শিক্ষার সংকীর্ণ উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অনেক কথাই বলার আছে। জীবিকা অর্জনের শুরুর আগে সব কিছু শেখার সময় মেলে না এবং নিঃসন্দেহে কেজো জ্ঞান খুবই দরকারি। কেজো জ্ঞানই আধুনিক জগতের নির্মাতা। এই জ্ঞান না থাকলে আমরা যন্ত্রাদি, মোটর গাড়ি কিংবা রেলগাড়ি বা উড়োজাহাজ পেতাম না; এখানে আরো যোগ করা যায় যে আধুনিক বিজ্ঞাপন ব্যবস্থা কিংবা প্রচারণা পদ্ধতি আমাদের জুটত না। আধুনিক জ্ঞান মানুষের গড় স্বাস্থ্যের প্রভূত উন্নতিসাধন করেছে, আবার একই সময়ে আবিষ্কার করেছে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে কীভাবে বড় বড় শহর পৃথিবী-পৃষ্ঠ থেকে মুছে ফেলা যায়। পূর্বেকার তুলনায় আমাদের জগৎ যে যে ক্ষেত্রে বিশিষ্ট তার উৎস এই কেজো জ্ঞান। কোনো সম্প্রদায়ই এই জ্ঞান এখনও যথেষ্ট পরিমাণে লাভ করেনি এবং নিঃসন্দেহে শিক্ষার দ্বারা এই জ্ঞানের প্রসার অবশ্যই ঘটাতে থাকবে।
এটা স্বীকার করতে হবে যে প্রথাগত সাংস্কৃতিক জ্ঞানের অনেকটাই ছিল বোকামিপূর্ণ। ছেলেরা বছরের পর বছর ব্যয় করে লাতিন ও গ্রিক ব্যাকরণ শেখে। পরিশেষে কিন্তু তারা গ্রিক বা লাতিন লেখকের পুস্তকাদি পাঠে সমর্থও হয় না, তাদের সে ইচ্ছাও থাকে না (নগণ্য ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে)। যে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক ভাষাসমূহ এবং ইতিহাস, লাতিন ও গ্রিকের চেয়ে অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য। এগুলো শুধু অধিকতর প্রয়োজনীয় নয়। এগুলো স্বল্প সময়ে অনেক বেশি সংস্কৃতি যোগায়। পঞ্চদশ শতাব্দীর একজন ইতালিবাসীর যা কিছু পড়ার দরকার ছিল তারা সে সব হাতের কাছে মাতৃভাষায় না পেলেও গ্রিক ও লাতিন ভাষায় অবশ্যই পেয়ে যেতেন, তাই এই ভাষাগুলো তাদের কাছে ছিল সংস্কৃতির অপরিহার্য চাবিকাঠি। কিন্তু সেই সময়ের পর মহৎ সাহিত্য বিভিন্ন আধুনিক ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে এবং সভ্যতার বিকাশ এতটা দ্রুত গতিতে সাধিত হয়েছে যে আমাদের সমস্যা বোঝার জন্য পুরাকাল সম্পর্কিত জ্ঞান হয়ে পড়েছে কম দরকারি অন্তত আধুনিক জাতিসমূহ এবং তাদের সাম্প্রতিক ইতিহাস সম্পর্কিত জ্ঞানের তুলনায়। প্রথাগত স্কুল শিক্ষকের দৃষ্টিকোণ, যা বিদ্যাবত্তার পুনরুজ্জীবনের সময় ছিল খুবই শ্রদ্ধেয়, ক্রমান্বয়ে অযথা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। কারণ তারা পঞ্চদশ শতাব্দীর পর জগৎ কতটা অর্জন করেছে তা পাত্তা দেয়নি। অথচ শুধু ইতিহাস এবং আধুনিক ভাষা নয়, উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে অবদান রাখে। অতএব এটা ধরে নেয়া যায় যে প্রত্যক্ষ উপযোগী না হয়ে শিক্ষার অন্যবিধ লক্ষ্য থাকা দরকার, এবং প্রথাগত পাঠ্যক্রমের প্রতি গুরুত্ব দেয়ারও দরকার নেই। উপযোগ ও সংস্কৃতি, যখন দুটিকেই বৃহত্তর পরিসরে ভাবা হয়, দেখা যায় তাদের মধ্যে অসামঞ্জস্য খুবই কম, যে কোনো একটির গোঁড়া প্রবক্তার কাছে অন্যরকম মনে হলেও।
