এইভাবে গ্রিক ও লাতিন ভাষার জ্ঞান, সঙ্গে সঙ্গে জ্যামিতি সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান, হয়তো জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানও, ভদ্রলোকদের বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়। জ্যামিতিক জ্ঞানের বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগকে গ্রিকরা অবজ্ঞা করতেন এবং শুধুমাত্র তাদের অবক্ষয়ের সময় জ্যোতিষশাস্ত্রের ছদ্মাবরণে জ্যোতির্বিদ্যার প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করেন। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দী হেলেনীয় নিরাসক্তি নিয়ে প্রধানত গণিত শাস্ত্রের চর্চা করে, এবং বিজ্ঞানের যে শাখাগুলো ভেলকিবাজির সঙ্গে জড়িত হয়ে মর্যাদা হারিয়েছিল সেগুলোর চর্চা এড়িয়ে চলার ঝোঁক দেখা যায়। জ্ঞানের ব্যাপকতর ব্যবহারিক ধারণার দিকে ক্রমিক পরিবর্তন, গোটা অষ্টাদশ শতকে চলেছে। ঐ সময়ের পর ফরাসি বিপ্লব এবং যন্ত্রপাতি বিকাশের দরুন পরিবর্তনের গতি ত্বরান্বিত হয়। ফরাসি বিপ্লব ভদ্রলোকের সংস্কৃতির প্রতি আঘাত হানে। অপরপক্ষে যন্ত্রপাতি অদ্রলোকসুলভ দক্ষতা ব্যবহারের বিস্ময়কর সুযোগ সৃষ্টি করে। গত দেড়শো বছর জুড়ে মানুষ অকেজো জ্ঞানের মূল্য নিয়ে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর প্রশ্ন তুলেছে। এবং ক্রমান্বয়ে তাদের এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে যে সেই জ্ঞান অর্জনই মূল্যবান যা সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোনো না কোনো অংশবিশেষে প্রয়োগ করা যায়।
ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে, যেখানে প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, জ্ঞান সম্পর্কিত উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কেবল মাত্র আংশিকভাবে স্থান লাভ করে। এখনও বিশ্ববিদ্যালগুলোতে চৈনিক ভাষার অধ্যাপক রয়েছেন যারা চৈনিক ধ্রুপদী রচনা পড়েছেন, কিন্তু সান ইয়াৎ-সেনের রচনাকর্মের সঙ্গে পরিচিত নন, অথচ সান ইয়াৎ সেনের রচনাদি আধুনিক চীন সৃষ্টি করেছে। এখনও এমন অনেক লোক রয়েছেন যারা প্রাচীন ইতিহাস একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত পড়েছেন, যে পর্যায়ের রচয়িতাদের শৈলী বিশুদ্ধ অর্থাৎ তারা গ্রিসের ইতিহাস পড়েছেন আলেকজান্ডার পর্যন্ত, আর রোমের ইতিহাস পড়েছেন নিরো পর্যন্ত, কিন্তু পরবর্তীকালীন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস পাঠ করতে অস্বীকার করেন। কারণ ঐ সময়ের ইতিহাস যারা লিখেছেন তাদের বর্ণনারীতি নিকৃষ্ট। সে যাই হোক এমনকি ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডেও পুরাতন প্রথা এখন মিয়মাণ এবং রুশদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো অধিকতর আধুনিক দেশগুলোতে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। উদাহরণত, আমেরিকায় শিক্ষা পর্ষদ উল্লেখ করেছেন যে ব্যবসায়িক পত্রাদি রচনায় অধিকাংশ লোক মাত্র পনেরো শো শব্দ ব্যবহার করেন। সুতরাং তাদের উপদেশ স্কুলের পাঠ্যবিষয় থেকে বাকি শব্দগুলো বাদ দিতে হবে। ইংরেজদের উদ্ভাবিত মৌলিক ইংরেজি আরো অনেক দূর এগিয়ে গেছে, এখানে আট শত শব্দ যথেষ্ট মনে