্যে ভ্রান্তি কোথায়?

ধর্ম-এখানে অসুবিধাটা অংশত পাণ্ডিত্য সংক্রান্ত, অংশত সামাজিক। পাণ্ডিত্য সংক্রান্ত কারণে খুব কম শিক্ষিত লোকেরই এখন ধর্মীয় বিশ্বাসে তীব্রতা আছে, যা সম্ভব ছিল, ধরুন, সেন্ট টমাস অ্যাকুনাসের সময়। অধিকাংশ আধুনিক মানুষের কাছে ঈশ্বর কিছুটা অস্পষ্ট, জীবন শক্তির নামান্তর কিংবা এমন কোনো শক্তি নয় যা আমাদের জন্য ন্যায়ের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। বিশ্বাসী ব্যক্তিরাও পরজগতের চেয়ে ধর্মের ইহজাগতিক ফলাফল নিয়ে অধিক ভাবেন। তারা খুব একটা নিশ্চিত নন যে এই জগত ঈশ্বরের গৌরব প্রকাশের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল। তারা বরং ঈশ্বরকে ব্যবহারিক প্রকল্প মনে করেন যার কাজ হলো বর্তমান জগতের উন্নতিসাধন। ঈশ্বরকে পার্থিব জগতের প্রয়োজনের অধীনস্ত করা তারা প্রকারান্তরে নিজেদের বিশ্বাসের আন্তরিকতায় সংশয় লেপন করেন। তারা হয়তো ভাবেন, সাবাথেরমতো ঈশ্বরকেও মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্টি করা হয়েছিল। গির্জাসমূহকে আধুনিক আদর্শের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ না করার সমাজতাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। গির্জাগুলো উপহার হিসেবে প্রাপ্ত প্রভূত সম্পত্তির জন্য ঐ সম্পত্তি রক্ষার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। উপরন্তু এসব গির্জা নিষ্পেষণমূলক নীতির সঙ্গে জড়িত, এই নীতমালা জীবনের অনেক সুখকে নিন্দনীয় বলে রায় দিয়ে বসে আছে, আর তরুণরা এসব সুখের মধ্যে ক্ষতিকর কিছু দেখতে পান না। গির্জাগুলো নানা প্রকার অত্যাচারও করে থাকে। আর সন্দেহবাদীদের কাছে তা অপ্রয়োজনীয়ভাবে নির্দয় বলে মনে হয়। আমি বেশ কিছু উৎসুক তরুণকে জানি যারা খ্রিষ্টের শিক্ষাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন পরে তারা দেখতে পান যে তাদের গির্জাচালিত খ্রিষ্টধর্মের বিরোধী এবং সমাজচ্যুত গণ্য করা হয়। তাদের অত্যাচারও সইতে হয়েছে, যেন তারা যুধ্যমান নাস্তিক্যবাদী।

দেশ-অনেক যুগে এবং স্থানে দেশপ্রেম ছিল প্রগাঢ় বিশ্বাসের ব্যাপার। এই বিশ্বাসের প্রতি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা সম্পূর্ণ সম্মতি দিতে পারতেন। শেক্সপিয়রের সময়ে ইংল্যাণ্ডে, ফিশতের সময়ে জার্মানিতে, ম্যাসিনির সময়ে ইতালিতে এই বিশ্বাসটা ছিল। পোল্যাণ্ড, চিন এবং বহির্মঙ্গোলিয়ায় এই বিশ্বাসটা এখনও বিদ্যমান। পশ্চিমের জাতিসমূহের মধ্যে দেশপ্রেম এখনও অত্যন্ত শক্তিশালী। সেখানকার রাজনীতি, সরকারি ব্যয়, সামরিক প্রস্তুতি এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয় দেশপ্রেম নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু বুদ্ধিমান তরুণরা দেশপ্রেমকে পর্যাপ্ত আদর্শ হিসেবে গ্রহণে অপারগ; তারা মনে করে নিপীড়িত জাতির জন্য দেশপ্রেম খুবই দরকার, কিন্তু নিপীড়িত জাতি স্বাধীনতা অর্জন করার পরই যে জাতীয়তাবাদ এক সময় বীরত্বব্যঞ্জক ছিল তা নিপীড়নমূলক হয়ে পড়ে। পোল্যাণ্ডবাসীরা মারিয়া তেরেসা অশ্রু বিসর্জন দেবার পর থেকে আদর্শবাদীর সহানুভূতি ভোগ করেছেন, আবার তারাই নিজেদের স্বাধীনতা সংগঠিত করেছেন ইউক্রেনীয়দের নিষ্পেষণের জন্য। আইরিশ জনগণ, যাদের উপর ব্রিটিশ জাতি আট শ বছরের জন্য সভ্যতা আরোপ করেছিল, নিজেদের স্বাধীনতা কাজে লাগিয়ে আইন প্রণয়ন করে উৎকৃষ্টমানের বই প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দেয়। পোলরা ইউক্রেনীয়দের খুন করছে আর আইরিশরা খুন করছে সাহিত্য, এই দৃশ্যগুলো একটি ক্ষুদ্র জাতির জন্যও জাতীয়তাবাদ যে আদর্শ হিসেবে অপর্যাপ্ত তা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু শক্তিধর জাতির বেলা যুক্তিটা বাড়তি শক্তি লাভ করে। ভার্সাই সন্ধি তাদের কাছে খুব একটা প্রেরণাদায়ক ব্যাপার ছিল না যাদের আদর্শ রক্ষা করতে গিয়ে ভাগ্যবলে আত্মাহুতি দিতে হয়নি। অথচ এই আদর্শগুলোর প্রতি তাদের শাসকরা বিশ্বাসঘাতকতা করে। যুদ্ধ চলাকালে যারা এই নীতিবাক্য প্রচার করতেন যে তারা সমরবাদের বিরুদ্ধে যুধ্যমান, যুদ্ধের শেষে তারাই নিজ-নিজ দেশে সমরবাদীতে পরিণত হন। এই ধরনের ঘটনা বুদ্ধিমান তরুণদের কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে তুলেছে যে দেশপ্রেম বর্তমান যুগের সবচেয়ে বড় অভিশাপ এবং এই সমরবাদী নীতি যদি নমনীয় না করা যায় তাহলে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।

প্রগতি-মার্জিত তরুণদের কাছে এই উনিশ শতকী আদর্শে খুব বেশি ব্যাবিট জাতীয় মানবতা রয়েছে। পরিমাপযোগ্য প্রগতি ঘটে মোটর গাড়ি তৈরির সংখ্যা কিংবা কী পরিমাণ বাদাম ভক্ষণ করা হলো, এই জাতীয় গুরুত্বহীন ব্যাপারে। প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ বস্তু পরিমাপযোগ্য নয়। ফলে এটা মান উন্নয়ন কিংবা সংখ্যা বাড়ানোয় আগ্রহী ব্যক্তির পদ্ধতির জন্য উপযুক্ত বিষয় নয়। উপরন্তু বহু আধুনিক উদ্ভাবন মানুষকে করেছে অসহায়। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে রেডিও, সিনেমা এবং বিষাক্ত গ্যাসের নামোল্লেখ করতে পারি। শেক্সপিয়র একটি যুগের উত্তৰ্ষ পরিমাপ করেছেন ঐ যুগের কাব্যশৈলী দ্বারা (৩২তম সনেট দেখুন)। কিন্তু পরিমাপের উক্ত রীতি এখন সেকেলে হয়ে গেছে।

সৌন্দর্য-সৌন্দর্য জিনিসটায় এমন কিছু আছে যার জন্য একে সেকেলে মনে হয়। কিন্তু কেন যে সেকেলে মনে হয় সেটা বলা দুষ্কর। যদি আধুনিক কোনো চিত্রকর সম্পর্কে অভিযোগ তুলে বলা হয় যে তিনি সৌন্দর্য-সন্ধানী তাহলে তিনি তো ক্ষেপেই যাবেন। আজকাল দেখা যায় অধিকাংশ শিল্পী জগতের বিরুদ্ধে ক্রোধ-দ্বারাই উদ্বুদ্ধ বোধ করেন, সুতরাং তারা নির্মল সন্তোষের চেয়ে তাৎপর্যময় ব্যথার চিত্র আঁকায় সমধিক উৎসাহী। তদুপরি অনেক ধরনের সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি দেয়ার জন্য একজনকে কিছুটা ভাবগম্ভীর হতে হয়, যা বুদ্ধিমান আধুনিকের পক্ষে সম্ভব নয়। এথেন্স কিংবা ফ্লোরেন্সের মতো ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের একজন ক্ষমতাবান নাগরিক অনায়াসে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে গণ্য করতে পারতেন। তখন ধুলার ধরণী ছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত, সৃষ্টির লক্ষ্যই ছিল মানুষ, তার শহর মানুষকে সর্বোকৃষ্ট করে তুলেছে, তিনি নিজেও নিজ শহরের সর্বোকৃষ্ট ব্যক্তিদের অন্যতম। অনুরূপ পরিস্থিতিতে ঈস্কিলাস কিংবা দান্তে স্বীয় আনন্দ ও বেদনা গুরুত্ব দিয়ে নিতে পারতেন। তিনি অনুভব করতে পারতেন ব্যক্তি-আবেগের মূল্য রয়েছে, আরো অনুভব করতেন বিয়োগান্তক ঘটনা অমর কবিতায় ধরে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু আধুনিক মানুষ, যখন দুর্ভাগ্যপীড়িত হয়, নিজেকে পরিসাংখ্যিক সমগ্রতার পূর্ণসংখ্যা হিসেবে দেখতে পায় তাদের চোখের সামনে অতীত ও বর্তমান ভেসে ওঠে তুচ্ছ পরাজয়ের নিরানন্দ মিছিল হিসেবে। মানুষকেই তাদের মনে হয় হাস্যকর দাম্ভিক জীবন হিসেবে। এই মানুষ অসীম নিস্তব্ধতার ভেতর সংক্ষিপ্ত বিরতির সময় কেবলি চিৎকার আর হইচই করে। unaccomodated man is no more but such a poor, bare, forked animal.১৮ বলেন রাজা লিয়র এবং এই ধারণা তাকে উন্মাদ করে দেয়, কারণ এই ধারণাটি তার কাছে পরিচিত নয়। কিন্তু এই ধারণা আধুনিক মানুষের কাছে খুবই পরিচিত। ফলে উক্ত ধারণা মানুষ যে তুচ্ছ শুধু এই বিশ্বাসে তাদের পৌঁছায়।

সত্য-পুরাকালে সত্য ছিল সন্দেহাতীত, শাশ্বত এবং অতি-মানবিক। তরুণ বয়সে আমি নিজে এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করি এবং সত্য-সন্ধানে নিজেকে নিবেদন করে তারুণ্যের অপব্যয় করি। আজ কিন্তু একদল শত্রুর অভ্যুদয় ঘটেছে যারা সত্য নিধনে প্রস্তুত: প্রয়োগবাদ, ব্যবহারবাদ, মনস্তত্ত্ববাদ, আপেক্ষিকতা পদার্থশাস্ত্র এই শক্রদলের অন্যতম। গ্যালিলিও এবং ইনকুইজিশন এ ব্যাপারে এক হতে পারেনি যে পৃথিবী সূর্যের চারদিক প্রদক্ষিণ করে নাকি সূর্যই পৃথিবীর চারদিক প্রদক্ষিণ করে। তবে তারা একমত ছিলেন যে এ প্রসঙ্গে তাদের মতামতের বিরাট পার্থক্য রয়েছে। তবে যে একটি ব্যাপারে তারা অভিন্ন মত পোষণ করতেন তা ছিল একেবারে ভুল। মতটি হলো, এ ব্যাপারে তারা যা বলছেন তা শুধু শব্দগত প্রভেদের ব্যাপার। প্রাচীনকালে সত্যের পূজা সম্ভব ছিল; বাস্তবিক পক্ষে মানব বলি দেয়ার যে প্রথা ছিল তা থেকেই পূজার প্রতি আন্তরিকতার প্রমাণ মেলে। কিন্তু সরল মানবিক এবং আপেক্ষিক সত্যের পূজা করা কঠিন বৈকি। এডিংটনের মতে মধ্যাকর্ষণ সূত্র পরিমাপের সুবিধাজনক নিয়ম মাত্র। এই সূত্র অন্যান্য সূত্রের চেয়ে অধিকতর সত্য নয়, যেমন পরিমাপের মেট্রিক পদ্ধতি ফুট ও গজ থেকে অধিক সত্য নয়।

প্রকৃতি ও প্রকৃতির সূত্র অন্ধকারে ছিল: ঈশ্বর বললেন, নিউটন হও, আর পরিমাপে সুবিধা হয়ে গেল।

এই মনোভাবে মহত্ত্বের অভাব আছে বলেই মনে হয়। স্পিনোজা যখন কিছুতে বিশ্বাস করতেন, তিনি মনে করতেন ঈশ্বরের আলোকিত ভালোবাসা উপভোগ করছেন। কিন্তু আধুনিক মানুষ মার্ক্সের সঙ্গে সহমত পোষণ করে মনে করে যে অর্থনৈতিক অভীষ্টই তাকে পরিচালিত করে কিংবা ফ্রয়েডের প্রভাবে মনে করে নির্দিষ্ট যৌন তাড়নার জন্যই সে কোনো তত্ত্বে আস্থা রাখছে কিংবা যৌন-তাড়নার জন্যই লোহিত সাগরে প্রাণীকুলের প্রকারভেদে বিশ্বাস করে। তবে কোনো ক্ষেত্রেই সে স্পিনোজার মতো পুলক অনুভব করতে পারে না।

এতদূর আমরা বুদ্ধিবাদী ভঙ্গিতে সিনিসিজমের বিচার করেছি, মনে করেছি সিনিসিজমের বুদ্ধিগত কারণ রয়েছে। যাহোক, আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদরা বলতে কখনো ক্লান্তি বোধ করেন না যে, বিশ্বাস কদাচিৎ ন্যায়সঙ্গত অভিলাষ দ্বারা নির্ধারিত হয়, অবিশ্বাস সম্পর্কে একই কথা খাটে, যদিও সংশয়বাদীরা এ ব্যাপারটা প্রায়শই উপেক্ষা করে চলেন। ব্যাপক সংশয়বাদীতার কারণ সম্ভবত সমাজতাত্ত্বিক, বুদ্ধিগত নয়। প্রধান কারণ ক্ষমতাহীন স্বাচ্ছন্দ্য। ক্ষমতার অধিকারীরা সিনিক হন না, কারণ তারা তাদের ধ্যান-ধারণা অপরের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন। নিপীড়িত জনগণও সিনিক হন না, যেহেতু তাদের মন ঘৃণায় পূর্ণ, আর ঘৃণা, অন্য যে কোনো সবল ভাবাবেগের মতো, প্রচণ্ড বিশ্বাস বয়ে আনে। শিক্ষা, গণতন্ত্র এবং ব্যাপক উৎপাদন অভ্যুদয়ের আগ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ বুদ্ধিজীবীরা প্রভাবিত করেছেন, তাদের গলা-কাটা গেলেও এই প্রভাব কোনো সময় খর্ব হয়নি। আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন। আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা যদি নির্বোধ ধনীদের প্রচারক কিংবা রাজবিদূষক হিসেবে কাজ করতে রাজি থাকে তবে তাদের বড় চাকরি লাভ এবং মোটা টাকা উপার্জনে কোনো মতেই অসুবিধা হয় না। ব্যাপক উৎপাদন এবং প্রাথমিক শিক্ষার ফল দাঁড়িয়েছে যে, নির্বুদ্ধিতা এখন অনেক গভীরে প্রোথিত। সভ্যতা উন্মেষের পর থেকে নির্বুদ্ধিতা এত বেশি গভীরে প্রোথিত হয়নি। জার সরকার লেনিনের ভ্রাতাকে হত্যা করলে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ লেনিন কিন্তু সিনিকে পরিণত হয়ে যাননি, তাঁর মধ্যে জন্ম নিয়েছে ঘৃণা, এবং আজীবন এই ঘৃণার অনুপ্রেরণায় কাজ করে শেষ পর্যন্ত সফল হন। কিন্তু সমধিক দৃঢ় পশ্চিমা দেশগুলোতে ঘৃণাবোধ করার সুযুক্তি কদাচিৎ মেলে। এত ব্যাপক জিঘাংসা সাধনের সুযোগ ঘটে না। বুদ্ধিজীবীদের কাজের আদেশ দেয় এবং অর্থ যোগায় সরকার কিংবা ধনীরা, যাদের উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের জন্য ক্ষতিকর না হলেও হাস্যকর বলেই মনে হয়। কিন্তু সিনিসিজমের একটু ছোঁয়া থাকার দরুন তারা পরিস্থিতির সঙ্গে বিবেকের সাযুজ্য ঘটাতে সমর্থ হয়। তবে এটা সত্য যে ক্ষমতাসীনরা আশা করে কোনো কোনো কর্মকাণ্ডে সম্পূর্ণ প্রশংসনীয় কাজ হোক, এইসব কাজের মধ্যে প্রধান হলো বিজ্ঞান; পরবর্তী হলো আমেরিকায় গণস্থাপত্যশিল্প। কিন্তু একজন মানুষের শিক্ষা যদি কেবল সাহিত্যগত হয়, যা এখনও প্রায় দেখা যায়, তাহলে বাইশ বছর বয়সে সে দেখতে পায়, সকল দক্ষতা নিয়ে যা-কিছু তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তার জন্য সে কিছুই করতে পারছে না। এমনকি পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও বিজ্ঞান-সাধকরা সিনিসিজমে ভোগেন না; কারণ সমাজের অনুমতিক্রমেই তাদের বুদ্ধি কাজে লাগাতে পারেন। তবে আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এরা ব্যতিক্রম এবং ভাগ্যবান।