অনেক ক্ষেত্রে সংস্কৃতি এবং প্রত্যক্ষ উপযোগকে সমন্বিত করা যায়, তবু বিভিন্ন ধরনের কিছু পরোক্ষ উপযোগ রয়েছে এমন জ্ঞানের অধিকারে যা প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে না। আমি মনে করি, আধুনিক জগতের অত্যন্ত বাজে কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের উন্নতি সাধন সম্ভব এই ধরনের জ্ঞানের প্রতি উৎসাহ বাড়িয়ে, এবং সাদামাটা পেশাদারী নৈপুণ্য অর্জনের পিছে একটু কম ছুটে।
যখন সচেতন তৎপরতা কোনো এক বিশেষ লক্ষ্য হাসিলে নিয়োজিত হয়, তখন অধিংকাশ লোকের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ফল দাঁড়ায় ভারসাম্যহীনতা, সঙ্গে যুক্ত হয় এক ধরনের স্নায়বিক বৈকল্য। যারা যুদ্ধকালে জার্মান নীতি পরিচালনা করেছেন তারা অনেক ভুল করেছেন, উদাহরণত, ডুবোজাহাজের ব্যবহার ব্যাপারে। এতে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তির পক্ষ নেয়, অথচ নতুন কোনো লোক এই কাজটিতে (ডুবোজাহাজ ব্যবহার) বিজ্ঞতা দেখতেন না। কিন্তু তারা মাথা ঠিক রেখে ব্যাপারটা বিচার করতে পারেন নি, কারণ তারা মানসিকভাবে ছিলেন ভারাক্রান্ত, অবকাশ বা ছুটি তাদের মোটে জোটেনি। এই একই জিনিস দেখা যাবে যেখানে কতিপয় লোক এমন কাজে নিয়োজিত হয় যা তাদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে। জাপানি সাম্রাজ্যবাদী, রুশ কম্যুনিস্ট এবং জার্মান নাৎসি, এদের সবার রয়েছে কঠিন গোঁড়ামি, যা একান্তভাবেই নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদনের মানসিক জগতে বাস করে। যখন কাজটি গোঁড়াদের অনুমান মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভাব্য হয় তখন ফল দাঁড়ায় চমৎকার; কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য কোনো বিরুদ্ধ শক্তি থাকলে তা ভুলে থাকা হয়, কিংবা উক্ত শক্তিকে শয়তানের কাজ বলে গণ্য করা হয়, যা মোকাবেলা করতে হবে শাস্তি এবং সন্ত্রাস দিয়ে। শিশুদের ক্ষেত্রে যেমন বয়স্ক মানুষদেরও খেলাধুলা করার দরকার রয়েছে, কিংবা এমন একটা সময় তাদের থাকা দরকার যখন কাজের কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকবে না, উপস্থিত আনন্দ উপভোগ ছাড়া। কিন্তু যদি খেলাধুলাকে উদ্দেশ্য সাধন করতে হয় তাহলে এমন ব্যাপারে সুখ ও উৎসাহ খুঁজে পাওয়া সম্ভব করে তুলতে হবে যার সঙ্গে কাজের সম্পর্ক নেই।
দেখা যায় যে আধুনিক শহরের লোকদের আমোদ-প্রমোদের ঝোঁক উত্তরোত্তর নিষ্ক্রিয় ও সমষ্টিগত হচ্ছে। অপরের দক্ষ কার্যকলাপ নিষ্ক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। সন্দেহ নেই, প্রমোদের ব্যবস্থা একেবারে না-থাকার চেয়ে এটা ভালো, কিন্তু সেই জনগোষ্ঠীর চেয়ে উত্তম হবে না শিক্ষার মাধ্যমে যারা বিস্তৃততর পরিসরে চিন্তাশীল উৎসাহে নিমগ্ন, এবং তা কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়। উন্নততর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা যন্ত্রাদির উৎপাদনশীলতা দ্বারা মানুষকে উপকৃত করবে, অবকাশ বৃদ্ধি করবে ব্যাপক হারে। আবার অতিরিক্ত অবসর একঘেয়ে হয়; কিন্তু যারা চিন্তাশীল কাজ ও উৎসাহের সঙ্গে জড়িত তাদের বেলায় একঘেয়ে হবে না। অবসরভোগী জনমানুষকে সুখী হতে হলে তাদের অবশ্যই শিক্ষিত হবে হবে। এবং (তাদের শিক্ষিত হতে হবে। একই সঙ্গে মানসিক উপভোগ এবং কারিগরি জ্ঞান প্রত্যক্ষ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে।