ফ্রান্সিস বেকন, যিনি তাঁর বন্ধুদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে খ্যাতি অর্জন করেন, জোর দিয়ে বলেছেন, জ্ঞানই হলো শক্তি। তবে সকল জ্ঞান সম্বন্ধেই এটা সত্য নয়। স্যার টমাস ব্রাউন ইচ্ছাপোষণ করতেন সাইরেনরা কী গান করে তা জানা। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হতে পারলেও এটা তাঁকে হাকিম থেকে হাই শেরিফ (High Sheriff) হতে সমর্থ করত না। যাকে আমরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বলি সেই ধরনের জ্ঞানের কথা ছিল বেকনের মনে। বিজ্ঞানের উপর তিনি যে গুরুত্ব আরোপ করলেন তাতে কিন্তু আরব্য এবং মধ্যযুগের প্রথম দিকের ঐতিহ্য দেরিতে বহন করা হলো। ঐ ঐতিহ্য অনুসারে জ্ঞান প্রধানত গঠিত জ্যোতিষবিদ্যা, আলকেমি ও ভেষজবিজ্ঞান নিয়ে; এই সবগুলিই বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে গণ্য হতো। বিদ্বান ব্যক্তি তাকেই মনে করা হতো যিনি এইসব বিজ্ঞানে ব্যুৎপন্ন, এবং ফলে জাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী। একাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে দ্বিতীয় সিলভেস্টার পোপকে, অন্য কোনো কারণে নয়, শুধু অনেক বই পড়েছেন বলে সার্বজনীনভাবে বিশ্বাস করা হতো জাদুকর হিসেবে এবং আরো মনে করা হতো যে, তিনি ভূ-প্রেতের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ। প্রসপেরো, যিনি শেক্সপিয়রের সময়ে ছিলেন কাল্পনিক চরিত্র মাত্র, অতঃপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিদ্বানব্যক্তি সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করা হয়েছে তাকে তার প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করা হয়, অন্তত তার জাদুকরী ক্ষমতার জন্য। আমরা এখন যেমন জেনেছি, বেকন সঠিকভাবে বিশ্বাস করতেন যে, বিজ্ঞান মানুষের হাতে তুলে দিতে পারে অধিকতর শক্তিশালী জাদুদণ্ড, যে দণ্ড সম্পর্কে অতীতকালের প্রেসিদ্ধ ব্যক্তিগণ স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারতেন না।
রেনেসাঁস, যা বেকনের সময়ে ইংল্যান্ডে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে, জ্ঞানের উপযোগবাদী ধারণার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। গ্রিকরা হোমারের পরিচিতি অর্জন করে, আমরা যেমন মিউজিক হলের গান সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখি। কারণ হোমারের লেখা উপভোগ তারা করতেন, এবং তাদের মধ্যে কিন্তু এমন বোধ কাজ করত না যে তারা জ্ঞানানুসন্ধান করছেন। কিন্তু ষোড়শ শতকের লোকেরা প্রথমে ব্যাপক ভাষাতাত্ত্বিক বিদ্যা অর্জনের আগে তাঁকে বুঝতে শুরু করতে পারে নি। তাঁরা গ্রিকদের ভক্তি করতেন, এবং আনন্দ উপভোগে বঞ্চিত হতে ইচ্ছুক ছিলেন না; সুতরাং তারা গ্রিকদের অনুসরণ করতেন; ধ্রুপদী রচনাপাঠ এবং অন্যান্য উপায়ে। যে উপায়গুলো খুব সুস্পষ্ট নয়। রেনেসাঁসের