যদি এই নিদান সঠিক হয় তাহলে আধুনিক সিনিসিজম কেবলমাত্র প্রচার দ্বারা কিংবা তরুণদের সামনে উন্নততর কোনো আদর্শ উপস্থাপন করে দূর করা যাবে না। ধর্মযাজক এবং জরাজীর্ণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্ম থেকে নির্গত আদর্শ থেকে উন্নততর বলেও প্রমাণিত হবে না। এই রোগের প্রতিবিধান তখনই মিলবে যখন বুদ্ধিজীবীরা এমন কাজ পাবে যা তাদের সৃষ্টিশীল ঝোঁক বাস্তবায়নের সহায়ক হবে কিংবা বাস্তবায়ন করতে পারবে। ডিসরেলি যে ব্যবস্থাপত্রের পক্ষে বলে গেছেন তা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা আমি দেখতে পাচ্ছি না; আগে তোমাদের প্রধান শিক্ষকদের শিক্ষিত করো। এই শিক্ষা হবে আরো বাস্তব শিক্ষা, সাধারণভাবে সর্বহারা শ্রেণিকে কিংবা ধনিক শ্রেণিকে যে শিক্ষা দেয়া হয় তার থেকে আলাদা হতে হবে। এই শিক্ষা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বিবেচনায় রাখবে। উপযোগীবাদী এষণা থেকে শুধু সামগ্রীর পাহাড় গড়বে না, যা কারো সময়ে কুলাবে না উপভোগের। মানব দেহ সম্পর্কে কিছু জ্ঞান না থাকলে কাউকে ডাক্তারী পেশায় নিয়োজিত হতে দেয়া হয় না অথচ একজন অর্থলগ্নিকারী যদি তার কাজের বিচিত্র দিক সম্পর্কে অজ্ঞ হন তবু তাকে নির্বোধে কারবার চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়, কেবল ব্যতিক্রম করা হয় যদি তার ব্যাংকের খাতায় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। জগণ্ডা কী সুখকরই না হতো যদি অর্থশাস্ত্র এবং গ্রিক কবিতা বিষয়ে পরীক্ষায় যিনি পাস করেননি তাকে স্টক এক্সচেঞ্জে কাজ করার অনুমতি প্রদান করা না-হতো, কিংবা রাজনীতিকরা ইতিহাস এবং আধুনিক উপন্যাসের জ্ঞান রাখতে বাধ্য হতেন। কল্পনা করুন একজন বড় শিল্পপতি এই প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন: আপনি যদি প্রচুর পরিমাণে গম মজুদ করেন, তার প্রতিক্রিয়া জার্মান কবিতায় কী হবে? আধুনিক বিশ্বে হেতুবাদ যে কোনো সময়ের চেয়ে সমধিক জটিল এবং এর শাখা-প্রশাখা সুদূর বিস্তৃত, বৃহৎ সংগঠনের সংখ্যা বৃদ্ধিই এর কারণ; কিন্তু এই সংগঠনগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারা মূর্খ, তারা তাদের কাজের ফলাফল এক শতাংশও বোঝে না। রাবলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি হারানোর ভয়ে তার বই নিজের নাম গোপন করে ছাপতেন। আধুনিকরা বলে ঐ ধরনের বই লিখতেই যাবেন না। কারণ আজকের দিনের প্রচারণার নিখুঁত পদ্ধতি লেখকের নাম ঠিকই খুঁজে বের করবে। জগতের শাসককুল সর্বকালেই নির্বোধ ছিল। কিন্তু বর্তমান কালের শাসকদের মতো তাদের এত ক্ষমতা ছিল না। এই শাসকদের কীভাবে বুদ্ধিমান করে তোেলা যায় তার উপায় খুঁজে বের করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমস্যার সমাধান কি সম্ভব নয়? অসম্ভব আমি মনে করি না, তবে কাজটা যে সহজ তাও আমার মনে হয় না।

 ১০. আধুনিক প্রকৃতিগত সমরূপতা

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমেরিকায় ইউরোপীয় পর্যটকগণ দুটি বিশেষত্ব দেখে চমকে ওঠেন; প্রথমত, গোটা যুক্তরাষ্ট্রের (পুরাতন দক্ষিণাঞ্চল বাদে) সর্বত্র দৃষ্টিভঙ্গির একেবারে অনুরূপতা, দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক লোকালয়ের আসক্তিপূর্ণ অভিলাষ এটা প্রমাণ করা যে তাদের এলাকা বিশিষ্ট এবং অন্য যে কোনো এলাকা থেকে ভিন্ন। অবশ্য দ্বিতীয়টির কারণ প্রথমটি। প্রত্যেক জায়গা স্থানীয় গরিমা বোধের কারণ থাকুক এই বাসনা পোষণ করে। সুতরাং ঐতিহাসিক কিংবা ঐতিহ্যগত বিশিষ্টতা থাকলে তারা সেটা খুব যত্নের সঙ্গে লালন করেন। বাস্তবে সমরূপতা যত বেশি হয়, বিভিন্নতা খোঁজার আগ্রহ হয় তত প্রবল ঐ সমরূপতা কিছুটা লঘু করার জন্য। পুরাতন দক্ষিণাঞ্চল বস্তুত অবশিষ্ট আমেরিকা থেকে একেবারে আলাদা, এত আলাদা যে একজনের বোধ হয় সে অন্য কোনো দেশে এসেছে। এই অঞ্চল কৃষিভিত্তিক, আভিজাতিক এবং ভূতাপেক্ষ (retrospective)। অথচ বাকি আমেরিকা শিল্পায়ন, গণতান্ত্রিক এবং ভবিষ্যত্মখীন। যখন আমি বলি যে পুরাতন দক্ষিণাঞ্চলের বাইরে আমেরিকা শিল্পায়ত তখন আমি এমন অঞ্চলের কথাও ভাবি যে অঞ্চল প্রায় সামগ্রিকভাবে কৃষিকর্মে নিবেদিত, কারণ মার্কিন কৃষিজীবীদের মানসিকতা শিল্পপতির। তারা অত্যন্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি কাজে লাগায়; রেলওয়ে এবং টেলিফোনের উপর তারা খুব বেশি নির্ভরশীল। এই কৃষক দূরের বাজার-ঘাট সম্পর্কে খুব সচেতন, কারণ এসব বাজারে তার পণ্য যায়; সে আসলে পুঁজিবাদী, এমন হতে পারত যে সে অন্য কোনো ব্যবসায় নিয়োজিত। ইউরোপ বা এশিয়ায় আমরা যে ধরনের কৃষক দেখি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার অস্তিত্ব নেই। এটা আমেরিকার জন্য বিরাট আশীর্বাদ। এবং সম্ভবত ওল্ড ওয়ার্ল্ডের তুলনায় এক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্ৰেষ্ঠতা, কারণ অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকরা নির্দয়, লোভী, রক্ষণশীল এবং অদক্ষ। আমি সিসিলি এবং ক্যালিফোর্নিয়ার কমলালেবুর কুঞ্জ দেখেছি; বৈসাদৃশ্য দুহাজার ব্যবধানের প্রতিনিধিত্ব করে। সিসিলির কমলালেবুর কুঞ্জ রেল স্টেশন কিংবা নদী-বন্দর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত, গাছগুলোতে বার্ধক্যের ছাপ, গাঁটযুক্ত, দেখতে সুন্দর; আবাদের পদ্ধতি একেবারে পুরাকালীন। লোকগুলো অজ্ঞ ও অর্ধ-বর্বর, রোমক ক্রীতদাস এবং আরব্য আক্রমণকারীদের সংকরজাতীয় উত্তরসূরি; গাছ সম্বন্ধে তাদের বুদ্ধিমত্তায় ঘাটতি তারা পুষিয়ে নেয় জীবজানোয়ারের প্রতি নির্দয় আচরণ করে। নৈতিক অধঃপতন এবং আর্থিক ব্যাপারে অযোগ্যতার সহযোগী হয় সহজাত সৌন্দর্যজ্ঞান যা সব সময় একজনকে মনে করিয়ে দিচ্ছে থিওক্রিটাস এবং হেসপিরাইডিসের উদ্যান সম্পর্কিত উপকথা। ক্যালিফোর্নিয়ার কমলালেবু কুঞ্জে এলে হেসপিরাইডিসের উপকথাকে সুদূর অতীতের মনে হয়। সবগুলো গাছ দেখতে একই রকম লাগে। যত্নের ছাপ সুস্পষ্ট, প্রতিটি গাছ সমান দূরত্বে লাগানো। সবগুলো কমলার আকৃতি সমান নয়। কিন্তু যন্ত্র দিয়ে অতি যত্নে বাছাই হবার পর দেখা যায় একটি বাক্সের সবগুলো কমলালেবু সমান আকৃতির। এগুলো উপযুক্ত জিনিসের সঙ্গে উপযুক্ত স্থানে আনা হয়, অতঃপর উপযুক্ত রেফ্রিজারেটর-গাড়িতে ওঠে এবং উপযুক্ত বাজার এদের শেষ গন্তব্যস্থল। যন্ত্র এদের গায়ে Sunkist কথাটা ছাপ মেরে দেয়। অন্যথায় এমন কোনো লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে ওদের উৎপাদনে প্রকৃতির কোনো হাত ছিল। উপরন্তু আবহাওয়া পর্যন্ত কৃত্রিম, কারণ যখন উদ্যান কুয়াশায় ছেয়ে যায় তখন উষ্ণ রাখা হয় ধোঁয়ার আবরণ সৃষ্টি করে। এই ধরনের কৃষিকর্মের সঙ্গে যারা যুক্ত তারা পূর্বকালের কৃষিবিদদের মতো অনুভব করে না যে তারা প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের দাস; বরং তারা নিজেদের প্রভু মনে করেন, প্রাকৃতিক শক্তিই তাদের ইচ্ছার কাছে নত হয়। ফলে ওল্ড ওয়ার্ল্ডে শিল্পপতি এবং কৃষিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যে তফাত রয়েছে আমেরিকায় সে ধরনের তফাত লক্ষ্য করা যায় না। মার্কিনী পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মানবিক; তুলনায় অ-মানবিক অঙ্গ তাৎপর্যহীনতায় তলিয়ে যায়। আমাকে সব সময় দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় বলা হতো যে আবহাওয়া লোকগুলোকে পদ্মাভুকে পরিণত করেছে। কিন্তু আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে আমি এর কোনো প্রমাণ পাইনি। আমার কাছে তাদের মিনিয়াপলিস এবং ইউনিপেগের লোকদের মতোই মনে হয়েছে। যদিও দুটি অঞ্চলের মধ্যে আবহাওয়া, দৃশ্যাবলি এবং প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রভেদ যতটুকু হওয়া সম্ভব তার কম নয়। নরওয়ে এবং সিসিলির লোকদের পার্থক্য বিষয়ে একজন যখন বিবেচনা করেন এবং এর সঙ্গে তুলনা করেন (ধরুন) উত্তর ডাকোটার একজন লোকের সঙ্গে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার। একজন লোকের প্রভেদের ঘাটতি, তখন একজন উপলব্ধি করেন ভৌত পরিবেশের দাস না হয়ে প্রভু হয়ে তারা মানবিক ব্যাপারে কতটা বিপ্লব সাধন করেছে। নরওয়ে এবং সিসিল, উভয়ের প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে; তাদের প্রাক-খ্রিষ্টীয় ধর্ম ছিল, যে ধর্মে আবহাওয়ার প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়া বাস্তব রূপ নেয়। তারপর খ্রিষ্টধর্ম আসে এবং অনিবার্যভাবে দুটি দেশে দুই ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করে। নরওয়েবাসীরা ভয় করত বরফ ও তুষার; সিসিলির লোকদের ভয় ছিল লাভা ও অগ্নিগিরির প্রতি। নরক উদ্ভাবিত হয়। দক্ষিণাঞ্চলীয় আবহে; নরক যদি নরওয়েতে উদ্ভাবিত হতো, তাহলে সে নরক হতো। হিমশীতল। কিন্তু উত্তর ডাকোটা কিংবা দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় নরক আবহাওয়াগত ব্যাপার নয়; উভয় অঞ্চলে এটা টাকার বাজারে গুরুতর চাপ। এতেই বোঝা যায় আধুনিক জীবনে আবহাওয়ার গুরুত্বহীনতা।

আমেরিকা মনুষ্য-নির্মিত জগৎ; উপরন্তু এই জগৎ মানুষই তৈরি করেছে যন্ত্রের সাহায্যে। আমি কেবল ভৌত পরিবেশের কথা ভাবছি না, সমভাবে চিন্তা এবং আবেগ সম্পর্কেও ভাবছি। একবার ভাবুন তো বাস্তবিক ভয়াবহ একটা খুনের কথা; খুনীর পদ্ধতি আদিকালের হতে পারে, কিন্তু যারা খুনের তথ্য প্রচারিত করে তারা সাহায্য গ্রহণ করে বিজ্ঞানের সর্বশেষ উৎস বা উদ্ভাবনের। শুধু বৃহৎ নগরগুলো নয়, প্রেইরি অঞ্চলের নির্জন খামার এবং রকি অঞ্চলের খনির আখড়ায় রেডিও সর্বশেষ সকল তথ্য প্রচার করে, ফল দাঁড়ায় এই যে, যে কোনো দিন দেশের প্রত্যেক বাড়িতে আলাপ আলোচনার অর্ধেক বিষয় হয় অভিন্ন। ট্রেনে সমতলভূমি অতিক্রমের সময়, লাউডস্পীকার থেকে সাবানের বিজ্ঞাপন শোনা যাচ্ছিল, আমি না শোনার চেষ্টা করছিলাম, এক বৃদ্ধ কৃষক আমার কাছে এসে হাসি মুখে বললেন, আপনি যেখানেই যান না কেন সভ্যতা এড়াতে পারবেন না। হায়! কি সত্য কথা। আমি ভার্জিনিয়া উলফের একটা বই পড়ার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সে দিনের জন্য বিজ্ঞাপনের জয় হলো।

জীবনের বাস্তব প্রয়োজনের অনুষঙ্গাদির অনুরূপতা কোনো গুরুতর ব্যাপার নয়। কিন্তু ভাবনা ও অভিমত যদি অভিন্ন হয় সেটা হবে অধিকতর বিপজ্জনক। তবে এটা আধুনিক উদ্ভাবনসমূহের অনিবার্য ফল। বিচ্ছিন্ন ও ক্ষুদ্র আকারে উৎপাদনের চেয়ে সম্মিলিতভাবে এবং বিরাট পরিমাণে উৎপাদন করতে গেলে অনেক সস্তা পড়ে। এটা যেমন অভিমত উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি প্রযোজ্য সামান্য পিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে। আজকের দিনে অভিমত উৎপাদনের প্রধান উৎসসমূহ হলো বিদ্যালয়, গির্জা, পত্র-পত্রিকা, সিনেমা এবং রেডিও। যন্ত্রপাতির ব্যবহার যত বাড়বে প্রাথমিক স্কুলগুলোতে শিক্ষা ততই প্রমিত হবে। ধরে নেয়া যায় যে নিকট ভবিষ্যতে স্কুল শিক্ষায় সিনেমা এবং রেডিও-র ব্যবহার দ্রুত গতিতে বাড়বে। এর অর্থ হলো একটা কেন্দ্রে পাঠ তৈরি করা হবে এবং যেখানে উক্ত কেন্দ্রের পণ্য ব্যবহার করা হবে সেখানে পাঠ হবে অভিন্ন। আমি শুনেছি কোনো কোনো গির্জা আদর্শ ধর্মোপদেশ অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত যাজকদের কাছে প্রতি সপ্তাহে প্রেরণ করে, এবং এই যাজকরা যদি মানব প্রকৃতির সাধারণ নিয়মে চলেন, তাহলে নিঃসন্দেহে তারা কৃতজ্ঞ বোধ করেন যে তাদের নিজেদের ধর্মোপদেশ তৈরির জন্য কষ্ট করতে হলো না। এই আদর্শ ধর্মোপদেশ অবশ্যই ঐ সময়ের তাজা বিষয়ের উপর আলোকপাত করে, লক্ষ্য হলো দেশের সর্বত্র একই গণআবেগ জাগ্রত করা। এই একই ব্যাপার উচ্চমাত্রায় সংবাদপত্রের বেলায় খাটে। সংবাদ সর্বত্র টেলিগ্রাফের মাধ্যমে আসে এবং ব্যাপক আকারে ব্যবহৃত হয়। পুস্তক সমালোচনা, শ্রেষ্ঠ পত্রিকাদি বাদে, নিউইয়র্ক থেকে সানফ্রানসিসকো, মেইন থেকে টেক্সাসে, একই। তবে একটা ব্যতিক্রম; আপনি যতই উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হবেন দেখতে পাবেন সমালোচনার পরিসর ছোট হয়ে আসছে।