করা হয়। নন্দনতাত্ত্বিক অর্থে বক্তৃতার মূল্য রয়েছে এই ধারণা মারা যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে এই ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে শব্দাবলির একমাত্র লক্ষ্য হলো ব্যবহারিক তথ্য পরিবেশন। রুশদেশে ব্যবহারিক লক্ষ্য উদ্ধারে আস্থা আমেরিকার চেয়েও আন্তরিক: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যা-কিছু শেখানো হয় তা যেন শিক্ষা ও সরকার সম্পর্কে কোনো কাজে লাগে। একমাত্র কিছুটা মুক্তি পাওয়া গেছে ধর্মতত্ত্বের জন্য অতি পবিত্র বলে গণ্য ধর্মগ্রন্থ চর্চা করতে হবে মূল জার্মান ভাষায় এবং কিছু কিছু অধ্যাপককে দর্শন সম্পর্কে জানতে হবে বুর্জোয়া পরাবিজ্ঞানীদের সমালোচনা থেকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ রক্ষার জন্য। তবে গোঁড়ামি যতই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, এই ক্ষুদ্র ছিদ্রপথও ততই বন্ধ হয়ে যাবে।
সর্বত্রই জ্ঞান ধীরে-ধীরে গণ্য হচ্ছে স্বয়ং শুভ হিসেবে নয়, কিংবা সাধারণভাবে জীবন সম্পর্কে প্রশস্ত ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ার মাধ্যম হিসেবেও নয়, বরং গণ্য হচ্ছে নিতান্তই প্রযুক্তিগত দক্ষতার উপাদান হিসেবে। এটি বৃহত্তর সামাজিক অখণ্ডতার অংশ যা সম্ভব হয়েছে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি এবং সামরিক প্রয়োজনীয়তার জন্য। আজকের দিনে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরস্পরনির্ভরতা অতীতকালের চেয়ে অনেক বেশি, সুতরাং একজন লোকের উপর বিশেষ জীবন যাপনের চাপ অনেক বেশি। বাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে, ধনীদের জন্য স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলো এবং (ইংল্যান্ডে) যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাচীনত্বের দাবিতে অভেদ্য হয়ে গেছে সেগুলি বাদে, তাদের ইচ্ছে মতো অর্থ ব্যয় করতে দেয়া হয় না, বরং তাদের রাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে হবে যে তারা প্রয়োজনীয় অভীষ্ট বাস্তবায়ন করছেন ছাত্রদের দক্ষতা প্রদান এবং আনুগত্য শিখিয়ে। এটি সেই আন্দোলনের অনুরূপ যার পরিণতি দাঁড়িয়েছে বাধ্যতামূলক সামরিক চাকুরি, বয় স্কাউট, রাজনৈতিক দল সংগঠন, এবং পত্রিকাদি কর্তৃক রাজনৈতিক ভাববিলাস প্রচার। আমরা আগের চেয়ে স্বীয় স্বদেশবাসীর প্রতি অনেক বেশি সচেতন, এবং পুণ্যবান হয়ে থাকলে আমরা তাদের উপকার করার জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন থাকি এবং যা কিছুই ঘটুক না কেন তারা আমাদের উপকার করে। আমরা ভাবতেই পারি না যে একজন লোক অলসভাবে জীবন উপভোগ করবে, তার উপভোগের গুণাগুণ যতই সুরুচিপূর্ণ হোক না কেন। আমরা উপলব্ধি করি যে প্রত্যেক ব্যক্তি একটা মহৎ উদ্দেশ্য (সে যাই হোক) বাস্তবায়নের জন্য কিছু কাজ করবে। আরো এজন্য যে কত বাজে লোক এই মহৎ উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে কাজ করছে এবং এটা স্তব্ধ করে দেয়া দরকার। আমাদের মন অবসর পায় না, অতএব আমাদের জ্ঞান অর্জন করে যেতে হবে, তবে এমন জ্ঞান নয় যা দিয়ে আমরা যা-কিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তার জন্য লড়াই করতে সাহায্য পাই।