সময়ে বিদ্যার্জন ছিল Joie de vivre-এর অংশ, সুরাপান ও যৌনকর্মের মতোই। এবং এটা শুধু সাহিত্য সম্পর্কেই সত্য নয়। অন্যান্য জটিলতার বিষয় সম্পর্কেও সত্য ছিল। ইউক্লিডের পুস্তকের সঙ্গে হবসের প্রথম পরিচয়ের গল্পটা সবাই জানেন; পুস্তকটি খোলর পর আকস্মিকভাবে তার চোখ পড়ে পিথাগোরাসের একটি উপপাদ্যে, তিনি বিস্ময়সূচক চিৎকার করে ওঠেন, হা ঈশ্বর, এ সম্ভব হতে পারে না এবং পেছন দিক থেকে সংশোধনী পাঠ করতে শুরু করেন যতক্ষণ না স্বতঃসিদ্ধে পৌঁছেন, এবং প্রমাণ দেখতে পান ও সত্যতা অনুভব করেন। কেউ সন্দেহ করতে পারবেন না যে এটা ছিল তাঁর জন্য বড় আনন্দদায়ক মুহূর্ত। এই মুহূর্তে তিনি ক্ষেত্র জরিপের কাজে জ্যামিতির উপযোগিতার ভাবনা দ্বারা কলুষিত হন নি।
সত্য যে, রেনেসাঁস ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরাকালীন ভাষাসমূহের ব্যবহারিক প্রয়োজন দেখতে পায়। ধ্রুপদী লাতিন ভাষার প্রতি নতুন প্রীতির প্রাথমিক ফল ছিল পোপের নির্দেশাবলি ও কনস্টান্টাইনের উপহার যে জাল ছিল তা ধরা পড়ল। বাইবেলের প্রাচীন লাতিন তর্জমায় (vulgate) এবং প্রাচীন গ্রিক তর্জমায় (Septuagint) যে ত্রুটিগুলো আবিষ্কৃত হয় তাতে প্রটেস্টান্ট পুরোহিতদের কাছে গ্রিক ও হিব্রু ভাষা বিতর্কমূলক অস্ত্রের দরকারি অঙ্গে পরিণত হয়। প্রজাতান্ত্রিক গ্রিস ও রোমের নীতিমালার সহায়তা নেয়া হয় পিউরিটানদের ক্ষেত্রে স্টুয়ার্টদের প্রতিরোধ এবং জেসুইটদের ক্ষেত্রে রাজতন্ত্রীদের প্রতিরোধ ন্যায়ানুগ করে তোলার জন্য। রাজতন্ত্রীরা পোপের প্রতি আনুগত্য পরিত্যাগ করেছিলেন। তবে এসবই ধ্রুপদীবিদ্যা পুনরুজ্জীবনের প্রতিক্রিয়া, কারণ নয়, এবং লুথারের একশো বছর আগে থেকেই ধ্রুপদী বিদ্যা চর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটে ইতালিতে। রেনেসাঁসের প্রধান অভিপ্রায় ছিল মানসিক স্ফূর্তি এবং শিল্পকলা চর্চা ও কল্পনা প্রতিভা বৃদ্ধি ও বিকাশের স্বাধীনতা সংরক্ষণ, এই স্বাধীনতা হারিয়ে গিয়েছিল, স্থান লাভ করেছিল অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার, যা মনশ্চক্ষুতে ঠুলি পরিয়ে দেয়।
দেখা গেল, গ্রিকরা তাদের মনোযোগর একটি অংশ এমন কিছু বিষয়ে নিবদ্ধ করেছিলেন যা বিশুদ্ধ সাহিত্যিক ও শৈল্পিক নয়; তারা দর্শন, জ্যামিতি এবং জ্যোতির্বিদ্যার মতো বিষয়ও চর্চা করেছেন। এই বিষয়গুলো চর্চা শ্রদ্ধেয় ব্যাপার ছিল। তবে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয়। সত্য যে, হিপ্পোক্রাটিস ও গ্যালেনের নামের জন্য চিকিৎসাশাস্ত্র মর্যাদা লাভ করে; কিন্তু অন্তর্বর্তীকালে আরব দেশের লোক ও ইহুদিরাই শুধু এর চর্চা চালিয়ে যায় এবং জাদুটোনার সঙ্গে কঠিনভাবে জড়িয়ে পড়ে। এ জন্যই প্যারাসেলসাস-এর মতো লোকদের খ্যাতি দ্ব্যর্থক। রসায়নশাস্ত্রের সঙ্গে আরো বাজে গন্ধ যুক্ত হয়। এবং এই শাস্ত্র অষ্টাদশ শতকের আগে মর্যাদা লাভ করেনি।