সম্ভবত আধুনিক জগতে অনুরূপতা সৃষ্টির সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে সিনেমা, কারণ সিনেমার প্রভাব শুধু মার্কিন মুলুকে সীমাবদ্ধ নয়। এর অবাধ অনুপ্রবেশ জগতের সর্বত্র। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাদ দিয়ে ধরতে হবে। তবে এখানে আলাদা জাতের অনুরূপতা রয়েছে। বিস্তৃত অর্থে, মিডল ওয়েস্ট কি পছন্দ করে সে সম্পর্কে হলিউডের অভিমত সিনেমায় রূপদান করা হয়। এই ব্যবস্থাপত্রের আলোকে প্রেম, বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের আবেগ প্রমিত হচ্ছে। জগতের সর্বত্র তরুণের কাছে আধুনিকতা সম্পর্কে শেষ কথার প্রতিনিধিত্ব করে হলিউড। একই সঙ্গে হলিউড তুলে ধরে ধনী ব্যক্তিদের সুখ এবং কীভাবে ধনবান হওয়া যায় তার পদ্ধতি। অনুমান করছি, অদূর ভবিষ্যতে সিনেমা সার্বজনীন একটা ভাষা অবলম্বনে বাধ্য করবে এবং সেই ভাষাটা হবে হলিউডের।

আমেরিকার অপেক্ষাকৃত অধিক অজ্ঞদের মধ্যে শুধু অনুরূপতা রয়েছে মনে করলে ভুল হবে। এই ব্যাপারটা খাটে, একটু কম মাত্রায় হলেও, সংস্কৃতির বেলায়। আমি ঐ দেশের সর্বত্র বইয়ের দোকান দেখতে গেছি, লক্ষ্য করেছি সব দোকানেই এই বেস্ট সেলার প্রাধান্য পেয়েছে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে। যতটুকু বুঝতে পেরেছি, আমার মনে হয়েছে যে আমেরিকার সংস্কৃতিবান মহিলারা প্রতি বছর ডজন খানেক বই কেনে, এবং ঐ এক ডজন পুস্তকই সর্বত্র বিক্রি হয়। কোনো লেখকের কাছে ব্যাপারটা অত্যন্ত সন্তোষজনক, অবশ্য তিনি যদি ঐ এক ডজন পুস্তকের একটির লেখক হন। কিন্তু এখানে ঘটনা ইউরোপ থেকে আলাদা। ইউরোপে অনেক বই, বিক্রি কম: গুটিকয় বই, বিক্রি অধিক এমন নয়।

আবার এটা ধরে নেয়া ঠিক হবে না যে অনুরূপতার প্রতি ঝোঁক একেবারে খারাপ কিংবা একেবারে ভালো। এর সুবিধা অসুবিধা দুই-ই রয়েছে; অবশ্যই এর প্রধান সুবিধা হলো এতে এমন জনগোষ্ঠী তৈরি হয় যারা শান্তিপূর্ণভাবে সহযোগিতার পরিবেশে বাস করতে সমর্থ। এর বড় অসুবিধা এখানে যে এটা যে জনগোষ্ঠী তৈরি করে তার প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায় সংখ্যালঘু অত্যাচারের। এই ত্রুটি হয়তো সাময়িক, কারণ অদূর ভবিষৎতে সংখ্যালঘু বলে কিছু থাকবে না। অবশ্য অনেকটা নির্ভর করে অনুরূপতা কীভাবে অর্জন করা হয় তার উপর। একটা উদাহরণ নেয়া যাক; দক্ষিণ ইতালিবাসীদের প্রতি স্কুলগুলো কী করছে। গোটা ইতিহাস জুড়ে দক্ষিণ ইতালিয়াবাসীরা খুন, অসদুপায়ে অর্থ উপার্জন এবং নান্দনিক সংবেদনশীলতার জন্য বিশিষ্ট। পাবলিক স্কুলগুলো কার্যকরীভাবে এই তিনটির শেষটি থেকে তাদের আরোগ্য করে, এবং এ ক্ষেত্রে তাদের আমেরিকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অনুরূপ করে তোলে, কিন্তু বাকি দুটি সুস্পষ্ট গুণ ব্যাপারে স্কুলগুলো চিহ্নিত করার মতো কোনো সাফল্য দেখাতে পারে না। এতে অনুরূপতা লক্ষ্য হওয়ার বিপদগুলোর একটি উপলব্ধি করা যায়; অসদগুণের চেয়ে সদগুণ বিনষ্ট করা সহজতর, সুতরাং মান কমিয়ে দিয়ে সহজেই অনুরূপতা অর্জন করা সম্ভব। অবশ্য এটা পরিষ্কার, যে দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী বৈদেশিক সেখানে বিদ্যালয়ের মাধ্যমে বিদেশাগতদের ছেলেমেয়েদের গ্রহণীয় করে তোলার চেষ্টা নেয়া হবেই এবং ফলে নির্দিষ্ট মাত্রায় মার্কিনীকরণ অবশম্ভাবী। সে যাই হোক, দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে, এই প্রক্রিয়ার একটা বড় অংশ নগ্ন জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্রভাবিত হবে। আমেরিকা ইতঃমধ্যেই জগতের সবচেয়ে শক্তিধর দেশে পরিণত হয়েছে, এবং দেশটির প্রাধান্য দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। এতে স্বভাবতই ইউরোপে ভীতি সঞ্চারিত হয়েছে এবং সবকিছু সমরতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী লক্ষণাক্রান্ত বলে ভীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমেরিকার হয়তো দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াবে ইউরোপকে রাজনৈতিক সদবুদ্ধি প্রদান, তবে আমি আশংকিত যে তার ছাত্ররা অবাধ্য প্রমাণিত হবে।

আমেরিকায় অনুরূপতার দিকে ঝোঁকের সঙ্গে, আমার মনে হয়েছে, গণতন্ত্র সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে গণতন্ত্রের জন্য দরকার সব মানুষকে একরকম হওয়া, এবং যদি কোনো ব্যক্তি অন্য একজন ব্যক্তি থেকে আলাদা হন তাহলে ধরা হয় তিনি নিজেকে ঐ ব্যক্তি থেকে উন্নততর বলে জাহির করছেন। ফ্রান্স আমেরিকার মতোই গণতান্ত্রিক অথচ ফ্রান্সে এ ধরনের মত পোষণ করা হয় না। ডাক্তার, উকিল, যাজক, সরকারি কর্মচারী সবাই ফ্রান্সে আলাদা ধরনের। প্রত্যেকটি পেশার নিজস্ব ঐতিহ্য এবং মান রয়েছে, অথচ একটা পেশা অপরাপর পেশা থেকে উন্নততর বলে জাহির করা হয় না। আমেরিকার সকল পেশাজীবীই ব্যবসায়ী শ্রেণির মতো। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, একজনের ডিক্রি জারি করা উচিত ঐকতানে শুধু কয়েকটি বেহালা থাকবে। এমন বোধ কারো মধ্যে কাজ করে না যে বাস্তবে সমাজ হবে একটা প্যাটার্নের মতো কিংবা প্রাণবান, যেখানে বিভিন্ন অঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করবে। কল্পনা করুন চোখ ও কান বিবাদ করছে কোনটা ভালো, দেখা না শোনা, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে যে কোনোটাই ভালো। কাজ করে না, যেহেতু এর কোনোটিই উভয় কাজ করতে পারে না। গণতন্ত্র সম্পর্কে আমেরিকায় এরকম ধারণাই পোষণ করা হয়। যে কোনো ধরনের চমত্তারিত্ব ব্যাপারে, যা সার্বজনীন হতে পারে না, অদ্ভুত ঈর্ষা বোধ করা হয়, তবে খেলাধুলার ক্ষেত্রে নয়, এখানে আভিজাত্য খুব উৎসাহের সঙ্গে প্রশংসা করা হয়ে থাকে। মনে হয় গড় মার্কিনীরা মস্তিষ্কের চেয়ে পেশির প্রতি বেশি বিনয়। কারণ হয়তো এই যে, তাদের মস্তিষ্কের চেয়ে পেশির প্রতি শ্রদ্ধা গভীরতর এবং বেশি আন্তরিক। আমেরিকায় বিজ্ঞানের জনপ্রিয় গ্রন্থের যে প্লাবন তার অনুপ্রেরণা, অংশত, যদিও অবশ্য গোটাটা নয়, এসেছে একথা স্বীকার করার অনিচ্ছা থেকে যে বিজ্ঞানে এমন কিছু আছে যা শুধু বিশেষজ্ঞরাই বুঝতে পারেন। ধরুন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বোঝার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার রয়েছে এমন ধারণাই ওদের কাছে বিরক্তিকর। আবার ওদের বলুন প্রথম শ্রেণির ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার করে, কেউ মোটেই বিরক্ত হবে না।

অর্জিত খ্যাতির প্রতি অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে আমেরিকায় বেশি শ্রদ্ধা দেখানো হয়, তবে তরুণদের জন্য এ ধরনের খ্যাতি অর্জনের পন্থা কঠিন করে তোলা হয়। কারণ জনগণ কোনো খামখেয়ালি সহ্য করতে পারে না, কিংবা যাকে বলা হয়। একজন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে এটা তাদের কাছে অসহ্য, অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ইতঃমধ্যেই প্রসিদ্ধ বলে চিহ্নিত হয়ে থাকলে আলাদা কথা। ফলে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের তারা শ্রদ্ধা করলেও দেশে তৈরি করতে পারে না। ইউরোপ থেকে আমদানি করতে হয়। এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রমিতকরণ এবং অনুরূপতা। অসাধারণ মেধা, বিশেষ করে শিল্পের ক্ষেত্রে, তরুণ বয়সে বিরাট বাধার সম্মুখীন হতে বাধ্য। যতদিন সবার কাছে প্রত্যাশা করা হবে তারা সফল নির্বাহী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্যাটার্ন অনুসরণ করবে, ততদিন এর ব্যত্যয় হবে না।

অসাধারণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রমিতকরণ অসুবিধার কারণ হতে পারে, তবে সম্ভবত গড় মানুষের সুখ বৃদ্ধি করে। কারণ তারা তাদের চিন্তা এতটা নিশ্চয়তার সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারে যে তা যেন তার শ্রোতার চিন্তার অনুরূপ। উপরন্তু এটা জাতীয় সংহতির উন্নতি সাধন করে, এবং অন্যত্র মতভেদের পার্থক্য খুব বেশি হলেও এখানে রাজনীতি হয় কম তিক্ত। দাঙ্গাবাজ মনোভাবও কম হয়। আমি মনে করি না যে লাভ ও ক্ষতির মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করা সম্ভব, কিন্তু আমি মনে করি, আমেরিকায় আজ যে প্রমিতি লক্ষ্য করা যায়, তা গোটা ইউরোপে অচিরে দেখা দেবে জগৎ আরো যন্ত্রনির্ভর হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে। অতএব যে সব ইউরোপীয় ভদ্রলোক এক্ষেত্রে আমেরিকার ক্রটি দেখতে পান তাদের উপলব্ধি করা উচিত যে তারা তাদের দেশে ভবিষ্যৎ ব্যাপারে অনুরূপ ত্রুটি দেখতে পাবেন। এক্ষেত্রে আমেরিকার ত্রুটি দেখতে পাওয়ার অর্থ হলো সভ্যতার অনিবার্য এবং সার্বিক ঝোঁকের প্রতিকূলে নিজেদের দাঁড় করানো। নিঃসন্দেহে জাতিসমূহের মধ্যে প্রভেদ হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আন্তর্জাতিকতা সহজতর হয়ে আসবে এবং একবার আন্তর্জাতিকতা প্রতিষ্ঠিত হলে অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষায় সামাজিক সংহতির গুরুত্ব খুবই বেড়ে যাবে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে শেষের দিকের রোমক সাম্রাজ্যের মতো অচলাবস্থা সৃষ্টির ঝুঁকি এতে থেকে যায়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আমরা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বৈপ্লবিক শক্তি কাজে লাগাতে পারি। সার্বিক বুদ্ধিগত অবক্ষয় না-ঘটলে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যা আধুনিক জগতের নতুন বৈশিষ্ট্য, অচলাবস্থা অসম্ভব করে তুলবে এবং সেই ধরনের স্থবিরতা ঠেকিয়ে রাখবে যা ইতিহাসের অনেক সাম্রাজ্য গ্রাস করেছে। বর্তমান ও ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে ইতিহাসের যুক্তি প্রয়োগ বিপজ্জনক, কারণ বিজ্ঞান সূচনা করেছে সম্পূর্ণ পরিবর্তন। অতএব আমি অযথা নৈশ্যবাদী হওয়ার কোনো যুক্তি দেখি না, প্রমিতকরণ অনভ্যস্ত ব্যক্তিদের রুচিকে যতই আঘাত করুক না কেন।

১১. মানুষ বনাম কীট-পতঙ্গ

যুদ্ধ এবং যুদ্ধের গুজবের ভেতর, যেখানে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি এবং অনাক্রমণ চুক্তি মানব বংশের প্রতি অভূতপূর্ব হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে অপর একটি দ্বন্দ্ব, হয়তো সমধিক গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনের চেয়ে কম মনোযোগ কাড়ছে। আমি এখানে মনুষ্য ও কীট-পতঙ্গের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের ব্যাপারটা বোঝাচ্ছি।

আমরা নিজেদের Lords of Creation বা আদি পুরুষ পদে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি; গুহামানবের মতো সিংহ, বাঘ, বিরাটকায় হস্তীসদৃশ কোনো প্রাণী বা বন্য শূকরের ভয়ে ভীত হওয়ার আর দরকার করে না আমাদের। আমরা একে অপরকে যে ভয় পাই সেটা বাদ দিয়ে ধরলে নিজেদের নিরাপদই বোধ করি। কিন্তু বৃহৎ জন্তুরা আমাদের অস্তিত্বের জন্য আর হুমকি না হলেও, ক্ষুদ্র জন্তুদের সম্পর্কে সে কথা বলা চলে না। এই গ্রহের প্রাণের ইতিহাসে পূর্বে বৃহৎ জন্তুরা ক্ষুদ্র জন্তুদের একবার জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল। বহুকাল ডাইনাসোর নিরুদ্বেগভাবে জলাশয় ও বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছে, একটা ডাইনাসোরের অপর একটা ডাইনাসোরকে ভয় করা ছাড়া তাদের আর কোনো ভয়ের ব্যাপার ছিল না। সংশয় ছিল না যে তাদের সাম্রাজ্য নিরঙ্কুশ। মূষিক, ক্ষুদ্র সজারু, ইঁদুরের চেয়ে বড় নয় এমন ক্ষুদ্র ঘোড়া, প্রভৃতি ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জায়গা করে দিয়ে ডাইনাসোর এক সময় বিলুপ্ত হয়। ডাইনাসোরের বংশ কেন ধ্বংস হয় তা জানা যায় না, তবে মনে করা হয় যে ঐ অতিকায় প্রাণীর মাথার মগজ ছিল খুবই সূক্ষ্ম, এবং শিকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য অসংখ্য শিং গজানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। ঘটনা যাই হোক, ডাইনাসোরের ধারা অনুসরণ করে জীবনের বিকাশ ঘটেনি।

স্তন্যপায়ী প্রাণী নিরঙ্কুশ প্রাধান্য পাবার পর আকারে বাড়তে লাগল। কিন্তু হস্তীসদৃশ অতিকায় প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেছে। অন্যান্য বৃহৎ আকৃতির প্রাণীও বিরল হয়ে এসেছে। ব্যতিক্রম শুধু মানুষ এবং মনুষ্য-কর্তৃক বশীভূত প্রাণীরা। মানুষ ক্ষুদ্রাকৃতি হলেও বুদ্ধি দ্বারা সফলতার সঙ্গে বিরাট জনসংখ্যার পুষ্টির ব্যবস্থা করেছে। মানুষ নিরাপদ, তবে ক্ষুদ্রকায় প্রাণী, কীট-পতঙ্গ এবং অণুজীব থেকে নয়।

কীট-পতঙ্গাদির প্রাথমিক সুবিধা এই যে, এদের সংখ্যা অগণন। সারা পৃথিবীতে যত মানুষ রয়েছে সেই সংখ্যক পিপীলিকা একটি ক্ষুদ্র বনে সহজেই বাস করতে পারে। কীট-পতঙ্গ আরো একটা সুবিধা ভোগ করে, এরা আমাদের খাদ্য পরিপক্ক হওয়ার আগেই ভক্ষণে সক্ষম। অনেক অনিষ্টকর কীট-পতঙ্গ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে বসবাসে অভ্যস্ত ছিল, মানুষ এদের বিনা অভিপ্রায়ে নতুন পরিবেশে স্থানান্তর করে, সেখানে এরা অশেষ ক্ষতিসাধন করেছে। কীট-পতঙ্গ এবং অণুজীবের জন্য ভ্রমণ ও বাণিজ্য অত্যন্ত জরুরি। হলুদ জ্বর আগে শুধু পশ্চিম আফ্রিকায় দেখা গেছে, ক্রীতদাস ব্যবসা এই জ্বর পশ্চিম গোলার্ধে বহন করে আনে। বর্তমানে আফ্রিকার দরজা উন্মুক্ত হওয়ার ফলে ঐ জ্বর ক্রমান্বয়ে উক্ত মহাদেশ পেরিয়ে প্রাচ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পূর্ব উপকূলে পৌঁছলে এই জ্বর ভারত ও চিনের বাইরে রাখা সম্ভব হবে না। এবং এই জ্বর দেশ দুটির জনসংখ্যার অর্ধেক কমিয়ে ফেলতে পারে বলে আশংকা করা যায়। নিদ্রারোগ সমধিক মারাত্মক আফ্রিকান ব্যাধি, এবং এই রোগ ক্রমান্বয়ে বিস্তারিত হচ্ছে।

সৌভাগ্য এই যে, বিজ্ঞান একটি উপায় উদ্ভাবন করেছে, যা দিয়ে ক্ষতিকর কীট পতঙ্গ দমন করা সম্ভব। অধিকাংশ কীট-পতঙ্গ পরান্নভোজীর হাতে প্রাণ হারায়, যারা বেঁচে যায় তারা গুরুতর কোনো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে না। আর কীটতত্ত্ববিদগণ এই ধরনের পরান্নভোজী নিয়ে গবেষণা এবং এদের বংশবিস্তার করে চলেছেন। এদের কার্যকলাপের সরকারি প্রতিবেদন অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক; প্রতিবেদনে এ ধরনের বাক্যের সমাবেশ থাকে: ত্রিনিদাদের চাষিদের অনুরোধক্রমে তিনি ব্রাজিল যান ইক্ষুর Froghopper কীটের জৈবশত্রু খোঁজার জন্য। আপনি হয়তো বলবেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইক্ষুর Froghopper-এর কোনো সুযোগই থাকবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে যুদ্ধ যতদিন চলবে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দুদিকেই কাটবে বা দুমুখো হবে। উদাহরণত সদ্যপ্রয়াত প্রফেসর ফ্রিৎস হেবার নাইট্রোজেন গ্যাস নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবহারের উপায় উদ্ভাবন করেন। তার সাধ ছিল এই গ্যাস ব্যবহার করে জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করবেন। কিন্তু জার্মান সরকার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরির জন্য এটা ব্যবহার করেন এবং সম্প্রতি হেবার সাহেবকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। কারণ তিনি বোমা নয় জমিতে প্রয়োগযোগ্য সার উৎপাদনে অধিক আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তী মহাযুদ্ধে এক পক্ষ অপর পক্ষের শস্যক্ষেত্রে ক্ষতিকর কীট লেলিয়ে দেবে এবং যুদ্ধ শেষে এই কীট দমন কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে। আমরা যত বেশি জানব, আমরা একে অপরের ততবেশি ক্ষতি করতে পারব। মানুষ যদি একে অপরের প্রতি ক্রোধবশত কীট-পতঙ্গ এবং অণুজীবদের সাহায্য গ্রহণ করে, এবং আরো একটা মহাযুদ্ধ সূচিত হলে তারা তা করবে, তাহলে এটা কোনো মতেই অসম্ভব নয় যে শেষ পর্যন্ত প্রকৃত বিজয়ী পক্ষ হবে একমাত্র কীট-পতঙ্গেরা। হয়তো মহাজাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুঃখিত হবার কিছু নেই; কিন্তু মানুষ হিসেবে আমি নিজ প্রজাতির জন্য দীর্ঘশ্বাস না ছেড়ে পারি না।

.

অধ্যায় ১২ — শিক্ষা ও শৃঙ্খলা

যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাতত্ত্বের দুটি দিক থাকতে হবে; জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি ধারণা এবং মনস্তাত্ত্বিক গতিবিদ্যার বিজ্ঞান অর্থাৎ মনের অবস্থার পরিবর্তনের বিধি। যদি দুজন ব্যক্তি জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন তবে তারা শিক্ষা সম্পর্কেও একমত হওয়ার প্রত্যাশা করতে পারেন না। গোটা পাশ্চাত্য সভ্যতায় শিক্ষাযন্ত্র দুটি নৈতিকতত্ত্ব দ্বারা শাসিত হচ্ছে: খ্রিস্টধর্ম এবং জাতীয়তাবাদ। গুরুত্ব দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে এই দুটি ব্যাপার সহাবস্থান করতে পারে না। এবং এটা জার্মানিতে ক্রমান্বয়ে পরিষ্কার হচ্ছে। নিজের সম্পর্কে বলতে পারি এই দুটি ব্যাপার। যেখানে বিভিন্ন সেখানে খ্রিস্টধর্মের প্রতিই আমি পক্ষপাতী হবো। যেখানে অভিন্ন সেখানে দুটিই প্রমাদযুক্ত বলে আমার ধারণা। শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে যে ধারণা আমি বিকল্প হিসেবে পেশ করতে চাই তাহলে সভ্যতা। এবং সভ্যতাকে আমি যে অর্থে বুঝে থাকি তার সংজ্ঞা অংশত ব্যক্তিকেন্দ্রিক, অংশত সামাজিক। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এতে অন্তর্ভুক্ত হলো বুদ্ধিগত ও নৈতিক গুণাবলি: বুদ্ধিগত দিক থেকে সুনির্দিষ্ট ন্যূনতম সাধারণ জ্ঞান, নিজের পেশা সম্পর্কে বাস্তবিক দক্ষতা এবং সাক্ষ্যনির্ভর মতামত গঠনের অভ্যাস; নৈতিক দিক থেকে, পক্ষপাতহীনতা, সদয়ভাব, এবং কিছুটা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ। এর সঙ্গে আমি আরো একটা গুণ যোগ করব, যা নৈতিকও নয়, বুদ্ধিগতও না। সম্ভবত তা শারীরতাত্ত্বিক: জীবনের প্রতি আগ্রহ ও আনন্দ। সম্প্রদায়সমূহের কাছে সভ্যতা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দাবি করে, মানুষের সঙ্গে মানুষের কারবারে ন্যায় প্রতিষ্ঠা চায়; এবং এমন লক্ষ্য নির্ধারণ যাতে মানবজাতির কোনো অংশত স্থায়ী ক্ষতি সাধিত না হয়। এবং উপায় ও উপেয়র মধ্যে খোঁজে বুদ্ধিমান অভিযোজন।

এগুলোকেই যদি শিক্ষার উদ্দেশ্য বলতে হয় তাহলে মনোবিজ্ঞানের বিবেচনা করতে হবে এই উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য কী করা যেতে পারে; বিশেষ করে বিবেচনা করতে হবে কতটা স্বাধীনতা সর্বাধিক কার্যকর প্রমাণিত হওয়া সম্ভবপর।

শিক্ষাক্ষেত্রে স্বাধীনতার প্রশ্নে বর্তমানে তিনটি প্রধান মতবাদী গোষ্ঠী রয়েছে। এই তিনটি গোষ্ঠীর মধ্যে অংশত উদ্দেশ্যগত পার্থক্য রয়েছে, অংশত মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের দিক থেকেও তফাত আছে। অনেকে বলে থাকেন শিশুদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে, তারা যতই মন্দ স্বভাবের হোক না কেন; আবার অনেকে তাদের কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ অধীনে রাখার পক্ষে মত দেন, তারা যতই সচ্চরিত্র হোক না কেন। আরো এক গোষ্ঠীর অভিমত হলো তাদের স্বাধীনতা দেয়া উচিত, কিন্তু স্বাধীনতা দেয়া সত্ত্বেও তাদের সদাচারী হতে হবে এবং সবসময়ই। শেষোক্ত গোষ্ঠী বৃহত্তর হলেও এদের দাবির যৌক্তিকতা সামান্যই। বয়স্কদের মতোই সব শিশু যদি স্বাধীন হয় তবে পুণ্যবান হবে না। এই যে বিশ্বাস করা হয় স্বাধীনতা নৈতিক সম্পূর্ণতা নিশ্চিত করবে এটা রুশোবাদের ধ্বংসাবশেষমাত্র, পশু ও শিশুদের নিয়ে চর্চা করতে গেলে এই তত্ত্ব টিকবে। যারা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন তাদের ধারণা হলো শিক্ষার কোনো সদর্থক উদ্দেশ্য থাকা উচিত নয়। শিক্ষা কেবল স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এ দলের সঙ্গে আমি ঐকমত্য পোষণ করি না, এই দলের মত অতিবেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং অযথা জ্ঞানের গুরুত্বের প্রতি উদাসীন। আমরা যে ধরনের সমাজে বাস করি সেখানে সহযোগিতার দরকার রয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত তাড়না থেকে প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার সহযোগিতা সৃষ্টির প্রত্যাশা অসার কল্পনা মাত্র। সীমাবদ্ধ এলাকায় বিরাট জনগোষ্ঠীর বসবাস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদেই কেবল সম্ভবপর: সুতরাং শিক্ষাদর্শকে প্রয়োজনেই যৎকিঞ্চিৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে। যে সকল শিক্ষক সর্বাধিক স্বাধীনতা অনুমোদন করেন তাদের সাফল্য নির্ভর করে কিছুটা বদান্যতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং প্রশিক্ষিত বুদ্ধির উপর, যা, যেখানে সকল আবেগ অনিয়ন্ত্রিত, সৃষ্টি হওয়া প্রায় অসম্ভব। সুতরাং তাদের গুণাবলি স্থায়িত্ব পেতে পারে না যদি তাদের পদ্ধতি হয় নির্জলা। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, শিক্ষাকে বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, কিছুটা সদর্থকও হতে হবে। আবার এটা যোগানোর পরও শিক্ষাকে অবশ্যই মানসিক ও নৈতিক মাধ্যমের যোগান দিতে হবে, কারণ শিশুরা নিজ থেকে এগুলো অর্জন করতে পারবে না।

শিক্ষায় বড় রকমের স্বাধীনতা প্রদানের পক্ষে যে যুক্তিগুলো খাড়া করা হয় তার উৎস মানুষের স্বাভাবিক সৎগুণ নয় বরং কর্তৃত্বের প্রতিক্রিয়া এবং এটা কেবল কর্তৃত্বের যারা শিকার তাদের বেলায় খাটে না, যারা কর্তৃত্ব খাটায় তাদের বেলায়ও সমানভাবে খাটে। যাদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে হয় তারা হয় অতি বাধ্য অথবা বিদ্রোহী, এবং এই দুটি মনোভাবেরই অনেক ত্রুটি রয়েছে।

অতি-বাধ্যরা উদ্যম হারিয়ে ফেলে, চিন্তা ও কর্ম, উভয় ক্ষেত্রে; উপরন্তু উদ্যমে ব্যাঘাত থেকে যে ক্রোধ জন্মে তা প্রকাশ পায় দুর্বলতরদের উপর খবরদারির ভেতর। এজন্যই নিপীড়নমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বরচিত পথে চলে: যে লোক পিতা-কর্তৃক নিপীড়িত হয় সে পুত্রকে নিপীড়ন করে। পাবলিক স্কুলে গ্লানি অর্জনের স্মৃতি নিয়ে সাম্রাজ্য-নির্মাতা হলে নেটিভদের উপর তা চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা নড়ানো যায় না। এইভাবে অযথা কর্তৃবাদী শিক্ষা ছাত্রদের দুর্বলচিত্ত অত্যাচারীতে পরিণত করে, কথায় বা কাজে মৌলিকতা অর্জন করতে পারে না কিংবা সহ্য করার সমর্থতা লাভ করে না। শিক্ষকদের উপর এর প্রতিক্রিয়া আরো খারাপ হয়। তাদের মধ্যে ধর্ষকামী ও কঠোর নিয়মানুবর্তী হওয়ার ঝোঁক দেখা দেয়। সন্ত্রস্ত করতে পারলে তারা খুশি হয় এবং অন্যকিছু করে সন্তুষ্ট হয় না। এই লোকগুলো যেহেতু জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে ফলে ছাত্ররা অর্জন করে জ্ঞানাতংক, এবং ইংরেজ উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি একে মানব প্রকৃতির হিসেবে ধরে নেয়, অথচ বাস্তবে এটা কর্তৃবাদী পণ্ডিতদের বদ্ধমূল ঘৃণার অঙ্গ।

অপরদিকে বিদ্রোহীরা, যদিও তাদের দরকার রয়েছে, কমই ন্যায়ানুগ হয়। উপরন্তু বিদ্রোহ করার বহু উপায় রয়েছে, এবং বিদ্রোহীদের একটি ক্ষুদ্র সংখ্যার লঘু অংশ মাত্রই কেবল বিজ্ঞ। গ্যালিলিও একই সঙ্গে বিদ্রোহী এবং বিজ্ঞ ছিলেন; যারা সমতল পৃথিবীর তত্ত্বে বিশ্বাস করেন তারাও সমানভাবে বিদ্রোহী, কিন্তু এরা নির্বোধ। প্রথাবিরুদ্ধ মতামত মাত্রেই সঠিক, এই ধরনের অনুমোদনের প্রতি ঝোঁক বিপজ্জনক। অর্থাৎ আলোকবাতির খুঁটি গুঁড়িয়ে দেয়া কিংবা শেক্সপিয়র কোনো কবিই নয় মনে করা কোনো উপকারে আসে না। অবশ্য এই ধরনের অতি-বিদ্রোহী মনোভাব অনেক ক্ষেত্রে প্রাণবান ছাত্রদের উপর অতিরিক্ত কর্তৃত্ব খাটানোর প্রতিক্রিয়া। আর যখন বিদ্রোহীরা শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন অনেক সময় তারা ছাত্রদের অবাধ্য হতে উৎসাহিত করেন। আবার একই সঙ্গে ছাত্রদের জন্য নিখুঁত পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করেন, অথচ এই দুটি লক্ষ্য কিছুতেই সহাবস্থান করতে পারে না।

দরকার অবাধ্যতাও নয়, বিদ্রোহও নয়, দরকার সৎস্বভাব এবং জনগণ ও নতুন ভাবধারার প্রতি সাধারণ বন্ধুত্বপূর্ণ আনুকূল্য প্রদর্শন। এই গুণগুলো অংশত আসে দৈহিক কারণে, যার প্রতি প্রাচীনপন্থি শিক্ষকরা কমই গুরুত্ব দেন; কিন্তু মানুষের প্রধান প্রবণতাসমূহ বাধাগ্রস্ত হলে যে হতবুদ্ধিকর অথর্বর বোধ জাগে তা থেকে মুক্ত থাকতে পারলে ঐ গুণগুলো অধিক লাভ করা যায়। যুবকদের বন্ধুভাবাপন্ন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হতে হলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরকার হলো, তাদের অনুভব করতে দিতে হবে। যে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে বাস করছে। এর জন্য প্রয়োজন হলে শিশুদের গুরুত্বপূর্ণ বাসনাগুলোর প্রতি সুনিশ্চিত সহানুভূতি দেখাতে হবে, এবং কেবল তাকে ঈশ্বর-মহিমা সংকীর্তন কিংবা স্বদেশের মহত্ত্বের গুণগান করার মতো বিমূর্ত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে চলবে না। এবং শিক্ষা প্রদানের সময় সব রকমের চেষ্টা নিতে হবে যাতে ছাত্ররা বোধ। করে যে যা শেখানো হচ্ছে তা খুবই মূল্যবান-অন্তত যখন কিছু শেখানো হয়। ছাত্ররা যখন স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করে তখন তারা দ্বিগুণ দ্রুত শেখে এবং অর্ধেক অবসাদ ভোগ করে। এসবই সব ধরনের স্বাধীনতার পক্ষে বৈধ যুক্তি।

এই যুক্তি সহজেই আরো দূর এগিয়ে নেয়া চলে। এটা বাঞ্ছনীয় নয় যে শিশুরা দাসত্বের দোষ এড়িয়ে চলতে গিয়ে অভিজাতদের দোষ অর্জন করবে। শুধু বড় ব্যাপারে নয়, নিত্যদিনের ছোটখাটো ব্যাপারেও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা সুবিবেচনাবোধ সভ্যতার আবশ্যিক উপাদান, এটি না থাকলে সমাজজীবন অসহনীয় হয়ে উঠবে। এখানে কিন্তু আমি অনুগ্রহপূর্বক এবং ধন্যবাদ বলার মতো শিষ্টতার সাধারণ নিয়ম। সম্পর্কে ভাবছি নাঃ রীতিমাফিক শিষ্টতা বর্বরদের মধ্যেই সম্পূর্ণ বিকশিত হয় এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উন্নতির সঙ্গে তাল রেখে হ্রাস পায়। আমি বরং ভাবছি দরকারি কাজের ন্যায্য অংশীদার হওয়ার ইচ্ছা সম্পর্কে। মনের অসুস্থতা এক ধরনের শিষ্টতা এবং এটা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয় যে শিশু নিজেদের সর্বশক্তিমান মনে করবে কিংবা যুবকরা মনে করবে যে বয়স্কদের বেঁচে থাকার লক্ষ্যই হলো তাদের সুখী করা। এবং যারা অলস ধনীদের অনুমোদন করেন না তাদের চিন্তার সামঞ্জস্য থাকে না যদি তারা তাদের সন্তানদের কাজ দরকারি এই বোধে আপুত না করেন, এবং এমন অভ্যাস গড়ে দেন যাতে তারা নিয়তির কাজ করা সম্ভব মনে করে।

আরো একটি ব্যাপার: এ ব্যাপারে স্বাধীনতার প্রবক্তারা কমই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ভাবুন ছোটদের একটি সম্প্রদায়ের কথা যেখানে বয়স্করা হস্তক্ষেপ করেন না; সেখানে সবলের অত্যাচার হয় প্রবল, এবং এই অত্যাচার বয়স্কদের চেয়েও হিংস্র হতে পারে। যদি দুটি ২/৩ বছরের ছেলেকে এক সঙ্গে খেলতে দেয়া যায়, তবে তারা ঝগড়া করবে, একজন হবে জয়ী, অপরজন পরিণত হবে দাসে। যেখানে তারা সংখ্যায় অধিক সেখানে একজন কি দুজন পূর্ণ প্রভুত্ব অর্জন করবে, বাকিদের স্বাধীনতা অনেক খাটো হয়ে যাবে, অথচ বয়স্করা হস্তক্ষেপ করলে দুর্বল ও কম কলহপ্রিয়দের স্বাধীনতা তুলনামূলকভাবে বেশি হতো। অপরের প্রতি সুবিবেচনা শিশুদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগরিত হয় না, এটা শেখানো উচিত, এবং কর্তৃত্ব খাটানো ছাড়া এটা শেখানো সম্ভব নয়। বয়স্কদের ক্ষমতাচ্যুতির বিরুদ্ধে এটা সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি।

আমি মনে করি না যে শিক্ষাবিদগণ স্বাধীনতার ঈঙ্গিত কাঠামোর সঙ্গে দরকারি ন্যূনতম নৈতিক প্রশিক্ষণের মিলনের সমস্যা সমাধান করতে পেরেছেন। স্বীকার্য যে, সঠিক সমাধান অভিভাবকরাই অসম্ভব করে তোলেন সন্তানদের সংস্কৃতিবান স্কুলে ভর্তি করার আগেই। মনঃসমীক্ষকরা যেমন রোগসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে আমরা সবাই উন্মাদ, অনুরূপভাবে আধুনিক স্কুলের কর্তারা, অভিভাবকদের দ্বারা বিশৃঙ্খল হওয়া ছাত্রদের সংশ্রবে এসে সিদ্ধান্ত নেন যে সব শিশু দুরূহ প্রকৃতির এবং অভিভাবকরা একেবারে নির্বোধ। অভিভাবকদের অত্যাচারে যেসব ছেলে বন্য হয়ে গেছে তাদের দীর্ঘ কিংবা স্বল্প সময়ের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা দরকার, তবেই তারা বয়স্কদের নিঃসন্দিগ্ধ মনে করবে। কিন্তু যাদের সঙ্গে গৃহে বিজ্ঞতার সঙ্গে আচরণ করা হয়েছে তারা তদারকি সহ্য করবে। এই শিশুদের বোধ করতে হবে যে তাদের এমন ব্যাপারে সাহায্য করা হচ্ছে যে ব্যাপারকে তারা নিজেরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। যে বয়স্ক ব্যক্তি শিশুদের পছন্দ করেন এবং শিশুদের সাহচর্যে স্নায়ুর চাপ বোধ করেন না তারা শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে অনেক দূর অগ্রসর হতে পারেন এবং তা পারেন শিশুদের বন্ধুতাপূর্ণ অনুভূতি না হারিয়ে।

আমার মনে হয় আধুনিক শিক্ষাতাত্ত্বিকরা শিশুদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নঞর্থক দিকের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদানের পক্ষপাতী, পক্ষান্তরে শিশুদের সাহচার্য উপভোগের সদর্থক দিকের প্রতি কম গুরুত্ব প্রদানে আগ্রহী। আপনার যদি শিশুদের প্রতি সেই ধরনের অনুরাগ থাকে যে ধরনের অনুরাগ দেখা যায় অনেক লোকের ঘোড়া ও কুকুরের প্রতি, তবে তারা আপনার ইংগিতে সাড়া দেবে, বিধিনিষেধ মানবে, হয়তো কিছুটা আনন্দদায়ক অসন্তোষের সঙ্গে। কিন্তু কিছুতেই ক্ষুব্ধ হবে না। শিশুদের প্রতি সেই ধরনের অনুরাগের কোনো মূল্য নেই যেখানে তাদের সামাজিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র কিংবা ক্ষমতালিপ্সা প্রকাশের সুযোগ গণ্য করা হয়। কোনো শিশুই কৃতজ্ঞ বোধ করবে না যদি তার প্রতি উৎসাহের উৎস হয় আপনার দলের জন্য ভোট লাভ কিংবা রাজা বা দেশের জন্য তাদের উৎসর্গ করা। ঈপ্সিত অনুরাগ হলো শিশুদের মেলায় স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ, এবং কোনো অন্তর্গত অভীষ্ট না-থাকা। এই গুণ যে শিক্ষকের রয়েছে তার শিশুর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের দরকার করবে না, এবং প্রয়োজনে মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিসাধন না করেই তিনি হস্তক্ষেপ করতে পারবেন।

দুর্ভাগ্যবশত, কর্মভারাক্রান্ত একজন শিক্ষকের পক্ষে শিশুদের প্রতি হৃদোখিত অনুরাগ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়; তার অনুভূতি দাঁড়ায় প্রবাদের ময়রার মতো; মিষ্টির প্রতি ময়রার যে অনুভূতি, ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের অনুভূতির সঙ্গে তার তুলনা চলে। আমি মনে করি না যে শিক্ষা কারো একান্ত পেশা হওয়া উচিত: এই পেশায় নিয়োজিত হবে তারা যারা দুঘণ্টা শিক্ষকতা করে বাকি সময় ছাত্রদের থেকে দূরে কাটাবেন। যুবকদের সমাজ খুবই ক্লান্তিকর, বিশেষত যখন কঠোর শৃঙ্খলা এড়িয়ে যাওয়া হয়। ক্লান্তি বা শ্রান্তি পরিশেষে জন্ম দেয় বিরক্তির, যা এক সময় কোনো না কোনোভাবেই প্রকাশিত হবেই, পেরেশান শিক্ষক নিজেকে যে তত্ত্বেই গড়ে তুলুন না কেন। প্রয়োজনীয় বন্ধুভাবাপন্ন অনুভূতি কেবল আত্মসংযম দ্বারা রক্ষা করা যায় না। কিন্তু যেখানে এটা বর্তমান, সেখানে আগে থেকে দুষ্টু ছেলের প্রতি আচরণের নিয়ম রাখা নিষ্প্রয়োজনীয়, যেহেতু আবেগ সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছায় এবং যে-কোনো সিদ্ধান্ত সঠিক হবে যদি সে অনুভব করে আপনি তাকে পছন্দ করেন। কোনো নিয়মই, যতই বিজ্ঞতাপূর্ণ হোক, স্নেহ কিংবা বিচক্ষণতার বিকল্প হতে পারে না।

১২. শিক্ষা ও শৃঙ্খলা

যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাতত্ত্বের দুটি দিক থাকতে হবে; জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি ধারণা এবং মনস্তাত্ত্বিক গতিবিদ্যার বিজ্ঞান অর্থাৎ মনের অবস্থার পরিবর্তনের বিধি। যদি দুজন ব্যক্তি জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন তবে তারা শিক্ষা সম্পর্কেও একমত হওয়ার প্রত্যাশা করতে পারেন না। গোটা পাশ্চাত্য সভ্যতায় শিক্ষাযন্ত্র দুটি নৈতিকতত্ত্ব দ্বারা শাসিত হচ্ছে: খ্রিস্টধর্ম এবং জাতীয়তাবাদ। গুরুত্ব দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে এই দুটি ব্যাপার সহাবস্থান করতে পারে না। এবং এটা জার্মানিতে ক্রমান্বয়ে পরিষ্কার হচ্ছে। নিজের সম্পর্কে বলতে পারি এই দুটি ব্যাপার। যেখানে বিভিন্ন সেখানে খ্রিস্টধর্মের প্রতিই আমি পক্ষপাতী হবো। যেখানে অভিন্ন সেখানে দুটিই প্রমাদযুক্ত বলে আমার ধারণা। শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে যে ধারণা আমি বিকল্প হিসেবে পেশ করতে চাই তাহলে সভ্যতা। এবং সভ্যতাকে আমি যে অর্থে বুঝে থাকি তার সংজ্ঞা অংশত ব্যক্তিকেন্দ্রিক, অংশত সামাজিক। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এতে অন্তর্ভুক্ত হলো বুদ্ধিগত ও নৈতিক গুণাবলি: বুদ্ধিগত দিক থেকে সুনির্দিষ্ট ন্যূনতম সাধারণ জ্ঞান, নিজের পেশা সম্পর্কে বাস্তবিক দক্ষতা এবং সাক্ষ্যনির্ভর মতামত গঠনের অভ্যাস; নৈতিক দিক থেকে, পক্ষপাতহীনতা, সদয়ভাব, এবং কিছুটা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ। এর সঙ্গে আমি আরো একটা গুণ যোগ করব, যা নৈতিকও নয়, বুদ্ধিগতও না। সম্ভবত তা শারীরতাত্ত্বিক: জীবনের প্রতি আগ্রহ ও আনন্দ। সম্প্রদায়সমূহের কাছে সভ্যতা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দাবি করে, মানুষের সঙ্গে মানুষের কারবারে ন্যায় প্রতিষ্ঠা চায়; এবং এমন লক্ষ্য নির্ধারণ যাতে মানবজাতির কোনো অংশত স্থায়ী ক্ষতি সাধিত না হয়। এবং উপায় ও উপেয়র মধ্যে খোঁজে বুদ্ধিমান অভিযোজন।

এগুলোকেই যদি শিক্ষার উদ্দেশ্য বলতে হয় তাহলে মনোবিজ্ঞানের বিবেচনা করতে হবে এই উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য কী করা যেতে পারে; বিশেষ করে বিবেচনা করতে হবে কতটা স্বাধীনতা সর্বাধিক কার্যকর প্রমাণিত হওয়া সম্ভবপর।

শিক্ষাক্ষেত্রে স্বাধীনতার প্রশ্নে বর্তমানে তিনটি প্রধান মতবাদী গোষ্ঠী রয়েছে। এই তিনটি গোষ্ঠীর মধ্যে অংশত উদ্দেশ্যগত পার্থক্য রয়েছে, অংশত মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের দিক থেকেও তফাত আছে। অনেকে বলে থাকেন শিশুদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে, তারা যতই মন্দ স্বভাবের হোক না কেন; আবার অনেকে তাদের কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ অধীনে রাখার পক্ষে মত দেন, তারা যতই সচ্চরিত্র হোক না কেন। আরো এক গোষ্ঠীর অভিমত হলো তাদের স্বাধীনতা দেয়া উচিত, কিন্তু স্বাধীনতা দেয়া সত্ত্বেও তাদের সদাচারী হতে হবে এবং সবসময়ই। শেষোক্ত গোষ্ঠী বৃহত্তর হলেও এদের দাবির যৌক্তিকতা সামান্যই। বয়স্কদের মতোই সব শিশু যদি স্বাধীন হয় তবে পুণ্যবান হবে না। এই যে বিশ্বাস করা হয় স্বাধীনতা নৈতিক সম্পূর্ণতা নিশ্চিত করবে এটা রুশোবাদের ধ্বংসাবশেষমাত্র, পশু ও শিশুদের নিয়ে চর্চা করতে গেলে এই তত্ত্ব টিকবে। যারা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন তাদের ধারণা হলো শিক্ষার কোনো সদর্থক উদ্দেশ্য থাকা উচিত নয়। শিক্ষা কেবল স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এ দলের সঙ্গে আমি ঐকমত্য পোষণ করি না, এই দলের মত অতিবেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং অযথা জ্ঞানের গুরুত্বের প্রতি উদাসীন। আমরা যে ধরনের সমাজে বাস করি সেখানে সহযোগিতার দরকার রয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত তাড়না থেকে প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার সহযোগিতা সৃষ্টির প্রত্যাশা অসার কল্পনা মাত্র। সীমাবদ্ধ এলাকায় বিরাট জনগোষ্ঠীর বসবাস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদেই কেবল সম্ভবপর: সুতরাং শিক্ষাদর্শকে প্রয়োজনেই যৎকিঞ্চিৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে। যে সকল শিক্ষক সর্বাধিক স্বাধীনতা অনুমোদন করেন তাদের সাফল্য নির্ভর করে কিছুটা বদান্যতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং প্রশিক্ষিত বুদ্ধির উপর, যা, যেখানে সকল আবেগ অনিয়ন্ত্রিত, সৃষ্টি হওয়া প্রায় অসম্ভব। সুতরাং তাদের গুণাবলি স্থায়িত্ব পেতে পারে না যদি তাদের পদ্ধতি হয় নির্জলা। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, শিক্ষাকে বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, কিছুটা সদর্থকও হতে হবে। আবার এটা যোগানোর পরও শিক্ষাকে অবশ্যই মানসিক ও নৈতিক মাধ্যমের যোগান দিতে হবে, কারণ শিশুরা নিজ থেকে এগুলো অর্জন করতে পারবে না।

শিক্ষায় বড় রকমের স্বাধীনতা প্রদানের পক্ষে যে যুক্তিগুলো খাড়া করা হয় তার উৎস মানুষের স্বাভাবিক সৎগুণ নয় বরং কর্তৃত্বের প্রতিক্রিয়া এবং এটা কেবল কর্তৃত্বের যারা শিকার তাদের বেলায় খাটে না, যারা কর্তৃত্ব খাটায় তাদের বেলায়ও সমানভাবে খাটে। যাদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে হয় তারা হয় অতি বাধ্য অথবা বিদ্রোহী, এবং এই দুটি মনোভাবেরই অনেক ত্রুটি রয়েছে।

অতি-বাধ্যরা উদ্যম হারিয়ে ফেলে, চিন্তা ও কর্ম, উভয় ক্ষেত্রে; উপরন্তু উদ্যমে ব্যাঘাত থেকে যে ক্রোধ জন্মে তা প্রকাশ পায় দুর্বলতরদের উপর খবরদারির ভেতর। এজন্যই নিপীড়নমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বরচিত পথে চলে: যে লোক পিতা-কর্তৃক নিপীড়িত হয় সে পুত্রকে নিপীড়ন করে। পাবলিক স্কুলে গ্লানি অর্জনের স্মৃতি নিয়ে সাম্রাজ্য-নির্মাতা হলে নেটিভদের উপর তা চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা নড়ানো যায় না। এইভাবে অযথা কর্তৃবাদী শিক্ষা ছাত্রদের দুর্বলচিত্ত অত্যাচারীতে পরিণত করে, কথায় বা কাজে মৌলিকতা অর্জন করতে পারে না কিংবা সহ্য করার সমর্থতা লাভ করে না। শিক্ষকদের উপর এর প্রতিক্রিয়া আরো খারাপ হয়। তাদের মধ্যে ধর্ষকামী ও কঠোর নিয়মানুবর্তী হওয়ার ঝোঁক দেখা দেয়। সন্ত্রস্ত করতে পারলে তারা খুশি হয় এবং অন্যকিছু করে সন্তুষ্ট হয় না। এই লোকগুলো যেহেতু জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে ফলে ছাত্ররা অর্জন করে জ্ঞানাতংক, এবং ইংরেজ উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি একে মানব প্রকৃতির হিসেবে ধরে নেয়, অথচ বাস্তবে এটা কর্তৃবাদী পণ্ডিতদের বদ্ধমূল ঘৃণার অঙ্গ।

অপরদিকে বিদ্রোহীরা, যদিও তাদের দরকার রয়েছে, কমই ন্যায়ানুগ হয়। উপরন্তু বিদ্রোহ করার বহু উপায় রয়েছে, এবং বিদ্রোহীদের একটি ক্ষুদ্র সংখ্যার লঘু অংশ মাত্রই কেবল বিজ্ঞ। গ্যালিলিও একই সঙ্গে বিদ্রোহী এবং বিজ্ঞ ছিলেন; যারা সমতল পৃথিবীর তত্ত্বে বিশ্বাস করেন তারাও সমানভাবে বিদ্রোহী, কিন্তু এরা নির্বোধ। প্রথাবিরুদ্ধ মতামত মাত্রেই সঠিক, এই ধরনের অনুমোদনের প্রতি ঝোঁক বিপজ্জনক। অর্থাৎ আলোকবাতির খুঁটি গুঁড়িয়ে দেয়া কিংবা শেক্সপিয়র কোনো কবিই নয় মনে করা কোনো উপকারে আসে না। অবশ্য এই ধরনের অতি-বিদ্রোহী মনোভাব অনেক ক্ষেত্রে প্রাণবান ছাত্রদের উপর অতিরিক্ত কর্তৃত্ব খাটানোর প্রতিক্রিয়া। আর যখন বিদ্রোহীরা শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন অনেক সময় তারা ছাত্রদের অবাধ্য হতে উৎসাহিত করেন। আবার একই সঙ্গে ছাত্রদের জন্য নিখুঁত পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করেন, অথচ এই দুটি লক্ষ্য কিছুতেই সহাবস্থান করতে পারে না।

দরকার অবাধ্যতাও নয়, বিদ্রোহও নয়, দরকার সৎস্বভাব এবং জনগণ ও নতুন ভাবধারার প্রতি সাধারণ বন্ধুত্বপূর্ণ আনুকূল্য প্রদর্শন। এই গুণগুলো অংশত আসে দৈহিক কারণে, যার প্রতি প্রাচীনপন্থি শিক্ষকরা কমই গুরুত্ব দেন; কিন্তু মানুষের প্রধান প্রবণতাসমূহ বাধাগ্রস্ত হলে যে হতবুদ্ধিকর অথর্বর বোধ জাগে তা থেকে মুক্ত থাকতে পারলে ঐ গুণগুলো অধিক লাভ করা যায়। যুবকদের বন্ধুভাবাপন্ন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হতে হলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরকার হলো, তাদের অনুভব করতে দিতে হবে। যে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে বাস করছে। এর জন্য প্রয়োজন হলে শিশুদের গুরুত্বপূর্ণ বাসনাগুলোর প্রতি সুনিশ্চিত সহানুভূতি দেখাতে হবে, এবং কেবল তাকে ঈশ্বর-মহিমা সংকীর্তন কিংবা স্বদেশের মহত্ত্বের গুণগান করার মতো বিমূর্ত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে চলবে না। এবং শিক্ষা প্রদানের সময় সব রকমের চেষ্টা নিতে হবে যাতে ছাত্ররা বোধ। করে যে যা শেখানো হচ্ছে তা খুবই মূল্যবান-অন্তত যখন কিছু শেখানো হয়। ছাত্ররা যখন স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করে তখন তারা দ্বিগুণ দ্রুত শেখে এবং অর্ধেক অবসাদ ভোগ করে। এসবই সব ধরনের স্বাধীনতার পক্ষে বৈধ যুক্তি।

এই যুক্তি সহজেই আরো দূর এগিয়ে নেয়া চলে। এটা বাঞ্ছনীয় নয় যে শিশুরা দাসত্বের দোষ এড়িয়ে চলতে গিয়ে অভিজাতদের দোষ অর্জন করবে। শুধু বড় ব্যাপারে নয়, নিত্যদিনের ছোটখাটো ব্যাপারেও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা সুবিবেচনাবোধ সভ্যতার আবশ্যিক উপাদান, এটি না থাকলে সমাজজীবন অসহনীয় হয়ে উঠবে। এখানে কিন্তু আমি অনুগ্রহপূর্বক এবং ধন্যবাদ বলার মতো শিষ্টতার সাধারণ নিয়ম। সম্পর্কে ভাবছি নাঃ রীতিমাফিক শিষ্টতা বর্বরদের মধ্যেই সম্পূর্ণ বিকশিত হয় এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উন্নতির সঙ্গে তাল রেখে হ্রাস পায়। আমি বরং ভাবছি দরকারি কাজের ন্যায্য অংশীদার হওয়ার ইচ্ছা সম্পর্কে। মনের অসুস্থতা এক ধরনের শিষ্টতা এবং এটা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয় যে শিশু নিজেদের সর্বশক্তিমান মনে করবে কিংবা যুবকরা মনে করবে যে বয়স্কদের বেঁচে থাকার লক্ষ্যই হলো তাদের সুখী করা। এবং যারা অলস ধনীদের অনুমোদন করেন না তাদের চিন্তার সামঞ্জস্য থাকে না যদি তারা তাদের সন্তানদের কাজ দরকারি এই বোধে আপুত না করেন, এবং এমন অভ্যাস গড়ে দেন যাতে তারা নিয়তির কাজ করা সম্ভব মনে করে।

আরো একটি ব্যাপার: এ ব্যাপারে স্বাধীনতার প্রবক্তারা কমই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ভাবুন ছোটদের একটি সম্প্রদায়ের কথা যেখানে বয়স্করা হস্তক্ষেপ করেন না; সেখানে সবলের অত্যাচার হয় প্রবল, এবং এই অত্যাচার বয়স্কদের চেয়েও হিংস্র হতে পারে। যদি দুটি ২/৩ বছরের ছেলেকে এক সঙ্গে খেলতে দেয়া যায়, তবে তারা ঝগড়া করবে, একজন হবে জয়ী, অপরজন পরিণত হবে দাসে। যেখানে তারা সংখ্যায় অধিক সেখানে একজন কি দুজন পূর্ণ প্রভুত্ব অর্জন করবে, বাকিদের স্বাধীনতা অনেক খাটো হয়ে যাবে, অথচ বয়স্করা হস্তক্ষেপ করলে দুর্বল ও কম কলহপ্রিয়দের স্বাধীনতা তুলনামূলকভাবে বেশি হতো। অপরের প্রতি সুবিবেচনা শিশুদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগরিত হয় না, এটা শেখানো উচিত, এবং কর্তৃত্ব খাটানো ছাড়া এটা শেখানো সম্ভব নয়। বয়স্কদের ক্ষমতাচ্যুতির বিরুদ্ধে এটা সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি।

আমি মনে করি না যে শিক্ষাবিদগণ স্বাধীনতার ঈঙ্গিত কাঠামোর সঙ্গে দরকারি ন্যূনতম নৈতিক প্রশিক্ষণের মিলনের সমস্যা সমাধান করতে পেরেছেন। স্বীকার্য যে, সঠিক সমাধান অভিভাবকরাই অসম্ভব করে তোলেন সন্তানদের সংস্কৃতিবান স্কুলে ভর্তি করার আগেই। মনঃসমীক্ষকরা যেমন রোগসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে আমরা সবাই উন্মাদ, অনুরূপভাবে আধুনিক স্কুলের কর্তারা, অভিভাবকদের দ্বারা বিশৃঙ্খল হওয়া ছাত্রদের সংশ্রবে এসে সিদ্ধান্ত নেন যে সব শিশু দুরূহ প্রকৃতির এবং অভিভাবকরা একেবারে নির্বোধ। অভিভাবকদের অত্যাচারে যেসব ছেলে বন্য হয়ে গেছে তাদের দীর্ঘ কিংবা স্বল্প সময়ের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা দরকার, তবেই তারা বয়স্কদের নিঃসন্দিগ্ধ মনে করবে। কিন্তু যাদের সঙ্গে গৃহে বিজ্ঞতার সঙ্গে আচরণ করা হয়েছে তারা তদারকি সহ্য করবে। এই শিশুদের বোধ করতে হবে যে তাদের এমন ব্যাপারে সাহায্য করা হচ্ছে যে ব্যাপারকে তারা নিজেরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। যে বয়স্ক ব্যক্তি শিশুদের পছন্দ করেন এবং শিশুদের সাহচর্যে স্নায়ুর চাপ বোধ করেন না তারা শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে অনেক দূর অগ্রসর হতে পারেন এবং তা পারেন শিশুদের বন্ধুতাপূর্ণ অনুভূতি না হারিয়ে।

আমার মনে হয় আধুনিক শিক্ষাতাত্ত্বিকরা শিশুদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নঞর্থক দিকের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদানের পক্ষপাতী, পক্ষান্তরে শিশুদের সাহচার্য উপভোগের সদর্থক দিকের প্রতি কম গুরুত্ব প্রদানে আগ্রহী। আপনার যদি শিশুদের প্রতি সেই ধরনের অনুরাগ থাকে যে ধরনের অনুরাগ দেখা যায় অনেক লোকের ঘোড়া ও কুকুরের প্রতি, তবে তারা আপনার ইংগিতে সাড়া দেবে, বিধিনিষেধ মানবে, হয়তো কিছুটা আনন্দদায়ক অসন্তোষের সঙ্গে। কিন্তু কিছুতেই ক্ষুব্ধ হবে না। শিশুদের প্রতি সেই ধরনের অনুরাগের কোনো মূল্য নেই যেখানে তাদের সামাজিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র কিংবা ক্ষমতালিপ্সা প্রকাশের সুযোগ গণ্য করা হয়। কোনো শিশুই কৃতজ্ঞ বোধ করবে না যদি তার প্রতি উৎসাহের উৎস হয় আপনার দলের জন্য ভোট লাভ কিংবা রাজা বা দেশের জন্য তাদের উৎসর্গ করা। ঈপ্সিত অনুরাগ হলো শিশুদের মেলায় স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ, এবং কোনো অন্তর্গত অভীষ্ট না-থাকা। এই গুণ যে শিক্ষকের রয়েছে তার শিশুর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের দরকার করবে না, এবং প্রয়োজনে মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিসাধন না করেই তিনি হস্তক্ষেপ করতে পারবেন।

দুর্ভাগ্যবশত, কর্মভারাক্রান্ত একজন শিক্ষকের পক্ষে শিশুদের প্রতি হৃদোখিত অনুরাগ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়; তার অনুভূতি দাঁড়ায় প্রবাদের ময়রার মতো; মিষ্টির প্রতি ময়রার যে অনুভূতি, ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের অনুভূতির সঙ্গে তার তুলনা চলে। আমি মনে করি না যে শিক্ষা কারো একান্ত পেশা হওয়া উচিত: এই পেশায় নিয়োজিত হবে তারা যারা দুঘণ্টা শিক্ষকতা করে বাকি সময় ছাত্রদের থেকে দূরে কাটাবেন। যুবকদের সমাজ খুবই ক্লান্তিকর, বিশেষত যখন কঠোর শৃঙ্খলা এড়িয়ে যাওয়া হয়। ক্লান্তি বা শ্রান্তি পরিশেষে জন্ম দেয় বিরক্তির, যা এক সময় কোনো না কোনোভাবেই প্রকাশিত হবেই, পেরেশান শিক্ষক নিজেকে যে তত্ত্বেই গড়ে তুলুন না কেন। প্রয়োজনীয় বন্ধুভাবাপন্ন অনুভূতি কেবল আত্মসংযম দ্বারা রক্ষা করা যায় না। কিন্তু যেখানে এটা বর্তমান, সেখানে আগে থেকে দুষ্টু ছেলের প্রতি আচরণের নিয়ম রাখা নিষ্প্রয়োজনীয়, যেহেতু আবেগ সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছায় এবং যে-কোনো সিদ্ধান্ত সঠিক হবে যদি সে অনুভব করে আপনি তাকে পছন্দ করেন। কোনো নিয়মই, যতই বিজ্ঞতাপূর্ণ হোক, স্নেহ কিংবা বিচক্ষণতার বিকল্প হতে পারে না।

১৩. স্টয়িসিজম ও মানসিক স্বাস্থ্য

আগে যেখানে অনেক শিক্ষাগত সমস্যার সুরাহা (খুবই অসফলভাবে) করা হতো নিছক নৈতিক শৃঙ্খলা দ্বারা, সেসব সমস্যা এখন আধুনিক মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে আরো অপ্রত্যক্ষভাবে কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমাধা করা হয়। বিশেষত মনঃসমীক্ষণ সম্পর্কে যাদের জ্ঞান সীমিত তারা মনে করেন স্টয়িক আত্ম-পরিচালনার কোনো দরকার নেই। আমি এই মতের অনুসারী নই। বর্তমান নিবন্ধে আমার অভিপ্রায় হলো যেসব পরিস্থিতি একে দরকারি করে তোলে এবং যেসব পদ্ধতিতে এটা তরুণদের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করা যায় তা বিবেচনা করা; এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য কিছু বিপদ এড়ানোর উপায়ও বিবেচনা করতে চাই।

আমরা এখনি সবচেয়ে দুরূহ এবং সবচেয়ে দরকারি সমস্যা নিয়ে নিবন্ধের সূচনা করব। এই সমস্যার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার স্টয়িসিজম: আমি মৃত্যুর কথা বলছি। বিভিন্ন উপায়ে মৃত্যু-ভয় মোকাবেলার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমরা একে এড়িয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করতে পারি; আমরা কখনো এর উল্লেখ পর্যন্ত না করতে পারি, এবং সবসময়ই মৃত্যু-চিন্তা এলে আমাদের ভাবনা ভিন্নমুখী করতে পারি। ওয়েলসের টাইম মেশিনের প্রজাপতি জনগণের পদ্ধতি এটাই ছিল। কিংবা আমরা উল্টো পথও অবলম্বন করতে পারি এবং বিরামহীনভাবে মানবজীবনের স্বল্পায়ু সম্পর্কে ভাবতে বা ধ্যান করতে পারি, এই আশায় যে অতি-পরিচয় অবজ্ঞা জন্ম দেবে; পঞ্চম চার্লস সিংহাসন ত্যাগের পর নিভৃত জীবনে এই পথটাই বেছে নিয়েছিলেন। কেমব্রিজের একটি কলেজের জনৈক ফেলো এতদূর গিয়েছিলেন যে নিজের কক্ষে শবাধার নিয়ে ঘুমাতেন এবং ঐ কলেজের চত্বরে কোদাল নিয়ে যেতেন কৃমি দ্বি-খণ্ড করার জন্য। এবং নির্ভুলভাবে বলতেন: হয়েছে! তুমি এখনও আমাকে ধরতে পারনি। তৃতীয় একটি পন্থাও রয়েছে, এই পন্থাটি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়, পন্থাটি হলো নিজেকে এবং অপরকে বোঝানো যে মৃত্যু মৃত্যু নয়। বরং মৃত্যু হলো নতুন ও উন্নততর জীবনের দরোজা। এই তিনটি পন্থা, বিভিন্ন অনুপাতে মিশ্রিত হয়ে অধিকাংশ মানুষকে এই আপসে পৌঁছায় যে অস্বাচ্ছন্দকর বাস্তবতা হলো মৃত্যু।

সে যাই হোক, এই প্রত্যেকটি পদ্ধতি সম্পর্কে আমার আপত্তি রয়েছে। আবেগগত কৌতূহলের কোনো বিষয় সম্পর্কে ভাবনা এড়ানোর চেষ্টা করা, যৌনতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফ্রয়েডপন্থিরা যেমন উল্লেখ করেছেন, অসফল হতে বাধ্য, এবং এর পরিণাম দাঁড়ায় নানা ধরনের অবাঞ্ছনীয় বিকৃতি বা বিচ্যুতি। এখন অবশ্যই একটি বাচ্চা ছেলের জীবন থেকে মৃত্যু-চেতনা সরিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে। এটি ঘটে কি ঘটে না, তা ভাগ্যের ব্যাপার। যদি বাবা বা মা, ভাই বা বোন মারা যায়, তাহলে এমন কোনো উপায় নেই কিংবা কিছু করার থাকে না যাতে একটি বাচ্চা ছেলের মৃত্যু সম্পর্কে আবেগগত সচেতনতা অর্জনে বাধা দেওয়া যায়। এমনকি যদিও, ভাগ্যগুণে, একটি ছেলের প্রথম জীবনে মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতা স্বচ্ছ নাও হয়, শীঘ কিংবা বিলম্বে সে এই সচেতনতা অর্জন করবে; এবং যারা এ বিষয়ে একেবারেই অপ্রস্তুত তারা সচেতন হওয়ার পরই খুব সম্ভব অত্যন্ত ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। অতএব মৃত্যুকে এড়িয়ে না গিয়ে, মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের একটা দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠার অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে।

আবার বিরামহীনভাবে মৃত্যু-চিন্তার অভ্যাস অন্তত সমান ক্ষতিকর। কোনো একটা বিষয়ে খুবই একান্তভাবে চিন্তা ভুল, বিশেষত যখন আমাদের চিন্তা কার্যে পরিণত হতে পারে না। অবশ্য আমরা মৃত্যু মুলতবি রাখতে চেষ্টা করতে পারি, এবং সীমাবদ্ধতার ভেতর যে-কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তি তা করে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের মৃত্যুকে ঠেকাতে পারি না। অর্থাৎ এটি একটি লাভহীন চিন্তার বিষয়। উপরন্তু এটি একজন মানুষের অপরের প্রতি এবং ঘটনাবলির প্রতি কৌতূহল হ্রাস করে এবং বস্তুগত কৌতূহলই শুধু মানসিক স্বাস্থ্য সংরক্ষণ করতে পারে। মৃত্যু-ভয় মানুষকে এই বোধ তাড়িত করে যে সে বাহ্যিক শক্তির দাস, এবং দাস মনোবৃত্তি থেকে সুফল আসতে পারে না। যদি কোনো ব্যক্তি গভীর ধ্যান করে সত্যিই মৃত্যু ভয় থেকে আরোগ্য লাভ করতে পারেন, তাহলে তিনি এ বিষয়ে ভাবনায় ক্ষান্তি দেবেন। যতক্ষণ তিনি এই চিন্তায় নিমগ্ন থাকবেন, তা প্রমাণ করবে যে তিনি মৃত্যু ভয় ছাড়তে পারেন নি। অতএব এই পদ্ধতি অন্য পদ্ধতি থেকে উন্নততর নয়।

মৃত্যু উন্নততর জীবনের দরোজা, এই বিশ্বাসে, যৌক্তিকভাবে, যে-কোনো ব্যক্তির যে-কোনো প্রকার মৃত্যু-ভয় বন্ধ করা উচিত। ডাক্তারি পেশার জন্য সৌভাগ্য যে বস্তুত এ ধরনের কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটে না। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা এর মধ্যে ধরা হচ্ছে না। কেউ কি দেখতে পান, যারা মৃত্যুকে চরম পরিণতি মনে করেন তাদের চেয়ে ভবিষ্যৎ জীবনে বিশ্বাসীরা অসুখ-বিসুখ ব্যাপারে কম ভীত কিংবা যুদ্ধে অধিকতর সাহসী। স্বৰ্গত এফ, ডব্লু. এইচ, মাইয়ার্স বলতেন, তিনি কীভাবে এক নৈশ ভোজনোৎসবে জনৈক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন মৃত্যুর পর তার কী পরিণতি হবে বলে তিনি মনে করেন। ঐ ব্যক্তি প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু চাপ প্রয়োগ করা হলে জবাব দেন, ও হ্যাঁ, আমি চিরন্তন আশীর্বাদের উত্তরাধিকারী হবো, কিন্তু আমি আশা করব আপনি এ ধরনের অপ্রীতিকর বিষয়ে কথা বলবেন না। অবশ্যই এ ধরনের পরিষ্কার অসংলগ্নতার কারণ হলো ধর্মীয় বিশ্বাস শুধু অধিকাংশ মানুষের সজাগ চিন্তায় অস্তিত্বশীল, এবং কোনো মতেই মানুষের নিশ্চেতন কার্যকারিতা সংশোধন করতে সফল হয়নি। মৃত্যু-ভয় সফলভাবে মোকাবেলা করতে হলে, তা করতে হবে কতকগুলো পদ্ধতিতে, যা সামগ্রিকভাবে মানবিক আচরণ প্রভাবিত করে, শুধু, যাকে আমরা সাধারণভাবে বলি সজাগ-চিন্তা, আচরণের সেই অংশ প্রভাবিত করলে চলবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রভাব কাজ করতে পারে, কিন্তু মানবজাতির সংখ্যাগুরু এই প্রভাবের বাইরে থাকবে। আচরণগত যুক্তি ছাড়াও এই ব্যর্থতার আরো দুটি উৎস রয়েছে: একটি হলো আন্তরিক ধর্মানুরাগী হওয়া সত্ত্বেও নির্দিষ্ট কিছু সন্দেহ থেকে যায়, এবং এটা সংশয়বাদীদের মধ্যে ক্রোধের আকারে প্রকাশ পায়; অপর কারণটি হলো, ভবিষ্যৎ জীবনে বিশ্বাসীরা, তাদের বিশ্বাস যদি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়, তাহলে মৃত্যুর সঙ্গে যে-আতংক জড়িত হবে তার মাত্রা কমানোর চেয়ে বাড়িয়ে দেয়, ফলে যারা এ ব্যাপারে সর্বাত্মক নিশ্চিত বোধ করেন না তাদের ভীতি বৃদ্ধি পায়।

তাহলে, অতঃপর, আমরা তরুণদের এই জগতের সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য কী করব, যেখানে মৃত্যু বাস্তব ঘটনা? আমাদের তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে এবং এই লক্ষ্য তিনটি মেলানো কঠিন কাজ। ১. আমরা অবশ্যই তাদের মধ্যে এমন কোনো বোধ অনুপ্রাণিত করব না যে মৃত্যু এমন একটি বিষয় যা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে ইচ্ছা করি না, কিংবা এ ব্যাপারে ভাবতে তাদের উৎসাহিত করি না। এ ধরনের বোধ যদি আমরা তাদের মধ্যে অনুপ্রাণিত করি তাহলে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে যে এর মধ্যে একটা মজাদার রহস্য রয়েছে, এবং এ বিষয়ে অতিরিক্ত ভাবতে শুরু করবে। এক্ষেত্রে যৌনশিক্ষা ব্যাপারে সুপরিচিত যে আধুনিক অবস্থান, তা প্রযোজ্য। ২. তথাপি, আমরা অবশ্যই, যদি সম্ভব হয়, এমন কাজ করবো যাতে তাদের অধিক এবং ঘন-ঘন মৃত্যু নিয়ে ভাবনা থেকে বিরত রাখা যায়। মৃত্যুভাবনা নিয়ে নিমগ্ন থাকার প্রতি এক ধরনের আপত্তি রয়েছে, যে ধরনের আপত্তি তোলা হয় নোংরা পুস্তকে (Pornography) নিয়ে নিমগ্ন থাকার ব্যাপারে। কারণ, এতে দক্ষতা হ্রাস পায়, সার্বিক বিকাশ ব্যাহত হয়, এবং এমন আচরণে অভ্যস্ত করে যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং অপরের জন্যও সন্তোষজনক নয়। ৩. আমরা অবশ্যই কারো মধ্যে শুধুমাত্র সচেতন চিন্তা দ্বারা মৃত্যু বিষয়ে সন্তোষজনক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করার আশা করবো না; বিশেষত, এই বিশ্বাস থেকে কোনো কল্যাণ হয় না যে মৃত্যু কম ভয়ংকর (অন্যকিছু হওয়ার চেয়ে), যেহেতু (স্বাভাবিকভাবেই) ঐ ধরনের বিশ্বাস সচেতনতার নীচু স্তরে অনুপ্রবেশ করতে পারে না।

উপযুক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট শিশু বা কিশোরের অভিজ্ঞতা অনুসারে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। যদি শিশুটির অতি নিকটের কেউ মারা না যায়, তাহলে মৃত্যুকে সাধারণ ব্যাপার বলে গ্রহণ করা খুবই সহজ হবে। এতে বড় কোনো আবেগগত স্বার্থ জড়িত থাকবে না। মৃত্যু ব্যাপারটা যতক্ষণ বিমূর্ত ও নৈর্ব্যক্তিক, ততক্ষণ এর উল্লেখ করতে হবে অনাসক্ত কণ্ঠে, ব্যাপারটা ভয়ানক, ও রকম কোনো আভাস যেন না মেলে। যদি শিশুটি জিজ্ঞেস করে আমি কি মরব? তাহলে একজনের বলা উচিত হবে, হ্যাঁ, তবে কিছুকালের মধ্যেই নয়। মৃত্যু সম্পর্কে কোনো প্রকার রহস্যময় ধারণা সৃষ্টি হওয়ায় বাধা দিতে হবে। অযোগ্য হয়ে যাওয়া খেলনার পর্যায়ে একে নামিয়ে আনতে হবে। যদি সম্ভব হয়, তাহলে এটা অবশ্যই বাঞ্ছনীয় যে তরুণদের কাছে মৃত্যু দূরতম ঘটনা বলে মনে করাতে হবে।

যদি শিশুটির নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কেউ মারা যায়, তাহলে ব্যাপারটা ভিন্নভাবে বিবেচনা করতে হবে। উদাহরণত, শিশুটির একটি ভাই মারা গেলে স্বাভাবিকভাবেই পিতামাতা অসুখী হবেন এবং যদিও তারা চাইবেন না যে শিশুটি বুঝতে পারুক তারা কতটা অসুখী, তবু এটা সঠিক এবং প্রয়োজনীয় যে ছেলেটা অন্তত কিছু বুঝুক তার পিতামাতার অসুখটা কোথায়। স্বাভাবিক স্নেহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং ছেলেটির অনুভব করা উচিত তার মুরুব্বীরা এটা অনুভব করেন। উপরন্তু, যদি অতিমানবিক প্রচেষ্টায় তারা তাদের দুঃখ ছেলেটির কাছে গোপন রাখেন তবে সে ভাবতে পারে: আমি মারা গেলে তারা কিছুই মনে করবে না। এই ধরনের চিন্তা থেকে মানসিক ব্যাধি বিকাশলাভ করতে পারে। সুতরাং যদিও এ ধরনের ঘটনার আঘাত শৈশবকালের শেষের দিকে পেলে তা ক্ষতির কারণ হয় (প্রথমদিকে খুব বেশি অনুভব করা যায় না)। এবং ঘটলে তার গুরুত্ব আমাদের খুব বেশি খাটো করে দেখা উচিত হবে না। এই বিষয়টি এড়িয়ে চলাও উচিত হবে না, অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদানও হবে অন্যায়। অভীষ্ট সম্পর্কে সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে যা কিছু সম্ভব তা অবশ্যই করতে হবে: ছেলেটির মনোযোগ নতুন বিষয়ে আকৃষ্ট করতে হবে, সর্বোপরি নুতনভাবে স্নেহসিক্ত করতে হবে। আমি মনে করি কোনো ছেলের একটি ব্যক্তির প্রতি তীব্র অনুরাগ সবসময়ই কিছু হারানোর চিহ্ন। এই অনুরাগ পিতা-মাতার মধ্যে একজনের প্রতি জাগতে পারে যদি এদের মধ্যে একজনের ভেতর দয়ার অভাব দেখা দেয়, এই অনুরাগ শিক্ষকের প্রতিও জাগতে পারে যদি পিতা-মাতা উভয়ে হন নির্দয়। সাধারণত এটা ভীতি থেকে জন্মে থাকে: অনুরাগের লক্ষ্য তিনিই হন যিনি নিরাপত্তা বোধ জাগাতে পারেন। শৈশবে এই ধরনের অনুরাগ স্বাস্থ্যকর নয়। উক্ত অনুরাগের অস্তিত্ব যেখানে রয়েছে সেখানে যদি ভালোবাসার পাত্র মারা যায় তাহলে ছেলেটির জীবন বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাইরে থেকে সবকিছু ভালো মনে হলেও, পরবর্তীকালীন অনুরাগের সঙ্গে আতংক জড়িত হবে। স্বামী (কিংবা স্ত্রী) এবং সন্তানেরা উল্কণ্ঠা-আক্রান্ত হবে। তাছাড়া যখন নিজের জীবন স্বাভাবিকভাবে যাপন করে যাবে, তাদের কাছে মনে হবে হৃদয়হীন। সুতরাং পিতা বা মাতার এ ধরনের অনুরাগের বস্তুতে পরিণত হয়ে খুব উফুল্ল বোধ করা উচিত হবে না। ছেলেটির পরিবেশ যদি হয় স্বাভাবিকভাবে বন্ধুতাপূর্ণ এবং সুখী তাহলে বিয়োগব্যথা অধিক অসুবিধা ছাড়াই উত্তীর্ণ হতে পারবে। জীবনের প্রতি ঝোঁক ও আশাই যথেষ্ট, শর্ত থাকে যে উন্নতি ও সুখের অনুকূলে স্বাভাবিক সুযোগ থাকতে হবে।

কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালে মৃত্যুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপারে আরো সদর্থক কিছু থাকা দরকার। সাবালক জীবন সন্তোষজনক হওয়ার জন্যই এটা প্রয়োজনীয়। পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির উচিত মৃত্যু সম্পর্কে কম ভাবা, কি নিজের কি তার ভালোবাসার পাত্রদের সম্পর্কে, এজন্য নয় যে সে ইচ্ছাকৃতভাবে তার চিন্তা ভিন্ন পথে পরিচালিত করবে, কারণ তা হবে অকেজো প্রচেষ্টা, যা বাস্তবে কোনোদিন সফল হয় না। বস্তুত এটা করতে হবে তার কৌতূহল ও কার্যক্রমের বিভিন্নমুখিনতার জন্য। যখন তিনি মৃত্যু সম্পর্কে ভাববেন, প্রকৃষ্ট কাজ হবে স্টয়িকসুলভ ঔদাসীন্য সহকারে তা ভাবা, ইচ্ছাকৃত এবং সুস্থিরভাবে, ব্যাপারটার গুরুত্ব কমানোর চেষ্টা এতে থাকবে না। বরং ব্যাপারটার উর্ধ্বে ওঠার নির্দিষ্ট গর্বানুভব এত কাজ করবে। নীতিটা হবে অপরাপর যে-কোনো আতংক থেকে অভিন্ন সম্ভাব্য চিকিৎসা হলো আতংকজনক বস্তু সম্পর্কে দৃঢ়সংকল্প অনুধ্যান। কেউ মনে-মনে বলতে পারেন: আচ্ছা হা, যদি তা ঘটেই যায় তাহলে কি ই বা হলো? লোকেরা যুদ্ধে মৃত্যুর মতো ঘটনায় এই মনোভাব অর্জন করে, কারণ ঐ সময় তাদের নিশ্চিত ভাবে বোঝানো হয় যে তারা একটা লক্ষ্যের জন্য তাদের কিংবা প্রিয়জনের জীবন উৎসর্গ করেছে। এই ধরনের উপলব্ধি সবসময়ই কাম্য। সবসময়ই একজনকে ভাবতে হবে যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের জন্য তিনি বেঁচে আছেন এবং তার মৃত্যু, তার স্ত্রী কিংবা সন্তানের মৃত্যু জগৎ সম্পর্কে তার প্রবল আগ্রহের পরিসমাপ্তি ঘটায় নি। সাবালক জীবনে এই মনোভাব আন্তরিক এবং গম্ভীর হতে হবে। বয়ঃসন্ধিকালে একজন তরুণের উচিত উদার উৎসাহে আপুত হওয়া এবং তার জীবন ও বৃত্তি সেই মোতাবেক উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। বয়ঃসন্ধি ঔদার্যের পর্যায়কাল; এই সময়টা কাজে লাগাতে হবে উদার অভ্যাস গড়ার জন্য। পিতা কিংবা শিক্ষকের প্রভাবে এটা অর্জন করা যেতে পারে। উন্নততর সমাজে মায়েরাই অনেক সময় এটা করতে পারেন; কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় মহিলাদের জীবন এমন যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে এবং আমি যতটা বিদগ্ধ হওয়া উচিত মনে করি তা হয় । একই কারণে নব্য যুবকদের (যুবতিদেরও) পুরুষ শিক্ষকের সঙ্গ পাওয়া উচিত। যতক্ষণ না এক নতুন শ্রেণির মহিলার আবির্ভাব ঘটে যারা আগ্রহের দিক থেকে অধিকতর নৈর্ব্যক্তিক।

সম্প্রতিকালে মানবজীবনে স্টইকবাদের স্থানকে সম্ভবত কিছুটা খাটো করে দেখা হয়, বিশেষত প্রগতিশীল শিক্ষাবিদগণ খাটো করে দেখে থাকেন। যখন দুর্ভাগ্যের হুমকি আসে, তখন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য দুটি উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। আমরা দুর্ভাগ্য এড়িয়ে চলতে পারি কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি যে অবিচল ধৈর্য নিয়ে আমরা এই দুর্ভাগ্যের মোকাবেলা করব। প্রথম পদ্ধতিটি খুবই শ্রদ্ধেয় যদি ভীরুতা ব্যতিরেকে তা সম্ভব হয়; কিন্তু দ্বিতীয়টিরও দরকার আছে, অবিলম্বে কিংবা কিছুকাল। পরই এর দরকার হবে, অন্তত তার জন্য তো অবশ্যই দরকার, যিনি ভীতির ক্রীতদাসে পরিণত হতে প্রস্তুত নন। এই দৃষ্টিভঙ্গিই স্টইকবাদ। একজন শিক্ষকের পক্ষে তরুণদের মধ্যে স্টইকবাদ বিস্তার দূরূহ হয়ে পড়ে এজন্য যে এই কাজটি করতে গেলে ধর্ষকাম মুক্তির পথ খুঁজে পায়। অতীতকালে শৃঙ্খলা-সম্পর্কিত ধারণা এতটা হিংস্র ছিল যে, শিক্ষা হয়ে দাঁড়াত নিষ্ঠুরতার প্রতি অনুরাগের সদর রাস্তা। শিশুকে ভোগান্তির শিকারে পরিণত করে আনন্দ লাভ না করে তাদের প্রয়োজনীয় ন্যূনতম শৃঙ্খলা শেখানো কি সম্ভব? প্রাচীনপন্থিরা অবশ্য অস্বীকার করে বলবেন, এই কাজটি করে তারা কোন সুখ বোধ করেন না। এই গল্পটা সবাই জানেন; জনৈক পিতা আর পুত্রকে বেত্রাঘাত করার সময় বলেছেন : পুত্র, এতে আমি তোমার চেয়ে বেশি আঘাত পাচ্ছি। পুত্র জবাবে বলেছিল : তাহলে বাবা, তুমি কি এ কাজটি আমাকে করতে দেবে? The Way of all Flesh উপন্যাসে স্যামুয়েল বাটলার কঠোর পিতামাতার ধর্ষকামী সুখের যে চিত্র এঁকেছেন তা আধুনিক মনস্তত্ত্বের যে-কোনো ছাত্র সাগ্রহে গ্রহণ করবেন। তাহলে আমরা এ ব্যাপারে কী করব?

অনেক বিষয়ের মধ্যে মৃত্যু-ভীতি একটি যা আমরা স্টইকবাদের সাহায্যে মোকাবেলা করতে পারি। দারিদ্র্যের ভয় রয়েছে, দৈহিক যন্ত্রণার ভয় রয়েছে, সন্তানের জন্মদানের ভীতিও ধরতে হবে,-এটা ধনবান মহিলাদের মধ্যে খুবই ক্রিয়াশীল। এই সব ভয় ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং এখন কম-বেশি তুচ্ছ গণ্য করা হয়। কিন্তু যদি আমরা এই পথ বেছে নিই যে জনগণের এ ব্যাপারে কিছু মনে করা উচিত হবে না, তাহলে, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ্যে এই ঝোঁকও দেখা দেবে যে অকল্যাণ লঘু করার জন্য কিছু করা নিষ্প্রয়োজন। দীর্ঘকাল মনে করা হতো সন্তান জন্মদানের সময় মায়েদের চেতনানাশক (Anaesthetics) কিছু গ্রহণ করা উচিত হবে না। জাপানে এই ধারণা আজ পর্যন্ত টিকে আছে। পুরুষ ডাক্তারগণ অভিমত ব্যক্ত করতেন যে, চেতনা নাশক ক্ষতিকারক। অথচ এই অভিমতের পক্ষে কোনো যুক্তি নেই, নিঃসন্দেহে এর অন্তর্নিহিত কারণ ছিল নিশ্চেতন ধর্ষকাম। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো জন্মদানের বেদনা প্রশমিত করা হতে লাগল, ধনাঢ্য মহিলারা বেদনা সহ্য করতে কম ইচ্ছুক হতে লাগলেন, তাদের সাহস প্রয়োজনের তুলনায় দ্রুতগতিতে হ্রাস পেল। স্পষ্টতঃই একটা ভারসাম্য থাকা উচিত। গোটা জীবন মখমল-তুল্য এবং সুখকর করা অসম্ভব, সুতরাং মানুষকে এমন মনোভাব গড়ে তুলতে সমর্থ হতে হবে যা জীবনের অপ্রীতিকর পর্যায়ের জন্য উপযুক্ত হবে। তবে আমাদের এটা করতে নিষ্ঠুরতা যথাসম্ভব কম উৎসাহিত করতে হবে।

যাদের বাচ্চা ছেলেদের লালন পালন করতে হয় তারা অতিশীঘ্র শেখেন অতিরিক্ত সহানুভূতি ভ্রমাত্মক। একেবারে কম সহানুভূতি অবশ্য সমধিক ভ্রমাত্মক, কিন্তু এক্ষেত্রে, অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই, কোনো চরমপন্থা ভালো নয়। যে শিশু শুধু সহানুভূতি পেতেই অভ্যস্ত যে অতিক্ষুদ্র দুর্ভোগের জন্য সোরগোল তুলবে। গড় পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি সাধারণ আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেন এই জ্ঞানের কল্যাণে যে সোরগোল তুলে সহানুভূতি লাভ করা যাবে না। শিশুরাও অবিলম্বে বুঝতে পারে, যে ব্যক্তি অনেক সময় কিছুটা কঠোর সেই ব্যক্তি তাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট। সহজাত প্রবৃত্তি তাদের জাগিয়ে দেয়, তাদের ভালোবাসা হচ্ছে কি হচ্ছে না এবং যাদের কাছ থেকে তারা স্নেহ আশা করে তারা যদি শিশুর উপযুক্ত বিকাশের আন্তরিক ইচ্ছা থেকে কঠোরও হন, তবে সে কঠোরতা তারা সহ্য করবে। সুতরাং তত্ত্বগতভাবে সমাধান অত্যন্ত প্রাঞ্জল: ভালোবাসা দ্বারা অনুপ্রাণিত হোন, তারাও সঠিক কাজটি করবে। যাহোক, বস্তুত ব্যাপারটা কিন্তু আরো জটিল। ক্লান্তি, বিরক্তি, অধৈর্য পিতা বা মাতা কিংবা শিক্ষককে আক্রান্ত করতে পারে। অতএব এমন শিক্ষাতত্ত্ব থাকা বিপজ্জনক যেখানে শিশুর চূড়ান্ত কল্যাণের স্বার্থে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি এই অনুভূতিগুলো তাদের উপর চাপিয়ে দেবে। তথাপি এই তত্ত্ব যদি সত্য হয় তবে তা গ্রহণ না করে উপায় নেই এবং বিপদের দিকটা সম্পর্কে পিতা-মাতা কিংবা শিক্ষককে সচেতন করতে হবে, যাতে শিশুদের রক্ষার জন্য সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

এতক্ষণ আলোচনার ভেতর আমরা যে সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেছি এখন তার সারসংক্ষেপ করা চলে। জীবনের বেদনাদায়ক দুর্ভোগ সম্পর্কে বলা যায়, এ সম্পর্কে জ্ঞান শিশুদের কাছ থেকে আড়াল করা যেমন উচিত হবে না তেমনি অনুচিত হবে তাদের উপর জেদ করে এই জ্ঞান আরোপ করা। এই জ্ঞান আসবে যখন পরিস্থিতি একে অনিবার্য করে তুলবে। বেদনায়ক ঘটনা সততা ও নিরাসক্তির সঙ্গে বোঝাঁপড়া করা উচিত, তবে পরিবারে কারো মৃত্যু হলে দুঃখ গোপন করা স্বাভাবিক কাজ হবে না। বয়স্ক ব্যক্তিদের উচিত হবে আচরণে জাঁকালো সাহস প্রদর্শন, যা তরুণরা নিশ্চেতনভাবে তাদের উদাহরণ থেকে আয়ত্ত করবে। বয়ঃসন্ধিকালে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে বিশাল কিছু নৈর্ব্যক্তিক স্বার্থ এবং এমনভাবে শিক্ষাদান করতে হবে (ইশারায়, সুস্পষ্ট উপদেশের আকারে নয়) যাতে তারা এই ধারণা লাভ করে যে বেঁচে থাকার লক্ষ্য শুধু স্বীয় স্বার্থ হাসিল নয়। দুর্ভাগ্য সহ্য করার শিক্ষা তাদের দেয়া উচিত; দুর্ভাগ্যে পতিত হলে তারা যেন স্মরণ করতে পারে জীবনে বেঁচে থাকার আরো অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু তাদের সম্ভাব্য দুর্ভাগ্য সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত হবে না। দুর্ভাগ্য মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যও তাদের এ নিয়ে চিন্তা করা ঠিক নয়।

শিশুদের শিক্ষা দেয়া যাদের পেশা তাদের নিজেদের উপর নজর রাখতে হবে শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপাদান শৃঙ্খলা থেকে তারা যেন ধর্ষকামী সুখ আহরণ না করেন; শিক্ষার লক্ষ্য সবসময়ই হবে চরিত্র ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ। কারণ বুদ্ধির জন্যও শৃঙ্খলার প্রয়োজন, শৃঙ্খলা ব্যতিরেকে সঠিক চিন্তাশক্তি অর্জন করা যায় না। তবে বুদ্ধির শৃঙ্খলার প্রকৃতি ভিন্ন এবং তা বর্তমান নিবন্ধের আওতা-বহির্ভূত বিষয়। আমি শুধু আর একটি কথা বলব, তা হলো সেই শৃঙ্খলা সর্বোত্তম যা অন্তর্গত প্রবণতা থেকে আসে। এটা যাতে সম্ভব হয় তার জন্য শিশু বা কিশোরকে কঠিন একটা কিছু অর্জনের অভিলাষ পোষণ করতে হবে, এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করার জন্য ইচ্ছুকও হতে হবে। এ ধরনের অভিলাষ সম্পর্কে পরিপার্শ্বের কিছু ব্যক্তির কাছ থেকে সাধারণত ইঙ্গিত আসে; ফলে আত্ম-শৃঙ্খলাও শেষ পর্যন্ত শিক্ষাগত উদ্দীপনার উপর নির্ভর করে।

১৪. ধূমকেতু

আমি যদি ধূমকেতু হতাম তাহলে বর্তমানকালের মানুষের অধঃপতিত জাতি গণ্য করতাম।

আগের যুগে ধূমকেতুর প্রতি শ্রদ্ধা সার্বিক ও গভীর ছিল। একটা ধূমকেতু সিজারের মৃত্যুর বার্তা বহন করেছিল। আর একটি ইঙ্গিত রেখেছিল যে, সম্রাট ভেসপাসিনের মৃত্যু আসন্ন। কিন্তু এই সম্রাট নিজে সবল চিত্তের মানুষ ছিলেন। তাই দাবি করলেন, ঐ ধূমকেতু নিশ্চয় অন্য কোনো তাৎপর্য বহন করছে। সম্রাটের যুক্তি ছিল এ রকম: ধূমকেতুটি কেশাচ্ছন্ন, অথচ তিনি নিজে নিষ্কেশ। তবে কম লোকই এই ধরনের কঠোর যুক্তি কবুল করতে পেরেছিলেন। মাননীয় (The Venerable) বিড বলেছেন, ধূমকেতুরা রাষ্ট্রবিপ্লব, মড়ক, যুদ্ধ, বাতাস এবং উত্তাপের সূচনাবাহক। জন নকস ধূমকেতুর মধ্যে স্বর্গীয় ক্রোধের চিহ্ন দেখতে পেতেন, অন্যান্য স্কটল্যান্ডবাসী প্রটেস্টান্টরা ভাবতেন ধূমকেতু রাজাকে সতর্ক করে দিচ্ছে পোপের শিষ্যদের উচ্ছেদ করা হোক।

আমেরিকা, বিশেষ করে নিউ ইংল্যান্ড, ধূমকেতুর প্রতি উপযুক্ত মনোযোগ দিয়েছে। ১৬৫২ সালে আকাশে একটা ধূমকেতুর উদয় ঘটে যখন বিখ্যাত মি: কটন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁর মৃত্যুর পর ধূমকেতুটা আড়ালে চলে যায়। দশ বৎসর পর নতুন ধূমকেতু অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় সুখ এবং লাম্পট্য ও ফ্যাশনদুরস্ত পোশাক পরিধান করে ঈশ্বরের সৃষ্টি অপব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার জন্য বোস্টনের দুষ্ট অধিবাসীদের সর্তক করে দেয়। ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট বিখ্যাত Increase Mather-এর বিবেচনায় ধূমকেতু এবং সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হার্বাডের প্রেসিডেন্ট এবং ঔপনিবেশিক গবর্নরদের মৃত্যুর বার্তা বহন করে এনেছিল। তাই তিনি তার অনুসারীদের আদেশ করেন প্রভুর কাছে প্রার্থনা করতে যাতে তিনি আকাশের নক্ষত্ররাজির স্থলে ধূমকেতু না পাঠান।

এইসব কুসংস্কার ক্রমান্বয়ে দূরীভূত হয় হ্যাঁলির এই আবিষ্কার দ্বারা যে অন্তত একটি ধূমকেতু গ্রহের মতো সূর্যের চারদিকে নিয়মমাফিক ঘোরে। নিউটন যখন ঘোষণা দিলেন ধূমকেতুরা মধ্যাকর্ষণ সূত্র মেনে চলে, সেটাও কুসংস্কার নিরসনে সাহায্য করে। পুরোনো ধ্যান-ধারণার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাপকদের নিষেধ করা হয়েছিল তারা যেন কিছুকালের জন্য এসব নতুন তত্ত্বের উল্লেখ না করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য গোপন করে রাখা যায় নি। আজকের দিনে এমন জগতের কল্পনা করা দুরূহ যেখানে উচ্চ-নিচু, শিক্ষিত কি অশিক্ষিত ব্যক্তি ধূমকেতু নিয়ে মাতবেন এবং যখনই ধূমকেতুর আগমন ঘটে তখন আতঙ্কগ্রস্ত হবেন। আমরা অনেকেই ধূমকেতু একবারও দেখিনি। আমি দুটি ধূমকেতু দেখেছি। কিন্তু সে দুটি ধূমকেতু প্রত্যাশার কম হৃদয়গ্রাহী ছিল। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে যে পরিবর্তন এসেছে তার কারণ শুধু যৌক্তিকতা নয়; কৃত্রিম আলোকসজ্জাও এর কারণ। একটি আধুনিক শহরের রাস্তায় রাত্রিকালীন আকাশ দেখা যায় না। মফস্বল শহরে গাড়ির সম্মুখ-বাতি জ্বালিয়ে আমরা চলাফেরা করি। আমরা আকাশ মুছে দিয়েছি। এ-কালের গুটিকয় বিজ্ঞানীই শুধু নক্ষত্র, গ্রহ, উল্কা এবং ধূমকেতু সম্পর্কে সচেতন আছেন। অন্য যে-কোনো কালের চেয়ে আজকের আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের দুনিয়া অনেক বেশি মানুষের হাতে গড়া। এতে কিছুটা ক্ষতি এবং লাভও হয়েছে। মানুষ তার রাজ্যে নিরাপদ থেকে তুচ্ছ, উদ্ধত এবং কিছু পরিমাণে উন্মাদরোগগ্রস্তও হচ্ছে। তবে আমি মনে করি না যে ১৬৬২ সালে বোস্টন শহরে ধূমকেতু যে নৈতিক ক্রিয়া করেছিল, আজকের দিনে তা পারবে; এখন তা করতে গেলে আরো সবল ওষুধের দরকার করবে।

Exit mobile version